সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মায়ের জীবনে ট্র্যাজেডি!


আমি মা, আমিই এই সৃষ্টির মূল কারিগর। এই প্রকৃতি, নদী, সাগর, পাহাড়, মালভূমি সব আমার ইচ্ছেয় গড়ে উঠেছে। রাত্রির অন্ধকার, ভোরের আলো, অপরাহ্নের বৈরাগ্য - স্রেফ আমার ঈশারাতেই সুখ দুঃখের ব্যঞ্জনা বয়ে আনে। ফুল ফোটা না ফোটা তাও নির্ভর করে আমার ওপরেই। পাখিদের কলতান, গাছে গাছে বাতাসের মর্মর ধ্বনি সব আমার বীনার তারে ওঠা সুর মূর্ছনা হয়ে বেজে যায়। আমার অমোঘ লীলার ছোঁয়াতেই পাতার রং সবুজ, ফুলের বর্ণ গোলাপী। আমার সৃষ্টির অমোঘ জাদুময়তায়, শুঁয়োপোকা অবলীলায় প্রজাপতি হয়ে যায়, নদী দিকভ্রান্ত হয়ে বয়ে যায় দুকূল প্লাবিত করে, সমুদ্রের জলস্ফীতি মুদ্রা স্ফীতির মত বেড়ে চলে দিনদিন। আমার চেতনার গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছে অতীত, সেজে উঠছে বর্তমান, দিগন্তের ওপারে আঁকা হচ্ছে অনাগত ভবিষ্যতের ছবি। সময়ের বিবর্তন সেও আমারই খেলা। হাট থেকে বাজার, বাজার থেকে বাজার অর্থনীতি এমনকি শেয়ারের উত্থান পতন ও গিরগিটির মত নিত্য রং বদলায় রূপান্তরের অঙ্গ হিসেবে। কাশফুলের দোলা দিয়ে আমিই কবির ভাবনায় নীলাকাশে ভেসে যাওয়া অমন কিম্ভুতকিমাকার মেঘ গুলোকে পর্যন্ত শারদীয় ফেনিল উচ্ছাসের সঙ্গে তুলনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছি। শিউলি তলায় আমার উৎসাহেই গুচ্ছের ফুল পড়ে থাকে ভোরবেলায়। "আশ্বিনের শারদ প্রাতে" বেজে ওঠে মহালয়ার ভোরে। কখনো কখনো আশ্বিনে ঝড় ও ওঠে সব ভেঙে চুরমার করে দিতে। ১৯৪২ সালের আগস্ট বিপ্লবের রেশ তখনো চলছে। তখনো আন্দোলনে উত্তাল মেদিনীপুরের গ্রাম শহর। তার মধ্যে এসেছিল প্রবল ঝড় - মহা পূজার দিনেই। কাঁথির ঝড় বলে খ্যাত ওই ঝড়ে কত মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছিলেন তার কোনো ইয়াত্তা নেই। শেষে সেই ঝড় থেমেওছিল সেই মায়ের কৃপাতেই। দাদুর মুখে শুনেছি দেড় দিন ধরে বৃষ্টি আর ঝড় চলার পরে যখন মানুষের ক্রন্দন ধ্বনি ছাপিয়ে যাচ্ছিল ঝড়ের আওয়াজকেও তখনই শোনা গেল 'রে' ...'রে'... 'রে' ধ্বনি। মাতৃ কন্ঠে সেই ধ্বনি যেন অন্তিম সতর্কবার্তা ছিল উন্মাদ প্রকৃতির প্রতি। ব্যাস, অনেক হয়েছে এবার থামো। তৎক্ষণাৎ স্তব্ধ হয়েছিল ঝড়। এতদিন পরে তা গল্পের মতো শোনালেও তা ছিল অকাট্য সত্যি। কিন্তু সৃষ্টির শর্তই তো ধ্বংসের ওপর নব জীবনের জয়গান গাওয়া। আসলে ধংস আর সৃষ্টি দুইই মায়ের অনায়াস অদ্ভুত দুই লীলা। মায়ের চোখের অগ্নি দৃষ্টি কিংবা হাতের বরাভয় মুদ্রা সবই মায়ের রূপের অরূপ। তাই মা এত অপরূপ

কিন্তু সৃষ্টির কি অপার মহিমা। যার হাতে সমস্ত সৃষ্টির চাবিকাঠি, যিনি সৃষ্টির পবিত্র হোমাগ্নি প্রোজ্জ্বলিত করেন নিজ হস্তে তিনি নিজে কিন্তু তাঁর নিজের আপন মূর্তি গড়ান তারই সন্তান কে দিয়ে। ছেলের হাতেই সেজে ওঠেন তিনি । ছেলের চোখেই দেখেন, ছেলের তাপে অনুতাপে জ্বলেন, পোড়েন। ছেলের ভালোবাসায় করুনাময়ীর হাঁসি হাসেন। ছেলের দুঃখে তাঁর চোখ সজল হয়।পারত পক্ষে ছেলের শোকে, দুঃখে, আনন্দে, বিহ্বলতায় গড়ে ওঠে মায়ের ইমেজ, মায়ের আপন ভাবমূর্তি।
এটাই মায়ের সৃষ্টির ট্র্যাজেডি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...