সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।  


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহিনী পড়ে বোঝা যায় কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে কতটা ভয়ের মেঘ পুঞ্জিভূত হয়েছিল সেই মহা সাক্ষাৎ পর্ব নিয়ে।  "তখন তাঁহার কাছে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বসিয়াছিলেন। পুস্তকে-ভরা তাঁহার ঘরের মধ্যে ঢুকিতে আমার বুক দুরু দুরু করিতেছিলতাঁহার মুখচ্ছবি দেখিয়া যে আমার সাহস বৃদ্ধি হইল, তা বলিতে পারি না। ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা তো আমি পাই নাইঅতএব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল। বোধকরি কিছু উৎসাহ সঞ্চয় করিয়া ফিরিয়াছিলাম।"  
রবীন্দ্রনাথের যখন ৭৮ বছর বয়স, তখন রবীন্দ্রনাথ আবার পৌঁছলেন ‘আদিকবি’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সকাশে। যদিও বিদ্যাসাগর তখন সশরীরে নেই। প্রয়াত হয়েছেন অনেক দিন। রবীন্দ্রনাথ গেলেন বিদ্যাসাগরের জন্মভূমি মেদিনীপুরে, বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত একটি স্মৃতি মন্দির উদ্বোধন করতে। উদ্বোধন মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতায়, বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রবর্তক বলতে কুণ্ঠিত হলেন না।  বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি, একদা তার দ্বার উদঘাটন করেছেন বিদ্যাসাগর।  
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথই, বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের অন্যতম - অগ্রণী স্থপতির ভূমিকায় অভিষিক্ত করেছিলেন।  বিদ্যাসাগরের সমাজ ও শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কীর্তিকে বিন্দুমাত্র ছোট না করেও, বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর অবদানকেই বেশি এগিয়ে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।  বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাই দ্ব্যর্থ হীন ভাষায় বলেছিলেন,
বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।" পাশাপাশি বলতে ভোলেননি, বাংলা গদ্য সাহিত্যের গতিশূন্য স্রোতে, বিদ্যাসাগরের বইয়ে দেওয়া সেই মহাসাগরীয় ঢেউ এর কথাও। “তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।" কিংবা "বিদ্যাসাগরই বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন।" প্রভৃতি উক্তিতে,  বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের অমূল্য অবদানকে সম্ভাষিত করেছেন।   
বিদ্যাসাগরের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া বিভিন্ন সময়কার ভাষণ-সংকলন ‘চরিত্রপূজা’য় তাই পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়, রবীন্দ্র মননে ঠিক কতটা উঁচু স্থানে বিরাজ করতেন বিদ্যাসাগর! ক্লান্তিহীন রবীন্দ্রনাথ সেখানে সদা তৎপর, বিদ্যাসাগরকে অন্য দৃষ্টিকোন থেকে তুলে ধরতে। মানবিক বিদ্যাসাগরের মূল্যায়নে, রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে কোনোরূপ ঘাটতিই চোখে পড়ে না। 
বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারবার মনে উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহেতিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।"

বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...