কল্পনা আসলে এক
রকমের আগুন। যে আগুন সব মানুষের মধ্যেই থাকে, তবে ছাই চাপা হয়ে। কল্পনার আগুন ছাড়া এমনকি বিজ্ঞানেও নতুন কোনো আবিষ্কার সম্ভব নয়। সাধারণত
শিশু বয়সে যদি সেই আগুন উসকে ওঠার সুযোগ পায় তাহলেই ভবিষ্যৎ জীবনে কল্পনা প্রবণ মানুষ হিসেবে বড় হয়ে ওঠার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। বিশেষ করে সাহিত্য কলা
বা শিল্প সংস্কৃতির জগতে, যেখানে নিত্য কল্পনার চাষ, সেখানে সফল হতে গেলে অবশ্যই
একজনকে কল্পনা শক্তির অধিকারী হতে হয়। যদিও কল্পনা প্রবণদের অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী দুঃখ সহ্য
করতে হয় কারন কল্পনাতে আকাশ আর জমিন সহজে মিশে যেতে পারলেও বাস্তবে তা গাঁজাখুরি
ছাড়া কিছু নয়।
বয়স বাড়লে কিন্তু হাজার প্রণোদনাতেও
কল্পনার আগুন আর জ্বালানো সম্ভব হয় না। কারন বাস্তবের রূঢ় অভিজ্ঞতা সেই আগুনকে স্ফুরিত হতে দেয় না,
আমৃত্যু দমিয়ে রাখে তাকে।
এবারে প্রশ্ন শিশুবেলার সেই অবোধ বিস্ময় ঠিক কোন রসায়নে কল্পনার রসদে পরিনত হয়, যা দিয়ে শিল্প সাহিত্যের আঙিনায় ফুটে ওঠে কালজয়ী সব ফুল? সম্ভবত রূপকথার গল্প – সে বইয়ের মুদ্রিত অক্ষরে হোক কিংবা ঠাকুরদা ঠাকুমার
মুখ থেকে শোনা পুরানের কাহিনী থেকে। যদিও বর্তমানে বিভিন্ন অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমে দেখা
রূপকথার গল্প কিন্তু কোনোভাবেই কল্পনাকে প্রাণিত করতে পারে না। কারন যা কিছু এখানে
ঘটে সবটাই চোখের সামনে তাই এ ক্ষেত্রে কল্পনার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না।
আসলে ইয়াকুবের অন্তহীন নানা গালগল্পের মোহে, সুনীল যেন ক্রমশই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলেন। কখনো সে বলছে তার চাচা অনেক দূরের হাট - হাসিমারা থেকে হরিন শাবক নিয়ে এসেছেন বাড়িতে অথচ বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল গ্রামের হাট থেকে একটা ছাগল কিনে এনেছেন তার চাচা। কখনো বা বলছে আকাশ থেকে মাটিতে বিদ্যুৎ এসে পড়লে তা একটা সাদা আলোক রেখায় পরিনত হয়ে যায়, যে আলোক রেখা আবার তার বাড়িরই পেছনে থাকা একটা ছাই গাদার মধ্যে ঢুকে পড়ে আর তারপরেই সেখান থেকে স্পষ্ট একটা বাচ্চা মেয়ের খিলখিল করা হাঁসির শব্দ শোনা যায়।
ইয়াকুব কি শুধু মজা পাওয়ার জন্যই দিনরাত এমন নিখাদ মিথ্যে কথা গুলো বলে যেত নাকি কল্পনার লাগমহীন ঘোড়ায় চেপে শিশুমনের অপার বিস্ময় সুখের আনন্দকে নিজের মতো করে উপভোগ করার জন্যই চালিয়ে যেত এমন উদ্ভট কল্পনার বেসাতি!
“সত্যি হোক বা না হোক কাহিনীটা আমার মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হতে থাকে। স্পষ্ট যেন দেখতে পাই মশাল নিয়ে হইহই করে ছুটে আসছে দস্যুদল, একটা শিশুকে কোলে নিয়ে ছুটছে, একটা গুহার সামনে গরগর করতে করতে ঘুরছে একটা চিতাবাঘ।"
শিশুবেলায় রূপকথার গল্প পড়ার হয়তো সৌভাগ্য হয় নি সুনীলের। কিন্তু সেই অপূর্ণতা মিটিয়ে দিয়েছিল ইয়াকুবের বলা মিথ্যে কাহিনীগুলোই। প্রজ্বলিত করেছিলো তাঁর শিশুমনের কল্পনার আগুনকে, যার কুসুম প্রভায় আগামী দিনে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল বাংলা সাহিত্যের সুবিশাল আঙিনা।
সুনীল কিন্তু তাঁর কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করতে ইয়াকুবকেই তাঁর কল্পনা উসকে দেওয়ার দীক্ষাগুরু হিসেবে অভিহিত করেছেন। কি বলেছেন, সুনীল?
“মানুষ বয়সের সঙ্গে পা ফেলতে ফেলতে অনেক কিছু শেখে। সব মানুষের জীবনেই বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ব্যাপারে এক একজন দীক্ষাগুরু থাকে। আমার কল্পনা উসকে দেওয়ার প্রথম দীক্ষাগুরু ওই ইয়াকুব”।
সুনীল ‘অর্ধেক জীবন’ এ লিখেছেন সারাজীবনে ইয়াকুবকে আর কখনো দেখেননি তিনি। তবে সারাজীবনে যে কখনো তাকে ভুলতেও পারেননি সে কথা ও জলের মতো পরিষ্কার।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পর্কে আরও লেখা পড়ুনঃ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন