ঢাকুরিয়া ব্রীজে গাড়িটা উঠতেই, মেয়েটি আকুল হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে - বাইরের একলা আকাশটাকে খুঁজতে থাকে।
ব্রীজ পেরিয়ে, ঢাকুরিয়া স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে বাসটা দাঁড়াতে, বিজনের সামনে বসা দুটো লোক ব্যাগ পত্র নিয়ে নেমে যায়। ভদ্রমহিলা, বাচ্চা মেয়েটাকে একটা সিটে বসতে বলেন। "বস্, বস্ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস!" বিজন ভদ্রতার খাতিরে ভদ্রমহিলাকে আর একটি সিটে বসতে বললে, ভদ্রমহিলা বিনীত ভাবে সামনে নেমে যাবেন বলে বিজনকেই বসতে বলেন। অগত্যা...।
মেয়েটির কাঁধের দু পাশ দিয়ে ঝুলতে থাকে কমলা ফিতে দিয়ে বাঁধা পরিপাটি বিনুনি দুটি। চোখ গুলোয় শুধু, কেমন যেন একটা উদাস উদাস ভাব। ঠোঁটে কিন্তু সবসময় হালকা একটা হাঁসির রেখা লেগে থাকে।
"তোমার নাম কি?" বিজন জিজ্ঞাসা করে মেয়েটিকে। "সৌমিলী!" "সৌমিলী মন্ডল!" "কোন ক্লাসে পড়?"
বলতে, বলতে মেয়েটি তার ছোট্ট মানি ব্যাগ থেকে দশ টাকার একটা নোট বার করে কন্ডাক্টরের হাতে দেয়। মুখে বলে, "একটা দশ।"
"বাবা, মুদিখানার দোকান করেন।" "তার মধ্যে আবার দোলের সময় রং বেচেন। দীপাবলির সময় পটকা।" নিজে নিজেই বলে যায় মেয়েটি। "কোথায় দোকান, যাদবপুরে?" "না না, নবদ্বীপে!" "তাহলে, এখানে তুমি কার কাছে থাকো?"
বিজন খানিক কাটাছেঁড়া করে। মুদি দোকান করে মেয়েকে ফিল্ম পরিচালক বানিয়েছেন, ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন, বেশ অনুপ্রাণিত করার মতো। সেইরকম ভাবলে কত কিছুই তো ঘটে পৃথিবীতে, যার হিসেব মেলানো যায় না।
বিজন বেশী না ভেবে মেয়েটিকে পরের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। এটা বিজনের বরাবরের স্বভাব। বাসে হোক, ট্রেনে হোক, পাশে বসা মানুষটির দিকে নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে, অনেকটা মুখের দিকে ভাজা ছোলা বা বাদাম ছুঁড়ে দেওয়ার মত।
খানিক বাদে মেয়েটি যখন মুখ নীচু করে বলা শুরু করে, বিজন তার কানটাকে ওর মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে শোনার চেষ্টা করে।
মেয়েটি উঠে দাড়ালে, একজন - কপালে চন্দনের তিলক কাটা, গলায় তুলসীর মালা পরা বৈষ্ণবী মাসী মেয়েটির হাত শক্ত করে ধরে থাকে, যতক্ষণ না বাসটা পুরোপুরি দাঁড়াচ্ছে।
বাস ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে সুকান্ত সেতুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ, রাস্তা থেকে শোনা যায় সৌমী, সৌমী ডাক; কেউ ডাকছে, ভীষণ জোরে জোরে। বাসটা তখন খুব বেশী হলে কয়েক মিটার মত এগিয়েছে স্ট্যান্ড ছেড়ে।
এত কোলাহলের মধ্যেও, বিজনের কানে ডাকটা ঠিক পৌঁছে যায়। সে বাইরের দিকে চোখ ফেলে দেখে, সৌমিলীকে একটা কিশোর বয়সের ছেলে তারস্বরে ডাকছে সৌমী সৌমী বলে। ইউনিফর্ম দেখে মনে হচ্ছে যাদবপুর বিদ্যাপীঠের ছাত্র।
হয়তো ভয় পাচ্ছে, আবার না কেউ তাকে প্রশ্ন করে বসে, তোর সাথে কেউ নেই সৌমিলী, তুই কি আজও একা?
আকাশে মেঘ গুলো জটলা পাকাচ্ছে ক্রমশ, আর তার ছায়া এসে পড়েছে কোলকাতা শহরের মাথায়, পথে, হাটে, বাজারে সর্বত্র।
কাটা
ঘুড়িটা, কাঠ -বাদাম গাছের ডালায় জড়িয়ে লটপট করছিল হাওয়ায়। ঢাউস গাছটির মরচে ধরা লাল, লাল পাতাগুলি ও তেমনি। হাওয়ার তালে তাল মিলিয়ে এমন খ্যাপাচ্ছিলো ভো-কাট্টা হয়ে যাওয়া ঘুড়িটিকে, যে মাঝে মধ্যে ঘুড়িটির লেজ, একেবারে ত্রস্ত কিশোরীর মতো ফরফর, ফরফর করে উড়ছিল।
বিদীপ্তা তার ক্যামেরাটা অন করে।
আকাশে গোল গোল করে চক্কর কাটা কালো কালো পাখি, সম্ভবত কাকই হবে, নীল আকাশের শীতলপাটিতে ফুল বড়ি দেওয়ার মতো করে দু দিকের ডানা উজাড় করে মেলে ঘুরতে থাকে বারবার। পড়ন্ত বেলার হলুদাভ আলো তখন সামনের বহুতলটির গায়ে পড়ে রূপকথার পরিবেশ তৈরি করেছে। বিদীপ্তা বুঝতে পারে না, সে ঠিক কোন ছবিটা তুলতে চায়।
ধূর ...! কেমন উদ্দেশ্যে হীন লাগে বিদীপ্তার। পেশাদার ফটোশিকারী হিসেবে সে ভালোই জানে, যে দিন হবে না, সেদিন মাথা কুটে মরে গেলেও ভালো কিছু পাওয়া যাবে না।
সামনেই বি বি সি। তবে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং সেন্টার নয়। বাইপাসের ধারে, 'বেনু বন ছায়া' নামের একটি পার্ক।
হাঁটতে, হাঁটতে বিদীপ্তা এগিয়ে যায় ওইদিকে। বাইপাস দিয়ে পাগলের মতো ছুটে চলে শত সহস্র যান বাহনের শেষ না হওয়া স্রোত, সঙ্গে তাদের সম্মিলিত গাঁ- গোঁ শব্দ। অনেকটা সমুদ্রের গর্জনের মতো। রাস্তার ধারে দাঁড়ালে মনে হয় সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার উপরে আবার হর্নের বিরামহীন পো- পা; একেবারে শব্দ-গজ-ঘন্ট । বিশেষ করে, আজকের দিনে বিদীপ্তার বিক্ষিপ্ত মনকে আরো বিক্ষিপ্ত করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
বেরনোর সময়, বিদীপ্তার বাবা আজকে তাকে বেরুতে বারণ করেছিল, এখন কেন জানি বিদীপ্তার মনে হয়, না বেরুলেই বোধহয় ভালো করতো সে। আসলে, গত বছর এই দিনটিতেই ওর ছোট বোন সুদীপ্তা বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে, কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস, তার আর ফিরে আসা হয়নি। বিদীপ্তা, মনে করতে চায় না সে কথা। তাও, কেন যে আজ তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, অঙ্কিতের কথাটা যেন বেশী বেশী করে মনে পড়ছে তার।
অঙ্কিত, সুদীপ্তার বয়ফ্রেন্ড, সুন্দর স্মার্ট ছেলে। দুর্ধর্ষ স্পিডে বাইক চালাতো। ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন ডে'র বিকেলে সুদীপ্তাকে বাইকে বসিয়ে যেন ওর গতি আরো বেড়ে গিয়েছিল। বাইপাসেই, সায়েন্স সিটির কাছে, একটা বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে একটা ছোট গাড়িতে। ভীষণ গতিতে ছিল। স্পটেই, শেষ হয়ে যায় সুদীপ্তা। অঙ্কিত, কিভাবে প্রাণে বেঁচে যায়। যদিও ওর সাথে অনেক দিন আর কোনো যোগাযোগ নেই।
"আরে বাবা, একটু ধার দিয়ে হাঁটুন না," একেবারে, বিদীপ্তার ধার ঘেঁষে চলে যায় একটা বাইক।
"দেখেছিস, আজকের দিনে কেমন সিঙ্গেল ঘুরছে"
"কাউকে পাচ্ছে না, তুই যাবি?"
বিদীপ্তা স্পষ্ট শুনতে পেল, বাইকে বসে দুজন বলতে বলতে চলে গেল।
বিদীপ্তা, কিছু বলতে গিয়েও আটকে যায়। কি আর বলবে।
ওর আজ সঙ্গী নয়; ওর চাই একটা সেরা ক্লিক।
হঠাৎ বিদীপ্তার চোখ চকচক করে ওঠে। আরে, দারুন তো।
বি বি সি অব্দি তাকে যেতেই হোল না, তার আগেই উড়াল ব্রীজটার নীচে, নিরীবিলিতে এক জোড়া কপোত কপোতি কে দেখে, বিদীপ্তা রেডি হয়ে যায় আজকের সেরা শট টা নেওয়ার জন্য। খুব সন্তপর্নে সে ক্যামেরা তাক করে, ওদের দিকে। অনেকটা ঝিলের ধারে বক শিকার করতে বন্দুক তাক করার মতো। ভয় পেয়ে, পাছে উড়ে না পালায়।
'হ্যাপি ভ্যলেন্টাইনস ডে!" পরীর মত সুন্দর মেয়েটি দাড়িয়ে, তার সামনে টাটকা লাল গোলাপের স্টিক হাতে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ছেলেটি। অপার মুগ্ধতা তার চোখে মুখে। মেয়েটির গালে টোল পড়া হাসির উৎসব লেগেছে যেন।
বিদীপ্তা, আর দেরী করে না। শাটার দাবিয়ে দেয়। উঠে আসে টলটলে একটা ছবি।
বিদীপ্তা এবারে সেল ফোনটা বার করে অরিন্দমকে একটা ফোন করে। অরিন্দম, শহরের বিখ্যাত পত্রিকা গ্রুপের ডেস্ক ম্যানেজার। এখানে ছবিটা দিলে, রেট একটু বেশী পাওয়া যাবে।
"হ্যালো, একটা দারুন ছবি পেয়েছি আমি।"
"বলতে পারো, সেরা ছবি। ভ্যালেন্টাইনস ডে'র পুরো ক্রেজটা ধরতে পেরেছি, একেবারে সেন্ট পার্সেন্ট।"
ফোনে কথা শেষ হয় না, এর মধ্যে বিদীপ্তার একেবারে সামনে চলে আসে ছেলেটি। এবং কোনো কথা বলার আগেই, রীতিমতো ক্যামেরা ধরে টানাটানি করতে থাকে।
"আরে, আরে কি করছো?"
পাশে সেই পরীর মতো মেয়েটিও দাঁড়িয়ে আছে।
"পার্সোনাল ছবি বেচে, বিজনেস করা না। ভেঙে দেবো ক্যামেরা।"
এদিকে অরিন্দম "কি হোল, কি হোল" করে যেতে থাকে ফোনে।
"আগে আপনি ওই ছবিটাকে আমাকে দিয়ে দিন, না হয় নষ্ট করে দিন।"
"কেন করবো, পার্সোনাল যদি হয়, পাব্লিক প্লেসে কেন করছো?"
"দেখুন, বেশী বাড়াবাড়ি করলে না, আপনার বোনের অবস্থা করে দেবো!"
বিদীপ্তা যেন আকাশ থেকে পড়ে। "বোনের অবস্থা করে দেবো মানে?"
ভালো করে ছেলেটিকে, এবার মিলিয়ে দেখে বিদীপ্তা।
"এ কি, তুমি অঙ্কিত?"
সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে বিদীপ্তার। দুঃস্বপ্নের মতো লাগে তার পুরো ব্যাপারটা।
"এ সব কি বলছো তুমি যা তা!"
এবার অঙ্কিত যেন আরো উল্লসিত হয়ে ওঠে। "বিশ্বাস হচ্ছে না, না?"
বিদীপ্তা আর স্থির থাকতে পারে না। উত্তেজনায় গোটা শরীরটা তার কাঁপতে থাকে।
"তুমি কিসের জন্য এইরকম করলে, তোমার মতো ক্রিমিনাল কে আমার ফুলের মত বোন বিশ্বাস করে মরে গেল!"
"কিন্তু অরিত্র, তুমি তো কোনোদিন বলোনি আমায় এসব কথা," পরীর মতো মেয়েটির মুখ থেকে হঠাৎ যেন হাঁসি শুকিয়ে গিয়ে, চুপসে যাওয়া আমচুরের মত দেখায়, তার মুখটাকে।
"অরিত্র?"
"তুমি অঙ্কিত না?"
বিপন্ন বিস্ময়ে, বিদীপ্তা জিজ্ঞাসা করে অঙ্কিত কে।
এরমধ্যে পরীর মতো মেয়েটি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে, সোজা মুখ ঘুরিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে।
"দিপীকা, তুমি চলে যাচ্ছো! কিন্তু কেন?" "থামো, থামো, আমি বলছি, তুমি থামো, দিপীকা।"
পরীর মতো মেয়েটি, থামার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। সোজা হেঁটে এগিয়ে যায়। অঙ্কিত, বারেবারে তাকে ডেকে যায়।
একবার ও পেছন ফিরে তাকায় না, দিপীকা। আসলে সে তাকাতে চায়ও না।
"আমি অরিত্র, অঙ্কিত নই।"
বিদীপ্তা, এবার অঙ্কিতের সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ায়।
"তুমি যাবে না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে।"
"আমি পুলিশকে কল করছি!"
"আর কতো মেয়ের সর্বনাশ করবে তুমি?"
"দেখুন, ওই পুলিশ টুলিশের ভয় দেখাবেন না তো।"
"কি করে ওদের ম্যানেজ করতে হয়, ভালো করে জানা আছে।"
"সরুন!"
বিদীপ্তার হাতটাকে জোরে, ঠেলে সরিয়ে দেয় অঙ্কিত তার বুকের কাছ থেকে। বিদীপ্তা ভয় পেয়ে সরে আসে।
"যত্ত বাজে ঝামেলা!" অঙ্কিত এবার সটান এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই পেছন থেকে তার জামার কলার চেপে ধরে পুলিশ।
"এয়্ ব্যাটা দাঁড়া এখানে!" "খুব রংবাজি না!"
বিদীপ্তা ঘুরে দেখে, দিপীকা কে; ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে তখন।
তার চোখে মুখে, আবার সেই হাসির ছোঁয়া, তবে মুগ্ধতার নয়, সবক শেখানোর হাঁসি।
--_____------_______-------________-----__
মাশরুম!
"মাশরুম নেবেন, ভালো মাশরুম আছে...!" ট্রেন থেকে নেমে প্রতিদিনই অমল পরেশের চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আয়েস করে একটা সিগারেট ধরায়। আপ আর ডাউন দু দিকের দুটি লাইনের মধ্যিখানের এই জায়গাটিকে যেন বহমান নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের মত লাগে; আর পরেশের দোকানটাকে লাগে, চরে বসে যাওয়া নৌকার মতন।
"আজ খুব তাড়াতাড়ি ঢুকে গেলে মনে হয়?" অমল তার কাঁধের ভারী ব্যাগটাকে পাশে - বাঁশের মাচার ওপর নামিয়ে রাখে, সাবধানে। পরেশের দোকানের গা ঘেঁষেই রয়েছে ছোট মত একটি সেলুন। বিকেল, ৩ টে ১০ এর ডাউন নামখানা লোকাল ছেড়ে যেতেই সেলুনের দরজায় টাঙানো নোংরা পর্দাটি হাওয়ায় পতপত করে ওড়ে ছেঁড়া পালের মতো। ট্রেন চলে গেলে, সেলুনের ভেতর থেকে পুরানো দিনের হিন্দি গান বাজার আওয়াজ ভেসে আসে কানে।
"কামরাদা হাই স্কুলে, রিয়েজেন্টের বোতল গুলো আজকের মধ্যেই ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। এদিকেই তো স্কুল, তাই একেবারে মালপত্র ব্যাগের মধ্যে নিয়ে বেরিয়ে এসেছি।"
বলতে, বলতে অমলের চোখ চলে যায় মাশরুম বিক্রি করা ছেলেটির দিকে।
"হাই প্রোটিন, মাশরুম নেবেন, মিশনের তৈরী মাশরুম ..!"
ছেলেটির পরনে, সিকিউরিটি গার্ডের মত বুকে স্টিকার লাগানো জলপাই রঙের শার্ট আর টাইট নেভি ব্লু প্যান্ট। ডান হাতের আঙুল থেকে আঙুরের থোকার মতন ঝুলতে থাকে মাশরুমের পোঁটলা গুলি আর বাঁ হাতের চেটোর নীচে ধরা স্টিলের স্টিকটাকে মাটিতে ঠেকিয়ে, ছেলেটি সটান দাঁড়িয়ে থাকে প্লাটফর্মের ওপরে। মনে হয় ছেলেটি অন্ধ। চোখে কালো চশমা পরা।
অমল, ছেলেটির দিকে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যায়। যদিও তার মাশরুম নেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু ছেলেটির সাথে দেখা করার জন্য, তার যেন আর তর সইছিল না।
"এয়্, তোমার ব্যালেন্সটা নিয়ে যাও," পরেশ, দোকান থেকে হাঁক পাড়ে।
আর যাই হোক ছেলেটি তো ভিক্ষা করছে না। একেবারে মাথা উঁচু করে, সে যত অকিঞ্চিৎকর জিনিষই হোক না কেন, সেটাকে বিক্রি করছে, একজন প্রকৃত সেলসম্যান যেভাবে করে। কজন, পারে?
অমল কি ছেলেটাকে অযথাই বড় করে ভাবার চেষ্টা করছে? সে নিজেও বুঝতে পারে না।
"মাশরুম কত করে ভাই, তোমার?"
"আড়াইশো গ্রামের প্যাকেট, পঞ্চাশ টাকা দাম।"
"তুমি কি নরেন্দ্রপুর মিশনেই থাকো?"
"না, ট্রেনিং নেওয়ার সময় থাকতাম।" "এখন ওদের থেকে মালটাই শুধু কিনে নিয়ে আসি।"
ইতিমধ্যে এক স্থূল চেহারার, বেঁটে মতো মহিলা মাশরুমের একটা পোঁটলা নেয় আর ছেলেটির হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, "বাড়ি যাচ্ছো, কবে?" পূর্ব -পরিচিত বোধহয়। "এ হপ্তায় যাবো না।"
"তাহলে কাল রুমে থাকবে?" "হ্যা।"
"কাল সন্ধ্যায় তবে যাচ্ছি আমি, ঠিক আছে!" অমল দেখে ছেলেটির ঠোঁটে চটুল একটা হাসি খেলে যায়, মহিলাটির কথা শোনার পর। মহিলাটি তারপরে আর দাঁড়ায় না, হনহন করে হেঁটে চলে যায়।
দেখে শুনে অমলের কি যে হোল হঠাৎ করে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করে বসলো, "তুমি তো এখনো বিয়ে করোনি না?" হয়তো আগের থেকে ভেবে রেখেছিলো জিজ্ঞাসা করবে বলে, আচমকা বেরিয়ে গেছে।
"কেন বলুন তো? আপনার কি দরকার, জানার?"
একেবারে অপরিচিত কোনো লোকের কাছ থেকে যে এরকম প্রশ্ন আসতে পারে, ভাবতেই পারেনি। প্রাথমিক ভাবে তাই হকচকিয়ে গিয়েছিল, ছেলেটি।
"না...না বলতে চাইলে, থাক গে। বলতে হবে না!" অমলের কথা শুনে ছেলেটি তো হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। একে তো অনধিকার প্রশ্ন করছে, তারপরে আবার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে অযৌক্তিক অভিমানও করছে। কার মুখ দেখে যে সে উঠেছিল আজকে! ভাগ্যিস তার চোখ নেই।
অমলও হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। তবে এবার একটু সতর্ক হয়ে। "যদি কিছু মনে না করো, তবে তোমাকে একটা কথা বলতাম!"
"বলুন!" ছেলেটি এবার খানিক নরম হয়। আসলে অমলের বিগলিত কথা শুনে অনেক হাড় হৃদয়ের লোকও দমে যায়।
"বলছি কি, তোমার বাড়িতে আর কে কে আছেন? মানে বাবা, মা...!"
"সবাই আছেন, কিন্ত তারা দেশের বাড়িতে থাকেন। এখানে আমি একা।"
"তোমার স্ত্রী ও কি ওখানেই থাকে?"
এবার ছেলেটি রেগে যায়।
"আমার বিয়েই তো হোল না। আচ্ছা আমার মত অন্ধকে কে বিয়ে করবে বলুন তো!"
"আহা সেই জন্যই তো এত কথা জিজ্ঞাসা করছি তোমায়!"
"মানে?" "বলছি, বলছি!" অমলের কথায় ছেলেটির এবার ধৈর্য চ্যুতি হয়।
"এবার বলুন তো, কি বলবেন বলছিলেন?" ছেলেটির কন্ঠায় স্পষ্টতই বিরক্তির স্বর। অমল বুঝতে পারে আর একথা সে কথায় দেরী করলে চলবে না। সে রেডি হয়ে যায় এবারে আসল কথাটি বলে ফেলার জন্য, আর ঠিক তখনই দেখে এক জন ষন্ডা মার্কা লোক সেই মোটা, বেঁটে মতো মহিলাটিকে একেবারে টানতে টানতে নিয়ে আসছে ছেলেটির কাছে। "ভাই পাতিয়েছিস না! রোজ ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে গিয়ে কি আহ্লাদে করিস?" "ভেবেছিলি, জানতে পারবো না।"
"এয়্ ছোঁড়া, চোখে দেখিস না, তাও তোর এত সখ কিসের রে?"
"ছাড়ো, ছেড়ে দাও বলছি। আ:!"
লোকটা, ছেলেটার গলা চিপে ধরেছে। কোনোভাবে, তাকে ছাড়াতে না পেরে ব্যাথায় কেকিয় ওঠে, ছেলেটি।
বৌটা এবার কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, "ওর কোনো দোষ নেই। ও ভীষণ ভালো ছেলে। ওকে ছেড়ে দাও তুমি।"
এতক্ষণ অমল চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। এবারে একেবারে দাবড়িয়ে উঠে, ছেলেটির গলা ছেড়ে দিতে বলে লোকটিকে। "ছাড়ুন!"
"আপনি জানেন ওই ছেলেটি আমার হবু জামাই।"
"আ্যা....!"
সবাই, থ হয়ে যায় অমলের কথা শুনে। দ্বারকাঠ লোকটাও ছেলেটির গলা ছেড়ে দিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।
"আমার একমাত্র মেয়ে, সে ও ওর মতই অন্ধ। তার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে!"
শুনে, কারোর মুখে কোনো কথা ফোটে না।
একটা অপার মুগ্ধতার আবেশ শুধু দলা পাকিয়ে, আটকে থাকে বুকের কাছে। অত বড় আগুন হয়ে থাকা, বৌ টির স্বামী, তারও চোখের কোনা ভিজে চিকচিক করে ওঠে।
নীরবতা ভেঙে, বৌ টি এবার তার স্বামীকে উদ্দেশ্যে করে বলতে থাকে -
"ও হীরের টুকরো ছেলে। রোজ সন্ধ্যায় আমি ওর কাছে গান শুনতে যেতাম, শুনে নাও ভালো করে!"
"কি মিষ্টি গলা ছেলেটার, জানো না তো তাই!" আবেগে গলা কেঁপে যায়, বৌ টির।
অন্ধ ছেলেটি তখন তার হবু শ্বশুরের পা দুটি খুঁজে চলেছে, প্রণাম করবে বলে।
---______-------_______-------_______-------

রং নাম্বার!
এত রাত্রে ফোন! "ধূ...র! কে যে এত রাত্রে ফোন করছে,...," মশারির ভেতর থেকে গলা বের করে, মাথার কাছে টি- টেবিলটাতে হাত রাখতেই মুঠোর মধ্যে চলে আসে ফোন টা। মোবাইলের স্ক্রিনে আননোন নাম্বার দেখে, সুখময় আর রাগ চেপে রাখতে পারে না। "হ্যা... লো!" "কে বলছেন?" ওর আগের বস যে ওকে বলতেন, রাতের বেলায় ঘুমোতে যাবার আগে উনি ল্যান্ড লাইনের তারটাকে খুলে রেখে দিতেন, এখন মনে হচ্ছে খুব একটা খারাপ কিছু করতেন না।
"আ ...মি বলছি, সুখময়!" আশ্চর্য, নামটা জানলো কি করে? সুখময় ঢোঁক গেলে। কিন্তু গলার ঝাঁঝ কমায় না।
"আমি মানে? কে আপনি?"
পাশে তৃপ্তি শুয়ে; সুখময়য়ের কথা বলার আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। "ফোন রেখে ঘুমাও তো," জড়ানো গলায় সুখময়কে কথা গুলি বলতে বলতে তৃপ্তি পাশ ফিরে শোয়।
"তুমি চিনতে পারছ না? আমি মনীষা!" "মনীষা?" "কি ফাজলামো করছেন বলুন তো এত রাত্রে?" "রাখুন, এটা রং নাম্বার।" "আপনি ভুল জায়গায় ফোন করেছেন।"
"এভাবে ফোনটা কেটে দেবে না প্লিজ!"
"তার মানে, কি বলতে চাইছেন? সারা রাত ধরে গল্প করে কাটাবো আপনার সঙ্গে?"
"না চেনার অভিনয়টা ভালোই করতে পারো, দেখছি!"
"কি বলছেন আবোল তাবোল!" "আশ্চর্য তো!" ফোনটা এবারে কেটে দেয়, সুখময়।
রাতের মাল গাড়ী চলে যাওয়ার ভারী আওয়াজটা ক্রমশ হালকা হতে হতে, মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। জানালার বাইরে নিশি পোকার ঝুম ঝুম শব্দে, সুখময়য়ের মনে হয় কেউ নূপুর পায়ে পায়চারী করছে বারান্দায়। এদিকে শুক্লা একাদশীর চাঁদের আলো, কি যে মায়া ছড়িয়েছে কে জানে, জানালার পর্দাটি থেকে থেকে হাওয়ায় উড়ছে আর ঘরের মধ্যে ডেকে ডেকে আনছে এক গুচ্ছ বোবা জ্যোৎস্নাকে। সুখময়য়ের কেমন গা ছমছম করে ওঠে।
মনীষা!
সুখময় মনে করার চেষ্টা করে, মনীষা বলে কখনো কাউকে সে চিনতো কি না। রাস্তার কুকুরটা হঠাৎ কেঁদে উঠতে, সুখময়ের মনটা কেমন আর্দ্র হয়ে ওঠে। কোনো প্রয়োজন ছাড়া, এত রাত্রে কোনো মহিলা কি এমন আর্ত স্বরে কাউকে ফোন করতে পারে?
"ধূ ....র, মরুক গে। অত ভেবে কাজ নেই।" সুখময় মোবাইলটাকে বন্ধ করে রেখে দেয়, পাশে। তারপর কি ভেবে, তৃপ্তিকে পাশ থেকে কোল বালিশের মতো জড়িয়ে ধরে ঘুমনোর চেষ্টা করে।
"ফোনে মিটলো?" তৃপ্তির কথায় সুখময় কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ঝুঁকে, তৃপ্তির মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে দেখে ওর চোখটা তখনো আধবোজা হয়ে রয়েছে।
"কি ব্যাপার, তুমি এতক্ষণ ঘুমোও নি?"
"তুমি যে ভাবে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিলে, ঘুম আসে?"
" আর বলো না। আমি ফোন কেটে দিয়েছি। যত উটকো ঝামেলা!"
"এমন করে বলছো কেন, কোনো বিপদেও তো পড়তে পারে?"
"আরে বাবা, বিপদে পড়লে পুলিশে ফোন করুক না!" "আমার মতো কেরানি কে ফোন করে জ্বালানোর কি দরকার, বুঝি না!"
"ছাড়ো! তেমন দরকার হলে, ঠিক আবার ফোন ঘোরাতো।"
সুখময় এবার তৃপ্তিকে আলতো করে নিজের বুকের কাছে টেনে আনার চেষ্টা করে।
"জানো, মনীষা নামে আমার এক বান্ধবী ছিল কলেজে।" "ভারী মিষ্টি দেখতে ছিল।"
"ছেলেরা, পারলে ওর পায়ে পড়ে যেত, এরকম সুন্দরী!" "কিন্ত শুনলে অবাক হবে, শেষ পর্যন্ত ও একটা কালো, বেঁটে খাটো চেহারার, সদাশিব গোছের ছেলেকে ভালোবাসলো।"
"কি নাম ছিল ছেলেটির?"
"নাম....!" তৃপ্তি মনে করার চেষ্টা করে। " তোমাদের সঙ্গেই না আগে পিছে...!"
সুখময় কি কিছু মেলানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে?
"না, একই সেশনে। এবং একই সাবজেক্ট, ফিলোজফি অনার্স।" "ছেলেটা ফিলোজফিতে, মনে আছে হায়েস্ট মার্কস পেয়েছিলো সে বার।"
"ছেলেটার নামটা কি ছিল, মনে করো না!"
