ছোটবেলায় মেলায় দেখা একটা দৃশ্য এখনো ভুলতে পারিনি। একটা মানুষ অনেক উপর থেকে, গায়ে আগুন ধরিয়ে ঝাঁপ দিচ্ছে; নীচে অস্থায়ী ভাবে খোঁড়া ছোট্ট, চারকোনা মত একটা জলাশয় আছে - তার মধ্যে। ভীষণ ঝুঁকি পূর্ণ খেলা। যত দূর মনে পড়ে, লোকটির সারা গা মুড়ে ফেলা হয়েছিল মোটা কাপড়ের নিটোল বেষ্টনে, শুধু চোখ দুটি বাইরে বের করানো ছিল, দেখতে অনেকটা ছবিতে হেলমেট হীন মহাকাশচারীদের মত লাগছিল। আসলে জ্বলন্ত আগুন যাতে ত্বক কে না স্পর্শ করতে পারে তাই এত আঁটোসাঁটো ব্যবস্থা। অনেক দিন আগের কথা। তখন ফায়ার জ্যাকেটের কথা সে ভাবে জানা ছিল না বলেই মনে হয়। এখন যুগ অনেক এগিয়েছে। আর, সে এগোনোর মাসুল দিতে – পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে বৈশাখী দিনের স্বাভাবিক তাপমাত্রাও। সেটা কখনো ৪০ ডিগ্রি বা তাকে ছাড়িয়ে আরও উপরে। অবস্থা বুঝে স্কুল ছুটির ঘোষণা করতে হচ্ছে সরকার কে। দুপুর ১২ টার পর থেকে অসহ্য তাপদাহ থেকে বাঁচতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বাড়ি থেকে না বেরনোর। সূর্যের প্রবল রোষানলে ভূ-পৃষ্ট যেন সম্পূর্ণ এক অগ্নি বলয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। বাইরে পা রাখা মানেই, আমার লেখা শুরুর সেই লোকটির মত মরন ঝাঁপ দেওয়া-গায়ে আগুন লাগিয়ে। মনে হচ্ছে যেন জ্বলন্ত ইট ভাঁটার উপর দিয়ে হাঁটছি। যা অবস্থা, আগামী দিনে ফায়ার জ্যাকেটই না হয়ে যায় গ্রীষ্মের একমাত্র পোশাক।
কিন্তু এত গরম উপেক্ষা করেও যারা দিন দুপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে
পথে প্রান্তরে, হাটে বাজারে তারা কেউ ফায়ার ফাইটার না হতে পারে, চম্বলের দস্যু নির্ঘাত। তবে, ঘোড়ায় চড়ে নয়। বাইকে, অটোতে, বাসে, ট্রেনে এমনকি ফুটপাথে হেঁটে হেঁটে। হাতে
‘বেহড় বাগী বন্দুকে’র পরিবর্তে সেল ফোন, কায়দা করে ধরা, ছয় ইঞ্চির কালাশনিকভের মত।
আরো যেটা চমকপ্রদ সেটা হচ্ছে রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়ানো এই দস্যুদের মধ্যে মহিলারাই বেশি
। ওড়না কে কপাল অব্দি ঘোমটার মতন চাপিয়ে বেঁচে যাওয়া দুই প্রান্ত কে দুই দিক থেকে
চোখের নীচ থেকে নিয়ে পেছনে ঘাড়ের উপর বেঁধে গুঁজে রাখা। এখন যদিও রেডিমেড,
স্কার্ফের তৈরি দস্যু বা দস্যু রানীর মুখোশ পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। তবে মুখ পোড়ানো
রোদের ছোবল থেকে বাঁচতে ফুলন দেবীর দলে নাম লেখানো মহিলারা তাদের একমাত্র খোলা এক
জোড়া চোখের হাঁসি দিয়েই বুঝিয়ে দিচ্ছেন- এ গরমি উনকো কিতনা আচ্ছা লাগতি হ্যায়।
ধর্মতলার বাস স্ট্যান্ডে যে বিহারী আধবয়সী বুড়ো ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরের মধ্যে ভেজা লাল
শালু জড়ানো কুঁজো থেকে ঠাণ্ডা জলে লেবু নুনের সরবত বানিয়ে দিচ্ছে, তা কি শুধু
পেটের দায়ে? না কি গ্রীষ্মের গনগনে দুপুরে, এক পশলা বেসুরো বরষার মত ক্ষণিকের
তৃষ্ণা মুক্তিতে নেশায় ফেলার চেষ্টা?
গরম না পড়লে বোতল ফ্রিজে ঢোকে না। গলা ভেজাতে সবারই চাই চিল ঠাণ্ডা পানীয়। সে
বহুজাতিক কোম্পানির কেতার নীল, কালো বা কমলা জল হোক বা মিনারেল মেশানো সাধের ঝরনা
জল। প্রান যে তবু থেকে যায় অতৃপ্ত, জুড়ায় না কিছুতেই!
