সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গঙ্গা তীরের শ্মশানে গড়ে ওঠা ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির ইতিকথা!

ইংরেজ সাহেব জোব চারনক কর্তৃক কথিত কোলকাতা শহরের গোড়াপত্তন হয় ১৬৯০ সালে। গঙ্গার পাড় ধরে তখন জলা জঙ্গলে ভর্তি ছিল সুতানটি, গোবিন্দপুরের বিস্তীর্ণ পশ্চিম অংশ। কোথাও কোথাও আবার ছিল শ্মশান।  নদীর ধারে শ্মশান থাকাটাই বরাবরের ঐতিহ্য। কিন্তু এমন জলা জঙ্গল বেষ্টিত শ্মশান থেকে প্রায়শই ভেসে আসতে শোনা গেল  ঠনঠন করে ঘণ্টা বাজার শব্দ! তখন অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনা লগ্ন, আনুমানিক ১৭০৩ সাল, বাংলায় ১১১০। কিন্তু সকাল, সন্ধ্যা কেই বা বাজায় এই ঘণ্টা?  কথায় আছে ভগবান তাঁর পূজার স্থল নিজেই নির্বাচন করেন।


ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সিদ্ধেশ্বরী কালীর মূর্তি! 
কোলকাতা শহরের প্রাচীন কালী মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির মা সিদ্ধেশরীও তাঁর আজকের ঠিকানা কলেজ স্ট্রীট মোড় থেকে অদূরে - বিধান সরনীর ওপরে অবস্থিত কথিত ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির বর্তমান অবস্থান নিজেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে মা  তাঁর মাধ্যম করেছিলেন এক ভবঘুরে তন্ত্রসাধককে। উদয়নারায়ন ব্রহ্মচারী নামের সেই মাতৃ সাধক তাঁর সাধনার লক্ষ্য বিন্দু ঠিক করতে নিজের হাতে, জল মাটি দিয়ে গড়েছিলেন মায়ের মূর্তি। প্রসঙ্গত ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির মাতৃ মূর্তি আজও তৈরি হয় মাটি দিয়ে। প্রতি বছর দীপাবলী কালী পূজার সময় পুরনো মূর্তির জায়গায় নতুন মূর্তি প্রতিস্থাপিত হয় বেদীতে। মাটির তৈরি মাতৃ মূর্তি এখানে ঘোর কুচল বর্না এবং চতুর্ভুজা। ডান দিকের ওপরের হাতে খড়গ এবং নীচের হাতে ধরা থাকে নরমুণ্ড। দেবীর বামদিকের দুটি হাত অবশ্য অস্ত্র রহিত।  তার একটিতে বরাভয় মুদ্রা এবং অন্যটিতে বরদা মুদ্রা প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। মায়ের গায়ে থাকে রূপোর গহনার ঝলমলে সাজ।
জনশ্রুতি আছে সেই ব্রহ্মচারীর এমন নির্জন অরন্য বেষ্টিত শ্মশানকে তাঁর সাধন স্থল হিসেবে বেছে নেওয়ার পেছনে নাকি শবসাধনার মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধি লাভ করার উদ্দেশ্য ছিল। শবসাধনা হোল শাক্ত তন্ত্রের সবচেয়ে কঠিন আচার। নদীর ধারে, শ্মশানেই এই সাধনা করার উপযুক্ত স্থান। অমাবস্যার রাত্রে, সাধক শবের ওপরে উপবেশন করে ধ্যান করেন।
ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়, কোলকাতা নগরীর অন্যতম ব্যস্ত রাজপথ - বিধান সরণী যেখানে আজ ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি অবস্থিত, সেখানেই একদা শবসাধনার মত ভয়ঙ্কর, তন্ত্র সাধনার কাজ সম্পাদিত হত।
শাক্ত তান্ত্রিক উদয়নারায়ন শুরু থেকেই মায়ের পুজো  করতেন তন্ত্র মতে। আর এই মত অনুসারে মায়ের ভোগে মাছ কিংবা মাংসের পদ দেওয়াটাই দস্তুর।
ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি তে আমিষ ভোগ দেওয়ার প্রথা সেই থেকে। তবে জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিনীর পুজো এবং কার্ত্তিক অমাবস্যায় শ্যামা কালীর পুজোতে মাকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে এখানকার আর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভোগের কথা না বললেই নয়। সেটি হোল ডাব চিনির ভোগ।  আর এই বিশেষ ভোগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঠাকুর রামকৃষ্ণের স্মৃতি।  রামকৃষ্ণের সঙ্গে সেই কিশোর বেলা থেকে ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির যোগাযোগ। রামকৃষ্ণ ওরফে কামারপুকুরের গদাধর চট্টোপাধ্যায় গ্রাম থেকে আসার পর কালীবাড়ির অদুরে ঝামাপুকুর বলে একটি জায়গায় এসে উঠেছিলেন দাদার সঙ্গে। তখন থেকে এই কালীবাড়িতে তার যাতায়াত ছিল। কেউ কেউ বলেন প্রায়শই তিনি মন্দিরে এসে গান করে যেতেন সেই সময়ে। ঠনঠনিয়ার মা সিদ্ধেশ্বরীর প্রতি রামকৃষ্ণের ছিল অগাধ আস্থা। একবার তাঁর অন্যতম গৃহী অনুরাগী, কেশব চন্দ্র সেন ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে পড়লে রামকৃষ্ণ তাঁর মঙ্গল কামনায় ঠনঠনিয়ার মা কালীর কাছে ডাব চিনির ভোগ নিবেদন করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, কেশব চন্দ্র সেন সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তারপরে। সেই থেকে এই ভোগ দেওয়ার চল তৈরি হয়েছে এখানে। প্রসঙ্গত মায়ের মূর্তির ডান দিকেই রয়েছে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কল্পতরু মুদ্রার মূর্তি।
  


            পুষ্পেশ্বর শিবের মন্দির         
বর্তমান কালী মন্দির এবং তার সংলগ্ন আটচালার পুষ্পেশ্বর শিবের মন্দির অবশ্য নির্মাণ করেন শঙ্কর ঘোষ নামে জনৈক ব্যবসায়ী। সে ১৮০৬ সালের কথা।  যদিও মন্দির চুড়োয় প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে বাংলার ১১১০ সালের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ ইংরেজি হিসেবে ১৭০৩ সাল। আনুমানিক যে সময়ে উদয়নারায়ন ব্রহ্মচারী এখানে কালী পুজোর প্রবর্তন করেছিলেন, সেই সময়কে ধরেই ১৭০৩ বা বাংলার ১১১০ সালকে  প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।


ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি

ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে এলে মায়ের মূল মন্দিরের সামনে আজও দেখা যায় রক্ত বর্ণ রঞ্জিত সুবৃহৎ হাড়িকাঠ। স্টিলের কাঠামো দিয়ে ঘিরে রাখা এই হাড়িকাঠ কখনো বলির প্রয়োজন হলে উন্মুক্ত করা হয়।


  মূল মন্দিরের সামনে থাকা হাড়িকাঠ
হৈমন্তিক শ্যামা পুজোতে ফুল এবং আলোক সজ্জায় বিশেষ ভাবে সেজে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গন। নব নির্মিত মাতৃ মূর্তির প্রতিষ্ঠা হয়। এছারা মাঘ মাসের রটন্তী কালী পুজোর সময়েও এখানে বিশেষ পুজোর আয়োজন হয়। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...