সুখময় ক্রমশ যেন ধৈর্য হারিয়ে অস্থির হয়ে উঠছে।
"হ্যা, ওই তো ... ওর নামও সুখময়, সুখময় দাস!"
"কিন্তু, তুমি ওর নাম জানার জন্য এত উদগ্রীব হয়ে উঠেছো কেন?"
"আরে মেয়েটি তো, সুখময় কেই খুঁজছিল ফোনে!"
"কি বলছো!" তৃপ্তি, সুখময়ের হাতটাকে বুকের ওপর থেকে সরিয়ে সটান উঠে বসে।
বাইরে তখন মাটি ফেলা গাড়ির ঘড়ঘড় আওয়াজ। রাত্রেই ওরা মাটি ফেলে যায় রাস্তায়। গাড়িগুলির কর্কশ আওয়াজ, ক্রমশ যেন মনে হচ্ছে কান ভেদ করে বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ছে।
"তুমি একবার ফোনটা ঘোরাও না," তৃপ্তির কেমন টেন্সড লাগে। সুখময় ও ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছে। কেমন যেন একটা অপরাধবোধ চেপে বসেছে সুখময়ের বুকে।
সে ধীরে ধীরে ফোনটাকে অন করে, রিসিভড কল থেকে একেবারে ওপরে থাকা নাম্বারটাতে বার করে, ডায়াল করে।
ডায়াল টোনে বাজতে থাকে, রবীন্দ্রসঙ্গীত -'সখি ভাবনা কাহরে বলে...' কেমন বিসদৃশ শোনায়, সুখময়ের। ভাবে, কি বলবে।
"তুমি আমাকে ফোনটা দাও না, আমি কথা বলবো মনীষার সঙ্গে," সুখময় তৃপ্তিকে ফোনটা দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
একেবারে কেটে যাওয়ার মুহূর্তে ফোনটা রিসিভড হয়। "হ্যালো, মনীষা। শুনতে পাচ্ছিস আমি তৃপ্তি।"
"হ্যালো...!" একটা বাজখাঁই পুরুষের গলা ভেসে আসে ওপার থেকে। "বলুন, এন্টালী থানা থেকে বলছি।" "কি হয়েছে?"
থানার ফোনে, রবীন্দ্রনাথের গান! বেশ রস আছে পুলিশের লোকের।
"না মানে, একজন মহিলা এই নাম্বার থেকে ফোন করেছিলেন তো, তাই..!"
"হ্যা, ওই মহিলা একজনের নামে অভিযোগ জানাতে এসেছিলেন থানায়।"
"এত রাত্রে, কিসের অভিযোগ ..?"
"অপরাধ বিজ্ঞানে যত অপরাধ আর মত অভিযোগ, সব রাত্রেই হয়, বুঝলেন!" "বুঝলাম, কিন্তু কার বিরুদ্ধে অভিযোগ?"
" উনার বয়ফ্রেন্ডের বিরুদ্ধে।"
"কিসের অভিযোগ?" "ভদ্রমহিলা আসলে কনসিভ করে গেছেন .... । " তারপরে? কথা শেষ করতে না দিয়েই, তৃপ্তি ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
"শুনুন না," পুলিশের লোকটা ধমক দিয়ে ওঠে।
"তারপরে আর কি, পাখি ডিম পেড়ে উড়ে গেছে।"
"মানে!"
"মানে বুঝলেন না? বয়ফ্রেন্ড আর কোনো যোগাযোগ করছে না উনার সঙ্গে। ফোন ও ধরছে না।"
"ওহ তাই!"
"আমরা আমাদের এই হোয়াটসঅ্যাপে নাম্বার দিয়ে কালপ্রিট টা কে ধরার চেষ্টা করেছিলাম।"
"এনি ওয়ে, ওটা রং নাম্বার ছিলো।"
"আর কিছু জানার আছে?" আর কি বা জানার থাকতে পারে, তৃপ্তির!
বাকরুদ্ধ হয়ে, শুধু শুধু ফোনটাকে কানের কাছে গুঁজে রাখে, অনেক ক্ষণ।
কখন ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে যায়, ভগবান জানে।
---____-_------___------_____------________--

রং !
মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার পথে প্রণতি রঙের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। একদিন বাদে দোল। রাস্তার দুপাশে মুদি খানা থেকে দশকর্মার দোকান সবাই হোলি উপলক্ষে রং, আবির, পিচকারি, মুখোশ সহ রকমারী রংবেরঙের টুপি নিয়ে যে যার মত বসে গেছে একেবারে পসরা সাজিয়ে। "মা, আমাকে একটা মুখোশ কিনে দেবে কিন্তু," মিতুল মায়ের কাছে বায়না ধরে।
"সাগর দা, আমাকে তিনটে আলাদা আলাদা রঙের অল্প অল্প করে একটু আবির দিয়ে দাও না।" সাগর, কেমন যেন সন্দিহান দৃষ্টি হেনে তাকায় প্রণতির দিকে।
"এয়, ফেরত পয়সা নিয়ে যা।" "শালা, কথা দিয়ে এসেছিস মনে হয়, তর সইছে না।"
সাগর কথা গুলো বলতে বলতে কটমট করে তাকিয়ে থাকে প্রণতির দিকে। এ যেন কাহি পে শিকার আর কাহি পে নিশানা। প্রণতি চোখ নামিয়ে নেয়।
"তোমার এত জ্বালা কিসের, কাকা?"
ছেলেটি সাইকেল দাঁড় করিয়ে ফিরে আসলে প্রণতির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। "দাও, দাও!"
প্রণতি দেখে ছেলেটির কথার মধ্যে অন্যরকম মজার ইঙ্গিত। "কাল কি কাকিমার পায়ে খালি আবির ছুঁইয়েই কাজ সারবে নাকি?" কথা শুনে সাগরের ঠোঁটের কোনায় এক ঝলক চটুল-সমঝদারির হাসি খেলে যায়। পর ক্ষণেই অবশ্য প্রণতির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হওয়ার ভান করে সে। "আছা, বৌমা তোমাকে লাল, হলুদ আর সবুজ রঙের আবির দিয়ে দিই নাকি?"
"মা, সাগর জেঠু কে ওই... যে ওখানে, ওই দৈত্যের মুখোশটা দিতে বল না!" মিতুলের কথা শুনে সাগরের হঠাৎ প্রসেনের কথা মনে পড়ে যায়।
"গত বছর এমনি সময়ে তোর বাবা ছিল ...," বলতে বলতে, সাগর মিতুলকে আদর করে নিজের কাছে টেনে নেয়।
ক্লাস থ্রী তে পড়ে মিতুল। এই সেদিন পর্যন্ত স্কুল ছুটির পরে বাইকের পেছনে বসে, বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাড়ি ফিরত।
"মা, আমাকে একটু কোলে নাও না, আর হাঁটতে পারছি না।" প্রণতি কোনো কথা বলে না।
রাস্তার দুপাশে - ছোট বড় গাছ গুলো কেমন পুরনো শুকনো পাতা গুলো ঝেড়ে ফেলে নতুন পাতা দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে তাদের নিষ্পত্র শাখা প্রশাখা গুলিকে। সব বসন্তের বাতাসের কামাল। বসন্তের বাতাসে যে কি জাদু আছে কে জানে, যেন আগুন ঝরছে সেন বাবুদের ঘরের পেছনে থাকা বিশাল শিমূল গাছটির ডালা পালা থেকে। দত্তদের সোনার দোকান, দত্ত জুয়েলারীর পাশে রয়েছে একটি ধুলো পড়া পলাশ গাছ। গাছটির গোড়য় দুনিয়ার নোংরা আবর্জনা জমে থাকে সারা বছর। এখন তাতে কমলা বর্ণের লেলিহান অগ্নিদল ডানা মেলেছে কি অপরূপ তেজদীপ্ততায়...! "মা...। সরে আসো?"
"দেখে হাঁটুন, দিদি! বাচ্চাকে নিয়ে হাঁটছেন, একটু দেখে হাঁটুন," পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বাইকের থেকে গলা চিরে বলে যায় একটি লোক। প্রণতির যেন সম্বিৎ ফেরে। স্কুল ব্যাগটাকে কাঁধ বদল করে মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে।
পরের দিন সকাল থেকে মিতুল, মুখোশ পরে দাদু দিদাকে চমকাতে শুরু করে দেয়। "আমি দৈত্য, তোমাদের ধরে ধরে পাতাল পুরী তে নিয়ে যাব।"
প্রণতি প্লাস্টিকের বালতিতে অর্ধেক মত জল নিয়ে ওতে লাল আবির গুলে দেয়, মিতুলের জন্যে। গত বছর ওর বাবা মেয়ের জন্যে যে পিচকারি এনেছিল, সেটা বারান্দার আরসায় ওঠানো পড়ে ছিল এক বছর। প্রণতি চেয়ারের উপরে উঠে পিচকারিটাকে নামিয়ে মেয়ের হাতে দেয়।
"কারুর চোখে মারবে না কিন্তু, মিতুল সোনা।"
প্রণতি চান করতে যাওয়ার আগে শশুর, শাশুড়ির পায়ে একটু একটু করে সবুজ আবির দিয়ে প্রনাম সারে। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতে গিয়ে, শাশুড়ির দীর্ঘ শ্বাস গিয়ে পড়ে প্রণতির সাদা, ফ্যাকাশে সিঁথির উপরে। প্রণতি উপলব্ধি করতে পারে সে শ্বাসাঘাত। "কতদিন আর এমন করে কাটাবে, তুমি বৌমা!" বলতে বলতে মিতুল ছুটে চলে আসে প্রণতির কাছে।
"মা, দেখো না বালতির জল কেমন কমে গেছে।" প্রণতি এবার জলে হলুদ আবির ঢেলে দেয়।
"কি মজা, কি মজা," রঙিন জল ভর্তি পিচকারি মারতে মারতে পাশের বাড়ির অনুকে তাড়া করে নিয়ে যায় মিতুল।
রিটায়ার্ড চাকুরে প্রাণতোষ বাবু নাতনির ছুটে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
একটা ফোনে, কেমন যেন সব চুরমার হয়ে গেল। কেউ খবর দিল, আপনার একমাত্র ছেলে প্রসেন বাইক অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ব্যাস, সব শেষ। পরের দিন সংবাদ পত্রে খবর বেরুল, স্পটেই বত্রিশ বছরের তরতাজা ছেলে, পেশায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যু। ডুকরে ওঠেন, প্রাণতোষ বাবু। কিন্তু ভেঙে পড়ার আগে প্রাণতোষ বাবু কিছুতেই মচকাতে চান না। তাই প্রাণপণে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করে যান।
কেউ ফোন করছে মনে হয়! "কে আবার ফোন করবে এখন," বলতে বলতে প্রণতির শাশুড়ি ঘরের মধ্যে উঠে গিয়ে টি- টেবিলের উপরে বাজতে থাকা ফোনটাকে তুলে কোনোরকমে রিসিভ করে। "হ্যালো!"
"কে?"
"আমি রণজিৎ বলছি, পিসিমনি।! "ওহ রণজিৎ, কেমন আছিস বাবা ওখানে?" "ভালো।"
"অনেক দিন হয়ে গেল, কবে আসবি আবার দেশে?" "আসবো কি, অলরেডি এসে গেছি।" "গত কালকেই নেমেছি।" "তুমি ভালো আছো তো, পিসিমনি?"
উত্তর আসার আগেই রণজিৎ প্রণতির খোঁজ খবর নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে।
"প্রণতি বৌদি কেমন আছে, পিসিমনি?"
"ও আর কেমন থাকবে বল, যাই হোক এসেছিস যখন একবার আমাদের বাড়ি ঘুরে যা।"
"যাবো বলে বেরিয়েই, ফোনটা করছি তোমায়।"
"দুপুরে ওখানেই খাবো, বৌদিকে ভালো করে রান্না করতে বোলো।" "ঠিক আছে, ঠিক আছে।"
"বৌমা..!" "রণজিৎ আসছে। আমার মেজদার ছোটো ছেলে।" প্রণতি তার শাশুড়ির পেছনেই দাঁড়িয়েছিল। "কানাডা থেকে কালকেই এসে পৌঁছেছে সে।"
রণজিৎ.....!
বিড়বিড় করে নামটা উচ্চারণ করতে করতে, প্রণতি চপলা তরুনীর মতন ছুট্টে তার ঘরে ঢুকে পড়ে; তারপরে কি ভেবে আলমারি খুলে একগাদা শাড়ির মধ্য থেকে খুঁজে খুঁজে সেই শাড়িটা বার করে, সেই সবুজ জমিনের বালুচরী শাড়িটা। যেটা পরলে তাকে 'খুব কিউট লাগে' বলে বলেছিলো রণজিৎ। প্রণতি শাড়িটাকে বুকের উপর ফেলে, আয়নার সামনে একবার এদিক একবার ওদিক করে ঘুরে ঘুরে দেখে কেমন লাগছে তাকে।
সেবার মিতুলের পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার জন্মদিনে এসেছিলো রণজিৎ। পরের দিন প্রসেন অফিসে বেরিয়ে গেলে, রণজিৎ একান্তে তার হাতটা ধরে বলেছিলো, "তুমি সত্যিই খুব সুন্দরী বৌদি।" "আই রিয়েলি এডমায়ার ইউ!"
"মা, মা.…..! তুমি কোথায় মা। আমাকে একটু রং দিয়ে যাও না।"
প্রণতি মেয়ের ডাক শুনেও আয়নার সামনে থেকে নড়তে পারে না। কোন খেয়ালে যে ডুবে থাকে সে আয়নার দিকে তাকিয়ে। মেয়ের ডাকেও সাড়া দিতে তখন তার মন সায় দেয় না।
ইতিমধ্যে, দরজা পেরিয়ে তারা ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে রণজিৎ। আড় চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় অধোবদন প্রণতি দেখে - রণজিৎ তার লাল রং ভর্তি দুহাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে দাঁড়িয়ে আছে অধীর আগ্রহে। তার শরীর মন সব, সব সে রাঙিয়ে দেবে আজ।
----______------________-__--_______---------________------------____________------------
রং - ২
রোজ রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে - প্রণতি, টেবিলের উপরে রাখা প্রসেনের ফটোর সামনে গিয়ে খানিক চুপ করে দাঁড়ায়। তারপরে আদর করার ঢঙে প্রতিদিনই আঁচল বুলিয়ে বুলিয়ে মোছে ফটোটাকে। অনেকটা আল্পনা দেওয়ার মতো করে। এমন মোলায়েম ভাবে মোছে যেন স্বামীর হাসিমুখটিতে কোনো আঘাত না লাগে। মুছতে মুছতে, রোজই তার চোখ চলে যায় খাটে শুয়ে থাকা মিতুলের দিকে। ঘুমিয়ে কাদা হয়ে থাকে, মেয়েটা। সারাদিন যা ছুটোছুটি করে। একদিন ধরা পড়ে গিয়েছিল। "মা তুমি কাঁদছো?" মেয়ের প্রশ্ন শুনে প্রায় চমকে উঠে চটপট চোখের জল মুছে নিয়েছিল আঁচলের কাপড় দিয়ে। মিতুলের পরের প্রশ্নটি ছিল আরো মারাত্মক। "মা তুমি বাবার সঙ্গে কথা বলছিলে, বুঝি?" লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলো প্রণতি সেদিন। সত্যি সত্যিই সে খেয়াল করেনি কখন ফটোটাকে সে তার বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়েছিলো।
আজকের দিনটা তার কাছে একটু অন্যরকম। রণজিৎ তাকে রং মাখাতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে . ।। ওর লাল রং মাখা হাত দুটি প্রায় বাঁধ ভাঙা জলের তোড়ে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, কতক্ষন এভাবে ছিল কারুরই কোনো খেয়াল ছিল না। পেছন থেকে শাশুড়ি এসে না ডাকলে কি হতো কে জানে।
বুকের কাপড় ঠিক করতে করতে ছুট্টে নীচে নেমে গিয়েছিলো প্রণতি। শাশুড়ি, ভাইপোর জন্য স্কোয়াশের শরবত নিয়ে এসে থ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কি ভেবেছিল, ভগবান জানে।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে, প্রণতির শাশুড়ি পান চিবোতে চিবোতে রণজিৎ কে বলেছিলো, "মেজদা, বৌদির বয়স হচ্ছে, এবার একটা বউ আন বাবা, বাড়িতে।" "ওদেরও তো স্বাদ আহ্লাদ আছে নাকি!" উত্তরের আশায় - তেরছা চোখে ভাইপোর দিকে তাকিয়েছিলো প্রণতির শাশুড়ি। কিন্তু রণজিৎ তখন সম্পূর্ণ উদাস ভঙ্গিতে খাওয়ার টেবিলের উল্টো দিকে বসা প্রণতির দিকে তাকিয়েছিলো অধীর মুগ্ধতা নিয়ে। যে দৃষ্টির সামনে প্রণতির একেবারে জলে ভেজা চিড়ের মতো- গদগদ অবস্থা। সামাল দিতে, চকিতে মুখ নামিয়ে ফেলেছিলো প্রণতি। তারপরে কি ভেবে মেঝেতে পা ঘষটাতে ঘষটাতে মিতুল.. মিতুল.. বলে ডাক পেড়ে একেবারে বাড়ি মাত করে ফেলেছিল। কার্টুন দেখা ফেলে মিতুল তার মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালে প্রণতি যেন কোন্ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে বলে তাকে ডেকেছিলো নিজেই ভুলে যায়। উল্টে আদুরে আদুরে ভাব করে মিতুলকে কাছে টেনে তার দুই গাল চুমুতে চুমুতে একেবারে ভরিয়ে দেয়। "ওফ্, এর জন্য এতো ডাকাডাকি!" "শান্তিতে একটু একাও থাকতে দেবে না,"
"পাকা মেয়ে!": প্রণতি মিষ্টি করে মিতুলের নাকধরে
নাড়িয়ে দেয়।
"আজকে বৌদি এচোড়ের রান্নাটা জাস্ট ফাটাফাটি হয়েছিল।":
"তোমার দাদাও আমার হাতের রান্না খেয়ে ধন্যি ধন্যি করতো একেবারে।"
একটা মিষ্টি হাসি খেলে যায় প্রণতির টোল পড়া গালে।
" পিসিমনি, আমার একটা কথা বলার আছে তোমায়।"
"হ্যা বল্ না।।"
এরমধ্যে বাইরের বারান্দা থেকে প্রাণতোষ বাবুর "মনোরমা, মনোরমা" ডাক শুনে বিরক্ত হয়ে উঠে যায় প্রণতির শাশুড়ি। "এক গ্লাস জলও নিয়ে খাবে না।" "আমার হয়েছে যত জ্বালা।"
শাশুড়ির উঠে যাওয়াতে, প্রণতি যেন স্বস্তি খুঁজে পায়। এদিকে মিতুলও মা'র হাত ছাড়িয়ে ছুট্টে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় কার্টুন দেখতে। অনেক ক্ষণ চুপচাপ থাকে দুজন।
প্রণতি, কথা খোঁজে। রণজিৎ ঠোঁটে তর্জনী সেঁটে বসে থাকে। কি ভাবে কি জানে।
রণজিৎ কি খুব তাড়াতাড়ি করছে? অন্তত প্রণতির তাই মনে হয়।
"বৌদি, তোমাকে আমার একটা কথা বলার আছে।" প্রণতি চোখ তুলে তাকায় রণজিৎ এর দিকে। এমন সময়ে প্রণতির শাশুড়ি ফিরে আসে ডাইনিং এ।
"বৌমা, তোমার শ্বশুরের জন্য চা করো না একটু," প্রণতি উঠে যায়।
"বল্ রণজিৎ তুই আমাকে কিছু বলবি বলছিলি যেন।" প্রণতি যেতে যেতে রণজিৎ এর দিকে তাকায়, ট্যারা চোখে। কিছু বলার আগে রণজিৎ এর কি ওর সঙ্গে একবার কথা বলা উচিৎ নয়! রণজিৎ হয়তো প্রণতির চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিলো। তাই কি ফোন আসার কথা বলে তখনকার মতো সরে গেল পিসিমার কাছ থেকে? কে জানে!
রাত্রে খাওয়াদাওয়া শেষে, প্রণতি চলে আসে নিজের ঘরে। এবং প্রতিদিনের অভ্যাস মতো প্রসেনের ফটোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
হঠাৎ ঠক ঠক ঠক - করে দরজায় টোকা পড়ার শব্দে প্রণতি হকচকিয়ে যায়। নিশ্চিত রণজিৎ অপেক্ষা করছে দরজার ওপারে। কি করবে ভেবে পায় না। এদিকে মিতুল যথারীতি হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে বিছানায়। আর টেবিলে রাখা প্রসেনের ছবিটাও যেন আজ তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে মজা করে। প্রণতি কিছু একটা ভেবে দরজার কাছে যায়। তারপরে ছিটকিনিটা খুলে দিতেই একেবারে বন্যার জলের মতো ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে রণজিৎ। "প্লিজ বৌদি, না করো না!" "আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। আই ক্যান্ট লিভ উইদাউট ইউ, বৌদি।"
রণজিৎ প্রণতির বুকের ওপর তার মুখটাকে নিয়ে বিশ্রী ভাবে ঘষটাতে থাকে। "ছাড়ো, ছাড়ো। রণজিৎ, ইটস্ জাস্ট টু মাচ।" জোর করে রণজিৎ এর হাত ছাড়িয়ে প্রণতি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
সামনের বাগানের তেজপাতা গাছটার পাতায় স্ট্রীট লাইটের হলুদ আলো পড়ে বারবার পিছলে যাচ্ছিলো চৈত্র রাতের দমকা বাতাসের দোলায়। দূর থেকে ভেসে আসছিলো অস্পষ্ট রাতের জলসার গান।
রণজিৎ ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা নীচু করে। পুনরায় প্রণতির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস যেন হারিয়ে ফেলেছে সে।
প্রণতির মনে পড়ে - প্রসেন অনেক ভেবে মিতুলের ভালো নাম দিয়েছিলো - মৌনী। অর্থাৎ পাহাড়, যে আকাশ ছাড়া কারোর কাছে মাথা নত করে না। মিতুল কি মেনে নেবে রণজিৎ কে?
"মা, মা....! দেখো বাবা দাঁড়িয়ে আছে ঘরে।"
হঠাৎ মেয়ের ডাক শুনে, প্রণতি ছুটে বারান্দা থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে রণজিৎ দাঁড়িয়ে আছে মিতুলকে জড়িয়ে ধরে।
---_____------______-------____-------_____------
১
বালিয়াড়ি থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে ছেলেগুলো একবার নীচে পড়ছে। নীচ থেকে আবার উঠে যাচ্ছে বালিয়াড়ির ওপরে থাকা তাল গাছটির কাছে। তাল গাছটির মোটা মোটা কালো কালো শেকড় বেরিয়ে পড়েছে হিজিবিজি হয়ে যেন কোনো সাধুবাবার ঘাড় বেয়ে নামা চুলের জট। ওপরে উঠলে ওই শেকড় ছুঁয়ে আসতে হচ্ছে সবাইকে।
রাত্রিতে বৃষ্টি হয়েছে। সকালবেলায় তাই ভেজা বালি, ঈষৎ লালচে লাগছে। তার ওপরে দশ বারোটা ছেলে দাপিয়ে উঠছে নামছে, তাতে বালিয়ারির পৃষ্ঠ দেশ সেই মঙ্গল গ্রহের মাটির মতোই এবড়োখেবড়ো আর আলুথালু মনে হচ্ছে। অবশ্য যত বেলা বাড়বে, রোদ পড়ে পড়ে বালি শুকিয়ে যাবে। আর বালিয়াড়িকে তখন ঝুরঝুরে সাদা সুজির পাহাড়ের মতো লাগবে দেখতে।
"এয়, দাঁড়া দাঁড়া!" খালি গায়ে একটি ছেলে, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, একেবারে কান অব্দি ঝেপে এসেছে। বালিয়াড়ির উপর থেকে তার চিৎকারে সবাই হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে যে যেখানে ছিল। নিশ্চয়ই সানুর মাথায় কিছু দুষ্টুমির বুদ্ধি এসেছে।
বালিয়াড়ির নীচে তখন বছর সাত আটেকের একটি মেয়ে শুয়ে শুয়ে ওদের খেলা দেখছিল। হাত গুলো রোগা রোগা, পেটটা কেমন বুকের পাঁজরের নীচ থেকে ফুলে ঢোল হয়ে বেরিয়ে আছে। সবাই খেলা থামিয়ে দিতে তার ফ্যাল ফ্যাল করা দৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যে দুর্লক্ষ্য বস্তু নিরীক্ষণ করছিল কে জানে।
"চল, তুতুকে তুলে আনি চল।" "কি করবি,?"
'আগে তুলে আন না, তারপরে বলছি!" সবাই দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ তুতুকে তুলতে যায় না।
"এয়, রানা কোথায় গেল রে? ওকে দেখতে পাচ্ছি না!"
রানা রোজ কাঁধে করে নিয়ে আসে তার বোন কে, আবার খেলা শেষ হলে নিয়ে ফিরে যায়। তুতু ভালো করে বসতেও পারে না। "রানা দা তুতুকে শুইয়ে দিয়ে, ডাকাতের মড়া দেখতে গেছে।"
" ডাকাতের মড়া? কোথায়?" সানুর ধমক খেয়ে থতমত খেয়ে যায় খোকন। আমতা আমতা করে বলে, "মড়া চেরানো ঘরে।"
"ওহ। তাই?" "তাহলে আমরাও দেখতে যাব।" "চলো, চলো, সানুদা এখনুই দেখতে যাই চলো।" সবাই সমস্বরে সানুর কথার প্রতিধ্বনি করে ওঠে।
"কিন্তু সবাই চলে গেলে, তুতু কে এখানে দেখবে কে?" পানুর প্রশ্নের, কোনো উত্তর আসে না কারুর কাছ থেকে। এদিকে বছর বারো তেরোর সানুর মুখে তখন কঠিন অংক মিলিয়ে দেওয়ার খুশি। একফালি দুষ্টু হাঁসিতে ঠোঁটের কোন বেঁকে প্রায় কান ছুঁয়ে ফেলার জোগাড়।
কাজু বাদাম গাছের পুরু পাতা চুইয়ে পড়া জলের ফোঁটা গুলো হঠাৎ বাতাসের দীর্ঘশ্বাসে ঝড় ঝড় করে ঝরে পড়ে নীচের পাতায়, আবার কখনও পাতার ফোকর গলে একেবারে নীচে বালির উপর গিয়ে পড়ে, নিঃশব্দে। বালি, নিরবে শুষে নেয় সে জলের সিক্ততা।
" ভাবা যায়, তিন জন ডাকাত কে একেবারে মেরে মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দিয়েছে।" "বাহিরিতে এর আগেও ডাকাত মেরেছিল। মনে আছে?"
"এই ডাকাত গুলো নাকি কোলকাতার বেহালা থেকে নিয়ে এসেছিল, ওদেরই গ্রামের কোনো একজন।"
"তাই?" কথা বলতে বলতে পাড়ার দু-তিন জন গান্ধী স্মৃতি প্রাইমারি ইস্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায়। বাঁদিক বালিয়াড়ির দিকে একবার তাকিয়ে লালুর কেমন গা রি রি করে ওঠে। "দেখেছো, পাঁচু দা এই বিচ্ছু ছেলেগুলোর কান্ড! পড়া নেই শোনা নেই সকাল থেকে এখানে বালিয়াড়িতে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে।" "আর বলিস না।"
ইস্কুলটা পেরোলেই ফাঁকা মাঠ, মাঠের পূর্ব দিকে শ্মশান আর কবরস্থান পাশাপাশি। মাঝখানে একটা বিশাল বটগাছ। রথের সময় রথ হয় আবার মহররমের সময় - সুন্দর সুন্দর তাজিয়া আসে আশেপাশের গ্রাম থেকে, একেবারে মেলা বসে যায়। এই মাঠটিকে তাই কারবালার মাঠ ও বলা হয়।
আকাশের সূর্য, মেঘের আড়াল থেকে বেরোনোর জন্য রীতিমত লড়াই করছে যেন। মাঝে মাঝে বেরুচ্ছে আবার মেঘের তলায় ডুবে যাচ্ছে। বৃষ্টি বন্ধ আছে। শ্মশান পেরিয়ে কাঁথি মহকুমা হাসপাতালের নাতি উচ্চ পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারে মড়া চেরানো ঘর। লোকজনের ভিড় পাঁচিলের ওপর যেন একেবারে ভেঙে পড়েছে।
রানা অনেক ক্ষণ আগে এসেছে। তাই বেশ পাঁচিলের ওপর উঠে বসেছে সে। ওখান থেকে অপলক দৃষ্টিতে লাশ কাটা ঘরের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। বারান্দায় শোয়ানো ছিল তিনজন ষন্ডা মার্কা ডাকাতের নীল হয়ে যাওয়া লাশ তিনটে। গায়ে সুতোটিও নেই। কেমন বিভৎস দর্শণ মড়া গুলি। দেখছিল আর ভাবছিল তুতুকে ওখানে বালিয়াড়ির নীচে শুইয়ে দিয়ে এসেছে। কি করছে ভগবান জানে।
২
"পালা, পালা....!" এখুনি ঝেঁপে বৃষ্টি এসে পড়বে। ঈশান কোনে মসজিদের চূড়া - পুরো ঝাপসা হয়ে গেছে। শোঁ শোঁ শব্দে দ্রুত ভারী হয়ে আসছিলো সবার কান। এবারে স্কুল ঘরের টিনের চালে চড় চড় করে বৃষ্টি ফোঁটার আছড়ে পড়ার শব্দ কানে এসে যেতেই যে যার মতো করে বালিয়াড়ির নীচে নেমে যাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়।
সানু, বাদাম পাতা ভেঙে আনতে গিয়ে তালগাছের পেছনে কাজু বাদামের জঙ্গলে আটকে গেছে। এত জোরে বৃষ্টি হচ্ছে যে কাজু পাতার চারদিক থেকে জলের ঝারি একেবারে ঢলে ঢলে পড়ছে মাটিতে। আর্দ্র বালির ওপর জল পড়া গর্ত গুলি ছোট বড় কাজু পাতার সীমান্ত নির্মাণ করছে আল্পনা দেওয়ার মতো করে। আবার খানিক জোলো হাওয়ায় তা ছিতরে যাচ্ছে যাচ্ছেতাই ভাবে। পাতায় পাতায় ঠিকরে পড়া বৃষ্টির ছাঁটে সানুর চোখ মুখ ভিজে একেবারে একসা হয়ে গেছে। তাও মাথা বাঁচাতে একবার এদিক, একবার ওদিক করে যায় সানু।
স্কুল ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোকন হাঁক পাড়ে, "সানু দা তুমি পালিয়ে আসো এখানে।"
সানু একবার ভাবে ছুটে নেমে যাবে কি না। বৃষ্টি না এলে এতক্ষণে তারা হয়তো লাল ঘরে পৌঁছে যেত ডাকাতের মড়া দেখতে।
মরিচা রঙের ফিকে হয়ে যাওয়া লাল দেওয়াল দিয়ে ঘেরা লাশ কাটা ঘরকে অনেকে লাল ঘর বলেও ডাকে।
বৃষ্টি আসার আগে পানু দাঁত দিয়ে তাল পাতা চিরে লম্বা লম্বা কয়েকটি পিচ বের করে রেখেছিলো। কাজু বাদামের পাতা গুলিকে জোড়া দিয়ে দিয়ে পাতার ছাতা বানাতো সে। জোড়া দেওয়ার জন্য পিচ গুলোকে ভেঙে ভেঙে পিনের মতো আটকে দিতো। অনেকটা শাল পাতার থালার মতন।
"বৃষ্টি একটু কমলো মনে হয়!"
"চল্ চল্, তুতুর মাথায় বাদাম পাতার ছাতা চাপিয়ে দিয়ে আসি তাড়াতাড়ি।"
পানু ছুটে উঠে যায় বালিয়াড়ির ওপরে। মুঠোর মধ্যে তাল পাতার পিচ গুলো ধরা থাকে। "সানু দা জলদি বাদাম পাতা ভেঙে নিয়ে আসো দেখি।"
বৃষ্টি কমে এখন শুধু ধূলোর মতো ওড়াওড়ি করছে বাতাসে। ভাদ্র মাসের মেঘ - তার যৌবনবতী ভরাট চেহারা দিয়ে পুরো আকাশকে যেন ভারাবনত করে নামিয়ে এনেছে তালগাছের মাথার পরে।
ভিজে সপসপে সানু বাদাম পাতা নিয়ে এসে ফেলে মাটিতে। তারপরে হাতের চেটো দিয়ে কপালের ওপর থেকে জল মুছতে মুছতে তুতুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসে। "কি রে বেরোবি নাকি?"
গলা অব্দি গর্ত খুঁড়ে তুতুকে তার মধ্যে বসিয়ে দিয়েছে, সানু ও বাকিরা। তালগাছের ঠিক নীচে।
তুতু সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে। "দাড়া আমরা ডাকাতের মড়া দেখে আসি, তারপরে...!"
জুলুজুলু দৃষ্টিতে তুতু তাকিয়ে থাকে সানুর মুখের দিকে। সানু আবার ফিচেল হাসি হাসে।
ততক্ষণে পানু তুতুর মাথার ওপর বাদাম পাতার ছোট্ট থালা চাপিয়ে দিয়েছে। "আমরা যাচ্ছি, চুপটি করে থাকবি কিন্তু...!"
হৈ হৈ করে সবাই নেমে চলে যায় মড়া চেরানো ঘরের দিকে।
তুতুর ভেজা চুলের জল কপাল বেয়ে চোখের পাতা ছুঁয়ে গালের ওপর গড়িয়ে পড়ে। চোখের জল ও তো হতে পারে। কে জানে! তুতু তার অশক্ত হাতটাকে কিছুতেই গর্তের বাইরে বের করতে পারছে না যে!
ভরা ভাদ্রের সূর্য ও বোধহয় তুতুর মতোই অসহায় আজকে। মেঘের গর্ত থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছেনা।
মড়া চেরানো ঘরে তখন ডোম, বাপি মাদ্রাজি মড়ার খুলি ফাটাতে শুরু করেছে। বৃষ্টির সময়, রানা হাসপাতালের এমার্জেন্সির সামনে শেডের তলায় ঢুকে পড়েছিলো।
বৃষ্টি কমে যেতে রানা আর অপেক্ষা করে নি। দৌড় লাগিয়েছে বালিয়াড়ির দিকে। বৃষ্টিতে তুতুর যে কি হাল হয়েছে কে জানে।
"রানা দা, তুতু কে তাল গাছের নীচে বালি চাপা দিয়ে এসেছি।" রাস্তায় বাকিদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে খোকন রানাকে বলে দেয়, অতশত না ভেবে। "বালি চাপা দিয়ে এসেছিস মানে?"
যদিও কথার উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করে না সে। বরং আরো জোরে দৌড় লাগায়। "গলা, বার করা আছে বাইরে।" সানু গলা তুলে হেঁকে ওঠে।
বালিয়াড়ির নীচে পৌঁছেই ওপরে তাল গাছের গোড়ায় চোখ চলে যায় রানার। এ কি অবস্থা! শুধু মাথাটাকে ওপর নীচ করছে তুতু, দম দেওয়া পুতুলের মতন। মাথার ওপর থেকে বাদাম পাতার থালা খসে পড়ে গেছে পাশে।
হঠাৎ, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দখিনা হাওয়ার টানে নড়ে ওঠা তালপাতার খড়খড় শব্দকে আরো ভারী করে পাকা তাল খসে পড়ার অশুভ মহরৎ তৈরি হয়। রানা শ্বাস রোধ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুতুর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। তালটা ঠিক যেন তুতুর মাথার দিকে তাক করেই পড়ছে। একেবারে সোজা। পতনের গতি তালের ভরবেগের অঙ্ক মেনে, হয়তো রানার পৌঁছানোর আগেই তুতুর তুলতুলে মাথার ওপরে ছিতরে পড়বে। রানা হাঁফাচ্ছে ...! অভিকর্ষ বলের বিরূদ্ধে, বোনকে বাঁচাতে। ধপ্ ..!
---______--------_____________---------------_______________-----------_________________-----------------

ছেলের খোঁজে!
গল্পটি 'মাতৃ সেবা বার্তা ' পত্রিকার ২০১৭'র বার্ষিক সংখ্যায় পূর্ব প্রকাশিত। আজকের দিনে গল্পটির প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করে এই পরিসরে গল্পটিকে শেয়ার করে নিচ্ছি।
প্রচ্ছদের ছবিটি শ্রদ্ধেয় কবি ও বিশিষ্ট চিত্র শিল্পী প্রয়াত সুধাংশু বাগের আঁকা। পত্রিকার সম্পাদক সম্মানীয় শ্রী তাজিরূল ইসলামের অনুমতি ক্রমে অপূর্ব এই প্রচ্ছদ চিত্রটিকে গল্পের অলংকরণ হিসেবে পেশ করলাম।
গল্প - ছেলের খোঁজে!
১)
পৌষ সংক্রান্তির ভোর। কুয়াশার ওড়নায ঢাকা সমুদ্র, সমুদ্রের চাত। সূর্য রশ্মির সাগর -স্নান তাই আপাতত দুর অস্ত। হাটি- টি পাখির ডাক ক্রমশ - জোরে .. থেকে অপসৃয়মান হয়ে যায়। শন্- শন্ উত্তুরে হাওয়ায় ফুলে ফুলে ওঠে গঙ্গা পুজোর ছাউনি ত্রিপল; ফট্ ফট্ করে আছাড় খায় বাঁশ- দড়ির প্যান্ডেলে।
চুল ওঠা নেড়ি কুকুর একটি - সারা শরীর গুটিয়ে শুয়ে থাকে একেবারে প্রতিমার সামনে ঘট রাখার নির্দিষ্ট উঁচু জায়গাটায়।
মনোহারী দোকানের বিপিন, খুব ভোরে প্রাতকর্ম সারা অভ্যেস তার। বেবুর গাছের আগার দিকে একটা ডাল ভেঙে মাজন করতে করতে গাঙ পাড়ের ঝাউ বনের দিকে হাঁটা দেয় সে। কেউ কোথাও নেই। একটু দূরে গাঢ় কমলা রঙের চাঁই মতো দেখে বিপিনের গা কেমন ফুলে যায়। নিশ্চই রাতে কেউ মড়া পুড়িয়ে গেছে। এখনও ঠিক নেভেনি।
এদিকে শিশিরের জমাট বুনন আস্তে আস্তে আলগা হয়। জেগে উঠে চপ, রেস্টুরেন্ট, তেলেভাজা, হরেকমাল, মনোহারী থেকে গঙ্গা পুজোর আয়োজক মৎস্যজীবী গোষ্ঠীর অস্থায়ী অনুসন্ধান ঘর ও তাদের অবিন্যস্ত ত্রিপলের চালা গুলি।
ফেরার পথে বিপিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় অনন্ত সাধুর। ত্রস্ত পায়ে সাধুকে হেঁটে যেতে দেখে, বিপিন কৃত্রিম গলা খাকারি দেয়। ঘুম ভাঙা মন্দ্র গলায় গুনগুন করতে করতে ভ্রুক্ষেপহীন অনন্ত গতি বাড়িয়ে -এগিয়ে যায় তখনও না নেভা মড়া পোড়ানো আগুনে কাঠের দিকে।
বয়স ষাটের বেশি হলেও বেশ সুঠাম শরীর সাধুর। মুখ ভর্তি কাঁচা পাকা চুলের লম্বা দাড়ি বুক অবধি নেমে গেছে। শুধু মাথায় চুলের অভাবে জটাজট হতে পারে নি। বিপিন বুঝতে পারে অনন্ত নিজের ধান্দায় যাচ্ছে ওই দিকে। এই শীতে, তারপরে আবার খালি গায়ে....!
মড়ার না পোড়া হাড়, খুলি এইসব নিয়ে তো সাধুর কারবার।
বিপিন পেছন থেকে ডাকে না। ঘন কুয়াশার চাদরে সাধুর পার্থিব শরীর দ্রুত আবছায়া হয়ে যায় বিপিনের চোখে।
জিলিপি, ঝুরি ভাজা দোকানের মন্টু স্টোভে চায়ের জল বসিয়ে তার কারিগরকে হেঁকে ওঠে, "আরে তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হ্। সংক্রান্তির যাত্রায় মেলা জমতে দেরী হবে না, এটা মনে রেখো যেন।"
পাশে মেলার সুপরিচিত রেস্টুরেন্ট 'একান্ত আপন' এর মালিক তোতোন আড় মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বিজ্ঞের মতো বলে, " শীতের বেলা, বিকেল গড়াতে গড়াতে মেলা শেষ। এর মধ্যে যা কারবার করার করে নিতে হবে।"
বৈষ্ণবের দল গামছা পরে সকাল সকাল সমুদ্র স্নানে বেরিয়ে যায়। ওরা কাঠের গৌরাঙ্গ মূর্তি নিয়ে আসে মেলায়। সারাদিন পালা করে করে হরির নাম করে। সামনে পাতা একটা ধবধবে সাদা থানে ভক্তরা যার যেমন সামর্থ্য প্রণামী ফেলে।
২)
মহামায়া পিঠে রোদ লাগিয়ে উঠোনের এক কোনে রাখা খড় গাদার পাশে একটা চটের উপর পা ছড়িয়ে বসে।
শ্যামলী গোয়াল থেকে গরু বার করে উঠোনের সামনে বাথানে বাঁধছে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে পাশের বাড়ির সীতাকে। সম্পর্কে জা, "ও, সীতা আজ যাবি নে?"
মহামায়ার বড় ছেলে কানু ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তার দু- বছরের ছেলেকে কাঁখে ধরে। মায়ের কাছে বসিয়ে দিয়ে বলে, " বস্ এখানে ঠাকুমার কাছে।" কোল থেকে নামাতেই, চিল চিৎকারে কান্না জুড়ে দেয় বাচ্চাটি।
মহামায়া শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো পশ্চিমের লম্বা তেঁতুল গাছটার দিকে, উত্তুরে হাওয়ায় কেমন মনমরা বিষন্নতার হিন্দোল তার পাতায় পাতায়। আঁচলের খুঁটে চোখ দুটো মুছে নাতিকে কোলে তুলে আদর করতে করতে মহামায়া জিজ্ঞাসা করে, "দাদুভাই, বলতো তোর কাকা কবে বাড়ি ফিরবে?"
কানু কাঠা খানিক জমিতে ওলকপি চাষ করেছে। আজকে যেমন করে হোক সেচ দিতে হবে। কলসী কলসী জল পুকুর থেকে তুলে ঘপ্ - ঘপ্ করে ঢালে। অনেক সময় লাগবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করে মেলায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে কানুর।
শ্বশুর বাড়ি থেকে শালা, শালার বৌ আর ছোটো শালি দিপালী এসেছে আগের দিন রাতে। সবার ঘরেই কমবেশি আত্মীয় স্বজন এসেছে। এ তল্লাটে সংক্রান্তির মেলাই বড় উৎসব। কুটুম বন্ধু ছাড়াও গ্রামের ছেলে পুরুষেরা যে যেখানে থাক, মেলার দিন বা আগে ফেরা চাই -ই চাই।
শ্যামলী খুব ভোরেই গোবর জলে উঠোন নিকিয়ে দিয়েছে। রোদ লেগে শুকিয়ে ও গেছে। দিপালী খেজুর পাতার দুটো চাটাই পেতে ধপ্ করে একটাতে বসে পড়ে, আর অন্যটাতে ওর বৌদিকে বসতে বলে।
"বসলে হবে নে। এগুলো কুটে দাও দেখিনি, তাড়াতাড়ি।" শশব্যস্ত শ্যামলী দুটো বটি আরা একটা বাখারির ঝুড়িতে করে একটা বাঁধাকপি আর কিছু নতুন আলু রেখে দিয়ে যায় দিপালীদের সামনে।
রান্না বাটি, খাওয়া দাওয়া সেরে রোদে রোদে তারা বেরোবে মেলা দেখতে। সমুদ্র বাঁধের কোলে কোলে একে বেঁকে চলে গেছে সমুদ্র পানের যাওয়ার রাস্তা। তা প্রায় আধ ঘন্টা খানিক লাগবে হেঁটে পৌঁছতে।
"হ্যারে দিদি, বুবুন কোথায় রে? ওকি এখনও ঘুমিয়ে আছে?"
"ওর বাবা কখন ওকে তুলে দিয়ে গেছে," শ্যামলী বলতে বলতে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়।
"কই দেখছি না তো...!" " জামাইবাবু, বুবুন তোমার কাছে?" দিপালী হাঁক পাড়ে।
খানিক দূরে মহামায়া তখন আজব ঘোরে তন্ময়। ফ্যাল্ ফ্যাল করা চোখে কি যে দেখছে সামনের উঠোন ছাড়িয়ে সব্জির বাগান, তার পরে পুকুর, পুকুর পাড়ে চিরতা আর বনতুলসীর বেড়ার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মোরামের রাস্তার দিকে চেয়ে চেয়ে সেই জানে।
কানু হাঁক শুনে দৌড়ে আসে। "কোথায় গেল, কোথায় গেল বুবুন?"
দিপালী ছুটে যায় পাশের ঘরে। " হ্যা গো বুবুন কে দেখেছো তোমরা, ওকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না!"
কানুর মনে কু ডাকে। ও ছুটে যেতে যায় ওদের পুকুরের দিকে। যদি হামাগুড়ি দিয়ে চলে যায়....!
চিৎকার শুনে শ্যামলী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ত্রস্ত পায়ে। সামনেই হতভম্ব কানুকে পেয়ে ঝাঁকিয়ে ওঠে, "তোমার কি কোনো আক্কেল নেই গা। কার কাছে বাচ্চাকে রেখে গেছিলে তুমি?"
কোনো উত্তর না দিয়ে কানু পুকুর পানে ছুটে যায়।
"নিজের ছেলেকে খেয়েছে এখন নাতিটাকেও না দিলে শান্তি নেই। অলক্ষুণে বুড়ি কেন যে মরে না!"
শ্যামলীর আর্তোক্তি কানুর কানে ঢোকে বটে কিন্তু তারও আগে মহামায়ার মর্মে ঢুকে তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় একেবারে।
প্রতিবেশীদের আত্মীয় স্বজনেরা ও চলে আসে; আর হায় হায় করে।
দিপালী সোজা ছুটে সীতাদের খিড়কি পুকুরের দিকে চলে যায়। কই কোথাও তো কোনো অস্থিরতা নেই! শান্ত, স্থির, ঢেউহীন পুকুর! কামরাঙার ডালে বসা মাছরাঙার চোখের মণির মতো অবিচল। পুকুর পাড়ের ডুমুর গাছ, বাঁশ ঝাড়, কোথায়..?
"ও মা, কোচ গাছের তলায় বসে ও কে, বুবুন না?"
স্থির বিস্ময়ে বুবুন জলের বুকে পড়া রোদের খেলা দেখছে বিভোর হয়ে।
৩)
মহামায়ার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। ঠায় সকাল থেকে সেইখানে বসে। কানু ঘরের দাওয়া থেকে একবার ধর্মের ডাক দিয়েছিল বটে খেতে আসার জন্যে।
মহামায়ার খুব ইচ্ছে মেলায় আজ অনন্ত সাধুর সঙ্গে যেমন করে হোক দেখা করার।
হারিয়ে যাওয়া জিনিস আর মানুষ দুটোই ফিরিয়ে আনে অনন্ত সাধু তার মন্ত্র আর তন্ত্র শক্তি দিয়ে। সাধু, বছরে একবারই এ তল্লাটে আসে মেলা উপলক্ষে।
সৌদামিনীর স্বামী তো বারো বছর পর ফিরে এল। গয়ায় বাবা মার শ্রাদ্ধ দিতে গিয়ে উধাও হয়ে গেছিলো। অনন্ত সাধুই ফিরিয়ে এনেছে।
চার বছর আগে মহামায়ার ছোট ছেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে সেই যে নিখোঁজ হয়েছে..! অবশ্য ঐ লঞ্চের মাঝি বা অন্য কারোরই কোনো খোঁজ নেই।কিন্তু সাধু মহামায়াকে কথা দিয়েছে তার ছোট ছেলে মানু ফিরে আসবেই। ফি বছর মহামায়া যায় আর সাধু তাকে আশ্বস্ত করে।
সবাই মেলায় বেরোয়। মহামায়া পৌষের অপরাহ্নের অকিঞ্চিৎকর রোদের মতো বাথানের একপাশে পড়ে থাকে।
"কানু আমায় একটু নিয়ে চল্ না বাবা, মেলায়।" মহামায়ার এ হেন আব্দারে কানুর বিরক্তির সীমা থাকে না। "কেন, ফালতু ফালতু বুড়ো মানুষ এত দূর যাবে?"
৪)
মেলায় প্রচুর লোক। ছেলে পুলেরা প্যা পো বাঁশী বাজাচ্ছে অবিরত। জিলিপি ভাজার, ছ্যাক ছোঁক। রাম-নারায়ণ-রাম নাম গানে মুখরিত হচ্ছে আকাশ বাতাস। চলছে সমুদ্রের ভাটিয়ে যাওয়া চাতে হরদম চরকি বাজি। মাইকে - চিৎপুরের যাত্রা পালার কথা ঘোষনা হচ্ছে তারস্বরে। "আনন্দ সংবাদ, আনদ সংবাদ। আজ রাত্রি দশ ঘটিকায় কোলকাতার সুবিখ্যাত যাত্রা পার্টি দিগ্বিজয় অপেরার এবছরের অশ্রু সজল সামাজিক পালা ...."
মনোহারী দোকানে চলছে মেয়ে বউদের গমগমে কেনাকাটা। বিপিন বেশ ক্লান্ত, দোকানদারিতে।
কর্মচারীদের ওপর ছেড়ে বিপিন এবার একটা বিড়ি ধরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় খানিক জিরিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে।
সামনেই অনন্ত সাধু ভদ্রাসনে বসে। চোখ, আধ বোজা। সামনে - দুটো হাড় গুণ চিহ্নের মতো করে রাখা। দুটো হাড়ের মাথায় - মড়ার খুলি বসানো। তাতে আবার সিঁদুর লাগানো। খুব নাম এখানে সাধুর। কারবার ও ভালো
কিন্তু সাধুকে বেশ একটু বিব্রত দেখাচ্ছে কেন! বিপিন বিড়িতে লম্বা একটা টান দিয়ে সামনে গিয়ে দেখে - একটা বুড়ি খুব কান্নাকাটি করছে সাধুর হাতে পায়ে ধরে। সাধু যতই তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করছে এই বলে যে তার ছেলে ফিরে আসবেই, বুড়ি কিছুতেই তাকে ছাড়ছে না।
"মা কি কখনো ছেলেকে খেতে পারে, বলো? বলে দাও বাবা আমার ছেলে কবে ফিরে আসবে।" "এই জীবনে আমি কি তাকে দেখে যেতে পারবো?"
"আসবে, আসবে ঠিক ফিরে আসবে তোমার ছেলে।"
কিন্তু কোনো কিছুতেই আজ চিড়ে ভিজছে না। বুড়ি নড়ে যাচ্ছে না কোথাও।
উপায়ান্তর না দেখে অনন্ত এইবার তার তুণীর থেকে শেষ বাণ টি বের করে ছোঁড়ে বুড়ির দিকে লক্ষ করে, "ওঠো মা, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। দ্যাখো গিয়ে তোমার ছেলে পৌঁছে গেছে বাড়িতে।"
"ও বাবা তাই?'" "তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক বাবা!" মহামায়া এবারে তার শেষ সম্বল রূপোর বাউটিটাকে হাত থেকে খুলে সাধুর পায়ে দক্ষিণা স্বরূপ দিয়ে ফিরে যায় মা গঙ্গার নাম করতে করতে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। লাঠি হাতে মহামায়া যতটা সম্ভব দ্রুত লোকজন পেরিয়ে হেঁটে যায় বাড়ির দিকে।
অনুসন্ধান অফিসের মাইকে তখন ঘোষণা হচ্ছে -একটা ছোট্ট ছেলে আমাদের কাছে রয়েছে। সে ভীষণ কান্নাকাটি করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বাবা -মা হারিয়ে যাওয়া ছেলেটিকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যান। মহামায়া কি কিছু শোনে?
---_______----------_____________------------_________-----------___________---------____
ঝন
ঝন করে আচমকা একটা আওয়াজ উঠতেই, দীপেন্দুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। 'কি, কি, কি হল?" উল্টো দিক থেকে কেউ বোতল ছুড়ে মেরেছে বাসের মুখে। ড্রাইভারের সামনে দুদিকের কাঁচ ভেঙে পুরো ভাঙা খণ্ডহর। ধুলোর মতন কাঁচের গুঁড়ো উড়ে আসছে বাসের সামনে থেকে পেছনের দিকে। দীপেন্দু ঘুমিয়ে পড়েছিলো, তাই রক্ষে। সে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল হতভম্ব ড্রাইভার কোনোরকম গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে বসে আছে, তার সারা শরীরে কাঁচ ফুটে, রক্তারক্তি অবস্থা।
জানুয়ারী মাসের রাত। হু হু করে হিমেল হাওয়া ঢুকছে। "কেউ নামবেন না," কন্ডাকটর গোপাল, গম্ভীর কণ্ঠে কথা গুলো বলতেই একটা নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে বাসের মধ্যে। "ফার্স্ট এড বক্স টা তাড়াতাড়ি বের করুন গোপাল দা;"
"আস্তে আস্তে, আ...।" ড্রাইভারের কেবিনে বসা এক প্যাসেঞ্জারের চোখের নীচ থেকে ফুটে যাওয়া কাঁচের টুকরো বের করতে গিয়ে চিল চিৎকার বাসের মধ্যে। দীপেন্দু মোবাইল অন করে টাইম দেখে রাত বারোটা দশ। "গোপাল দা জায়গাটা ঠিক কোথায়?" "বাজকুলের কাছাকাছি।"
সামনের রাস্তা জুড়ে নিকষ কালো অন্ধকার। তার উপরে আবার কুয়াশার জমাট পাহাড়। থেকে থেকে আসা ভারী লরির হেড লাইট তাতে টক্কর খেয়ে সাদা ধোঁয়া ফেটে বেরুচ্ছে ভুস ভুস করে।
দীপেন্দু, কনডাক্টর গোপালের কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে আস্তে আস্তে করে বলে, "নীচ থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসছি।" নামতেই ঘন কুয়াশায় মাথা ভিজে জবজবে হয়ে যায় দীপেন্দুর।
"আরে কি হোল? দাঁড়িয়ে পড়েছিস এখানে?" পরমেশ্বর পরিবহনের অন্য একটি নাইট সার্ভিস বাস এসে দাঁড়ায় পাশাপাশি। "একি, কাঁচ ভেঙে গেল কিভাবে?"
"শালা মাতালেরা চলন্ত গাড়ি থেকে খালি মালের বোতল ছুঁড়ে মেরেছে।" "দীঘা যাচ্ছে না ফিরছে?"
"দ্যাখ, শালারা কোন নয়নজুলিতে উল্টে পড়ে আছে কিনা।" বলতে বলতে ড্রাইভার আচমকা কথা থামিয়ে দেয়। কান খাড়া করে, পাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে ..!
"ধর্, ধর্,...ধর্...!" "পালাচ্ছে, ধর্...!."
কি হোল? একটা তীব্র কোলাহল - দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে, বাস রাস্তার দিকে!
বাসের কন্ডাক্টর গোপাল কাউকে বাস থেকে নামতে বারণ করে। দীপেন্দু নীচেই থেকে যায়। গোপাল দরজা টেনে সপাটে বন্ধ করে দেয়।
দীপেন্দু বিস্ফারিত চোখে দেখে- পূব আকাশে হলুদ আগুনের লেলিহান শিখা কিভাবে কুয়াশার চাপ কাটিয়ে ফগ লাইটের মতো অসংখ্য কালো কালো মাথাগুলো কে ভয়ঙ্কর ছায়া চিত্রের মতো এঁকে যাচ্ছে সাবলীল নিপুনতায়।
2)
ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। টালির চালার বাঁশ, বাতা ফট্ ফাট্ আওয়াজ করতে করতে ফেটে যাচ্ছে আর হাওয়ায় - লক্ষ লক্ষ হাউই ফাটা হলুদ আগুনের স্ফুলিঙ্গ যেন উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। আর্ত চিৎকারে ফেটে যাচ্ছে দিগ্বিদিক।
কিন্তু সেদিকে কারোর কোনো খেয়াল নেই। উর্ধ্বশ্বাসে একদল মানুষ ছুটে চলেছে ফাঁকা মাঠ চিরে বাস রাস্তার দিকে। "ওই ধর..ধর্..! পালাচ্ছে….!" "ওকে ছাড়লে হবে না। শালা...বড় সর্দার. ওকে ধর্!"
ফাঁকা মাঠের মধ্যে সাত আট খানা ঘর প্রায় গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতনই অবস্থান ছিল তাদের। বর্তমানে আগুনের বলয়ে বন্দী বৃহদাকার চিতার মতো জ্বলছে দাউ দাউ করে।
৩)
শীতের দিনে জানালা দরজা বন্ধ, তবু মাইকে তারস্বরে বাজা হিন্দি গান কানে চলে আসছিল। কিছুতেই ঘুম আসছিল না মহসীনের। দাস পাড়ায় নারায়ণ পূজা হচ্ছে। মহসীন, রহিমার কাছে সরে যেতে, মাঝখানে শোওয়া আব্দুল ভোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে। মহসীন আদর করে আব্দুলের কপালে হাত বুলিয়ে দেয়।
"রাত হোল, ঘুমিয়ে পড়," রহিমার কথায় পাশ ফিরে শোয় মহসীন। সন্ধ্যায় রেশন তুলে বাড়ি ফেরার পথে মহসীন, নারায়ণ পূজা মণ্ডপের সামনে গণেশের পান দোকানে দাঁড়িয়েছিল পান খাবে বলে। সামনে, লাল সরু মোরাম রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে কাজলাগড়ের দিকে। রাস্তা ডিঙ্গিয়ে দক্ষিণে বিশাল ফাঁকা মাঠ। ধান কাটা হয়ে গেছে, এখন আদীগন্ত রিক্ততা সারা মাঠ জুড়ে। মাঠ পেরিয়ে মহসীনদের বস্তি। বস্তি ঘরের ইতিউতি জ্বলা হলুদ আলোর টিমটিমে জ্যোতি বোল্ডারের রাস্তা থেকে মনে হচ্ছে যেন দূর গাঙে ভেসে থাকা একাধিক জেলে নৌকার ছইয়ে জ্বলা হলুদাভ হ্যারিকেনের আলোক গুচ্ছ। অনিত্য বাতাসে প্রকম্পিত, অবিন্যস্ত বাতি পুঞ্জ যেন পিলসুজে জ্বলা কম্পমান দীপশিখার মতন অনিশ্চয় ভবিষ্যতের ধারাভাষ্য হয়ে ফুটে আছে।
ফাঁকা মাঠে গোল হয়ে বসে ছেলে ছোকরা রা বোতলের ঠুং ঠ্যাং আওয়াজ তুলছে আর খিস্তি খেঁউড় করছে মন খুলে। তাদের সঙ্গে আবার শিং ভেঙে আসরে, ঢুকে পড়েছে মোড়ল কালী।
"ওই শালা দাঁড়িয়ে আছে!" "যাবো ? যাবো একবার শালাকে এমন মার মারবো না একেবারে মক্কা পাঠিয়ে দেবো।"
"শালা, পাশে নারায়ণ পূজা হচ্ছে আর গরু মেরে মাংস খাওয়া হচ্ছে মৌজ করে?"
মহসীনের কেমন বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। সে সাইকেলে উঠে বাড়ির দিকে রওনা হতেই কানে ভেসে আসে হুমকি, "ধরে আন, শালা পালাচ্ছে। আজ কচুকাটা করবো শালাকে।"
কালী ওদের সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। "দাড়া, শান্ত হ। এত অস্থির হলে হবে না। ঠিক সময়ে এর অ্যাকশন নেবো।"
"উফ!" মহসীনের মুখ থেকে কখন যে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে শব্দটি, সে বুঝতেও পারে না। "কি হোল?" "ঘুম আসছে না? কি এত ভাবছ বলোতো তুমি?" মহসীন রহিমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। এত বড় বিপন্নতার ভার যে কি করে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে ভাগ করে নেবে বুঝতে পারে না। চুপ করে থাকে।
"বাইরে অনেক মানুষ জনের কোলাহল মনে হচ্ছে না ..!" " কোনো গোলোযোগ হলো না তো...!"
"চুপ করো! শুনতে দাও...!"
"কি হবে গো এখন!" মহসীন এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে যায় দরজার কাছে।
"দেখি তো!" "এ কি...!"
"আব্দুল কে ডেকে দাও!" " আব্দুল...! আব্দুল...!"

হলুদ আগুনে রাক্ষস তার তীব্র বুভুক্ষা নিয়ে গিলে খাচ্ছে ঘর গুলোকে। "সব শেষ হয়ে গেল গো ...।" মহিলাদের চিল চিৎকারে রাতের আকাশ খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে কুয়াশা ঢাকা ছোট্ট জনপদটির জটায় হঠাৎ জ্বলে ওঠা হিংসার হোম কুন্ডে।
"মা, কারা এমন আগুন লাগাল?" খানিক দূরে ফতেমা, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আগুনের দিকে; চোখের সামনে সাধের ঘর গেরস্থালীর সব পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখে মুখে সহসা কোনো কথা আসে না ফতেমার। এদিকে পেটের মধ্যে ভয়ার্ত মুখটাকে গুঁজে ছোট্ট আইনুল তার শীর্ণ দুটো হাত দিয়ে আরও শক্ত করে জাপটে ধরে ফতেমাকে। ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফতেমার মুখ থেকে কখন যে অজান্তে বেরিয়ে আসে, "কে জানি, কোন হারামী এমন কাজ করলো!" "আল্লাহ্ ওদের মাফ করবে না দেখিস!"
"বাবা কোথায়, মা?" "চুপ্ কর্!" ছেলেকে ধমক দিয়ে ওঠে ফতেমা।
তাড়া খেয়ে বস্তির ছেলে মরদরা যে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে। শুধু বাবলা গাছের তলায় শুয়ে থাকা মেঠো রাস্তাটি নিথর সাপের মত নিশ্চুপ পড়ে থাকে। একে বেঁকে; দুধ খরিসের মত পৃষ্ঠ দেশ তার। পাশে বন তুলসী আর চিরতার ঝোপ ঝাড় নিরব দর্শকের মতো বেবাক দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুটা দূরে, লম্বা লম্বা তাল খেজুরে ঘেরা পালেদের পুকুর ঘুরে রাস্তাটি হঠাৎ ডান দিকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
বাবলা গাছের পাতা চুইয়ে টপ্ টপ্ করে কুয়াশা ফতেমার মাথায় পড়ে।
ফতেমা ছেলের মাথা বাঁচাতে আঁচল দিয়ে ঢেকে নেয়।
"আব্দুল...। আব্দুল...। বেটা কোথায় গেলি তুই?"
রহিমা, ছেলেকে খুঁজে প্রায় পাগলের মত দৌড়ে আসে। রহমানের মুদি খানার টিনের চালার নীচে আরও কয়েকজন মহিলা তখন জড়সড় হয়ে বসে, কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তীব্র হলুদ আগুনের আভায় চারিদিক কেমন যেন রূপকথার নরকের মতো লাগছিল। ঝুপড়ি ঝুপড়ি সোনাঝুরি গাছের মাথা গুলি ঝুল কালি মাখা কালো কয়লার স্তুপ যেন, শ্বাস হীন, নিস্তব্ধ - যেন কোন জাদু কাঠির স্পর্শে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে চতুর্দিক।
রহিমা কাউকেই খেয়াল করে না। তীব্র আত্রাসে যেন কোনো দস্যুর হাত থেকে বাঁচতে প্রাণপণ করে ছুটে যায় সে। "আব্দুল, ... আব্দুল......, কই গেলি তুই......।!"
কি ভেবে ফতেমা আইনুল কে বুকের কাছে টেনে আনে।
"আব্দুল...। আব্দুল...। বেটা!...!"
আব্দুল যে তার বাবার পেছনে পেছনে দৌড়ে যাচ্ছিল, ফতেমার নজর এড়ায় নি। পেছনে একগাদা উত্তেজিত লোক মহসীন কে ধরতে ছুটছিল।
" ওকে ছাড়া যাবে না। এই শালাই সর্দার।"
"শালা, বড্ড বাড় বেড়েছে!" ধাওয়া করা মানুষ গুলো আরোও যে কত কি গালাগালি করতে করতে ছুটে যাচ্ছিল ফতেমার সামনে দিয়ে; ফতেমা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে বাবলা গাছের আড়ালে সিঁটিয়ে যায়। একটু এগিয়ে গিয়ে খেসারি খেতের নাতি উচ্চ বাঁধের পাশে হঠাৎ দলের পেছনে থাকা কালী দাঁড়িয়ে পড়ে । লুঙ্গির ট্যাক থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরায় তারপরে আবার ছুট লাগায় বিড়িটাকে দু ঠোঁটে শক্ত করে চেপে ধরে। বাকিদের উদ্দেশ্য হাঁক পাড়ে, "কেউ ছাড়বি না শালাকে!"
ভয়ে ফতেমা আব্দুল কে টেনে আনতে গিয়েও পারে নি। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।
৪
পালেদের বিশাল তাল পুকুর ঘন কচুরিপানায় ভর্তি। পালেরা, কোলকাতায় থাকে। দীর্ঘদিন তাই সংস্কার হয় না। সাপ খোপের ভয়ে দিনের বেলাতেই লোকেরা ভয় পায় পুকুরে নামতে।
কিন্তু প্রাণ নিয়ে পালানো মহসীনের কাছে এখন বিষাক্ত সাপের ছোবল খাওয়াও মনে হয় বেশি নিরাপদ। পুকুর পাড় ঘুরতেই পেছনে থাকা কালীর দল কে আর দেখা যায় না। দেরী না করে মহসীন এক লাফে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুরের মধ্যে।
৫
যত চিৎকার কাছাকাছি চলে আসে, বাসের মধ্যে থাকা সমস্ত যাত্রী প্রায় শ্বাস রোধ করে অপেক্ষা করতে থাকে শেষে কোন্ ভয়ানক পরিস্থিতির যে সাক্ষী থাকতে হবে তাদের এই ভেবে।
দীপেন্দু সেল ফোন থেকে কাঁথি থানার ফোন নাম্বার খোঁজার চেষ্টা করে। খানিক বাদে কন্ডাক্টর গোপাল ও দীপেন্দুর পাশে এসে দাঁড়ায়।
বাইরে থেকে বারবার প্যাসেঞ্জারদেরকে সতর্ক করে, "সবাই চুপচাপ বসে থাকবেন। কেউ বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করবেন না।"
" শস্্্্্!" হঠাৎ দীপেন্দু হাত দিয়ে গোপালের মুখ চেপে ধরে। থামতে বলে ওকে। তারপরে হাতের ঈশারায় বাসের তলার দিকে তাকিয়ে দেখতে বলে। "এ কি!"
একটা বছর দশ বারোর ছেলে বাসের তলায় গুটিয়ে শুয়ে আছে।
"একি!" "কে তুই?" " আয় বেরিয়ে আয়"
" ভয় নেই, বেরিয়ে আয়, বলছি!"
কিছুতেই বেরোয় না দেখে গোপাল শেষমেশ বাচ্চাটিকে টেনে বাইরে বার করে আনে। ভয়ে আতঙ্কে তখন থরথর করে কাঁপতে থাকা বাচ্চাটির বিস্ফারিত ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে শুধু তার বিদীর্ণ বুকের গভীর থেকে উঠে আসা অদ্ভুত একটি ফোঁস ফোঁস আওয়াজ বেরিয়ে আসে। প্রবল চাপে, ফুটো হয়ে যাওয়া নল থেকে যেভাবে জল বেরিয়ে আসে হুসহুস করে সেভাবে।
"আব্বু, আব্বু...!"
দীপেন্দুর বুকের ভেতরটা কেমন কুয়াশায় ভেজা ঘেসো মাঠের মতোই আর্দ্র হয়ে যায়। সে স্থির থাকতে পারে না।
বাচ্চাটিকে বুকের কাছে টেনে নিতেই সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
"ভয় পাস না।" "তোর কিছু হবে না"
"এইখানে দেখ্, শালা লুকিয়ে আছে কি না!"
ছায়ামূর্তির মতো কয়েকটা লোক এসে হঠাৎ বাসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে।
" কে ওই বাচ্চাটা?" "কে এটা!"
"মহসীন এর ব্যাটা না? এত শীতে খালি গায়ে ...!"
কালীর এমন সংশয়ের সামনে নিরুপায় দীপেন্দু বুকে সাহস নিয়ে একবার বলেই দেয় "ও আমার ছেলে!"
-----_____________-----------------________----------------______________--------------------------------____________
একটি কবিতা ও তিনটি মৃত্যু!!! রাতে কোয়ার্টারে ফেরার পথে, আশিস হাসপাতালের এমার্জেন্সি ঢোকার মুখের রাস্তাটায় তিন জন মহিলাকে একসাথে বসে কান্নাকাটি করতে দেখে কোয়ার্টারে না ফিরে সরাসরি এমার্জেন্সিতে ঢুকে পড়লো। ইনডোরে ডিউটি রুমের মধ্যে ঢুকতেই, ডিউটিরত সিস্টার মৃদু বিস্ময় মাখা হাসি হেসে বলল, "কি ব্যাপার আশিস দা, এখন অসময়ে! সব ভালো তো?"
আশিস খানিক বিব্রত হয়ে বলল, "আরে, না না, আমি একটু...! মানে.., কেউ কি মারা গেল হাসপাতালে?"
গ্রামের হাসপাতালে কালে ভদ্রে এক আধটা রোগী মারা যায়। সাধারণত খুব ইনজিউরড্, বিষ খাওয়া, গলায় দড়ি বা সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসতে আসতে; না হয় ডাক্তারবাবুর প্রাথমিক ম্যানেজমেন্ট দিয়ে রেফার করতে যতটুকু সময় লাগে, ততটুকু সময় না দিয়েই যদি রোগী পটল তুলে নেয় তখন।
"হ্যাঁ, ঈশ্বরচন্দ্রপুরের একটি সাপে কাটা কেস, ওঝা - টোঝা দেখিয়ে যা হয়, একেবারে শেষ অবস্থায়, এ.ভি.এস শুরু করার আগেই - ইয়ং ছেলে। সদ্য বিয়ে করেছিলো।" "বৌয়ের পেটে তিনমাসের বাচ্চা!"
সিস্টার থামতেই আশিস আসছি বলে কোয়ার্টারের দিকে হাঁটা দেয়। আজকে ফিরতে একটু বেশ রাতই হয়েছে তার। রোজ সন্ধ্যার মত ষষ্ঠীদার চায়ের দোকান থেকে আড্ডা দিয়ে ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেছে তার। চা- সিগারেট সহযোগে একেবারে তুফান তোলা কথা চালাচালি চলে ওখানে। সম্পাদক তাজিরুল ইসলাম আর ওদের হাসপাতালেরই হেল্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট পন্ডিতদা সহ একেবারে তুখোড় প্যানেল। যাক্ সময়টা অন্তত দারুন কাটে সন্ধ্যার সময়। আর করবেটাই বা কি! আশিসের ফ্যামিলি থাকে দেশের বাড়িতেই। মেয়েকে লোয়ার কেজি তে ভর্তি করিয়েছে এবার। এই গেল সেপ্টেম্বরের পয়লা তারিখে, মেয়ে চার থেকে পাঁচে পা দিয়েছে।
ও খুব মিস্ করে মেয়েকে। ফার্মাসিস্ট হিসেবে এই হাসপাতালে জয়েন করার প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় মেয়েটার জন্ম।
আশিস একটু পা চালিয়ে আসছিল। কোয়ার্টারে ঢুকেই ফোন করবে। মেয়ের সঙ্গে একটু কথা বলবে আজ। দেরী হলে যদি ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু হাসপাতাল হয়ে আসতে একটু দেরীই হয়ে গেল। কোয়ার্টারের কাছটাতে বেশ অন্ধকার। আশিস পকেট থেকে টর্চটা বের করে জ্বালাতেই একেবারে সামনে দিয়ে একটা শেয়াল রাস্তার এপার থেকে ওপারে চলে গেল। কোয়ার্টারে ঢোকার মুখেই রয়েছে একটা বুড়ো আমড়া গাছ। সারা দিন পাকা পাতা খসে খসে প'ড়ে তলাটায় প্রায় স্তুপাকার হয়ে গেছে।
রাতের খাওয়ার রোজ নিয়েই চলে আসে, বাজার থেকে। খাওয়ার রাখার স্টিলের কৌটোটাকে পায়ের কাছে রেখে কোয়ার্টারের বাইরের রেলিং টা খুলতে যাবে - হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন।
আশিস কেমন ঘোরের মধ্যে ছিল। এমার্জেন্সির সামনে মহিলাদের কান্না তখনো ক্ষীণ ভাবে ভেসে আসছিল কানে। কেমন মিনমিন করা অদ্ভুত সুরে। ভূতেদের কান্নার মতন।
উদগ্রীব হয়ে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে গিন্নী বলল, " শুনেছো, মীনা দি'র বর মারা গেছে আজ!"
"হঠাৎ কি যে হলো...! কি ..বা এমন বয়স হয়েছিল!"
মীনাদির বর! আশিস আনমনে বিড়বিড় করতে থাকে। অনেক ছোটবেলা থেকেই মীনাদি ছিল, তাদের বাড়িতে। কাজের মেয়ে হলেও বাড়ির সবাই ওকে খুব ভালোবাসতো। ওদের বাড়ি থেকেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান ও হয়েছিল তাদের বাড়িতেই। এই তো কয়েক বছর আগে আশিসের বিয়েতেই কত আনন্দ করলো। একেবারে ঘরের মেয়ে জামাইয়ের মতন।
কেমন অস্থির লাগছিল আশিসের। খাওয় দাওয়া সেরে ঘুমোতে যাবে, কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলো না।
মৃত্যু তো জীবনের এক অন্তিম পরিণতি। বিজ্ঞজনেরা বলেন মৃত্যু আসলে দেহের মৃত্যু। অবিনশ্বর আত্মা জীর্ণ দেহ ছেড়ে কেবল নতুন দেহে বাসা বাঁধে। কিন্তু দেহ মানে কি, শুধুই হাড় মাংসের একটা কাঠামো! দেহের কি মন নেই? দেহ ঘিরে যে স্মৃতির সরনী তাও কি চিতায় ভস্মীভূত হয়ে যায়?
আশিস বুঝতে পারে না। কিছুটা আবেগতাড়িত হয়েই টেবিলে রাখা ডায়েরিটা নিয়ে খুলে বসে।
তারপরে তাতে কলম নিয়ে কিছু লিখতে যায়। কিন্তু পারে না। উঠে খানিক পায়চারি করে, উদভ্রান্তের মতন। তারপরে আবার বসে পড়ে। আবার কখন জানালার শিক ধরে বাইরের অন্ধকারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অস্থির হয়। এলোমেলো পায়চারি শুরু করে দেয় কখন আবার। শেষমেশ অনেক কষ্টে, অনেক ভেবে যে কথাটি শেষ পর্যন্ত সে লিখতে সক্ষম হয় তাই জীবনের একমাত্র ধ্রুব ও অপ্রতিরোধ্য নির্মম সত্যের প্রতিভূ - যার মধ্যে তার সমস্ত ভাবনার যাতনাকে আহুতি দিয়ে চিন্তার হোমানলে জাগানো আগুন -হলুদ কলমের তুঙ্গ চুম্বনে কেবল একটি শব্দই লেখা হয়ে ওঠে - 'মৃত্যু'। কিন্তু তারপরে? বারবার কলম টেনে টেনে মৃত্যু লেখাটির নীচে অসংখ্য এলোমেলো দাগই কেবল কেটে চলে সে ক্রমাগত। অনেকটা ভূতে পাওয়া মানুষের মতন। বাইরে তখন টুপ টাপ পাকা আমড়া পাতা খসার শব্দ এলোমেলো আসতেই থাকে।
গল্পের দ্বিতীয় পর্ব
অনেকদিন ধরে তাজিরুল ইসলাম লেখার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন। তাজিরুল সাহেব স্থানীয় ভাবে প্রকাশিত 'দিশা' পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, অনেক দিন ধরে। দেখা হলেই বলেন, " দাদা, কিছু লিখছেন তো?"
লিখবে কি? ভেতর থেকে সেই প্রণোদনা চাই তো! এ তো কোনো অর্ডার - সাপ্লাইর ব্যাপার নয়।
সাধারণ মানুষ দুঃখ পেলে কাতর হয়। আর লেখার জন্য তাকেই জ্বালানি করে লেখকেরা। সৃজন কর্মের রসদ হিসেবে বিষাদের ব্যবহার সেই বাল্মীকির যুগ থেকে চলে আসছে। এবং তা এখনোও চলছে। দুঃখকে শুধু সযত্নে লালন করে তাই নয় তাকে পুঁজি করেই কলমে শান দিয়ে যান নিরন্তর।
দক্ষিণের মাঠ থেকে হঠাৎ শেয়ালের ডাক শুনে নড়েচড়ে বসে আশিস। বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মধ্যে ধরা পেনটি যদিও যথাস্থানেই থাকে তার। এবার ঘুমোতে যেতে হবে। আলতো আড়মোড়া ভেঙে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় ডায়েরির মাঝখানে লেখা হয়ে যাওয়া এলোমেলো কবিতার লাইন গুলিকে। পাতার ওপরে বড়বড় হরফে লেখা 'মৃত্যু' কথাটিই থেকে যায় কবিতার শিরোনাম হয়ে।
জানি তুমি আসবেই!
রোজই শুনতে পাই
পাতা ঝরে পড়ে - টুপ্ টাপ্।
সময় নেই, অসময় নেই
তোমার তরী ভিড়তে পারে।
যতই হোক লোহার বাসর,
ছিদ্র পথে ঢুকবে সে কাল সাপ!
অবশেষে আশিস যখন ঘুমোতে যায় তখন ঘড়িতে রাত দুটো বেজে কুড়ি।
কবিতাটি আশিস ' কৃষ্টি ' পত্রিকার শারদ সংখ্যার জন্য মুকুলদির হাত দিয়ে পত্রিকার সহকারী সম্পাদক প্রণব সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেয়। মুকুলদি হাসপাতালেরই স্টাফ। পি এইচ্ এন্ এর চার্জে রয়েছেন। আর প্রণবদা মুকুলদির বর।
একটু আধটু লেখালেখি করে বলে, হাসপাতালের সবাই বেশ একটু অন্য চোখেই দেখে আশিসকে। আবার বন্ধুস্থানীয় অনেকে চায়ের আড্ডায় ফার্মাসিস্ট এর কবিতা লেখা নিয়ে একটু আধটু ঠাট্টা ইয়ার্কিও করে। যেমন সেবার 'দিশা' পত্রিকায় তার একটি কবিতা ছেপে বেরনোর পর ল্যাব টেকনিশিয়ান ব্যোমকেশ হাসতে হাসতে বলেছিলো, "কোথা থেকে টোকা হয়েছে এটা?"
"টোকা - টোকি!
সে আবার কি?" আশিসের ছড়া কাটা উত্তরে হাসির রোল উঠেছিল।
মহালয়ার দিন বৃষ্টি পড়ছিল অনর্গল। আর তার মধ্যেই মুকুলদি একেবারে প্রণবদাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির ফার্মেসিতে। ' কৃষ্টি ' পত্রিকার দু কপি আশিসের হাতে দিয়ে প্রণবদা একটা কপি থেকে ওর কবিতাটিকেই আবৃত্তি করে শোনাতে শুরু করে দেন। অসম্ভব ভালো গলা ভদ্রলোকের। বলার ভঙ্গী, আবৃত্তির স্টাইল ও খুব সুন্দর। আশিস চায়ের অর্ডার দিয়ে বইটা নেড়েচেড়ে দেখছিলো। অসাধারণ ভালো প্রচ্ছদ প্রবোধ বিশ্বাসের। নদীর চরে কাশের হিল্লোল। আর একটি ছোট্ট ডিঙি নৌকা। কেমন পদ্ম পাতায় জলের মতো টলটলে।
হঠাৎ ব্যোমকেশ ফার্মেসিতে ঢুকতেই, আশিস আরোও একটা চায়ের অর্ডার করতে যাচ্ছিল। আশিসকে থামিয়ে, ব্যোমকেশ বললো, " চা নয়, সিগারেট খাবো।"
মুকুলদি আশিসকে দেখিয়ে ব্যোমকেশকে বললো, "ব্যোমকেশ, আশিসের কবিতা বেরিয়েছে ' কৃষ্টি' তে। এই দ্যাখো।"
কবিতাটি পড়ে বেশ একটা শ্লেষ মাখা ক্যাজুয়েল হাঁসির ঝিলিক খেলে গেল ব্যোমকেশের মুখে। তারপর জামার কলারটাকে ঈষৎ খাড়া করতে করতে বললো, "মৃত্যু আসলে আসবে, ও এত ভেবে লাভ নেই।" "মৃত্যু নিয়ে এত অবসেশন কবিতা টবিতাতেই ঠিক আছে। আমার, ভালো লাগে না।"
তারপর কাজ আছে বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়।
পরের দিন আশিস অফিসে গেছে। ক্লার্ক রাজুদার সঙ্গে তার সার্ভিস বুক নিয়ে একটা দরকারি কাজ করতে। প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। এখনোও আসছে না দেখে সে অফিসের ফোন থেকে তার বাড়িতে ফোন লাগায়। রাজুদার বাড়ির পাশেই ব্যোমকেশের বাড়ি। দুজনে প্রায় একসঙ্গেই যাতায়াত করে। অফিসে আসার সময় ল্যাবে ব্যোমকেশকেও দেখলোনা আশিস। কি যে হলো দুজনের। একসঙ্গে ডুব দিল নাকি?
কিন্তু ফোনে আশিস যা শুনলো নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে কোনোভাবে।
ব্যোমকেশ আর কোনোদিনই অফিসে আসবে না। কাল রাতে, হৃদরোগে...!
ফোনটা কেটে যেতে, হতবাক আশিসের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, " মৃত্যু কি ব্যোমকেশের চ্যালেঞ্জটা এত সিরিয়াসলি নিয়ে নিল!"
---____--------________--------________--------________----------_________-----------_--_____-
বিজয়ায় ঘরে ফেরা! "এবারে - পুজো তিন দিনের," পঞ্জিকা উল্টাতে উল্টাতে, স্বগতোক্তির মত কথাগুলো বলে উঠলো, বনলতা।
পাশের বিছানায় শিবানী, শুয়ে শুয়ে শারদীয় 'দেশ'পড়ছিলো। বনলতার কথাগুলো কানে আসার পর, বইটাকে পাশে রেখে চশমার খাপটাকে মার্কারের মতো বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। তারপর, ধীরে - ধীরে উঠে বসে; ডান পায়ের হাঁটু ভাঁজ করে তার ওপর কনুই ঠেকিযে হাতের চেটোর মধ্যে গালকে গুঁজে ধরে একমনে বসে থাকে, আলতো কুঁজো হয়ে। পুরু চশমার কাঁচের মধ্য দিয়ে যে কি ফ্যালফ্যাল করে দেখে, কে জানে!
"ওঃ!" বনলতার অশক্ত হাতটা সজোরে কপাল চাপড়ালো মশা তাড়াতে।
"এর পরে দেখছি সন্ধ্যা হলে মশারী টাঙিয়েই বসতে হবে," বলেই শিবানীর দিকে ঘুরে তাকালো ঐক্যমত্যের আশায়।
শিবানীর চোখ তখন বনলতার খাটের ওপারে বড় ক্যালেন্ডারটার দিকে। দুর্গার ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার টি বহু বছর ধরে ঝুলছে ঐ দেওয়ালে।
অনেক বছর আগে - সেবার ও পুজো ছিল তিন দিনের। অষ্টমী আর নবমী একই দিনে পড়েছিলো। বাবান, শিবানীর ছেলে, তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। পুজো তিন দিনের বলে তার কি কষ্ট মনে।
অষ্টমীর অঞ্জলী দিতে শিবানী, স্বামী ছেলেকে নিয়ে হাজির হয়েছিলো বাপের বাড়ির পুজোয়। বহু দিনের পুরনো পুজো ওদের। ওই একটা পুজো ঘিরে গ্রাম জুড়ে মাতামাতি, দোকানপাট, ছেলেমেয়েদের হুড়োহুড়ি। গা - ঘরের বউ ঝি দের পুজোর ডালা নিয়ে ঠাকুর দালানের সামনে অঞ্জলীর হাপিত্যেশ, সন্ধ্যায় পাড়ার ছেলেদের দ্বারা ঐতিহাসিক পালা মঞ্চায়ন। চার পাঁচটা খাট কে একসাথে জুড়ে তার উপর জাজনি পেতে, কলা কুশলী দের সে কি দুঃসাহসিক পদচারণা! স্কুল শিক্ষিকা শিবানী খুড়তুতো জেঠতুতো বোনেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে, আড় চোখে দেখতো - ছেলে কেমন অঞ্জলী দিতে আসা ব্রতীদের ভিড় সামলাচ্ছে। বিশেষ করে ওর বয়সী মেয়েরা ওর এমনতর তৎপরতা দেখে ভীষণ মজা পেতো। আর মুচকি মুচকি হাসতো।
সেবার শিবানী তার স্বামী ছেলেকে নিয়ে সন্ধি পুজোর অঞ্জলী দিয়েছিলো। পার্থ, শিবানীর স্বামী,
রাষ্ট্রায়ত্ত এক ব্যাঙ্কের স্থানীয় শাখার ম্যানেজার। খুব রিজার্ভড গোছের। কথাবার্তা খুব একটা বলতো না। কিন্তু পুজার ওই কটা দিন একেবারে সব আগল খুলে উজাড় করা আনন্দে মেতে উঠতো। সেবার নবমীর সন্ধ্যা আরতিতে ধুনুচি নিয়ে ঢাকের তালে তালে একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছিল নেচে। পরের দিন দশমীতে শালাদের সঙ্গে পান ভোজনের আসরে, পার্থ একটু বেশিই খেয়ে নিয়েছিলো।
সকালেই ঠাকুর নিয়ে নদীর ঘাটে যাওয়া হবে বিসর্জন দিতে। শিবানী, সিঁদুর খেলায় ব্যস্ত। লক্ষ্য করেনি। ওদিকে পার্থ টলমল পায়ে, একেবারে শালাদের মধ্যমণি হয়ে গোগ্রাসে পুরোহিতের কাছ থেকে পুজোর ভাঙ চেয়ে খেয়ে চলেছিলো। একেবারে হাঁড়ি হাপুস করে দেয় আর কি..! একজন প্রায় জোর করে ছাড়িয়ে কিঞ্চিৎ গলায় ঢালতে পেরেছিলো কিনা বলা কঠিন। শিবানীর খুব হাসি পেয়েছিলো পার্থকে দেখে। পাড়ারই কোনো বৌদি আবার ওর কপালে কাপালিকের মতন লম্বা সিঁদুর টেনে দিয়েছিলো। সবাই - মায়ের মিষ্টি -মুখ পর্ব নিয়ে ব্যস্ত। শিবানী মায়ের হাতে একটা লতানো পানের খিল ধরিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ, "ধরো, ধরো পড়ে যাবে!" - শোরগোল শুনে তাকাতেই দেখে পার্থ ওয়াক, ওয়াক করে বমি করছে। শিবানী ছুটে গিয়ে ওর বুকটা চেপে ধরতে পার্থ তার ঘোলাটে চোখে শিবানীর সিঁদুর লেপা কপালের দিকে সেই যে একবার তাকিয়ে দেখলো। ব্যাস্! ছেলেরা মন্দিরের বাঁ দিকের বেল গাছটার নীচে ধরে শুইয়ে দিল। বেহুঁশ পার্থ। চোখেমুখে হরদম জলের ঝাপটা মারা হচ্ছে। বাবান তখন একান্তই অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো ভিড়ের মধ্যে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও কাজ হয়নি। দশমীর সন্ধ্যাবেলা, শিবানীর কপালের সব সিঁদুর মুছে দিয়ে পার্থ চলে গেল চিরকালের মতন।
এরমধ্যে, কখন যে বনলতা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারে নি শিবানী। বনলতার হাতের স্পর্শে ঈষৎ কেঁপে উঠে, ঘুরে তাকায় ওর দিকে। "ওঃ..!" চশমা খুলে হাতের চেটো দিয়ে চটপট গালের ওপর গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছে নিতে নিতে আসলে কি যেন লুকিয়ে ফেলতে চায় শিবানী।
প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো, বনলতার সঙ্গে সে একই ঘরে কাটাচ্ছে। তাদের জীবনের সব সুখ দুঃখের কথাই প্রায় দুজনের জানা। শিবানীর 'চতুরাশ্রম' এ ভর্তি হওয়ার আগে থেকে বনলতা এখানে আছে। বনলতা এবার শিবানীর হাত ধরে হালকা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, " খাওয়ার ঘন্টা পড়েছে -কতক্ষন, চল্, চল্!"
আজ কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলো না শিবানী। ক - দিন বাদেই পুজো।

আজ কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলো না শিবানী। ক-দিন বাদেই পুজো। মহালয়া শেষ, দেবী পক্ষ শুরু হয়ে গেছে।
ওদের এই বৃদ্ধাশ্রমটা শহর থেকে একটু দূরে। মেন গেট পেরিয়ে বাইরে গেলে ইতি উতি কাশফুলের হিন্দোল দেখা যায়। পিচ রাস্তার ওপারের বিলটায় লাল শাপলাও ফুটেছে বেশ।
কিন্তু শিবানীর বুকে কেমন একটা পাথর চাপা বেদনা। ছেলেকে অনেক করে এবার পুজোয় বাড়ি আসতে বলেছিলো। নাতি হয়ছে। মোবাইলের পর্দাতেই দেখেছে। এখনোও সরজমিনে দেখা হয়নি। নাতিকে কোলে বসিয়ে আদর করবে সে স্বপ্ন আর আজকাল দেখে না শিবানী।
এবারেও পুজোর দিনগুলোতে বন্ধই পড়ে থাকবে ঘরটা। জ্বলবে না কোনো আলো। ভেবেছিলো, এবারের পুজোর কটা দিন অন্তত খুব আনন্দ করে কাটাবে। বাড়ি ভর্তি লোকজন, নাতির দুষ্টুমি, হাঁক ডাক, তারপরে কতদিনের কত জমে থাকা কথার গজগজ, খোশগল্প, আলাপচারিতায় একেবারে মুখরিত হয়ে উঠবে 'ঘরে ফেরার ঘর'।
বাড়ির নামকরণ করার আগে, পার্থ এই নিয়ে শিবানীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলো। বলেছিলো, "দ্যাখো, বাড়ি হচ্ছে অ্যাকচুয়েলি হাফ্ ওয়ে হোম। ফেরার পথে পান্থশালা। অর্থাৎ ঘরে ফেরার ঘর। সে কথা এখন মনে পড়লে শিবানীর বড় কষ্ট হয়। পার্থ তাকে পান্থশালায় ফেলেই ঘরে ফিরে গেছে। আর তার - না ফেরা হোল ঘর না কিছু। 'ঘরে ফেরার ঘর' এখন নির্জন, তালাবদ্ধ। গেটের মুখে শিউলি গাছটা এই শরতেও হয়তো প্রতিদিন প্রত্যুষে ছড়িয়ে দেয় এক রাশ ঝরা ফুল। স্কুল থেকে অবসর নেওয়ার পর দু- এক মাস মতো ছিল বাড়িতে।
বাবানের এম সি এ করতে ব্যাঙ্গালুরু পাড়ি দেওয়ার পর থেকেই সে একা। রতুর মা, বাসনমাজা, কাপড় কাচা, ঘরদোর মোছা, স্নানের গরম জল করে দেওয়া, রাতের রুটি আর দশটায় স্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মাছের ঝোল ভাত সব দু-বেলা এসে এসে করে দিয়ে যেত। স্কুল, বাড়ি, পড়াশুনো এই সব নিয়ে চলে যাচ্ছিলো। ইতিমধ্যে কোর্স কমপ্লিট করার পরে বাবান ওখানকারই এক আই. টি কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি। মোটা মাইনে। রাতের বেলায় প্রায়ই ফোনে কথা হয়। কিন্তু কোনোদিনই বলে নি ভানুমতীর কথা। ওরই ব্যাচমেট, একই সঙ্গে পাশ আউট। এবং একই কোম্পানিতে ক্যামপাসিং এ সরাসরি একই সাথে জয়েনিং। ভানুমতী ওখানকারই মেয়ে। বাবানের সঙ্গে অনেক দিনের সম্পর্ক।
একদিন রাতে বাবানের ফোন আসছেনা দেখে শিবানী নিজেই বাবানকে ফোনে ধরে। উল্টোদিকে তখন অনেকের হাঁসি ঠাট্টা, কলরোল, তার মধ্যেই বাবান বলতে থাকে, "মা সরি, তোমাকে আগে বলা হয়নি, আজ দুপুরে আমি ভানুমতীকে বিয়ে করেছি। এখন পার্টিতে, বন্ধুদের সঙ্গে। কাল সকালে ফোন করবো।" শিবানী যেন আকাশ থেকে পড়ে। ফোনটাকে কানে গুঁজে, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। "কাল সকালে সব বলবো তোমায়, ফোনে!' ওপার থেকে ভেসে আসা বাবানের কথাগুলো কেমন নির্মম রসিকতার মতো শোনায় শিবানীর কাছে।
মাস দুয়েক পরে বাবান এসেছিল বউ কে সঙ্গে নিয়ে কয়েক দিনের জন্যে।
শিবানী অভিমানে চুপ করেছিলো। বৌমা পায়ে ছুঁয়ে প্রণাম করার পর আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নি শিবানী। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকিয়ে ঝর্ ঝর্ করে কেঁদে ফেলেছিলো। সেই শেষ! তারপরে আর বাবান এই মুখো হয়নি। বাবানের ছেলে হলো তাও প্রায় দুবছর হয়ে গেল। শিবানীর, আজতক্ নাতির মুখ দেখাই হলো না।
শুনেছে, বাবান ওখানে যশবন্তপুরমের কাছে একটা ভালো ফ্ল্যাট কিনেছে। শিবানী তাকে কোলকাতায় কোনো আই. টি কোম্পানিতে চাকরী নিয়ে চলে আসার কথা বলেছিলো। বিশাল বাড়ি। থাকার লোক নেই। ওরও তো বয়স হচ্ছে, কিছু হলে কে দেখবে!
বাবান এখন কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত, কোলকাতায় নাকি কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বললো, "পারতো, বাড়ি বেচে দিয়ে - তুমি বরং আমাদের এখানে চলে এসো, নয়তো...!"
"নয়তো কি?" "বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চাস মা কে!" শিবানী ব্যথায় কেকিয়ে ওঠে।
"মা, রাগ কোরো না, বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা করো"
"তোমাদের কালটা একরকম ছিল, এখন পুরো অন্যরকম।"
শিবানী চুপ করে ছেলের কথা শোনে, কোনো কথা বলে না।
"জীবন এখন রেসের মাঠ হয়ে গেছে, মা। থেমে গেলে মাড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে।"
শিবানী কোনো উত্তর দেয় না।
"আর প্রতি বছর পুজোয় তো বাড়ি যাবোই।" শিবানী এবার ফোনটা কেটে দেয়।
অবসর নেওয়ার এক মাসের মধ্যে পাশের বাড়ির বৃদ্ধ মনু বাবু, একাই থাকতেন ঘরে। স্ত্রী গত হওয়ার পরে দুই ছেলে কানাডা থেকে এসে জেদাজেদি করেও বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে পারেনি বাবাকে। কাজের মেয়ে দুই বেলা রান্না করে দিয়ে যায়, একদিন সকালে এসে অনেকে ডাকাডাকি করেও সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল মনু বাবু আর ইহলোকে নেই। মনু বাবুর মৃত্যুটা শিবানীকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছিলো। তাই আর দেরী করে নি, শিবানী। 'চতুরাশ্রম' এ যোগাযোগ করে চলে এসেছিলো।
দূরের মাঠে হঠাৎ শেয়াল ডাকার শব্দে শিবানীর কেমন যেন লাগে। ছোটবেলায় বাবান শেয়ালের ডাক শুনলে এক্কেবারে ছুট্টে এসে তাকে জড়িয়ে ধরতো।
বাবানের ছেলেও কি এমনটি করে!
বাবানরা নাকি এবার পুজোয় মরিশাস যাচ্ছে বেড়াতে। ফোন করে বললো, "মা, এবারেও যাওয়া হলো না, অফিসের কলিগরা সব যাচ্ছে, ছাড়লো না একেবারে।" "এর পরের বার নিশ্চয়ই যাবো।" শোনার পর, শিবানীর বুক কেমন রোদে পড়া দিকশূন্যপুরের মাঠের মতো শূন্য হয়ে যায়। "আরো এক বছর..!" ফোনটা কেটে গেলে, অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কথাগুলো হাহাকারের মতো ঘরের চার দেয়ালে মাথা কুটতে থাকে ।
পঞ্চমীর দিন সকালে, বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার ঘরে এসে বলে যায়, " অষ্টমীর সন্ধ্যায়, মাসীমা আপনারা তৈরী থাকবেন। সবাইকে ঠাকুর দেখাতে শহরে নিয়ে যাওয়া হবে।"
বনলতা শুনে বেশ খুশীই হয়। শিবানী চুপচাপই থাকে। মনে মনে যেন কিসের অঙ্ক কষতে থাকে!
বিকেলে, বাগানের মধ্যে - সরু মোরাম বেছানো লাল রাস্তা দিয়ে রোজকার মতো হাঁটতে বেরিয়ে, বনলতা এবার জিগ্যেসই করে ফেলে শিবানীকে, " কি এত ভাবছিস বলতো সকাল থেকে?"
"ভাবছি, শেষের সেই দিনটির কথা!"
"কি হবে এত ভেবে, যা হওয়ার হবে ক্ষণ," বনলতা শিবানীকে একটু হালকা করার চেষ্টা করে।
"তাও, সবারই তো একটা শেষ ইচ্ছা থাকে?" শিবানীর কথায়, বনলতা হাঁসতে হাঁসতে বলে, "ঈশ্বর আমার তো কোনো ইচ্ছাই পূরণ করেন নি। আর যদি শেষ ইচ্ছার কথা বলিস, আমার ইচ্ছে....!"
বনলতাকে থামিয়ে শিবানী বলে, "বনলতাদি, থাক না, বলতে হবে না। বরং এক কাজ কর, তুমি তোমার শেষ ইচ্ছার কথা একটা বন্ধ খামে লিখে আমার কাছে দিয়ে দাও। আমিও আমারটা তোমার কাছে দিয়ে দেবো।"
"একটা শর্ত, কেউ আমরা খুলে দেখবো না। যতক্ষণ না.....!"
বনলতা একদৃষ্টিতে শিবানীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
"দ্যাখো, কে কখন চলে যাবে - কেউ জানে না। দুজনের মধ্যে যে আগে যাবে, তার শেষ ইচ্ছে লেখা খামটি তখন অন্যজন খুলে দেখবে, তার আগে নয়।"
"বাব্বা! তোর যত উদ্ভট ভাবনা।" "জীবন চলে গেলে ইচ্ছা, অনিচ্ছার আর কি দাম?" "আর কেইবা দাম দেবে," বনলতার কথায় শিবানী চুপ করে থাকে, কি - বলবে ভেবে পায় না।
সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে শিবানী একটা বন্ধ খাম বনলতার হাতে তুলে দেয়। বনলতা পাঁজির ভেতরে যত্ন করে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে বলে, "আমার কোনো শেষ ইচ্ছে নেই বুঝলি!"
অষ্টমী আর নবমী একই দিনে পড়ায় দশমীর আগের দিন রাত্রে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার একরকম - হিড়িক পড়ে যায়।
দশমীর প্রাক-সন্ধ্যায়, গাড়ীতে পাশাপাশি বসে বনলতা ও শিবানী বৃদ্ধাশ্রমের আরো সব বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরোয়। শহরে ঢোকার মুখেই, নো - এন্ট্রি বোর্ড। মানুষের বন্যা নেমেছে রাস্তায়। গাড়ী সাইড করে রেখে সবাই একে একে নেমে আসে। ম্যানেজার ছোকরা ফের সাবধান করে দেয়, "প্রচুর লোক, কেউ কারো হাত ছাড়বে না, কোনো কারণে ভীড়ের মধ্যে কাউকে দেখতে না পেলে, মন্ডপের সামনে যে কোনো জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি খুঁজে নেবো।"
বনলতা ও শিবানী দুজন হাত ধরাধরি করে, পাশাপাশি হাঁটতে থাকে।
কিছুটা এগিয়ে একটা মন্ডপের ভেতরে পৌঁছে - কয়েক মুহূর্তের জন্যে বনলতা - শিবানীর হাতটাকে ছাড়িয়ে প্রতিমাকে প্রণাম করার উদ্দেশ্যে হাত দুটিকে বুকের কাছে জড়ো করে ধরে। ভক্তিতে, ঈষৎ ঝুঁকে যায় সামনের দিকে; আবেগে দু চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার। খানিক বাদে - আলতো ভীড়ের ধাক্কায় একটু সরে যেতেই চোখ খুলে - এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু, শি.বা.নী ...? কোথায় গেল, সে! শিবানীকে দেখতে না পেয়ে, আশেপাশে চোখ ফিরিয়ে খুঁজতে থাকে, বনলতা! কি...হলো, এইটুকু সময়ের মধ্যে! কোথায় - চলে গেল, সে!
ভীড় কি - ওকে ঠেলে আশেপাশে কোথাও নিয়ে চলে গেলো? ম্যানেজারের কথামতো, বনলতা এক জায়গায় সরে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় তার পা দুটি, নাগাড়ে কাঁপতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ম্যানেজার ছোকরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে - তাকে দেখতে পেয়ে বেশ আশ্বস্ত হয়। "যাক্, আপনারা এইখানে। চলুন, চলুন... সবাই বাইরে অপেক্ষা করছে।" নির্বাক বনলতা, এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে। "কি হোল, চলুন!" ম্যানেজার তাড়া দেয়।
এদিকে -ওদিক তাকিয়ে বনলতা কে একা দেখে সেও অবাক হয়ে যায়। "শিবানী মাসীমা... কোথায়?"
অনেক খুঁজেও শিবানীকে না পেয়ে, থানায় মিসিং ডায়েরি করতে হয়। ছেলের কাছে ফোন যায়।
রাত পোহালে দশমী। অনেক রাতে শিবানীকে ছাড়াই 'চতুরাশ্রম' এর বৃদ্ধ বৃদ্ধারা ফিরে আসে। বিধ্বস্ত বনলতা ঘরের মধ্যে ঢুকে খাটের উপরে ধপ করে বসে পড়ে। চোখ চলে যায় বালিশের পাশে রাখা পাঁজির দিকে, শিবানীর দেওয়া বন্ধ খামটি তখনো পাঁজির মধ্য থেকে আলতো উঁকি দিয়ে আছে। বনলতা ভয়ে ভয়ে পাঁজির ভেতর থেকে বন্ধ খামটা বের করে। কিন্তু, কথা তো ছিল...! শিবানী কি আর ফিরবে না কোনোদিন? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ ই খামটিকে ছিঁড়ে ফেলে বনলতা। বড় বড় অক্ষরে লেখা ধবধবে সাদা কাগজটি এক লহমায় বেরিয়ে আসে তার চোখের সামনে। "মা দশমীতে বাড়ী ফিরেছে। আমিও ফিরে যাচ্ছি আমার 'ঘরে'।" বনলতা, নাগাড়ে পড়ে যায়।
"জানি আমার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ হবে না। তবু শেষ ইচ্ছার কথা এখানে ব্যক্ত করে যাই।" উত্তেজনায় দমবন্ধ হয়ে আসে বনলতার। "আমার ছেলে নয়, আমার নাতিই যেন আমার মুখাগ্নি করে। যার মুখ আমি এখনো দেখি নি। সবাই ভালো থেকো।" তবে কি... বনলতা, সবার অলক্ষ্যে তার 'ঘরে ফেরার ঘরে' ফিরে গেল? ওখানে শিবানী গেছে কিনা কেউ কি খোঁজ নিয়েছে? "প্রবীর... প্রবীর..!" উদ্বিগ্ন বনলতা, ম্যানেজার কে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
পরের দিন দুপুরেই ছেলে, বৌমা, নাতি শহরে ফিরে আসে। বিমান বন্দর থেকে গাড়ী করে আসার পথে- অনেক গুলো প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা পেরিয়ে আসতে হয় তাদের। গঙ্গার ঘাটে ঘাটে মাকে বিসর্জন দেওয়া চলছে। ডুবে যাচ্ছে মায়ের চালচিত্র, হাত, পা, বুক, মুখ ...! ক্রমশ... হারিয়ে যাচ্ছে মায়ের স্মৃতি।
থেকে থেকে স্লোগান উঠছে - আসছে বছর আবার হবে। বছর বছর এগিয়ে যাবে।
সমাপ্ত
----_______--------------------------------_____________________-------------------------------_____

নৈঃশব্দ্য
বিকেল ৪ টে ৪৫ এর ট্রেন ছেড়ে গেল, হর্ন দিয়ে। অবিনাশ দোতলার জানালা দিয়ে ট্রেন ঢুকছে দেখেই বারান্দায় খানিক উদ্বিগ্ন পায়চারী করতে লেগে গেলেন। ট্রেন লাইন বরাবর - নাতি প্রশস্ত একটি পিচ রাস্তা চলে গেছে বাদলপুরের দিকে। রাস্তার পাশ ধরে ঝিল - তাতে জল কম, পানা ভর্তি। যতটুকু জল দেখা যায়, তাও ঝিম কালো। ঝিলের পাড়ে অবিনাশের বাড়ি। দোতলা। পশ্চিম মুখো - ব্যলকনি বার করা। বেডরুমের জানালা দিয়ে ট্রেনের যাওয়া আসা বিলক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা যায় একেবারে সিগন্যাল অপারেটরদের মতন। অবিনাশ যদিও স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ডাউনের দুটি স্টেশন পরেই, বাদলপুরে উনার স্কুল ছিল। ইতিমধ্যে মেঘের ঘন ছায়া এসে পড়েছিল ঘরের মধ্যে। অপরাহ্নের রোদ্দুর, রোজই অবিনাশের জানালা দিয়ে তার দ্রুত অস্তমিত হওয়ার বার্তা দিতে আসে একটু অভিমানের রং গায়ে মেখে। অবিনাশ, বিছানায় বসে রোদ পাহারা দেন, ঠায় সে দিকে চেয়ে থেকে যতক্ষণ না সন্ধ্যার অন্ধকার এসে ঢোকে তার ঘরে। সন্ধ্যা নামলে, ঘরের আলো জ্বালান এবং তারপরে লিখতে বসেন। ইতিমধ্যে, গুম গুম করে মেঘের আওয়াজ হওয়া শুরু হয়। হয়তো বৃষ্টি নামবে এখুনি। বাইরের বাগানে, বাতাবী লেবুর গাছটায় ঝুরঝুর করে দামাল হাওয়া ঢুকে পড়ে, এক প্রস্থ। সেদিকে অবশ্য কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই অবিনাশের। আজ তার মনটা দুপুর থেকে ভারী উচাটন হয়ে আছে। মেয়ে আসার কথা; হোয়াটসআপ মেসেজে লিখে পাঠিয়েছিল সকালবেলায়। বাগানের উত্তর-পশ্চিম কোনে, পাঁচিলের গা ঘেঁষে একটা পুরনো চালতা গাছ রয়েছে, তার পাশে রয়েছে একটা নাতিউচ্চ, আমলকি। আমলকির চিকন পাতায়, এর মধ্যে বড় বড় দানা বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু হয়ে গেছে, যদিও তাতে কোনো অনুরণন তৈরি হয় না পার্থিব শব্দময়তায়। বিশেষ কিছু কারণে ওই দিকে না তাকালে আমলকি পাতার এই রোমান্টিক জলকেলির দৃশ্য চোখের আড়ালেই থেকে যায়। কিন্তু চালতা গাছের ঢালু ঢালু পাতাগুলি প্রায় ডিঙ্গি নৌকার মত লম্বাটে; তার উপরে আবার পাতাগুলির পৃষ্ঠদেশ ঈষৎ কাষ্ঠল হওয়ার দরুন পড়ন্ত বৃষ্টির ফোঁটায় বেশ একটা উদ্ভট আওয়াজ বের হতে শুরু করেছে, ইতিমধ্যে। ঢপ, ঢপ, ঢপ ……… একেবারে মুখর হয়ে উঠেছে, চারদিক। অবিনাশ নির্বিকার মগ্নতায় বারান্দায় পায়চারী করেই যেতে থাকেন মেঝের দিকে ঝুঁকে। “মেয়েটা নিশ্চিত, এই ট্রেনটায় আসে নি!" "ট্রেন থেকে নেমে কতক্ষন আর লাগে, ঝিল মোড় ঘুরে বড়জোর তিন থেকে চার মিনিট!" মনে মনে নানা কাটাছেঁড়া করতে থাকেন অবিনাশ। "পই পই করে মেসেজে লিখে দিলাম ট্রেনটা ধরতে, শুনলো না!" "পরের ট্রেন, একঘন্টা পরে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে ততক্ষণে।" "সঙ্গে তার মেয়েটারও আসার কথা।“ চিন্তায়, অবিনাশের কপালের ভাঁজ আরও সুবিন্যস্ত হয়; বাইরে অবশ্য ততক্ষণে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে। রেলিং এর বাইরের দড়িতে ঝোলা অবিনাশের লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি সব নিঃসাড়ে ভিজে যেতে থাকে। মণির মা, দুপুরেবেলায় এসে কেচে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছিল ওগুলো। চারদিকে, এখন শুধু বৃষ্টির কলকল ধ্বনি। মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। অবিনাশ অবশ্য সেসব কিছু দেখছেন না।
ধ্যান ভাঙলো, হঠাৎ হাওয়ায় উচ্ছাসে রেলিং ছাপিয়ে ধেয়ে আসা - এক ঝাঁক ঠাণ্ডা বৃষ্টির তির গায়ে এসে বিঁধতেই! শিহরিত হয়ে এইপ্রথম বাইরের দিকে তাকালেন, অবিনাশ। “আরে…।।!” এর মধ্যে ঝক ঝক করে বিদ্যুতের আলো এসে পড়ে আবিনাশের চোখে। চোখ ধাধিয়ে যায় তার। দড়াম করে বাজ পড়ার আওয়াজ আসে তারপরেই, কিন্তু অবিনাশ ঠায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন রেলিং ধরে, প্রকাণ্ড শব্দে সার্সির কাঁচ ঝনঝন করে ওঠে, যেন ভেঙে পড়বে। অবিনাশ, নির্বিকার। একমাত্র দক্ষিণের ঢ্যাঙ্গা নারকেল গাছটির ডগায় আগুন ধরা দেখতে পেয়েই ভয়ে কেমন সিটিয়ে পড়েন, অবিনাশ। বাইরে জামা কাপড় গুলি থেকে তখন টুপিয়ে জল ঝরা শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে, ভেজা জামাকাপড় গুলোকে শেষমেশ বারান্দার মেঝেতে টেনে নামিয়ে ফেলেন। "কতক্ষন বৃষ্টি চলছে, কে জানে...!'
“লেখার টেবিলের পাশে জানালাটা তো খোলাই আছে এখনও?” মনে পড়তেই দ্রুত ঢুকলেন ঘরের মধ্যে। এর মধ্যে কখন যে বাদল হাওয়ায় নিজে থেকেই জানালার পাল্লাগুলি বন্ধ হয়ে গেছে! তবু ভালো, টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বই, কাগজ সব সুরক্ষিতই আছে। 'অমলতাস' পত্রিকার পুজো সংখ্যার জন্য উপন্যাস লেখা শুরু করেছে, এখনো সম্পূর্ণ হয় নি। আরোও কয়েকটা পর্ব লেখা বাকি আছে। উপন্যাসের নাম ' নৈঃশব্দ্য'
খানিক ধাতস্থ হয়ে, অবিনাশ আলোর সুইচটা জ্বালিয়ে দেন। কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগছিল ঘরের মধ্যেটা। এতক্ষণে অবিনাশ বুঝতে পেরেছেন, কেন তার মেয়ে এখনও পৌঁছায় নি। "নিশ্চিত, বৃষ্টিতে কোথাও আটকে পড়েছে। কোনো দোকান টোকান বা কারুর বাড়ির বারান্দার নীচে।"
টেবিলের ওপরে রাখা ফোনটার দিকে তাকান, ভাবেন মেয়েকে মেসেজ করবেন কি না। হঠাৎ ফোনটার স্ক্রীন আলোকিত হয়ে উঠতেই, অবিনাশ ঝুঁকে দেখেন আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসছে।
পুরো রিং হয়ে কেটে যায়, আবার ফোন আসে। একই নাম্বার থেকে। আবার...! এই নিয়ে তৃতীয় বার। বাধ্য হয়ে ফোনটা ধরেই ফেলেন। "হ্যালো!" "আপনি কি লেখক অবিনাশ মজুমদার?" "হ্যালো!"
"হ্যালো" অবিনাশ, ফোনটাকে রেখে দিতে যান টেবিলে।
"কথা বলুন, আমি সাহিত্য একাডেমী থেকে বলছি..!" "রং নাম্বার!" বলে অবিনাশ এবার ফোন কেটে দেন।
___----______________------------------------____________________________-------------

বৃষ্টিটা এবার ধীরে, ধীরে কমতে শুরু করেছে।
শেষ বেলার আলো পেতে, অবিনাশ পশ্চিমের বারান্দায় এসে দাঁড়ান। আরসা দিয়ে গড়িয়ে পড়া অনর্গল ধারাপাত এখন ফোঁটায়, ফোঁটায় বিচ্ছিন্ন হয়ে টপকাচ্ছে নিচের নয়নতারা আর জুঁই গাছগুলির ওপর।
ঝিলের জলের দিকে তাকিয়ে, অবিনাশ বরষার গতি মাপার চেষ্টা করেন। ঝিলের জলে তখনও - বিড়বিড় করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে।
কচুরিপানার সবুজ পাতা গুলোও থিরথির করে কেঁপে যাচ্ছে সমানে। বারান্দায় থেকে, থেকে ভেজা বাতাস ঢুকে পড়ছে, এলোমেলো ভাবে।
দক্ষিনের বাতাসে ভেসে আসা ধোঁয়া পোড়া গন্ধ নাকে লাগতেই, অবিনাশ ঘাড় বেঁকিয়ে তাকান সেদিকে। বাজ পড়া নারকেল গাছটির ডগায় তখনও ধিকধিক করে আগুন জ্বলছে। অবিনাশের চিন্তা হয়। “মেয়েটা কি ছাতাও নিয়ে বেরোয় নি!” আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে, অবিনাশ রাস্তার দিকে চোখ ফেরান। “বৃষ্টি কমে গেছে, অথচ ... এখনও এসে পৌঁছাচ্ছে না!”
এর মধ্যে কিছু পথচারী বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। ছাতা মাথায়, ছাতা ছাড়াও দু একজন স্টেশনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে হন্তদন্ত হয়ে। কয়েকজন আবার জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে মনে হয় – কিছু একটা বলছে ওর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সে সবই নিরর্থক। কারণ অদ্ভুত এক কাঁচের স্বর্গে ইদানীং বাস করছেন, অবিনাশ।
আলগোছে, বাঁ হাতের মুঠোর মধ্যেই ধরা ছিল তাঁর মোবাইল ফোন টা। মনে, মনে কিছু একটা ভাবতেও শুরু করেছিলেন বোধহয়....হঠাৎ ফোনটা কেঁপে উঠতেই, দ্রুত অন করে দেখেন মেয়ের টেক্সট মেসেজ। “বাবা, দারুন খবর আছে। গিয়েই বলছি, সব। বৃষ্টিতে আটকে ছিলাম। ‘মৌবন’ থেকে মিষ্টি নিচ্ছি, যতক্ষণ লাগে...। নিয়েই আসছি।“
মেসেজ পড়ে ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে বাঁকা হাঁসি খেলে যায়, অবিনাশের। “যত, আদিখ্যাতা!”
এদিকে - ভারী এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরে, ঝিল থেকে ওঠা উজানের কই মাছ ধরেতে রাস্তার কিনারে ভেজা মাটির দিকে প্রায় শকুনের দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঝিল পাড়ের মুদি দোকানী নীরেন। অবিনাশের বেশ মজা লাগে, নীরেনের কান্ডকারখানা দেখে। মাছ দেখলেই সটান হাঁটু মুড়ে বসে পড়ছে আর তারপরেই বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনী দিয়ে মাছের মাথাটাকে শক্ত করে চেপে ধরে সোজা লুঙ্গির কোঁচড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দিচ্ছে। নির্বাক ছায়াছবির মতই অবিনাশের চোখের সামনে সব অভিনীত হয়ে চলে একের পর এক।
“কটা, হোল?” অবিনাশ এবার হাঁক পেড়ে জিজ্ঞাসা করেন নীরেন কে। নীরেন এক গাল হেঁসে, মুখ নেড়ে কিছু একটা বলে। তারপরেই আবার কি ভেবে, হাতের ঈশারায় চারটে আঙ্গুলকে উঁচু করে ধরে নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখাতে থাকে অবিনাশকে। অবিনাশ, নীরেনের দিকে তাকিয়ে সদর্থক মাথা নাড়ে ওপরে নীচে।
“কি যে করছে মেয়েটা, এত দেরী ... হচ্ছে,” অস্থিরতা কাটাতে পারেন না, অবিনাশ। উদ্বিগ্ন হয়ে, ঝিল পাড়ের রাস্তায় - দূর .... পর্যন্ত চোখ ফেলে দেখেন মেয়ে আসছে কিনা। আপের একটা ট্রেন চলে যায়, রামনগরের দিকে। ট্রেনের মাথায় ঘন মেঘের সঞ্চার দেখে, অবিনাশের অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু কি আর করার, শুধু, শুধু ... ! অগত্যা! অবিনাশ, মোবাইলের ডেটা অন করে দেখেন হোয়াটসআপে কিছু আপডেট আছে কিনা। “এল এন ডায়াগনস্টিক থেকে... কি পাঠিয়েছে, রিপোর্ট নয়তো? দেখি তো!” ডাবল ক্লিক করতেই দুটো রিপোর্ট ডাঊনলোড হতে শুরু করে। ই ই জি রিপোর্টের শেষে লেখা দু লাইনে গিয়ে চোখ আটকে যায় অবিনাশের। Eighth cranial nerve (Auditory nerve) damaged permanently. “মানে…। অষ্টম
ক্রেনিয়াল নার্ভ, চিরকালের মত …!!“ “আঃ!’ গোঙানির মত একটা অভি দৈত্যাকার শব্দ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায় অবিনাশের মুখ থেকে। “হা ভগবান, শেষে সেই চির বধিরতার দেশে…, যেখানে শব্দ গুলো শুধু বেঁচে থাকবে লেখা অক্ষরে…!।“ রেলিং বেয়ে ওঠা মাধবীলতার ঝুমকো ঝুমকো ফুলের গন্ধে তখন চতুর্দিক ম ম করছে। অবিনাশ মেলাতে পারেন না। শুধু বুঝতে পারেন, তাঁর মনের মতো সন্ধ্যার ছায়াও ধীরে, ধীরে তার ডানা প্রসারিত করে চলেছে ঘরের চারপাশে। হঠাৎ রেলিঙের একপাশে ঝুলে থাকা মাধবীলতার বনে খানিক হাওয়ার বিক্ষেপ লক্ষ করে অবিনাশের কেন জানি মনে হয় বোবা মাধবীলতার মর্মে বুঝি কোনো ভাবে প্রবেশ করেছে তার এই মর্ম বিদারী হাহাকার।
“আঃ, ছাড়! ছাড়…!” এরমধ্যে কখন যে তার মেয়ে এসে পড়েছে। পেছন থেকে ছোট্ট নাতনিটি তাকে একেবারে জাপটে ধরে দাঁড়িয়ে আছে... "না ছাড়বো না, তোমাকে!" “দাদাই, তুমি কত্ত ... বড় লেখক না!” "আমাকে কিন্তু একটা বড়... ক্যাডবেরি দিতে হবে তোমায়!"
"আরে ছাড়, ছাড় ..." অবিনাশের কন্ঠায় অকৃত্রিম আদরের ছোঁয়া। পেছন ফিরে দেখেন, মেয়ে একগাল হাঁসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । “কি রে এত দেরী হোল তোর আসতে?” “এই তো…।!” মিষ্টির প্যাকেটটাকে পাশের টেবিলে রেখেই টিপ করে অবিনাশের পায়ে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে নীতা। “দাদাই কে প্রণাম কর, নিষ্ঠা!” অবিনাশ নাতনিকে কাছে টেনে তার কপালে চুমু দিয়ে দেন। এদিকে নীতার যেন আর তর সয় না। একেবারে বাঁধ ভাঙা জলের মতো কলকল করে বলাতে শুরু করে দেয়...!!
“জানো বাবা, ট্রেনে আসতে আসতে…।। এই মোবাইল খুলে একটু খবরের চ্যানেল গুলো দেখছিলাম আর কি,” “জেনে যে আমার কি আনন্দ হচ্ছে না বাবা, তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।“ অবিনাশ দেখছে- মেয়ে হাত মুখ নেড়ে কত কথা বলে যাচ্ছে। তার কাছে এসব নৈঃশব্দ্যের প্রগলভতা ছাড়া কিছুই মনে হয় না।
“জানো, সব চ্যানেল গুলোতেই দেখাচ্ছে…।।“! "ওহ্! দারুন... একেবারে...!"
অবিনাশ এবার মেয়েকে হাত নেড়ে থামতে বলেন, তারপরে ঈশারায় যা বলার লিখে বলতে বলেন। হঠাৎ মনে পড়ে যায় নীতার সে কথা! তার খেয়ালই ছিল না যে...! মুহূর্তে তার মুখটা শুকিয়ে একেবারে আমসি হয়ে যায়। অবিনাশ ঘরের মধ্যে ঢুকে লেখার টেবিল থেকে একটা কাগজ ও কলম নিয়ে এসে মেয়ের হাতে দেন।
বারান্দায়, সন্ধ্যার অন্ধকার বেশ জাঁকিয়ে ঢুকে পড়েছে এখন। লাইট অন করে দেন অবিনাশ। মেয়ের হাতে ধরা কাগজটিকে এবার চোখের সামনে তুলে ধরে, ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করেন। “তোমার ‘কাঁচের স্বর্গ’ উপন্যসের জন্য তুমি এবারে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পাচ্ছ বাবা!”
পড়া শেষ করে নির্বিকার অবিনাশ স্বগতোক্তির মতো বলে চলেন, "বেঁচে থাকতে তোর মা প্রায়ই বলতো, দেখো কোন না কোন দিন তুমি এই উপন্যাসের জন্য বড় পুরষ্কার পাবেই পাবে ।“
"এক মাস আগে যদি এই খবরটা আসতো……।!”
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
রবিবারের পরমানু গল্প!
শরত এসেছিস?
"কি রে কথা বলছিস না যে বড়!"
দীঘির জলে তখন রোদ আর মেঘের মিছিল। তার সাথে জুড়েছে উড়ো হাওয়ার উস্কানি।
শরত বিস্মিত হয়ে সে দিকেই তাকিয়ে থাকে।
অভিমানে তার বুকে ওঠা ঢেউ আর দীঘির জলে ওঠা হাওয়ার স্রোতের মধ্যে মিল খুঁজে পায় সে।
এদিকে পাড়ের তাল গাছগুলি অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জল মাপতে থাকে। মাঝে মাঝে হাওয়ার ধাক্কায় তাদের পুরু পাতার কন্ঠস্বরে অদ্ভুত খড়খড়ে ধ্বনি যেন কারোর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে বলে মনে হয় শরতের!
"ক দিন বারিদটা যা জ্বালালো আমায়!" প্রকৃতি, কাকে বলছে এসব? নাকি স্বগতোক্তি করছে? কে জ্বালালো প্রকৃতি কে? শরত লুকিয়ে লুকিয়ে - কান খাড়া করে শোনে, প্রকৃতির কথা।
"অমন হোমদা, কালো, লোমশ ভারী শরীর তার! তার উপরে উঠতে বসতে চুমুর বর্ষা। কখনো টিপ টিপ, কখনো আবার দারুন জোরে, একেবারে মুষলধারে।"
"সে কি!"
কিন্তু সব শুনেও সে চুপচাপ থাকে। কোনো কথা বলে না। সে আজ প্রকৃতিকে বড় সারপ্রাইজ দিতে চায়। প্রকৃতি যদি চলে ডালায় তবে শরতও চলে পাতায়।
অনেক দিন পরে আকাশ কে আজ দেখা যাচ্ছে একেবারে নীল রাজপুত্তুর সেজে নাইতে নেমেছে দীঘির জলে। তুলোর মতো নরম, শুভ্র রাজকীয় তার দেহ সজ্জা একেবারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জলের স্বচ্ছ আয়নায়!
এর মধ্যে আবার আকাশের বাতিঘর থেকে এসে পড়েছে চড়া আলোর বেআব্রু করা ফোকাস, আর তাতেই একেবারে অগ্নি শর্মা হয়ে উঠছে তাল গাছ গুলির মুখ ; পরক্ষণেই আবার ছায়া ধূসরতায় ঝিম ধরা সবুজের প্রলেপ লাগছে চোখে, যেন কত রহস্যময়।
আসলে সারি সারি তাল গাছ গুলি যেন চারদিক খোলা প্রেক্ষাগৃহের যবনিকা, বেশ ঝুলে আছে দিগন্তের সিলিং থেকে। রোদ ছায়ার প্রক্ষেপণে প্রতিনিয়ত সেখানে চলছে রঙের পরিবর্তন; তার থেকে নজর যেন সরতেই চাইছে না শরতের।
আরোও দূরে - সুপারি বাগান ছাড়িয়ে, ঠা - ঠা বিলের মাঝে ফুটে থাকা - গুচ্ছের কাশ ফুলের পালে তখন উদোম লুটোপুটি খেলছে হাওয়া।
প্রকৃতি এবার উঠে দাঁড়ায়। তার শরীরে বর্ষা উত্তর ভরা যৌবনের ঢল, অনেকটা দীঘির জলের মতন। তার নিঃশ্বাসে শিউলি ফুলের সুবাস। গলায় পদ্ম হার। হাতে ধরা লাল শাপলার রেকাবির মতো গোল হরিৎ পত্র। তাতে একগুচ্ছ শিশির ধোয়া ফুলরাজি।
"কিন্তু শরত, শরত কোথায়!"
উদ্বেলিত প্রকৃতি আবারও ডেকে ওঠে, "শরত এসেছিস!"
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
অজয়, রণিতা - কথা বলতে বলতে ফিরছিলো বাজার থেকে। মফস্বল শহর, সরু রাস্তা তায় দুপাশের দোকানের সামনে রাখা সাইকেল - বাইকে উপছে পড়ছে রাস্তা। পথচারীদের - সাইকেল, রিক্সা, ছোট গাড়ি বাঁচিয়ে হেঁটে যাওয়া প্রায় প্রতিবন্ধক দৌড়ের মতনই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কোথাও কোথাও আবার ফুচকা, মশলা মুড়ির ঠ্যালা ঘিরে ছোট ছোট জটলা। দুজনের দুহাতেই ছোট ছোট পলিথিনের ব্যাগ।
বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ভ্যাপসা গরম ভাবটা একটু কমেছে। এখন পড়ন্ত বেলায় মিইয়ে আসা মেঘলা রোদ, বাড়ির ছাদ গুলোকে কেমন যেন মায়াময় করে রেখেছে। বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকের গলির মুখে একটা ভাঙা ইউরিনাল। রণিতা নাকে ওড়না চাপা দিয়ে অজয়কে তাড়া দেয়, " একটু পা চালিয়ে হাঁটো।"
আজকে ২৩শে আগস্ট। তাদের বিবাহের তিন বছর পূর্ণ হোল। দুজনের খুব কাছের বন্ধু বান্ধব মিলে জনা চার পাঁচ কে নেমন্তন্ন করেছে এই উপলক্ষে।
দু- কামরার ভাড়া বাড়িতে কত জনকেই বা ডাকা যায়। এ পাড়ায় সবার নিজস্ব বাড়ি। ভাড়াটে বলতে ওরাই। দাদার অমতে বিয়ে করার ফল - বউকে নিয়ে ঘর ছাড়তে হয়েছে। কিছু দিন এ বন্ধু, ওই বন্ধুর বাড়ি করে অজয় যখন হন্যে হয়ে একটি স্থায়ী মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছিলো, তারই অফিসের কলিগ গৌতম তাদের বিশাল বাড়ির দোতলার দুটো ঘর এবং বাইরে বারান্দা সমেত ওদের থাকার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলো। সেই থেকেই এখানে।
গৌতমের বাবা কিছু দিন হলো প্রয়াত হয়েছেন। গৌতম একমাত্র ছেলে। অজয়কে গৌতমের মা প্রায় নিজের ছেলের মতোই দেখেন।
সন্ধ্যার অন্ধকার, শহরের গলিগুলোকে আগেই ঢেকে ফেলে। রাস্তার আলোগুলো তখনো জ্বলেনি। খানা খন্দের জল কাদায় রণিতার শালোয়ারের পা দুটো একেবারে নোংরা হয়ে গেছে। বিরক্তিতে তার গা রি রি করে ওঠে, "জঘন্য!"
বাইরের গেট খুলে ঢুকতে গিয়ে - দোতলায় অন্ধকার দেখে অবাক হয়ে যায় অজয়। "কি ব্যাপার, তোমার মা কি ঘুমিয়ে আছেন নাকি? কোনো আলো-টালো দেখছিনা!" রণিতাকে -কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে অজয়।
রণিতা হাতের ব্যাগ দুটো সামলে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। অজয় নীচ থেকে সিঁড়ির লাইটটা জ্বেলে দেয়। সিঁড়ির বাঁ দিকের ছোট্ট ঘরটায় থাকে গৌতমের মা। আধখোলা দরজার মধ্যে দিয়ে ঘরের ভেতরটা কেমন আবছায়া, ভুতুড়ে লাগে। তার মধ্যে আবার থেকে থেকে খুব কষ্ট করে শ্বাস টানার শব্দ - যেন কত রহস্য লুকিয়ে আছে ঘরটির মধ্যে। অজয় দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে মাসীমা বলে ডাকে। কোনো সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকে মোবাইলের আলোয় লাইটের সুইচটা খুঁজতে থাকে। বুঝতে পারে বিকেলে বৃষ্টির পরে যে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে তাতে গৌতমের মা'র শ্বাসকষ্টটা আবার বেড়েছে। ক্রনিক অ্যাজমার রোগী। গতবার তো রাত্রি দুটোর সময় হাসপাতালে ছুটতে হয়েছিলো। পরে ডাঃ চ্যাটার্জি কে দেখিয়ে তাঁর পরামর্শ মতো একটা নেবুলাইজার কিনে ঘরে রেখেছে গৌতম। যখন যেমন লাগে দিলে কষ্টের লাঘব হয়।
লাইট জ্বালতেই দেখে খাটের ওপর সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁপাচ্ছেন মাসীমা।
"ওগো শুনছো?" দোতলার বারান্দা থেকে রণিতার ত্রস্ত ডাকে অজয় কোনো সাড়া দেয় না।
ঘরটার মধ্যে কেমন গুমোট ভাব। অজয় আস্তে করে ফ্যানটা ছাড়ে। পাখার হাওয়ায় দেওয়ালে টাঙানো কবেকার মা দুর্গার ক্যালেন্ডারটি হঠাৎ ই যেন নড়ে ওঠে এবং তারপরেই ফট্ ফট্ শব্দে বার বার দেওয়ালে উড়ে উড়ে আঘাত করতে থাকে।
"কি হোল! আরে তুমি কোথায় গেলে?" রণিতা আবার ডাক পাড়ে, এবারে একটু রাগত স্বরে।
এদিকে ঘরে কেউ এসেছে বুঝতে পেরে গৌতমের মা ততক্ষণে ফোঁপাতে শুরু করেছে।
গৌতমের অফিস থেকে ফিরতে দেরী আছে। ঘাড়ে মোবাইলটাকে গুঁজে গৌতমকে কল করতে করতে অজয় সন্ধানী দৃষ্টিতে ইতিউতি চোখ বোলায় - নেবুলাইজারটি যদি নজরে পড়ে।
"কতক্ষন থেকে ডাকছি তোমায়....!" রণিতা জোরে জোরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ডাকতে থাকে। "কোথায় গেলে, তুমি?"
"হ্যাঁ, অজয় বল্," কয়েকবার রিং হওয়ার পর গৌতম ফোন ধরে। "শোন না, গৌতম...!"
"আরে তোরা রেডি হ না, আমি ঠিক পৌঁছে যাবো।" গৌতম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, অজয় তাকে থামিয়ে দেয়। "সে ঠিক আছে। আমি সেটা বলছি না।" "মাসীমার ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখনিই নেবুলাইজার দিতে লাগবে।"
"ওহ্!" "লিলি কোথায়? লিলি নেই?" গৌতমের গলায় স্পষ্টতই উদ্বেগের চিখ।
লিলি গৌতমের বউ, প্রতিদিন বিকেলে তার জিমে যাওয়া চাই। আজও তার ব্যত্যয় হয়নি। গৌতমের ফোনটা কেটে যায়।
এদিকে রণিতা প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঘরে ঢোকে। "তুমি এখানে! কখন থেকে ডাকছি ...!"
"কি হয়েছে? এত টেনশড লাগছে কেন তোমাকে!" "কি হয়েছে?"
দ্বিতীয় পর্ব
"মা, পড়ে গেছে!" "অ্যাঁ?" রণিতার কথা শুনে অজয় হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। "কি করে? কোথায়?"
'বৃষ্টি শুরু হতে তাড়াতাড়ি করে ছাদে উঠতে গিয়েছিল, জামা কাপড় গুলো তো সব ছাদে মেলা ছিল ..!"
"হ্যাঁ, তারপরে?' "তারপরে কি হোল?" " তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে.., কি .. আর কপালে কষ্ট থাকলে যা হয়...! চিলেকোঠার গোড়ায় রাখা ইঁটে হোঁচট খেয়ে সটান মেঝেতে ..!" "এই রে..! কি সর্বনাশ!"
"এখন হাঁটু ফুলে ..., ভীষণ ব্যথা। একদম হাঁটতে পারছে না।"
"যাও না, তুমি একটু ফার্মেসি থেকে ঔষধ মলম টলম নিয়ে এসো!"
অজয় কি করবে বুঝতে পারে না।
রণিতা এখনোও জামা কাপড় ছাড়ে নি। মাথার অবিন্যস্ত চুল গুলো কপাল বেয়ে তার গালের ওপর এসে পড়েছে। বুকের খোলা জায়গায় বিন্দু বিন্দু ঘাম - সি এফ এল লাইটের রূপোলী আলোয় লবনাক্ত বালির মতো চিক চিক করছে।
এদিকে গৌতমের বউ ও একঘর! এখনোও এসে পৌঁছাল না। পাড়ারই এক জিমে যায়। বেশি দূরে নয়। গৌতমরা যে ঘরটায় থাকে সেটাও আবার তালা মারা।
হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতে, অজয় দেখে গৌতম কল করছে। "আমি লিলিকে ফোন করেছি। নেবুলাইজারটা আমাদের ঘরেই আছে।" "লিলি আসলে ...!"
"ও চলে গেল কি করে। এইভাবে অসুস্থ শাশুড়িকে একা বাড়িতে ফেলে... নিজের মা হলে পারতো?"ঝোঁকের মাথায়, অজয় কথাগুলো বলেই দেয় গৌতম কে।
হঠাৎ গেট ঠেলে, রাগত ভঙ্গিতে প্রায় আহত সিংহীর মতো গট গট করে লিলিকে ঢুকতে দেখে গৌতমের ফোনটা কেটে দেয় অজয়। দামী স্নিকারের সপাং সপাং আওয়াজ যেন এক একটা তীব্র কশাঘাত। "কতবার বলেছি বুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে। কোনো কিছুতেই সুখ নেই। জীবনটা একেবারে নরক করে ছেড়েছে!" রাগে গরগর করতে করতে নিজের ঘরের তালা খুলতে থাকে লিলি।
সিঁড়ির তলার ঘরে অসহায় মাসীমা তখন নেহাতই অক্ষম্য অপরাধীর মতো বসে ধুঁকতে থাকেন।
কষ্ট করে শ্বাস নিতেও যেন তার বড় বাধে।
রণিতা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। লিলি এসে যেতেই অজয়কে তাড়া দেয়। "কি গো যাও..!"
অজয় কথা না বলে বেরিয়ে যায়। গলির সন্ধ্যাবাতি গুলো ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে। পথে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট ছায়া গুলি মাড়িয়ে যেতে যেতে পুরনো অনেক কথাই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে অজয়ের। মায়ের আত্মহত্যা..! ওফ্! অজয়ের মাথাটা মুহূর্তে দপ করে ওঠে। " দাদা, একটু সাইড করে হাঁটুন," পাশ দিয়ে বেল দিতে দিতে এক সাইকেল আরোহীর কথায় ইতস্তত অজয় রাস্তার ধার ঘেঁষে হাঁটতে থাকে।
তবু রণিতাই একমাত্র যে তার পাশে এসে দাঁড়ালো।
রণিতাকে অজয় পড়াতো। ছোটবেলায় তার বাবা মারা যাওয়ায় দাদা -বৌদির সংসারে লাঞ্ছনা গঞ্জনা খেয়েই বেড়ে ওঠা রণিতার। তাই কিই বা করার ছিল তার। একমাত্র, মা সেও অসহায়। নিজেই পরন্নভোগী, তাই বলার কিছু জো ছিল না।
হঠাৎ গৌতমের মেয়ের, "কাকু কোথায় যাচ্ছ!" ডাক শুনে ঈষৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অজয়। "এই তো, একটু ঔষধের দোকানে যাচ্ছি," বলে অজয় পা চালায়। গৌতমের মেয়ে, এষা বুঝি নাচের ক্লাস থেকে ফিরছে।
আর একটু এগিয়ে বা দিকটাতে ঘুরলেই কৃষ্ণ মন্দির, তার পরেই বড় রাস্তা। মন্দিরে কৃষ্ণ নাম হচ্ছে এখন। এই মন্দিরেই তাদের বিয়ে হয়েছিল। মনে আছে রণিতাকে যেদিন ও প্রোপোজ করেছিল, রণিতা একেবারেই অবাক হয়নি। যেন আগে থেকে সবকিছুই সে জানতো। সটান রাজি হয়ে যায় সে। শুধু একটা শর্ত তার বৃদ্ধা মাকে সে দাদার সংসারে ফেলে আসতে পারবে না। তার কাছেই নিয়ে রাখবে। অজয় না করে না।
সকলে এসে পড়েছে। রণিতা শহরের নামী রেস্তোরাঁ 'কলি' থেকে স্পেশাল বানিয়ে নিয়ে আসা বিরিয়ানিটা একটু গরম করে সবার প্লেটে প্লেটে সার্ভ করতে থাকে।
তৃতীয় পর্ব
গৌতম একটা প্লেট টেনে খেতে খেতে বলে, "যাক, মা এখন একটু ভালো আছে। একটু ঘুমোচ্ছে।"
"তোর শাশুড়ি এখন কেমন আছেন, অজয়?" গৌতমের প্রশ্নে অজয় স্বস্তির হাসি হেসে ছোট্ট করে বলে, "ভালো!"
"এই তো মাকে খাইয়ে ব্যথার ওষুধ দিয়ে এলাম। শুতে যাওয়ার আগে একটু অ্যানালজেসিক জেল লাগিয়ে দেবো ক্ষণ.," বলতে, বলতে রণিতা স্যালাডের প্লেটটাকে ঈষৎ ঠেলে প্রাণেশের দিকে এগিয়ে দেয়। গৌতম এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল। রণিতার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আবার খাওয়া শুরু করে।
"তা যাই হোক, তিন বছর তো হোল, ঘুরে বেড়ানো। এবার একটা নিয়ে ফেলো," প্রাণেশ কথাগুলো বলেই রণিতার দিকে তাকায়। তার পুরু ঠোঁট বেয়ে দুষ্টু হাঁসির চোরা স্রোত - উপছে পড়তে চায়।
উত্তরে রণিতা শুধু মুচকি হাসে।
অজয় আজ রণিতার পছন্দ করা হলুদ রঙের পাঞ্জাবিটা পরে ছিলো। শোবার ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছিল সে। কোন্ নতুন ভূমিকায় যে নিজেকে দেখতে চাইছিল সে কে জানে, অনেকক্ষন এপাশ ওপাশ করে ঘুরে, ঘুরে নিজেকেই দেখে যাচ্ছিল একমনে।
সবাই চলে গেছে।
রণিতা সব গুছিয়ে তার মায়ের হাঁটুতে ব্যথার মলম মালিশ করছে। অজয়, রণিতাকে ডাকতে যাচ্ছিলো....., এর মধ্যে রণিতা প্রায় হুড়মুড়িয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকেই তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো, একেবারে আয়নার সামনে। বুকের কাছে ধরা তার দেওয়া উপহারের শাড়িটা। মেরুন রঙের একটি নাইটি পরেছিল রণিতা। তার উপরেই শাড়িটাকে বারবার পেঁচিয়ে পরার চেষ্টা করছিল সে।
অজয়, রণিতাকে একটানে বিছানায় বক্ষলগ্ন করে জড়িয়ে ধরে। রণিতা অস্ফুটে কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে না।
উল্টে একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, "লাইট নেভাবে না?" "লজ্জা টজ্জা বলে তো তোমার কিছুই নেই।"
হঠাৎ নীচের ঘরে শোরগোল শুনে রণিতা খানিক থমকে যায়। পরিষ্কার শোনা যায়, গৌতমের বউ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, "কালকেই তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবে। না হলে আমিই চলে যাবো এখান থেকে।" গৌতম তাকে থামাতে চেষ্টা করে। "আরে রাতটা তো যেতে দাও! কাল ভোরেই যা হোক ব্যবস্থা করবো।"
পাশের ঘরে মাসীমা খুক খুক করে কেশে ওঠেন। বোধহয় ঘুম ভেঙে সব শুনছেন, আর ভাবছেন বধির কেন হলাম না।
অজয়ের মনে এ সব আজ বিশেষ দাগ কাটতে পারে না। সে রণিতাকে আরো কাছে টেনে আনে; তার বুকের মধ্যে ক্রমাগত মুখ ঘষটাতে থাকে।
"কি হোল এমন জীবাশ্মের মতো পড়ে আছো! এরমধ্যেই সব....!"
কপট ধমকির সুরে অজয় রণিতাকে আরো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরতে চায়।
কিন্তু রণিতার মন যেন হঠাৎ ভেঙে যায়। ভালো লাগে না।
অজয়ের হাতের বেষ্টনী মুক্ত হতে চায় সে। পাশ ফিরে শুতে শুতে স্বগতোক্তির মতো করে বলে, "সেই তো এক কালসাপ কে দুধ কলা খাইয়ে পুষতে হবে, বড় করতে হবে...।"
উত্তেজিত অজয়, এক লহমায় যেন নিথর হয়ে যায়। চুপটি করে শুয়ে থাকে। কোনো কথা বলতে পারে না।
সমাপ্ত
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পুজোর জামা!
আটপৌরে শাড়ি পরা এক বয়স্ক মহিলা ঢাকুরিয়া স্টেশনের ২ নং প্লাটফর্মে ওঠার ঠিক মুখটায়, রেল লাইনের ধারে বসে কচু শাক বানিয়ে ছোট ছোট পলিথিনের চিকের মধ্যে ভরে ভরে রাখছিলেন। দাম জিজ্ঞাসা করলে বললেন, "১৫ টাকা, বাবা।" "নিয়ে যা, নারকেল কুরা, ছোলা দিয়ে রাঁধলে আর কিছু লাগবে না। তাই দিয়েই ভাত চলে যাবে।" মহিলা আমার মায়ের বয়সী। তাই মাসী বলে সম্বোধন করে, একটা দেওয়ার কথা বললাম। পয়সা দিয়ে চলে আসছি, পেছনে থেকে বলে উঠলেন, "সাবধানে যাবি, বাবা।" প্রায়ই ছেলেকে স্কুলে দিতে গিয়ে মাসীর কাছ থেকে এটা ওটা নিয়ে আসি। কবে পাঁচ টাকার থানকুনি শাক, কবে আবার দু আঁটি কুলেখাড়া বা এক গোছা হলুদ কুমড়ো ফুল। একটা ছোট প্লাস্টিক পাতিয়ে মাসী তার সমস্ত জিনিস রাখেন তার উপরে। কবে তাতে হয়তো দুটি চালতা থাকে, নস্করদের বাগান থেকে কুড়িয়ে আনা। কবে হয়তো একটা চাল কুমড়ো, ঘরের টালির চালে বেয়ে যাওয়া গাছ থেকে ভেঙে নিয়ে আসেন। বাকি সব শাক-পাতা আগের দিন বিকেলবেলায় আশেপাশের খাল বিল থেকে সংগ্রহ করে রাখেন। পরের দিন ভোরবেলায় নিয়ে আসবেন বলে। তালদী স্টেশনে, ক্যানিং লোকাল ধরেন ভোর পাঁচ টার সময়ে। সঙ্গে থাকে প্লাস্টিকের মধ্যে নেওয়া মুঠো কয়েক শুকনো মুড়ি।
কোনোদিন ট্রেনের আসতে দেরী থাকলে, মাসীর সঙ্গে সুখ দুখের কথাও হয় অনেক সময়। জানতে পারি, শাক সব্জী বিক্রি করেই মাসীর ডিউটি শেষ হয় না। এর পরে আবার ঢাকুরিয়ারই কালী বাড়ি লেনের এক বাবু-বাড়িতে যান রান্না করতে। "মাসে তিন হাজার টাকা করে দেয় ওরা।" মাসী একদিন বলেও দেন আমাকে অকপটে।
দুপুরবেলায় বাড়ি ফিরে, তবে দুটো ভাত পড়ে পেটে। ছোট বউ রান্না করে রাখে।
গ্রীষ্ম কাল যায়, বর্ষা আসে। মাসী তখন তার দোকান পাতেন, প্লাটফর্মের উপরে - কোথাও এক চিলতে পলকা, ছেঁড়া ছাউনির নীচে। এমনি করে একদিন পুজোর খুঁটি পুজো সম্পন্ন হয়ে যায়। মহালয়ার আগে প্যান্ডেলের বাঁশ পোতা হতে থাকে পাড়ায় পাড়ায়। মাসীর কিন্তু রোজনামচার কোনো বদল হয় না। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, "মাসী, পুজোর মধ্যেও আসবেন এখানে?" "হ্যাঁ, বাবা। আমাকে ছাড়া যে বাবুর ঘরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।" "বোনাস দিয়েছে?" "না, এখনো দেয়নি। প্রতিবছরই এইরকম দেরী করে।" বলেই দেখি, আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছেন মাসী। মনে হয় নাতি, নাতনির জন্যে কিছু কিনতে পারছেন না বলে কষ্ট হচ্ছে। "মাসী, ছেলেরা আপনাকে পুজোর কাপড় দিয়েছে তো?" প্রশ্নটা করেই মনে হল, ভুল করে উনার কাটা ঘায়ে বোধহয় নুন ছড়িয়ে দিলাম। উত্তর দিতে গিয়ে, মাসীর গলাটা যেন কেমন কেঁপে উঠল। "বড় ছেলে বানতলায়, চামড়া কারখানায় লেবারের কাজ করে। কিন্তু যতদিন থেকে বড় বউ, গড়িয়ায় বাবুর বাড়িতে কাজে ঢুকেছে, হাতে দুটো পয়সা এসেছে, মাকে আর পাত্তা দেয় না।"
সে কি? ছোট ছেলে?
"তার কাছেই তো থাকি। সে অবশ্য বলেছিল।" তাহলে আর কি।
"না, বাবা। সে বললে কি হবে। আমি না বলে দিয়েছি।"
"তাকে বলেছি, আমাকে দিতে হবে না। তুই বরং তোর মেয়ের হাতে দুটো বালা বানিয়ে দিস।"
"মেয়েটা - বাবা, খালি হাতে ঘুরে বেড়ায়, দেখতে ভালো লাগে না।"
আমি আর জিজ্ঞাসা করতে পারি না, মাসী কেন তার ছেলেকে মেয়ের জন্যে পুজোয় নতুন জামা কিনে দেওয়ার পরিবর্তে বালা গড়িয়ে দিতে বললেন। ঢাকুরিয়া থেকে ফেরার পথে কাপড়ের দোকান গুলিতে যে কত সুন্দর সুন্দর ফ্রক, চুড়িদার ঝোলে, চড়া আলোয় কত ঝলমল করে। তার নাতনির গায়ে কেমন লাগতো, এগুলো?
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ভেঁপু বাবার পুজো! ভেঁপু বাবার সঙ্গে দেখা বারুইপুর লোকালে। পরনে লাল ধুতি, হাঁটুর উপরে তুলে কাছা মারা। গায়ে লাল ফতুয়া। মাথায় লাল ফেট্টি। ফেট্টিতে কলমের মাথা ক্লিপের মত লাগানো। ক্লিপের খোলে ঢোকানো টাটকা একটা রক্ত জবা। আর একটা ক্লিপের খোল দেখি, খোলাই। মানে অন্য আর একটি ফুল ঢোকার অবকাশ এখনো আছে। হাতে ত্রিশূল, ত্রিশূলের মাথায় ঝুলছে স্টিলের কমণ্ডলু আর একটি প্লাস্টিকের চিক- তাতে কুচো ফুল ভরা। ফুল বলতে - গাঁদা, বেল, হর গৌরীর সাদা, গোলাপি পাঁপড়ির ঝুরো।
অন্য হাতে বিশাল একটা শিঙা। লোভ সামলাতে পারি না। কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করলে, বলেন “আমি তো - বাবা, শঙ্কর বাবা!”
বাড়ি?
"মথুরাপুর, কৃষ্ণ মন্দিরের আশ্রম।"
এখন কি আশ্রমে ফিরছেন? ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন শীর্ণ চেহারার শঙ্কর বাবা। কপালে চন্দনের তিলক কাটা, তার উপরে সিন্দুরের টিপ থাকলেও বাবার মুখের ছোট ছোট কাঁচা পাকা চুলের ভিড়ে বাবার বাবাগিরি যেন প্রকাশিত হতে পারে না, ঠিক ঠাক।
বিরক্তির ঢঙ্গে বলেন, “আশ্রমে যত চোর- চিটিংবাজরা থাকে। আমি যেখানে পারি সেখানে থাকি।"
তাহলে যাদবপুরে এসেছিলেন কি করতে?
“পুজো করতে।" কি পুজো করেন?
“সব! শিব, কালী, দুর্গা, গণেশ, কার্ত্তিক, সব।" দেখে শুনে লোভ সামলাতে না পেরে, বললাম, বাবা আপনার একটা ফটো নেবো। বাবা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শিঙ্গাটাকে মুখের কাছে বাজানোর মত করে ধরে, আমাকে বললেন “নাও, ফটো নাও”।
“গঙ্গাসাগর মেলায়, কত জনকে যে ছবি দিতে হয় এইভাবে, তার ইয়ত্তা নেই।“
এবারেও যাবেন?
“না গেলে, সারা বছর খাবো কি?”
গড়িয়া স্টেশনে ট্রেন আসতে, আমার সঙ্গে ভেঁপু বাবাও নেমে পড়েন। হাওয়াই চপ্পল পরা বাবাকে আমার আসল প্রশ্নটা করা তখনো বাকি আছে। স্টেশনের একটি চায়ের দোকান দেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, চা খাবেন?
বাবা মুখে কিছু না বললেও নিমরাজি হলেন না।
চা খেতে খেতে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পুজোয় কি করবেন? ঘোলাটে চোখে, বাবা কেমন একটা করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন। তারপর বললেন, “কি আর করবো! সারাবছর যা করি তাই।"
আমি উত্তর পাওয়ার জন্য তখনও অপলক তাকিয়ে আছি বাবার দিকে।
“ওই দোকানে দোকানে ফুল, চন্দন দিয়ে বেড়াবো।“
কিন্তু সে তো অনেক ব্রাহ্মনই শহর-বাজারে ঘুরে ঘুরে পুজো করেন। তার জন্যে এমন বেশভূষা, গলায় একাধিক রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ত্রিশূল, শিঙ্গা এসবেরই বা দরকার কি?
এ প্রশ্ন অবশ্য আমি করতে পারি নি, বাবাকে। তার আগেই বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "দে কিছু দক্ষিণা ছাড় তো এবার!"
"তোর ছেলে মেয়ের ভালো হবে।"
আ্যা...বাবা! "শুধু বাবা নয়, শঙ্কর বাবা বল!" আমার বিহ্বলতা কাটাতে আমাকে ফের তাড়া দিয়ে ওঠেন শঙ্কর বাবা।
" দে দে, যেতে হবে...!"
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
অন্ধের প্রতিমা দর্শন! মায়ার সংসারে, কে যাবি আগে...... ..
খালি গলায় গান করতে করতে, এক মধ্য বয়সী মানুষ স্টেশনের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলেন, অন্ধকারে পা ফেলার মত করে, ধীরে ধীরে। বাঁ হাতে ধরা একটি স্টিলের লাঠি দিয়ে বার বার পায়ের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুঝে নিচ্ছিলেন তাঁর এগোনোর পথ। কোথাও যেন একটা ভারী বুকের আঁচ পাচ্ছিলাম, তাঁর গানে। লোকটির পরনে, একটি ফ্যাকাশে নীল রঙের প্যান্ট, তার উপরে ছেড়ে পরা, ঘিয়ে রঙের হাফ শার্ট। মাথা ভর্তি কালো চুল, ব্যাক ব্রাশ করা। বেশ ভদ্রস্থ গোছের। বাঁ কাঁধে ঝুলছিল কালো রঙের অফিস ব্যাগ। ডান হাতে ধরা ভিক্ষার বাটি, তাও স্টিলের। এক টাকা, দু টাকার কয়েন পড়ার ধাতব শব্দে, ভদ্রলোক সচকিত হয়ে ওঠেন ঠিক কিন্তু তা চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য তাঁর হয় না। এদিকে - বিকেল সাড়ে তিনটার ডাউন ডায়মন্ডহারবার লোকাল, গড়িয়া স্টেশন থেকে নরেন্দ্রপুরের দিকে ছেড়ে চলে যায়। কিছু লোক চাপাচাপি করে ট্রেনে উঠে পড়ে। নেমে যায় কিছু লোক।
ভদ্রলোকের গলায়, পায়রার খোপের মতন একটা স্পিকার লাগানো কাঠের বাক্স ঝুলতে দেখে, আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনার সাউণ্ড সিস্টেম চলছে না?
“ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়েছে, কিছু ক্ষণ বাজার পরেই - ঘড় ঘড় করছে।" “নাহলে, এতে করেই গান চালিয়ে দিই আমি।"
না, না আপনি কিন্তু ভালোই গান করেন। আমি বললাম তাঁকে। আমার কথায় লোকটি হাসলেন, দাঁত বার করে। আপনি কি কোথাও গান শিখেছেন?
“না!” “শুনে শুনে!”
এতক্ষণ, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম। এবার ভদ্রলোক একটা বন্ধ গুমটির নিচে বসলেন।
“কি করবো বলুন, কাজ তো করতে হবে। বসে থাকলে তো হবে না।" সে ঠিক আছে। গানের মিউজিক চালিয়ে তার সঙ্গে গান করলে তো ভালো হয়।
“কারাওকের কথা বলছেন?” হ্যাঁ।
“বাউল গানের ওইভাবে পাওয়া যায় না। গুগলেও খুঁজেছি।"
আমি দেখবো ক্ষণ, বললাম তাঁকে।
ইতিমধ্যে আপ বারাসত লোকাল, স্টেশনে ঢুকতেই কয়েকজন যাত্রী ছুটতে ছুটতে এসে ট্রেনে উঠে চলে যায়।
কদিন ধরে নিম্নচাপের দরুন আকাশের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। যে কোনো সময় বৃষ্টি আসতে পারে। পুজোকেও আর বেশি দিন নেই। ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কটা বাজে। “চারটের ক্যানিং লোকাল ধরবো।" এখনো দশ মিনিট দেরি আছে। কোথায় থাকেন?
“বেদবেরিয়ায়। ভাড়া ঘরে।"
দেশের বাড়ি কোথায়?
“জীবনতলায়” “আমি আর আমার পরিবার থাকি। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে রাজস্থানে। ছেলে মহারাষ্ট্রে, রাজমিস্ত্রীর কাজ করে।"
কত টাকা ভাড়া দিতে হয়? “৬০০ টাকা। এক কামরার বাড়ি।"
আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ভাড়ার পরিমান শুনে। ছেলে, মেয়েরা কেউ আসবে পুজোয়?
“না!” "বার বার আসার যা খরচ, সম্ভব নয়।" "চড়কের সময়, জীবনতলায় বড় মেলা বসে। তখন আসবে।" উনার গলার স্বরে তিতির পাখির অসহায়তা টের পাই। আসলে উনার ছেলে বা মেয়ে পুজোয় বাড়ি না এলে, কার কি এসে যাবে।
পুজোর কদিন কি তাহলে স্টেশনে স্টেশনেই কাটবে? দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ভদ্রলোক উত্তর দেন, “না! বাড়িতে চলে যাব।"
অনেকদিন, পরে যাচ্ছেন না?
এতক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়েই কথা বলছিলেন ভদ্রলোক, এবার আমার অবস্থান ঠাউরে তাঁর কোটরাগত নিথর চোখ দুটিকে সাধ্যমত উপরে তুলে, ফিক করে হাসলেন।
"হ্যাঁ, সেটাই তো।তারপরে আবার পুজোর সময়। ভাইপোর ছেলে মেয়েদের জন্য জামা কাপড় নিয়ে যাবো ভেবেছি। বৌমাকে কিনে দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও, কি হবে জানি না।”
নিজেদের? “না, না। লাগবে না।" এবার যেন উনার কণ্ঠায় একটু রূঢ়তার শাসন শোনা গেল। একটু কি বেশি অনধিকার চর্চা করে ফেলছিলাম, আমি?
বিষয়ান্তরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, পুজোয় বাড়ি গিয়ে কি করবেন ঠিক করেছেন?
“জীবনতলায় কয়েকটা পুজো হয়। একটু ঠাকুর দেখতে বেরুব।"
একা? “পরিবার নিয়ে যাবে।"
তাই! কিন্তু আপনি ঠাকুর দেখবেন......!
“চোখে না দেখতে পেলেও, মনের অনুভবে তো বুঝতে পারবো।"
সত্যিই, মা কত করুনাময়ী। তাঁর মহাজাগতিক আদরের স্পর্শ, শুধু চোখ দিয়ে বোধহয় অনুভব করা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে ট্রেন ঢুকে গেলে, ভদ্রলোক লাঠি ঠোকাতে ঠোকাতে এগিয়ে গেলেন ট্রেনে উঠার জন্যে। যেতে যেতে বলে গেলেন, "বাউল গানের মিউজিক পেলে জানাবেন কিন্তু" আমি কোনো উত্তর না দিয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম স্টেশনে। আমার হাতে ধরা পাঁচ টাকার একটা কয়েন। কথায় কথায় ভদ্রলোকের বাটিতে আর দেওয়া হয়ে ওঠে নি।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
নীরা কি ফিরে এলো? ছেলের ইস্কুলের কাছে শ্যামলদার চায়ের দোকানে রোজই আমাদের কয়জন অভিভাবক বন্ধু ছোট ছোট প্লাস্টিকের কাপে শ্যামলদার তৈরি ‘জরি-বুটি’ চা হাতে খানিক আড্ডা মারি।
এই প্রসঙ্গে একটু বলে নিই এই জরি-বুটি নামটি কিন্তু আমারই দেওয়া। শ্যামলদা অবশ্য বলতেন আয়ুর্বেদিক চা। দোকানের সামনে আয়ুর্বেদিক চা পাওয়া যায় বলে কম্পিউটার ছাপানো কাগজ ও ঝোলানো থাকতো বেশ জাঁক করে।
তবে শ্যামলদা কথায় আর কাজে ভীষন পাক্কা। কথার সত্যতা প্রমাণ দিতে আবার দোকানের একপাশে গাদা করে ফেলে রাখতেন বন তুলসীর ডালা আর গুচ্ছের বাসক পাতা। চায়ের সাথে এই সব পাতার নির্যাস মিশিয়ে যে বেশ একটা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো কাজ তিনি করছেন সেই ব্যাপারে তার নিজের মনে অন্তত কোনো সংশয় ছিল না। কেটলি থেকে কাপগুলোতে চা ঢেলে ঢেলে দেওয়ার সময়ে একবার অন্তত বলবেনই বলবেন তার সেই অমোঘ ডায়ালগ, "উত্তর দক্ষিণ গোটা কোলকাতার কোত্থাও বস্ এই চা পাবে না"
"সারা কোলকাতা ঘুরে আসো । কোনোও লাভ হবে না!" কোনো কোনো সময় আমরাই ডায়ালগের বাকি অংশটা বলে দিতাম। "এই চা খেতে হলে বস্ সেই শ্যামলের কাছেই আসতে হব!" তাতে অবশ্য শ্যামলদা খুব যে খুশি হতেন এমনটা কিন্তু নয়। কখনো কখনো কপট ধমকের সুরে বলে উঠতেন, "ইয়ার্কি হচ্ছে!"
শ্যামলদা মেজাজি মানুষ।
তবে আবার গল্প শোনাতে ভীষণ ভালোবাসেন শ্যামলদা। আর তাঁর গল্প বলার বিশেষ একটা গুণ হলো প্রতিবারই গল্প বলা শেষ করে দারুন দারুন সব ক্যাচলাইন আওড়ানো, অনেকটা নীতি গল্পের মত। সব শেষে, আমার গল্পটি ফুরল, নটে গাছটি মুড়ল ধাঁচের ঠোঁটের মাঝখানে জ্বলা বিঁড়িটাকে টেনে কায়দা করে মধ্যমা আর তর্জনীর মধ্যে চেপে এমন একটা তুখোড় তুড়ি মারবেন যে এক ক্লিকে ঝরিয়ে ফেলবেন বিঁড়ির মুখের সমস্ত ছাইকে। দাপটখানা এইরকম যেন এরপর আর কোনো কথা হবে না। তারপর কপাল কুঁচকানো সূক্ষ্ম চোখে, ঠোঁটের কোণায় কি এক দুর্বোধ্য হাঁসির আভাস ফুটিয়ে এমন গৌরবের ভঙ্গিমায় তাঁর শ্রী-মুখ থেকে একরাশ দলা পাকানো বিঁড়িদগ্ধ ধোঁয়া ছড়িয়ে দেবেন যে তাঁর ছোট্ট দোকানটির ভেতরটা ভারাক্রান্ত না হযে পারবে না। কিন্তু তাতে কি! কারোর কিচ্ছুটি বলার নেই। জরি বুটি চায়ের বশ্যতা মেনে নিতেই হবে!
মনে আছে, শ্যামলদা একবার একটা গল্প বলা শেষ করে উপসংহারে বলেছিলেন, “ওপরওয়ালা প্রত্যেক মানুষেরই হুবহু একই রকম দেখতে আরেকটা মানুষ, পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ছেড়ে রেখেছেন”। এ তো গল্পের শেষ লাইন। গল্পটা কি?
শ্যামলদা গড়িয়া অঞ্চলের মানুষ। শ্যামলদার পাড়াতেই ভাড়াতে থাকতো নীরা; শ্যামলদার প্রেমে সে পড়ে ঠিক, কিন্তু বাড়ির চাপে বিয়ে করতে হয় মেদিনীপুরের এক স্কুল মাষ্টারকে। নীরার দেশ বাড়ি ছিল মেদিনীপুরেরই রামনগরে। সরকারি চাকুরে বাবার একমাত্র মেয়ে নীরা, পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। কিন্তু বখাটে শ্যামলদার যে গুনের জন্য নীরা তাঁর সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল তা হল শ্যামলদার একেবারে পরমবীরচক্র পাওয়ার যোগ্য বীরত্ব আর সাহস। সবার বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া শ্যামলদা এমনকি নীরার বিয়েতেও খুব খেটেছিলেন। তা সে পর্ব মিটে গেছে অনেকদিন।
বছর দুয়েক আগে, শ্যামলদা গড়িয়ার ফুটপাথ হকার সমিতির বার্ষিক সভা উপলক্ষে ডায়মন্ডহারবারে গেছেন; সন্ধ্যা পর্যন্ত চলেছিল সভা। ডায়মন্ডহারবারের হকার সমিতির সদস্যরা ছিল সেই সভার আয়োজক। যাই হোক, গল্পের আসল টুইস্টটা আসে এর পরেই।
হঠাৎ এক মহিলাকে, পেছন থেকে দেখেই অনেকটা নীরার মত মনে হওয়াতে শ্যামলদার খুব অবাক লাগে। না, নীরা কেন হতে যাবে। সে তো মেদিনীপুরে, স্কুল মাস্টারের গৃহিণী।
মনে মনে এই প্রশ্ন করতে করতে শ্যামলদা মহিলাটির প্রায় সামনে গিয়ে তো একেবারে থ। আরে নীরাই তো। সেই কোটরাগত চোখ, উঁচু কপাল, ওই তো গালের বাঁ পাশের ছোট্ট তিলটা পর্যন্ত ... মিলে যাচ্ছে। কিন্তু কি আশ্চর্য, নীরা কি চিনতে পারছে না তাকে। শুধু বয়স বাড়ার কারণে একটু পৃথুলা লাগছে নীরাকে। এই টুকুই পার্থক্য।
তবে..!
শ্যামলদা ধৈর্য আর ধরে রাখতে না পেরে সটান জিজ্ঞাসা করে ফেলেন, “নীরা, তুমি এখানে কি করছ?” আচমকা তার নাম ধরে একজন অপরিচিত লোক এরকম তুমি তুমি করে কথা বলাতে ভদ্রমহিলা তো একেবারে আকাশ থেকে পড়েন আর কি!
"হ্যাঁ বলুন!" নিজের বিস্ময় কে নিজের মতো করে একটু গুছিয়ে নিয়ে শ্যামলদার দিকে ভদ্রমহিলা এমন চোখ করে"তাকালেন যে শ্যামলদার তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা । "আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?'
"তুমি...মানে আপনি নীরা নন?" শ্যামলদাও সহজে হারতে চান না। "হ্যাঁ, আমি নীরা!"
"কিন্তু আপনি কে বলুনতো?'
"আ..মি শ্যামল!" "আমাকে চিনতে পারছো না, নীরা?"
"না!" ভদ্রমহিলার গলায় এবার একটু রূঢ়তার স্বর
"নীরা..তুমি কি এখনোও আমাকে না চেনার নাটক করে যাবে?'
"শুনুন আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।“
“সরিষা রোডে আমি একটা ছোট্ট ইমিটেশনের দোকান চালাই। তাই এখানে...।। "
"সম্ভবত অন্য কারোর সঙ্গে আমাকে গোলাচ্ছেন, আপনি!”
"সে কি, আপনি নীরা অথচ... নীরা নন?"
ভদ্রমহিলা, এবার হতবাক শ্যামলদার দিকে তাকিয়ে নিরুত্তর থাকাই শ্রেয় মনে করেন। সম্ভবত এরপরে কি বলবেন তাই মনে মনে ভাবতে থাকেন।
গল্প বলা শেষ করে সেদিনকার মতো আর কোনোদিন এতটা বিহ্বল হতে দেখিনি শ্যামলদাকে।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“বেলা কত হোল, সেটা খেয়াল আছে?”
শীতের বিকেলটা বড্ড চটপটে, অনেকটা - ঠিকা ঝিয়ের মতন; হনহন করে আসে আবার হনহন করে চলেও যায়। আসলে শীতের কোনো বিকেল নেই, যা আছে তা প্রলম্বিত দুপুর আর তারপরেই সন্ধ্যার ঝুপসি ছায়া নেমে আসে হঠাৎ যবনিকা পাতের মতন।
বিপুল, বারান্দায় বসে ছিল, আলগোছে সকালের খবরের কাগজটা ধরা ছিল তার হাতে।
অনিমা এবার ঘরের ভেতর থেকে তাড়া দিয়ে ওঠে ছেলেকে। “ ৪ টেয় পড়া, এখনো বেরনোর নাম
নেই, পৌঁছতে সময় লাগবে না?”
বিপুল তার নাতির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ঈশারায় কটা বাজে দেখতে বলে। ঋজু ঘরের মধ্যে ঢুকে মায়ের মোবাইল টিপে টাইম জানতে উঠে যায়।
এখন আর কেউ সময় জানতে হাত ঘড়ি বা দেওয়াল ঘড়ি দেখে না। হাত ঘড়ি গুলো ফ্যাশনের জন্য অনেকে পরে ঠিক দেওয়াল ঘড়ি বর্তমানে শো পিস ছাড়া আর কিছু নয়।
কাগজে কুম্ভ মেলা নিয়ে বিস্তারিত খবর ছেপেছে; সেটাতেই চোখ বুলোচ্ছিল বিপুল। পড়তে পড়তে,
ব্রাহ্ম মুহূর্তের সময় লেখা জায়গাটায় এসে
থমকে দাঁড়ায় সে। গলা তুলে, তারপরে বাইরের বোগেনভেলিয়া গাছটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভেবে বিড়বিড় করে নামতা পড়ার মত বলে চলে - ভোর ৪ টে পঞ্চাশ!
ভোর ৪ টে ৫০ এ তো রাজধানী এক্সপ্রেস সেবার মোঘল সরাই স্টেশন থেকে দিল্লীর দিকে ছেড়ে গিয়েছিল! টাইমটা এই কারণেই মনে আছে, সেই প্রথম ওর সামনে বসে থাকা একটি সুকেশী, সুন্দরী যুবতি তার দীর্ঘ যাত্রাপথের মৌনতা ভেঙ্গে তাকে জিজ্ঞাসা করে উঠেছিল, “কটা বাজে বলুন তো এখন?”
স্টেশনের শেষ প্রান্তে ফুটে থাকা ছাতিম ফুলের একরাশ ঝাঁঝালো গন্ধ যেন হঠাৎই সমস্ত আগল ভেঙ্গে, ওদের কামরার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল হৈ হৈ করতে করতে।
“আপনি কি দিল্লী যাচ্ছেন?” কেমন ঘোরের মধ্যে থাকা মানুষের মত মিনমিন করতে করতে মেয়েটিকে তারপরে জিজ্ঞাসা করেছিল বিপুল।
“না! আগ্রা”। “দিদির বাড়ি”।
মেয়েটির মনে হয় পুরো বাক্যে কথা বলার অভ্যেস নেই। তবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে, অনেক প্রশ্নেরই তো উত্তর দিয়ে দিলো ।
আর না চাইতেই যখন এত কথা বলে দিয়েছে, এবার নিশ্চয়ই ওর কথাও জানতে চাইবে মেয়েটি, এই ভেবে মোটামুটি রেডি হয়েই বসে ছিল, বিপুল। ভাবখানা এইরকম, একবার সুযোগ পেলে হয়। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, বেশ ডাঁটিয়েই উত্তর দেবে সে – শিবপুর থেকে জাস্ট পাশ আউট, বি টেক, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার; দিল্লী যাচ্ছি চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে। নামী নির্মাণ কোম্পানি হিসেবে ডি এফ এল এর নাম নিশ্চয়ই মেয়েটি শুনেছে আগে। তাই আলাদা করে আর এই নিয়ে কিছু বলার দরকার নেই। তাহলে ন্যাকা বলে ভাবতে পারে তাকে।
মনে মনে একটা মক কথোপকথনের মহড়া সেরে নিচ্ছিল সে।
কোন পদের জন্যে জিজ্ঞাসা করলে গলা নামিয়ে একটু হালকা স্বরেই বলবে, আপাতত জুনিয়র
ইঞ্জিনিয়ারের পদে। তবে আমার যাওয়া আসার
টিকিট ওরাই পাঠিয়ে দিয়েছে। এই কথাটা একটু জুড়ে না দিলে কেমন যেন গুরুত্ব থাকে না।
এছাড়া হাইট ৫ ফুট আট ইঞ্চি, ফর্সা, চাবুকের মতন গঠন – এ সব তো দেখতেই পাচ্ছে। বলার দরকার নেই।
তারপরে এক রাশ প্রত্যাশা নিয়ে, তীর্থের কাকের
মতোই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বসে ছিল সে!
কিন্তু কোথায় কি!
"দাদা, দাদা..!"
নাতির চিৎকারে বিপুল খবরের কাগজটাকে নামিয়ে সোফার ওপরে রাখে।
"কি ভাবছো অমন করে, দাদা?
"আচ্ছা, আগ্রা স্টেশন কি পেরিয়ে গেছে?"
"কি আবোলতাবোল বলছো বলতো তুমি?"
বিপুলের ঠৌটের কোনায় তখনো পরিহাসের হাঁসির উদ্ভাস লেগে থাকে।
"জামাকাপড় পরে, তাড়াতাড়ি বেরোও; স্যারের বাড়ি পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে না?"
"কটা বাজলো বল তো এখন!"
" ৩টে ৪০ হয়ে গেছে!"
"৩টে ৪০....?" বিপুলের দৃষ্টি পথে আবার ও বাইরের বোগেনভেলিয়া গাছটা ফিরে আসে। তার পাশেই একটা পুরনো পাম গাছ রয়েছে, কেমন ধূসর। আসলে শীতের রুক্ষতার ছাপ লেগেছে ওর গায়ে।
"দাদা, চলো!" ঋজু আবার তাড়া দেয়।
"৩টে ৪০..! শিয়ালদহ থেকে ডাউন ডায়মন্ড হারবার লোকালটা, এই মাত্র ছেড়ে গেল .... "!
"তো?" "আমরা তো এখন অটোতে করে ম্যাথ স্যারের বাড়ি যাবো, দাদা।"
বিপুলের চোখে হঠাৎ যেন কিসের ইঙ্গিত...!
