সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কোলকাতায় দুই চূড়া বিশিষ্ট জোড়া গির্জা গড়ে ওঠার কাহিনী!

কোলকাতা শহরের অন্যতম অনেক ঐতিহ্যশালী সৌধ যাদের মধ্যে শিয়ালদহ স্টেশন বিল্ডিং, কোলকাতা হাইকোর্ট, এমনকি জেনারেল পোস্ট অফিস এর মতো সুমহান স্থাপত্য নির্মাণেরও স্থপতি কিন্তু একজনই। তিনি - Walter B Granville. 
ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই প্রখ্যাত আর্কিটেক্টের উপরেই ভার পড়েছিল লোয়ার সার্কুলার রোডের ওপর অবস্থিত মিস্টার কোট্স এর বাগান বাড়ি ও তার সংলগ্ন ফাঁকা জায়গায প্রোটেস্ট্যান্ট দের জন্য একটি সুদৃশ্য গির্জা বানানোর। 


সেন্ট জেমস চার্চ, জোড়া গির্জা
দায়িত্ব পেয়ে যথারীতি Granville গির্জা নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়েছিল - ১৮৬২ সালের ৭ই জুন। বাংলার তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর John Peter Grant, গির্জার ভিত শিলা স্থাপন করেন। 


তোরণ স্তম্ভে লেখা - সেন্ট জেমস চার্চ 
একটু একটু করে বিশুদ্ধ গথিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত হতে থাকে গির্জাটি। চমকপ্রদ ভাবে গির্জার সম্মুখে দুটি সুউচ্চ চূড়া যা এককথায় অভূতপূর্ব ছিল, নজর কাড়লো সবার।
জোড়া চূড়া

চূড়া দুটির একটিতে বসানো হলো বৃত্তাকার দেওয়াল ঘড়ি। কৌনিক খিলান এবং রঙীন শার্সি আবৃত জানালার সৌকর্যে সেজে উঠতে লাগলো গীর্জার বহি প্রাকার। একই সঙ্গে গির্জার সংলগ্ন স্থানে নির্মিত হোল মহিলাদের জন্য প্রার্থনা কক্ষ - লেডিজ চ্যাপেল।  নির্মাণে কোনোরূপ খামতি যেন না থাকেকড়া নজর ছিল Granville'র।  কারণ গির্জাটি আগে যেখানে ছিল - লেবুতলা লেনের সরকারি মাদ্রাসার কাছেসেটাও একটা বাগান বাড়িতেই ছিল। মিস্টার রবার্ট ল্যাজেরাস ডি এলিভিয়েরা নামের এক সাহেবের বাগানবাড়িতে১৮২০ সালের ১৪ই নভেম্বর তারিখে পত্তন হয়েছিল এই গির্জারসেন্ট জেমস্ এর নামে। স্থানটি অধুনা সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার নামে পরিচিত হলেও পূর্বে জেমস্ স্কোয়ার নামে পরিচিত ছিল। 
কিন্তু হল কি কয়েকবছরের মধ্যেই দেখা গেল গির্জাটি ক্রমশ মাটিতে বসে যাচ্ছে।  যার ফলে গির্জাটির কোনো চূড়াই সেই সময় নির্মাণ করা সম্ভব হয় নি। কথিত আছে স্থানীয় লোকেরা এইজন্য গির্জাটি কে ন্যাড়া গির্জা বলে ডাকতো। কিন্তু যত সময় গেল তত যেন বিপত্তি ঘনিয়ে এল গির্জাটির ওপর। কারণ গির্জার কড়ি বর্গার ছাদে তখন শুরু হয়ে গেছে ভয়ঙ্কর উই পোকার প্রাদুর্ভাব। প্রতিহত করার চেষ্টা হয়নি এমন নয়। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। বরং ১৮৫৫ সালে সাধারণের জন্য গির্জায় প্রবেশ বন্ধ করে দিতে হয়।। শুরু হয় রিপেয়ারিং এর কাজ। কিন্তু লাভ তো কিছু হলোই না উল্টে মেরামতি চলাকালীনই হুড়মুড় করে ছাদ সমেত ভেঙে পড়েছিল গির্জা। তারিখটি ছিল ১৮৫৯ এর ২২শে আগস্ট। পরে জানা গেছে - যে বাগানবাড়িতে গির্জাটি নির্মিত হয়েছিল তা ছিল পুকুর ভরাট করা জলা জায়গা। 

তাই নতুন জায়গায়আর কোনো ভুল নয়। স্থপতির কড়া তদারকিতেই নির্মিত হচ্ছিল নতুন গির্জা ভবনটি। একসঙ্গে প্রায় ৫০০ জনের ও বেশী মানুষ যাতে বসে উপাসনা করতে পারে সেইভাবে গড়ে তোলা হোল প্রার্থনা কক্ষ। পাকা দু বছর লেগেছিল নির্মাণ করতে। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৪ সালের ২৫ শে জুলাই তারিখেসেন্ট জেমস্ ডে'র পবিত্র দিনে উদ্বোধন হয়েছিল স্থানান্তরিত সেন্ট জেমস্ গির্জার নয়া সৌধটি। উদ্বোধন করেছিলেন বিশপ কটন।সেই থেকে এই জোড়া চূড়া বিশিষ্ট গির্জা - কোলকাতা তথা সারা দেশ বাসীর কাছে জোড়া গির্জা হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। যার আজকের ঠিকানা ১৬৭আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডকোলকাতা ১৪. 
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো গির্জাটির উদ্বোধনের দিনেই পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে একটি স্কুল নির্মাণের ঘোষণা করা হয়। যে স্কুল টি আজকের দিনে সেন্ট জেমস স্কুল হিসেবে পরিচিত। গির্জা উদ্বোধনের পরের দিনই সমাচার দর্পণে লেখা হয় এই নিয়ে। “মোকাম কলিকাতায় বৈঠকখানাতে মাদ্রাসার নিকট এক নূতন গীর্জাঘর হইতেছে… গির্জাঘর সেন্ট জেমস নামে খ্যাত হইবেক এবং সেই গির্জাঘরের এক প্রদেশে দরিদ্রলোকের বালকদিগের বিদ্যাভাসার্থে প্রস্তুত হইবেক, তাহার খরচের কারণ এক সাহেব চারিহাজার টাকা শ্রীযুক্ত লর্ড বিশপ সাহেবের নিকট রাখিয়া গিয়েছেন।”  বর্তমানে গির্জাটির দুপাশে দুটি স্কুল রয়েছে, যার মধ্যে একটি সেন্ট জেমস্ স্কুল এবং অন্যটি Pratt স্কুল।  উল্লেখ্য এই Pratt স্কুল একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ -Archdeacon Pratt এর নামে নামাঙ্কিত। যেটা উল্লেখযোগ্য হোল এই Pratt সাহেব ই জোড়া গির্জা ও তৎসংলগ্ন শিশুদের একটি স্কুল নির্মাণের জন্য এই বাগানবাড়ির জায়গাটিকে সদুপোযোগ করার ব্যাপারে বিশেষ সহায়তা করেন। 
নারকেল, আম, সেগুন ইত্যাদি নানা দেশীয় গাছ গাছালিতে ভরা জোড়া গির্জা তার প্রায় দুশো বছরের সুপ্রাচীন ইতিহাসে অনেক বারই মেরামতির সম্মুখীন হয়েছে। সম্প্রতি আমি যখন যাই তখন ও একদফা মেরামতির কাজ চলছে, দেখলাম। তাই ভেতরে এখন প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। যদিও গির্জার ভেতরে ছবি নেওয়া বারণ।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...