বাস, ট্রেনের ছাদ - তাও তেতে যেন মাছ ভাজার তাওয়া। সঙ্গে জানালা দিয়ে তেড়ে আসা বাতাসের
গরম নিঃশ্বাস। কোথায় যাই আর কিভাবেই বা কুল অফ করি, ভেবে পাই না। শিয়ালদহ ষ্টেশনের তালগাছ সমান উঁচু শেডের নীচে দৈত্যাকার পাখার বিলাসী ঘূর্ণনে
অগ্নি ক্ষরণ কমার কোনো সম্ভাবনা তো তৈরি হয় না, বরং গরম হাওয়া টেনে অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়।
অগত্যা, হাসনাবাদের রাজবাড়ির বিখ্যাত কাঁচা মিঠে আমেই শান্ত থাকতে হয়। প্লাটফর্মের চাতালে ঝুড়ির উপর -অর্ধচন্দ্রাকার সারিতে সাজিয়ে রাখা থাকে এই সব ঝিম সবুজ 'উপকূলের আপেল'। বিক্রিও হয় দেদার। পুষ্টি পণ্ডিতদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম আমে ১০ মিলিগ্রাম করে ম্যাগনেসিয়াম থাকে, যা শরীরের অন্দরে তাপমাত্রার সন্তুলন রাখতে সাহায্য করে।
কিন্তু একা আমে যদি রক্ষে না হয়, চিন্তা নেই, আছে আরও উপকরণ। দারুন এই দহন জ্বালায় যা দিতে পারে কিঞ্চিৎ বাড়তি উপশম। দুই কাঁধে দুই চটের থলেতে ঠুসে ঢোকানো মুখ উলটো কাচের বোতল নিয়ে যিনি হাজির হন, কোমরে গামছা আঁটা লুঙ্গি আর ঘামে ভেজা গায়ে বুক খোলা, খাকি আলখাল্লা চাপিয়ে - তিনি কোনো মামুলি হকার হতে পারেন না। তিনি যেন, সেই মুহূর্তের সেই হাঁসফাঁস করা গরম থেকে মুক্তি দিতে কল্পনার শীতলতা ফেরী করা সত্যি সত্যি কোনো স্বপ্নের অবতার হয়ে আসেন। চলন্ত ট্রেনে, ফটাস ফটাস শব্দে ছিপি খুলে যাত্রীদের দিকে যিনি এগিয়ে দেন শ্যাওলা রঙের গলা সরু কচি কচি সোডার বোতল। এটি আম প্যাসেঞ্জারদের কাছে ফটাস জল
নামেও পরিচিত। এর পাশাপাশি, বরফ ফেলা মুখবন্ধ
প্লাস্টিকের ডাব্বায় আম পোড়া আমের সরবত বা
দই লস্যির তো কথাই হবে না। প্লাস্টিকের গ্লাসে নল চুবিয়ে কিছুক্ষণের জন্য তারিয়ে তারিয়ে টেনে নেওয়াই
যায় কাশ্মীরি আমেজ, রাজস্থানি হাওয়ায়। আমেজ যদি মধুর তবে, হোক না মন্দ এ গরমিয়ানা।
বৈশাখ মাসের জলাশয় গুলিও যেন এক একটা উষ্ণ প্রস্রবণে পরিনত হয়। পথ চলতি পুকুরগুলিতে আবার তেমন গাছ গাছালী দেখা যায় না চারদিকের পাড়ে। তাই কোথায় যে যাই আর কোথায় গিয়ে ঝাঁপ দেই এ গরম থেকে বাঁচতে। বুঝতে পারি না।
হঠাৎই মনে পড়ে যায়, পুরনো দিনের গ্রামাফোনের কথা। বিশেষ করে, এইচ এম ভি -গ্রামাফোনের উপরে থাকা সেই বহু পরিচিত কুকুর মুখো লোগোটার কথা। মনের আয়নায় ধুলো পড়ে পুরনো ছবিটা, অনেকটাই ধুন্দলা হয়ে গেছে। বড় বড় চোখে তাই ভাবতে চেষ্টা করি, বর্তমানে কি সাঙ্ঘাতিক দশা হয়েছে কুকুরটার। তীব্র গরম যেন দৃশ্যতই কাহিল করে তুলেছে এই প্রাণহীন ছবিটাকেও। হিচককের ছবির মত গ্রামাফোনের জড় কুকুরটাও বুঝি মুখ হাঁ করে অনর্গল লালা ঝরিয়ে যাচ্ছে ফ্যা ফ্যা শব্দে। প্রচণ্ড গরমে কি তাহলে রাস্তার কুকুর আর গ্রামাফোনের কুকুরের মধ্যেকার প্রভেদটা আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে আমার কাছে?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন