সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রবীন্দ্রনাথ নয়ঃ গান্ধীজীকে কে সর্বপ্রথম মহাত্মা উপাধি দিয়েছিলেন?

 রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজী হচ্ছেন তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে একেবারে শীর্ষে থাকা দুই ব্যক্তিত্ব অনেকটা ফুটবলের মারাদোনা বা ক্রিকেটের শচিন তেন্ডুলকর এর মতো স্ব স্ব ক্ষেত্রের চুড়ায় অধিষ্ঠিত এই দুই মহান মানুষের মধ্যে সখ্যতাও ছিল চুড়ান্ত দুজনেই পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সম্মানের প্রশ্নে একে অপরকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপায় অভিষিক্ত করেছেন বারেবারে গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথকে আখ্যায়িত করেছেন ঋষি তুল্য গুরুদেব রূপে তো রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীকে মহাত্মা আখ্যায় ভূষিত করেছেন 

    শান্তিনিকেতনে গান্ধীজী ও রবীন্দ্রনাথ।

যদিও রবীন্দ্রনাথই গান্ধীজীকে প্রথম মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন বলে যে প্রচলিত বিশ্বাস তা কিন্তু কোনোকালেই প্রশ্নের উর্ধে ছিল না, বিশেষ করে এলিট বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে গোড়া থেকেই এই নিয়ে দ্বিমত ছিল। আম জনমত অনুসারে ১৯১৫ তে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম গান্ধীজীকে মহাত্মা বলে সম্বোধন করেছিলেন, মোটের ওপর সেটাই সবার কাছে মান্যতা পেয়ে এসেছে।  কিন্তু তর্কের খাতিরে এই চিঠিকেই যদি প্রামাণ্য হিসেবে ধরাও হয় তাহলেও কিন্তু বিতর্ক দূর হয় না। কারণ চিঠিতে কোথাও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের বয়ানে গান্ধীজীকে মহাত্মা বলে অভিহিত করেননি। তিনি লিখেছেন - যাকে ভারতের কোটি কোটি মানুষ মহাত্মা বলে ডাকে তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা অর্থাৎ তিনি গান্ধীজীকে মহাত্মা বলার ক্ষেত্রে দেশের কোটি কোটি মানুষের রেফেরেন্স টেনেছেন। স্বভাবতই এটা বলা চলে - ১৯১৫ এর আগেই গান্ধীজীকে মহাত্মা বলার চল শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতেই পরিষ্কার ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যদি না হন তবে কে? কে প্রথম গান্ধীজীকে মহাত্মা নামে আখ্যায়িত করেছিলেন? এই বিতর্কিত প্রশ্নটি, রবীন্দ্রনাথের বহু কথিত পত্রদানের সময়কাল থেকে প্রায় ১০০ বছর অতিক্রম করার পর আবারো একবার চর্চার বিষয় হয়ে উঠতে দেখা গেল। গান্ধীর জন্ম রাজ্য গুজরাটেই উঠলো এই কূট প্রশ্ন। প্রশ্ন করলেন স্বয়ং গুজরাট হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা । 
২০১৬ সালে সন্ধ্যা মারু নামে এক পিটিশনারের আবেদনের ভিত্তিতে উক্ত বিচারপতি রাজকোট জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চান গান্ধীজীকে প্রকৃতপক্ষে কে মহাত্মা উপাধি দিয়েছিলেন।  কারণ রাজকোট জেলা পরিষদ তাদের রাজস্ব বিভাগের নিযুক্তির পরীক্ষায় এই সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন করেছিলো। এবং যে সকল পরীক্ষার্থী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম লিখেছিল তাদের উত্তর নির্ভুল ছিল না বলেই তাদের মত। এই নিয়ে সন্ধ্যা মারু নামের জনৈক পরীক্ষার্থী পিটিশন দাখিল করেন গুজরাট হাইকোর্টে।  আর তাতেই বিতর্কের সূত্রপাত। উল্লেখযোগ্য ভাবে বিচারপতির প্রশ্নের মুখে, রাজকোট জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ রীতিমতো হলফনামা দিয়ে জানিয়ে দেয় যে রবীন্দ্রনাথ নয়, গান্ধীজীকে প্রথম মহাত্মা বলেছিলেন এক সাংবাদিক তিনি সেভাবে কোনো বিখ্যাত বা নামী কেউ ছিলেন না দক্ষিণ আফ্রিকায়, গান্ধীজী কে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি চিঠিতে গুজরাটের জেতপুরের অধিবাসী উক্ত সাংবাদিকই তাঁকে সর্বপ্রথম মহাত্মা বলে উল্লেখ করেন এই প্রসঙ্গে রাজকোট জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ, প্রখ্যাত গান্ধী বিশেষজ্ঞ নারায়ণ দেশাইয়ের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দেখান।  যদিও নারায়ণ দেশাই উল্লেখিত ‘অজানা সাংবাদিক’ই যে গান্ধীজীকে সর্বপ্রথম মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন – একথাও পুরো সংশয় মুক্ত হয়ে বলা যায় না। কারণ তারও পূর্বে ১৯১৪ সালের জুলাই মাসেই গান্ধীজীকে মহাত্মা বলে সম্বোধন করার রেকর্ড দেখা যাচ্ছে। ভারত সরকার দ্বারা প্রকাশিত ‘মহাত্মা গান্ধী এ ক্রোনোলজি' অনুসারে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরের ঐতিহ্যমণ্ডিত সভাকক্ষ টাউনহলে আয়োজিত গান্ধীজীকে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম তাঁকে মহাত্মা বলে উল্লেখ করা হয়। এই বিষয়ে প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের মত বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাত্মা উপাধিকে নিশ্চিতভাবে জনপ্রিয় করেছিলেন, কিন্তু গান্ধীজীকে প্রথম মহাত্মা বলার শ্রেয় তিনি ডারবানের কথিত সংবর্ধনা সভার আয়োজকদেরই দিতে চান। কিন্তু এতেও বিতর্ক থেমে যায় না। কারণ কিছু ঐতিহাসিকের মতে ১৯১৪ এরও পূর্বে ১৯০৯ সালেই গান্ধীজীর বন্ধু ড প্রাণজীবন মেহতা, গোপালকৃষ্ণ গোখলেকে লেখা একটি চিঠিতে গান্ধীজীকে মহাত্মা বলে সম্বোধন করার নজির রেখে গেছেন। তাই সংশয়াতীত ভাবে গান্ধীজীকে প্রথম মহাত্মা বলার শ্রেয় কাউকেই সেভাবে দেওয়া যায় না।  

যদিও সকলেই গান্ধীজীর কথিত মহাত্মা নামের বিপুল জনপ্রিয়তার পেছনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাকেই অনস্বীকার্য বলে মনে করেন।
প্রসঙ্গত ২০১৬’র কথিত পিটিশনের রায় দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিও জনৈক ‘অজানা সাংবাদিক’ তত্ত্ব খারিজ করে দেন। এবং গুজরাট মাধ্যমিক পর্ষদের শিক্ষাক্রম অনুসারে গান্ধীজীকে মহাত্মা উপাধি দেওয়ার কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল বলেই বিতর্কের ইতি টানেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...