সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শালুক সন্ধানে!

 শালুক দিয়েই শ্রী রামচন্দ্র, দেবী দুর্গার অকাল বোধন সম্পন্ন করেছিলেন সে ত্রেতা যুগের কথা। রামায়ণের কালে। আসলে সেই সময়েও - সোনার লঙ্কার পুকুরদীঘিসরোবর চারিদিকেই রাশি রাশি নীল শাপলা ফুটে থাকতো। "আশ্বিনের শারদ প্রাতে" তাই রঘুনন্দন শ্রী রাম ১০৮ খানা নীলকমল দিয়েই সেরেছিলেন দেবীর আরাধনা। 

সাদা শাপলা
আজো দেবীর পুজোয় তাই শালুক ফুলের ভীষণ কদর। নবমীর পুজোর ডালিতে থাকতেই হবে নীল শাপলা।
রাবন বধ সাঙ্গ হয়েছে কত সহস্র বছর। কিন্তু রাবনের দেশ আজও ভোলেনি নীল মাহানেল কে।  শ্রীলঙ্কায় শালুককে নীল মাহানেল নামেই ডাকা হয়। তাই তদানীন্তন স্বর্ণলঙ্কা, অধুনা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় - শালুক পেয়েছে জাতীয় ফুলের সম্মান। এ কথা ঠিক, অকাল বোধন করে শ্রী রাম আসলে লঙ্কা পতি রাবনকেই বধ করার রাস্তা পরিস্কার করেছিলেন কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না ক্ষত্রিয় রামের হয়ে দেবীর সেই আবাহনী অর্চনায় মুনি পুত্র রাবনই ছিলেন মূল তন্ত্র ধারক। তাই কথিত ১০৮ টি শালুক ফুল আসলে রাবনের হাত দিয়েই অর্পিত হয়েছিল দেবীর পায়ে। শালুক ফুল নিয়ে অন্য আর এক অনুষঙ্গও রয়েছে শ্রীলঙ্কায়। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তাতেও সংখ্যা হিসেবে ১০৮ এর মাহাত্ম্য দেখা যায়।  অবশ্য এর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বাসের যোগ রয়েছে।  শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের মতে গৌতম বুদ্ধের পায়ের ছাপে পাওয়া  ১০৮ টি পবিত্র ছাপের মধ্যে একটি হল এই নীল শাপলা বা শালুকের। 
তো গেল নীল শাপলার কথা, লাল বা সাদা শাপলা কম সুন্দর নয়। সাদা শাপলা তো ভগবান কৃষ্ণের এমনকি পদ্ম ফুলের থেকেও বেশি প্রিয়। প্রাচীন গ্রীসে জলদেবীর উপাসনায় সাদা শাপলা উৎসর্গ করার প্রথা ছিল। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের টাকা পয়সা, দলিল দস্তাবেজেসাদা শাপলার জল ছাপ আঁকা থাকে। শাপলা, বাংলাদেশের জাতীয় ফুলমনসা পুজাতেও শাপলা ফুলের ব্যাবহার বহু পুরনো। আর এই সাদা শাপলাই বর্ষা উত্তর শরত ও হেমন্তের হাটে দেদার বিক্রি হয় পশ্চিম বঙ্গ তথা বাংলাদেশেনাল সমেত ফুল, সব্জি হিসেবে এর ভীষণ চাহিদা। আর শুধু বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গই বা কেন প্রাচীন মিশরেও শাপলাকে সব্জী হিসেবে খাওয়ার চল ছিল।  এমনকি জাপান বা চীনেও শাপলার পুষ্প দণ্ড সব্জী হিসেবে বিক্রি হয়। 

বাজারে বিক্রি হচ্ছে শাপলা
সেই বর্ষার শুরুতে, খাল, বিল, জলাশয় গুলোতে শাপলা ফোটা শুরু হয় গোলাকার খাঁজ কাটা পাতাগুলি জলের ওপর রেকাবির মত ভেসে থাকে। জলের বুকে পুষ্প দণ্ডের ওপর ফুটে থাকা শালুক গুলো ভোর বেলায় যতটা তরতাজা দেখায় বেলা বাড়লে এর কোমল পাপড়ি গুলো বুজে আসা আখি পল্লবের মতন ঝিমিয়ে পড়ে। শরৎ, হেমন্ত পেরিয়ে শীত কাল পর্যন্ত ফুটতে দেখা যায় শালুককে। তবে হেমন্তের পরে আর রান্না ঘরে আনা হয় না। 
দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামে গঞ্জে সাধারণ মানুষের ভাষায় শাপলা আবার শামলা নামে পরিচিত। যদিও শাপলার নামের অভাব নেই।  নানা ভাষায় রয়েছে এর নানা নাম। সংস্কৃত ভাষায় যেমন কুমুদ বা ইন্দিবর দক্ষিণী ভাষায় তেমনি শাপলাকে নীলুপ্পালা বা নীলথপালা নামে ডাকা হয়।
শাপলার মনোমুগ্ধকর মুগ্ধতা তার শেকড় ছিন্ন হওয়ার পরেও অনেক ক্ষণ বজায় থাকে। কাঁচের বয়ামে রেখে দিলে থাকে আরও বেশী দিন। তবে কেবল শোভা বর্ধনই নয় একটা সুন্দর, সুনন্দ গন্ধে চারিদিক আমোদিত করে রাখে এই শাপলা। তাই শাপলা নিয়ে একটা কবিতা না হলে যেন মন জুড়ায় না। সম্পূর্ণ হতে চায় না লেখা। তাই লিখলাম । 
নীচে রইল সেই কবিতাটি! 
কবিতার নামঃ ট্র্যাজিক শাপলা!
------------------------------------------ 
শালুক, তোমার ওই ফুলের কাছে 
আমার অনেক ঋণ! 
তুমি উজাড় করে সাজাও;
তোমার বদান্যতায় উপচে পড়ে
সে গভীর সৌন্দর্য
সু-গোপন অন্তরীন।

শেকড় ছেঁড়ার বেদনা,
হয়তো গুমরে মরে
তোমার ফুলের বুকে! 
নিবেদনে তবু সুনিবিড় ভালোলাগার 
মাধুরী লেগে থাকে। 
নিষ্ঠুর রোদের সে লাঞ্ছনা,
যেন দংশিত অধরের
আতঙ্ক ফোটাতে চায় মুখে।
তবু সম্মোহনী চুম্বন স্পৃহায় তোমার 
সুনন্দ পাপড়ি মেলা থাকে! 

তোমার হাজার বছরের 
জল পাত্র সাজানোর দুর্মর আকাঙ্ক্ষা,
ছিন্নমূল হয়েও দেবীর পায়ে পায়ে 
যাযাবর হয়ে যাওয়ার দিব্য লালসা 
তোমাকে কেন যে এত বড় করে দেয়! 
বুঝতে পারি, যন্ত্রণা লুকিয়ে 
হাঁসি মুখে থাকার সেই অমর 
চির কিংবদন্তী সিন! 


শাপলা তোলার সময়!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...