সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চেনা কিশোরের অচেনা গল্প!

বাবা মা'র পরে জীবনে যার কথা ভেবে আমার চোখে জল আসে তিনি কিশোর কুমার। তাঁর গানের গলা, গায়কী নিয়ে বলার কিছু নেই। সকলেই জানেন ভারতীয় সিনেমার নেপথ্য সঙ্গীত জগতে কি বিশাল উচ্চতায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। সে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। আজকে বরং বলবো কিশোর কুমারের গায়নশৈলীর মধ্যে যে জীবন দর্শনের প্রতিফলন হতে দেখি তার কথা। সামগ্রিক ভাবে কিশোর কুমারের গানের দর্শণ নিয়ে বলতে গেলে যে কথা সর্বাগ্রে বলতেই হয় সেটা তাঁর গানের মধ্যে প্রতিভাত হওয়া অসাধারণ এক নির্লিপ্ততাতার কথা। তার গাওয়া সবধরনের গানের মধ্যেই সেটা ফুটে উঠতে দেখা যায়। লঘু চালের কমেডি গান থেকে শুরু করে ধ্রুপদী এমনকি চরম দুঃখের গানেও নিজের অনুভূতির বৈভবকে মিশিয়ে দিয়েও অবাক নির্লিপ্ততাতায় - তাকে প্রকাশ করতে পারতেন তিনি। যা এক অনবদ্য শ্রবণ সুখের অনুভব প্রদান করে মুগ্ধ শ্রোতার কানে। তৈরি হয় চিরস্থায়ী, অনপনেয় অনুরণন। যেটা দিয়ে কিশোর কুমার কে আর সকলের থেকে আলাদা ভাবে চিনে নেওয়া যায় অতি সহজেই। আসলে তিনি অনন্য, চির উদাসী এবং চির বাউন্ডুলে। ১৯২৯ এর ৪ঠা আগস্ট, মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায় এক প্রবাসী বাঙালী পরিবারে জন্ম হয় আক্ষরিক অর্থেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে কিশোর কুমারের। আজ বলবো একটা রিয়েল ঘটনার কথা যা আমার বাবার কাছ থেকে শোনা। চেনা কিশোর কুমারের অচেনা গল্প। আশির দশকে কোলকাতার নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে হওয়া এক গানের জলসার কিশোর কুমার ছিলেন মুখ্য আকর্ষণ। বম্বের আরো অনেক শিল্পী ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। আমার বাবার সেই অনুষ্ঠানে দর্শক হিসেবে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। যাই হোক কিশোর কুমার সবাইকে অবাক করে দিয়ে একেবারে পাট করা ধুতি পাঞ্জাবিতে, যাকে বলে ফুল বাঙালী বাবু সেজে উপস্থিত হয়েছিলেন মঞ্চে। এবং এসেছিলেন ছয় বেহেরায় একেবারে হুম হুম শব্দে বয়ে নিয়ে আসা পাল্কি তে চড়ে। কেতা করে ধুতির কোঁচা ঢোকানো ছিল পাঞ্জাবীর সাইড পকেটে। একহাতে ধরা ছিল আস্ত এক পাকা রুই আর আর অন্য হাতে ছিল মিষ্টি ভর্তি মাটির হাঁড়ি। ভাবুন একবার। শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে। মন্ত্র মুগ্ধ দর্শক কে তারপরে সচকিত করে শুরু করেছিলেন 'লুকোচুরি' ছবির সেই বিখ্যাত জ্যাজ গান, ' শিং নেই তবু নাম তার সিংহ' । কিন্তু তিনি তো কিশোর কুমার। পরক্ষণেই ধরলেন '' ফান্টুস' ছবিতে শচীন দেব বর্মন এর সুরে গাওয়া সেই চির মরমী গান, ' দুখি মন মেরা শুন মেরা কহেনা' গান শেষ হতে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটতো দেখা গেল। কিশোর কুমার, মাইক হাতে মঞ্চের সামনে দর্শক আসনের দিকে ছুটে যাচ্ছেন। সবাই অবাক। এদিকে সেখানে এক মহিলা দর্শক, তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছেন। গানের দুঃখ নিশ্চিত রূপে,তাকে দারুন অভিঘাতে স্পর্শ করেছিল সেদিন। সবাই তাকিয়ে আছে কিশোর কুমারের দিকে। দেখা গেল, কিশোর কুমার নিজের পকেটে থেকে রুমাল বের করে ওই মহিলার গাল বেয়ে নামা জলের ধারা মুছে দিচ্ছেন। সেই এক নির্লিপ্ততার জীবন দর্শন!




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...