সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয়, মোহ ভঙ্গের নামই নেই।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে না রবীন্দ্রনাথের। পরিনত বয়সে পৌঁছে তাই যুক্তি দিয়ে তার সেই মুগ্ধতার নেপথ্য কারণ খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি।  ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায় তাই লেখেন, “সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝিতে পারি, কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না – তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনো তার ঝংকারটা ফুরায় না”।  শুধু সৃজনের স্তুতিতেই থেমে থাকলেন না রবীন্দ্রনাথ, সৃজনকারীকে দিলেন আদিকবির আসন।   ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায় তাই তিনি লিখলেন “আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা”। রবীন্দ্রনাথ ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ পড়েছিলেন, তখন তাঁর মাত্র চার বছর বয়স।  রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্ত পালের মতে রবীন্দ্রনাথের বর্ণ শিক্ষা মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত ‘শিশু শিক্ষা’ দিয়ে হলেও বর্ণ যোজনার শিক্ষা পান তিনি বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণ পরিচয়’ থেকে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে তাই ‘বর্ণ পরিচয়’ প্রথম পড়া বই।   রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। “তখন ‘কর’ ‘খল’ প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কুল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে”।
কিন্তু গোটা ‘বর্ণ পরিচয়’ খুঁজে কোথাও ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ পাওয়া যায় না।  যা পাওয়া যায়, ‘জল পড়ে, মেঘ ডাকে’ (‘বর্ণ পরিচয়’ এর প্রথম ভাগ, তৃতীয় পাঠ) এবং ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’ ( বর্ণ পরিচয় এর প্রথম ভাগ, অষ্টম পাঠ)।  তাহলে বিদ্যাসাগরকে কোনোভাবেই ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র স্রষ্টা বলা যায় না, তা সে রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন না কেন। আসলে মাত্র চার বছর বয়সে পড়া মুগ্ধ বিস্ময়ের স্মৃতি যে রবীন্দ্রনাথকে সারাজীবন এক অবিস্মরণীয় ঘোরের মধ্যে রেখেছিল তার প্রমান হিসেবে এই ভ্রান্তি ধরা থাকে ৫১ বছর বয়সে লেখা ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়।
কারণ ১৯১২ সালে প্রকাশিত ‘জীবন স্মৃতি’ র ‘শিক্ষারম্ভ’ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ যে ঠিক কোন অদৃশ্য ভ্রান্তি সুখে ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’ র পরিবর্তে ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ লিখলেন, জানলে সত্যিই মোহিত হতে হয়। প্রশান্ত পাল প্রণীত ‘রবিজীবনী’ র পাতায় সেই সত্যকে খুব সুন্দর ভাবে উন্মোচিত হতে দেখি। জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে' পাঠই তিনি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ভাবী মহাকবির সমস্ত চৈতন্য গদ্যের সেই সাদাসিধে রূপের অন্তরে নিহিত ছন্দটুকু আবিষ্কার করে গদ্যের ঘটমান বর্তমানকে কবিতার নিত্য বর্তমানে পরিণত করেছে  
পরিশেষে একথা বলাই যায় রবীন্দ্রনাথের লেখায় ঝরে পড়া অতুলনীয় এই লাইন দুটি দীর্ঘদিন ধরে তাঁর মনের আকাশে মেঘ হয়ে ঘণিভূত হচ্ছিল। যে মেঘ অনিবার্য ভাবে তার জলীয়বাষ্প আহরণ করেছিল পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’ থেকে। শেষ পর্যন্ত যা ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ হয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছিল রবি কবির অমোঘ কলমের স্পর্শে।

প্রসঙ্গত এর অনেক পরে, ১৯৫৯ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ 'জল পড়ে পাতা নড়ে' নামের একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। পরে এই উপন্যাসটির আরও কয়েকটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল 'দেশ ও মাটি মানুষ' শিরোনামে। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। আসলে 'জল পড়ে, পাতা নড়ে' র হ্যাং ওভার কাটিয়ে উঠতে পারেননি কেউই। সত্যি সত্যিই এর মুগ্ধতার রেশ যেন অপার ও অনিঃশেষ। 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...