----------------------------------------------------------------------
অচিনপুরে...! ( দ্বিতীয় পর্ব)
পোঁ করে হর্ন মেরেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। অনেকটা ছুটে এসেও, শেষ মুহূর্তে ট্রেনটা ধরতে পারলো না বিপুল।
মিনিট খানিক আগে পৌঁছলেও পেয়ে যেত। তবে বড় কিছু পাওয়ার আগে নাকি এরকম ছোটো খাটো না পাওয়ার ঘটনা ঘটে।
"দাদা.. চলো, চলো" "উঠে পড়ো..!" নাতি তাড়া দিতেই সম্বিৎ ফেরে বিপুলের, দেখে সামনে অটো দাঁড়িয়ে আছে, রাজমন্দির যাওয়ার।
মিনিট দশেকের পথ। স্ট্যান্ডে নেমে মিনিট খানিক হাঁটলেই স্যারের বাড়ি।
তাড়াহুড়োয় আজ মোবাইলটা নিয়ে বেরোয়নি। পাশে বসা লোকটি, ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছে দেখে বিপুল তাকে কটা বাজে জিজ্ঞাসা করে। লোকটি ঘাড় না তুলেই জবাব দেয় ১০মিনিট বাকি চারটে বাজতে।
"তার মানে, ৩ টে ৫০...!"
আর মাত্র ৭ মিনিট বাকি আছে ক্যানিং লোকাল ছাড়তে...!
প্লাটফর্ম জুড়ে লোকজনের হুড়োহুড়ি। থেকে থেকে মুড়ি ঘুঘনি মাখার দোকান থেকে কান ফাটানো ঢং ঢং আওয়াজ আসছে, ষ্টীলের ক্যানের গোলাকার মাথায় ক্যানেস্তারা পেটানোর মত চামচটাকে বারবার তুলে তুলে মারার কারনে এরকম বিকট শব্দ। আলগোছে এসবই দেখছিল বিপুল। ওর ট্রেন সেই ৪টে ৩৩এ। পিসতুতো বোনের বিয়ে, তাই ডায়মন্ড হারবার যাচ্ছে দুদিনের ছুটিতে।
"দাদা, নামো! এসে গেছি আমরা!"
"ওহ্ তাই!" চটপট অটো থেকে নেমে পড়ে বিপুল। ঋজু ক্লাস সিক্সে পড়ে। খুব সিরিয়াস পড়াশুনোয়। দাদুর আগে আগে হেঁটে এগিয়ে যায় সে। "স্যার ৬টায় ছাড়বে। চলে এসো কিন্তু!" ঘাড় ঘুরিয়ে বিপুল কে কথাগুলো বলতে বলতে স্যারের বাড়িতে ঢুকে পড়ে ঋজু। বিপুল নাতিকে হাত নেড়ে আশ্বস্ত করে। কিন্তু ...এখন কি.চারটে বেজে গেছে.. ! সময় জানতে বিপুল যেন আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না।
"আচ্ছা, কটা বাজে বলুনতো?" পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এক মাঝবয়সী ভদ্রলোককে, খানিকটা অস্থিরের মতোই জিজ্ঞাসা করে ফেলে বিপুল। "ওফ্। ৩ টে ৫৮!" রাগত দৃষ্টিতে ওর দিকে একবার তাকিয়েই, বলে এগিয়ে যান ভদ্রলোক।
"ইস্....!"
"আচ্ছা, ক্যানিং লোকালটা কি বেরিয়ে গেল?"
"হ্যাঁ, এই তো জাস্ট ১ মিনিট হলো, ছেড়ে গেল..!"
"ইস্....!" বিপুলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়া মেয়েটি এবার তার ডান হাতের তর্জনীকে দু ঠোটের মাঝখানে উল্লম্ব ভাবে সেঁটে রেখে, অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
"আপনি...!"
"আপনি.... সেই রাজধানীতে আমার সামনের বার্থে বসে আগ্রা যাচ্ছিলেন ...!"
চলার পথে কতজনের সঙ্গেই তো আমাদের সাক্ষাৎ হয়। তার বেশিরভাগই মূল্যহীন। দুএকজন থাকে, যাদের কোনোদিন ভোলা যায় না।
মেয়েটির সেদিনকার অবজ্ঞার কথা বিপুল আজও ভুলতে পারেনি।
"ও.... হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে পড়েছে ...!"
বলতে বলতে মেয়েটির চোখগুলো কেমন সরু হয়ে আসে। ঠোঁটের কোণে তীর্যক হাঁসির উদয় হয়। তবে আজ হাসিতে অবজ্ঞার চেয়ে অনুকম্পার ভাগই বেশী থাকে।
"আপনি তো আগ্রা পর্যন্ত আর কোনো কথাই বললেন না!" মেয়েটির কথায় যেন কতদিনের অভিমান ঝরে পড়ে।
বিপুল, শুনে থ হয়ে যায়। বলার মতো শব্দ হারিয়ে ফেলে। এতদিন তো সেই মেয়টাকে ভীষণ দেমাকী বলে ভেবে এসেছে।
আগ্রায় ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার সময়ে একেবারের জন্যেও মুখ তুলে তার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। উল্টে তার ঠোঁটে লেগে ছিল অবজ্ঞার চরম কটাক্ষ।
"আগ্রায় ট্রেন ঢোকার ঠিক আগেও আমি ভেবেছিলাম, অন্তত আমার নামটা জানতে চাইবেন আপনি!"
পাঁচ বছর আগের মেয়েটির গায়ে এখন সম্ভ্রমের মেদ। চোখের নীচে হালকা কালি।
"এখন কোথায় যাচ্ছেন...!" "ক্যানিং, মায়ের বাড়ি!"
"তবে...!"
"হ্যা, তিন বছর আগে...!" বলতে বলতে এক আধবয়সী লোক মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে দুটো সুইট রোল ধরা। "চলো, নাও! সেই ৫টা ১০এ ট্রেন।"
মেয়েটির চোখে যেন হঠাৎ আর্দ্র মেঘের যাওয় আসা শুরু হয়।
লোকটির হাত থেকে প্যাকেটটি নিয়ে এবার উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে সে।
ভদ্রলোক তার পিছু পিছু হেঁটে এগিয়ে যায়।
বিপুল ওইজায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে।
আজ ও মেয়েটির নাম জানা হলো না। কোথায় বিয়ে হয়েছে কি জানি, কোন অচিনপুরে.....!
---------------------------------------------------------------------------------------------
গল্পঃ জলে কচি কলা পাতার আভা!
পুকুরের ওই প্রান্তে দুর্বা মান্ডির ছোট্ট চার চালার বাড়ি। খড়ের ছাউনি দেওয়া। উদয়াস্ত পুকুরের জলে যত শুকনো পাতা পড়ে, দুর্বা মান্ডি সব একা হাতে সরিয়ে পাড়ের ওপর তুলে দেয়। জোছনার আলোয় দুর্বা মান্ডি, যুৎ হয়ে আড় বাঁশি বাজায় পুকুর পাড়ে বসে। জলের বুকে পড়া চাঁদের আলোয় তার বাঁশিতে যেন প্রেমের জোয়ার ওঠে। সন্ধ্যের পরে, পাশের বাঁশ জঙ্গল থেকে ঘনঘন ডাহুকের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। দুর্বার বাঁশির সুরে মজে, তারাও তখন ডাকতে ভুলে যায়।
গত কয়েকমাস ধরে দুর্বা লক্ষ করছে ওপারের মরা বেলগাছটি যেন যত দিন যাচ্ছে ক্রমশ জলের ওপর ঝুঁকে পড়ছে।
চিনে বাদামের ক্ষেত পেরিয়ে প্রতিদিন মাহিষ্য বাড়ির বৌ ঝিরা আসতো বেল পাতা ভাঙতে। পাতায় পাতায় তখন বেলগাছটির ডালাপালা একেবারে ভর্তি ছিল। দুর্বা, ত্রিনয়নী বেল পাতা পেড়ে দিত তাদের। খালি গায়ে, পরনের ছোট্ট গামছাটিকে প্রায় নেংটির মতো করে কাছা মেরে সে বেলগাছটিতে লপলপ করে উঠে যেতো। গায়ে বেল গাছের কাঁটা ফুটে গেলেও নীরবে তা সহ্য করতো।
"তোমার লাগে না, অমন করে গাছে উঠে যাও," হাত পেতে বেলপাতা গুলো নিতে নিতে মলিনার বুক ভারী হয়ে আসে কষ্টে। গায়ের রং কালো বলে মলিনার বিয়ে হয়নি। গ্রামের শিব মন্দিরে পুজোর ফুলপাতা সংগ্রহ করার দায়িত্ব বর্তেছে তার ওপরে। গাঁ ঘরে বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলে আইবুড়ো মেয়েদের পুজো আচচার কাজে লাগিয়ে দেওয়ার চল রয়েছে।
"কি গো কিছু বলছো না!" থুতনি ধরে সজোরে নাড়া দিতেই কেমন যেন হতভম্বের মতো তার দিকে তাকিয়েছিল দুর্বা। সে দৃষ্টিতে যাই থাকুক, ছলনা যে ছিল না মলিনা তা বিলক্ষণ বুঝেছিল।
দুর্বার মা তখন দাওয়ায় বসে বুনো নল ঘাসকে দড়ির মতন পাকিয়ে লক্ষী কুচো বানাচ্ছিল। ওর কথা কানে যেতেই একপ্রকার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে ছেলেকে। "দুববা, আয় বাবা। খাবিনে! বেলা কত হোল মালুম আছে!" মুহূর্তে মলিনা, দুর্বার জগদ্দল পাথরের মতো বুকের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পুকুরের ওপারে বসে থাকা তার মা'র দিকে চোখ ফেলতেই, দুর্বাও তার দেখাদেখি ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় ওদিকে তখন দুর্বার মা হাত নেড়ে নেড়ে ছেলেকে ঘরে আসার জন্য জোরেজোরে ঈশারা করে চলেছে ।
হঠাৎ একটা নেউল ছুট্টে পাশের ঘাস জঙ্গলে ঢুকতেই মলিনার বুক ছ্যাৎ করে ওঠে। কয়েকদিন আগে এখানেই একটা চন্দ্র বোড়া সাপ কে দেখেছিল গুটিয়ে শুয়ে থাকতে, সম্ভবত রোদ পোহাচ্ছিল।
মলিনা, পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় ছোট আল পথ ধরে। মুঠোর মধ্যে ধরা বেল পাতাগুলি, ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে যায়। দুর্বা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে দিকে আর ফিক ফিক করে হাসতে থাকে। হাতের পেশীগুলো যেন হঠাৎ ই তার লোহার মতো শক্ত হয়ে যায়।
কাঁধে, হঠাৎ - কাঁপা কাঁপা, অশক্ত কটি আঙুলের আঘাত পড়তেই ঘোর কেটে যায় দুর্বার। ঘুরে দেখে, তার মা দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। বাঁ হাতে একটা লম্বা কাটারি ধরা; শরীরের কাঁপনে এমন দোল খাচ্ছে যেন ফণা তোলা ভুজঙ্গ।
দুর্বা কিছু বুঝতে পারে না। রাজ্যের জিজ্ঞাসা তার দু চোখ জুড়ে - পতনোন্মুখ কোনো পাথরের মতো জাগতিক সমস্ত বিপন্নতা নিয়ে ঝুলে থাকে, অচিরেই যা খসে পড়বে ভূতলে।
দুর্বার মা এবার বেল গাছটার দিকে, কাটারি তুলে তুলে দেখায় আর ছেলেকে চোখে মুখের ঈশারায় বোঝানোর চেষ্টা করে, এই গাছটাই যত নষ্টের গোড়া। এই গাছটাকে কেটে দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে; না থাকবে লাউ আর না বাজবে লাউতারা।
দেখতে দেখতে, দুর্বার মা এবার সত্যি সত্যিই, বেল গাছটার দিকে এগিয়ে যায় কোপ মারার ভঙ্গিতে। দেখা মাত্র তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে দুর্বা; গাছটাকে আগলে, পাহাড়ের মতন বুক পেতে দাঁড়িয়ে পড়ে সামনে।
খানিকটা এগিয়ে এসেছিল মলিনা; হঠাৎ বেল পুকুরের দিক থেকে তীব্র গোঙানির মত একটা আওয়াজ আসছে শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
বাঁ দিকে চিনে বাদামের খেত পেরোলেই বোল্ডার ফেলা রাস্তা চলে গেছে মাহিষ্য পাড়ার দিকে। ধান কাটা হয়ে গেছে, তাই মাঠ এখন ফাঁকা। লোকজন ও নেই তেমন। মলিনা কান খাড়া করে শোনে, কেমন যেন আর্ত চিৎকার!
"কি রে মলিনা, এখানে দাঁড়িয়ে পড়লি যে বড়?"
ঘুরে দ্যাখে, ওদেরই পাড়ার নবীন মৈশাল দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় চোখ করে। মুখে কেমন ফিচেল হাঁসি। বয়সে অত প্রবীণ না হলেও সম্পর্কে মলিনার দাদু হয়। "তুমি শুনতে পাচ্ছো না, কিছু?"
"ও আর কি, সাঁওতাল পাড়ার ওই বোবা ছেলেটা, দুর্বা না কি নাম যেন!"
"তা সে বাদ দে, তুই বরং আমার সঙ্গে ওই তিনার মাঠের দিকে চল।"
" মানে?"
"বামুন পাড়ার গা ঘেঁষে কত্ত বেল গাছ আছে ওখানে, দেখিয়ে দেবো তোকে!"
শীতের বেলা, তাড়াতাড়ি ছোটে। রোদের রং বদলে যায় যখন তখন।
"না না, আজ লাগবে না," বলে এগিয়ে যায় মলিনা। দুর্বার জন্য কেমন মন খারাপ লাগে মলিনার।
"এ্যয় দাঁড়া না, ছুঁড়ি তোর অত তাড়া কিসের?" মলিনা না দাঁড়িয়ে, চলার গতি আরোও বাড়িয়ে দেয়।
পেছন থেকে এবার একটা শক্ত হাত ওর কোমরকে জাপটে জড়িয়ে ধরে। ছুঁয়ে যাওযার চেষ্টা করে ওর বুকের ওম। "জানিস তো তোর দিদা অসুস্থ!"
"ছাড়ো , ছাড়ো..!"
"আজ রাত্রে আসিস না..!" ফুঁসে ওঠে মলিনা। "তোমার কোনো লাজলজ্জা নেই!"
"ওহ্, সাঁওতাল পাড়ার ওই বোবা ছোঁড়াটার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করিস যখন লজ্জা লাগে না না?" "বেলপাতা তোলার নামে...!"
"ওর মা আজ গাছটাকে কেটেই ফেলছে, তখন কি করিস দেখবো।"
মলিনা ভ্যালভ্যল করে তাকিয়ে থাকে নবীন মৈশালের দিকে; দুনিয়ার বোবা দৃষ্টি এসে ভিড় করে তার চোখে।
"কোথায় পালাচ্ছিস?"
মলিনা, উল্টো দিকে সাঁওতাল পাড়ার দিকে ছুটতে থাকে। বেল গাছটাকে তাকে যে করে হোক বাঁচাতেই হবে।
----------------------------------------------------------------------------------------------
ভালো হয়ে ওঠো!
--------+--+-----++--
গোলাপ দিবসের এক টুকরো গল্প!
মুখ ভর্তি কুচকুচে, কালো দাঁড়ি গোঁফ; মাথায় পাগড়ির মতো জড়ানো চেক চেক গামছা; বছর পঁচিশের তরতাজা যুবক, ফুল বেচছে; রেলওয়ে প্লাটফর্মের এক প্রান্তে, সাকুল্যে দুটি প্লাস্টিকের বালতি আর একটি বড় বোতলের মধ্যে জল দিয়ে চুবিয়ে রাখা তার ফুলের পসরা। রজনীগন্ধা, ডালিয়া, জিনিয়া সঙ্গে অবশ্যই লাল টুকটুকে গোলাপ গুচ্ছ! বেশ লাগছিল দেখতে।
"তোমার গোলাপ কত করে"? জিজ্ঞাসা করতে এক জোড়া টলটলে চোখ তুলে ছেলেটি তাকিয়ে রইল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। তার ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকে এক চিলতে মুচকি হাঁসি।
মেয়েটির হাতে গোলাপ তুলে দিতে দিতে ছেলেটির হাঁসি যে অহেতুক কেন চওড়া হয়ে গেল কে জানে।
মেয়েটি চলে যেতে, কেউ নেই দেখে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, " আজ কি গোলাপ একটু বেশী বিক্রি হচ্ছে?"
আবার সেই সরল হাঁসি খেলে গেল তার চোখে মুখে। "হ্যাঁ, কেন কি জানি"!
"তুমি জানো না, আজ গোলাপ দিবস"?
"ওহ্ তাই"! "গোলাপ আজ খানিকটা বেশী তুললেই ভালো হতো মনে হয়"।
"গোলাপ তুলবি পরে, আগে দোকান তোল্ দিকি এখান থেকে"!
"অনুমতি না নিয়েই বসে পড়েছিস যে বড়," হাতে খইনি ডলতে ডলতে দেখি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন উর্দিধারী রেলওয়ে পুলিশ। যেমন দশাসই চেহারা তেমন বাজখাঁই গলা।
কথা শুনে, ছেলেটার হাঁসি যেন কোথায় উধাও হয়ে গেল নিমেষে। কিছু না বলে, শুধু ভ্যালভ্যল করে তাকিয়ে থাকে সে পুলিশটির দিকে।
খরিদ্দার সামলানোর মাঝে, কিছু রজনীগন্ধার স্টিক রেডি করে রাখছিল ছেলেটি। স্টিকের গোড়ায় সুতো দিয়ে বেঁধে দিচ্ছিল লাল লাল টাটকা গোলাপ।
পুলিশের রোষানলে পড়ে, হতবাক ছেলেটি তার হাতে ধরা গোলাপটিকে, একভাবে ধরেই থাকে বুকের সামনে।
"কি হলো, কথা কানে গেল না"? "দাঁড়িয়ে আছিস যে বড়"?
ছেলেটি কি করবে বুঝতে না পেরে তার হাতে ধরা গোলাপটিকেই এবার পুলিশটার হাতে ধরিয়ে দেয়। তারপর করজোড়ে বলে, "আজকে ছেড়ে দিন স্যার"!
বেজায় বিরক্ত পুলিশটি দেখি একেবারে ভিজে জল হয়ে গেলেন তৎক্ষণাৎ।
পুলিশ কি বিশেষ কিছু শুনতে পেলো তাহলে!
আমি তো স্পষ্ট শুনলাম ছেলেটি বললো, গেট ওয়েল সুন স্যার, ভালো হয়ে উঠুন।
সত্যি সত্যিই যে পুলিশটা এবার হাঁটা দিল সামনের দিকে।
-----------------------------------------------------------------------------------------------
রং ঠোঁট!
------------
শুধু ছবিই নেবেন, নাকি রঙ ও নেবেন?
না মানে...! মোবাইল হাতে পরিমল এবার ঘাড় সোজা করে দাঁড়াতেই দেখে সামনেই দাঁড়িয়ে ইয়াসমিন; মুখ টিপে টিপে হাসছে।
আরে তুই...! কি করছিস এখানে?
বসন্তের পড়তি দুপুর। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। টিউশন বাড়িতে যাচ্ছিল, পরিমল। সোনারপুরের এইদিকটায় একটা নতুন টিউশনি ধরেছে সে। ছাত্রী। ইলেভেনে পড়ে। গড়িয়া থেকে অটোতে সোনারপুর নেমে খানিকটা হেঁটে ভেতরের দিকে গেলেই ওর বাড়ি। রাস্তার ধারে, সরু খাটের ওপর সাজানো রঙের দোকান- এমন সুন্দর করে ট্রে গুলোতে নানা রঙের আবির ডাই করা আছে যে দেখে - ছবি নেবে বলে, সটান দাঁড়িয়ে পড়েছিল দোকানের সামনে।
তুমি একে চেনো, নাকি?
ইয়াসমিন এতক্ষণে মুখ খোলে। কলেজে, আমরা একই ইয়ার, বাবা। ওহ্।
পরিমল বুঝতে পারে, পাশ থেকে ওর বাবাই কথাটা প্রথম বলেছিলেন। লুঙ্গির ওপর সাদা ফতুয়া পরা ভদ্রলোকটিকে এবার ভালো করে দেখে, পরিমল। লম্বা, ফরসা গায়ের রং। পুরো রবীন্দ্রনাথের মতন দাড়ি, মাথায় কান ঝাঁপা চুল, শুধু গোঁফটা চাঁছা।
তুই আজ কলেজ যাস নি তাহলে? যাই নি, সে তো দেখতেই পাচ্ছিস।
পেছনের মুদিখানা দোকানে একজন খরিদ্দার এলে, ভদ্রলোক দোকানের দিকে হাঁটা দেন।
তোর বাবা যদি গোঁফ রাখতেন বুঝলি পুরো রবীন্দ্রনাথের মতোই দেখাতো। হ্যাঁ যা বলেছিস।
বাবা নিজেও সেটা অনুভব করেন। কতবার বলেছি, বাবা মোচটা রেখে দাও না। কিছুতেই শুনবে না। ভীষণ ধর্ম পরায়ন মানুষ।
জানিস, ফেসবুকেই পড়লাম সম্ভবত। সাবিনা ইয়াসমিন নামের জনৈকা লেখিকা খুব সুন্দর লিখেছেন এই নিয়ে।
আমার বাবাকে নিয়ে আমি তো কিছু লিখিনি?
আরে দূর। তোর নামের কি আর বঙ্গদেশে অন্য কেউ থাকতে পারে না নাকি!
সেই সাবিনা ইয়াসমিন লিখেছেন, তাঁর ঠাকুমা নাকি বলতেন রবীন্দ্রনাথ যদি মোচটা না রাখতেন তবে তাঁকে সাচ্চা একজন মুসলিম দরবেশের মতোই দেখতে লাগতো।
তবে হ্যাঁ, বাবা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের একজন ডাই হার্ট ভক্ত জানিস।
কেমন?
বাড়িতে লাল শালুতে মোড়া কোরানের পাশেই রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান রাখা থাকে সযত্নে।
তাই? হ্যাঁ।
এইজন্যই, তুই বাংলায় এত ভালো!
আরে না না।
তোর মতো এত ভালো কবিতা যদি লিখতে পারতাম!
পেছনে মুদিখানার দোকান থেকে হাফিজুল মিঞা মেয়েকে ডাক পাড়েন। ইয়াসি...!
বাক্স থেকে টাকা বার করে, গুনে গুনে গাটার বন্দি করে রাখছিলেন, সন্ধ্যায় আড়তদারের লোক এলে, দেবেন।
আমি এখনই বেরিয়ে যাবো, তুই একটু নজর রাখবি এই দিকটা। চান খাওয়া হয়নি, বেলা অনেক হয়ে গেল।
ইয়াসি রঙের দোকান থেকে 'হ্যাঁ বাবা' বলে সম্মতি জানায়।
এয় শোন্, এই ট্রে টাকে একটু ডান দিকে সরিয়ে দে তো, একটা ভালো করে ছবি নেই। দাঁড়া দিচ্ছি।
ছবি নেওয়া হয়ে গেলে পরিমল মোবাইলের স্ক্রিনে টাইম দেখে। তিনটে কুড়ি। হাতে আরোও দশ মিনিট সময় আছে।
এবছর রঙ খেলবি না? তুই তো জানিস...! শমিতা ... থাক সে কথা। তোর কথা বল। আমি...এবারে ঘরেই কাটাবো। এটা কি রকম ব্যাপার হলো! সবাইকে খালি রঙ দিয়ে যাবি, নিবি না. ..। শোন, এটা আমার বাবার দোকান। আমি থোড়িই রঙ বেচি। বাবা বাড়ি থেকে ফিরে আসতে যতক্ষণ, ততক্ষণ ই।
ও কথা বললে কি আর চিড়ে ভিজবে সোনা? আসলে তুই হচ্ছিস উৎপল দত্ত, রবি ঘোষের মতো কমেডিয়ান; সবাইকে হাসাবি কিন্তু নিজে হাসবি না।
এয়, বেশি বকবক করিস না তো। তুই বরং একটা ভালো কবিতা লিখে আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিস। ওই পড়েই কাটাবো সারাদিন। তাই? তাহলে শোন, শিরোনাম টা আমি ভেবেই ফেলেছি।
কি? পরিমল খানিক থেমে, শেষে বলেই দেয় - আমার গালে তোর রং ঠোঁট।
কি বললি...!
ইয়াসি মা, আমি এখুনি আসছি বাড়ি থেকে, বুঝলি। হাফিজুল মিঞা দোকান থেকে বেরিয়ে মেয়েকে আরো কিছু বলতে রঙের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন। এদিকে ইয়াসমিনের মনে যে কি আনন্দ নাকি বিস্ময়ের ঘোর কি যে হচ্ছিল ছাতা সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকে পরিমলের দিকে।
----------------------------------------------------------------------------------------------------
বাইক বর বিন্দাস!
------------------------
সেই সাত সকালে, বেরিয়ে পড়ে; রণিতা ঘর ছেড়ে। চায়ের দোকান সাথে মুড়ি আর ঘুগনি, বিক্রি করে তিন মাথার মোড়ে।
দেখতে কালো, ডাগরডোগর, বেশ লাগে কামিজ আর সালোয়ারে; বয়স - মেরেকেটে পঁচিশের দোরগোড়ে। সকাল হতেই জমজমাট - চা খাওয়ার ভিড়ে, দিনমজুর থেকে অফিসের বাবু সকলেই প্রাতরাশ সারে।
"কি রে, রাজু তো গেছে সেই কবে! ভালোই আছিস বল্ স্বামীকে একা ছেড়ে"!
রোজ
রাতে রাজু ঘুমের ঘোরে, রিং করে চটুল গানের সুরে! তিনমাস হলো রাজমিস্ত্রির কাজে, রাজু গেছে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরে।
পাড়ার ছেলে নান্টু রোজই আসে; বাইক রেখে চা সিগারেট ধরে দাঁড়ায় গা ঘেঁষে; ঢুকে আসে ছেঁড়া পলিথিনে ঢাকা কালো চালার ভেতরে।
গত রাত্তিরে রাজু বলেছিল ফোন করে, আসছে হোলি সে ফিরবে এবার ঘরে!
বললো বেশ আদর মাখা স্বরে, এসেই তোকে কিনে দেবো জামদানি আর সাজাবো সাতনরী হারে।
কি ভাবছিস বল্, খুশী হয়ে এবার না হয়, দে না একটা চুমু ফোনেই আওয়াজ করে।
"দে দে একটা সিগারেট, রাজুর কথা ভাববি পরে।"
নান্টুর ডাকে রণিতার সম্বিৎ যেন ফেরে।
"ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, কি হবে ন্যাকামি করে"!
"তোর শ্বশুর আর তোর শাশুড়ি, ওই দুটো হাড় বজ্জাত- চিনি আমি হাড়ে হাড়ে। কেমন শেয়ানা, কচি বউটাকে একা ফেলে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে কোন সেই হদ্দ দূরে।
"কি যা তা বলছিস তুই, লজ্জা শরম নেই কি একেবারে"!
"সেই দোকান সেরে, খাওয়াতে তো হবে রেঁধে বেড়ে"!
কথাটা মন্দ বলেনি নান্টু, রণিতার মনে ধরে।
"ছাড় ছাড়, ও সব দাসিগিরি ছেড়ে আজ বিকেলে চল আমার বাইকে চড়ে; বেনুবনে নিয়ে যাবো, হেব্বি মজা করে"!
কথা শেষ হতে না হতেই, দেখে নান্টুর বাপ হারান বাবু আসছে চেকচেক লুঙ্গি পরে।
"এখন পালাই, আসবো একটু পরে। "
নান্টু চলে গেলে রণিতা চেয়ে থাকে দূরে গাছের কাঁডে। শিমুল গাছটায় বেশ ধরেছে লাল ফুল, পাখিরা এসছে বেশ উড়ে।
হঠাৎ ফোনটা উঠতে বেজে, রণিতা দেখে ওরে, এই অসময়ে রাজুটাই বা কেন ফোন করে। হ্যালো বলে যেই না রণিতা ফোনটা কানে ধরে, চিৎকার করে রাজু বলে দারুন একখান স্বপ্ন দেখেছি আজকের কাকভোরে।
কি বলবো কি তোরে, স্পষ্ট দেখছি এবার দোলে - তুই আর আমি, উড়ছি বাইকে চড়ে!
--------------------------------------------------------------------------------------------------
বহু দিন আগে এক ট্রাক চালক, নাম গদাধর হালদার, ভীষণ স্নেহ করতেন আমাকে। ভালোবেসে আমি তাঁকে ডাকতাম, গদা দা। নদীয়ার, পলাশীপাড়ায় আমার সঙ্গে উনার আলাপ। আমার কর্মস্থল, পলাশীপাড়া ব্লক হাসপাতালে তাঁকে প্রায়শই আসতে হোত হাঁপানির ঔষধ আনতে। সেই সূত্রে উনি এলেই নানা জায়গায় যেহেতু উনার ট্রাক চালিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাই একটু ফাঁক পেলেই গল্প শোনানোর আবদার করতাম। তা উনি না করতেন না।
একদিন, অসমে গিয়ে সেখানে কি অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন তাই শোনাতে বসলেন। কামরূপের কামাখ্যা
মন্দির থেকে বেশী দূরে নয় এরকম একটা জায়গায়, রাত্রে ট্রাক চালিয়ে যাচ্ছিলেন দিসপুরের দিকে। রাস্তায় হঠাৎ এক সাধু তাঁর গাড়ির সামনে চলে এলে তিনি ব্রেক করে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হন। কি ব্যাপার, এরকম জনমানব শূন্য রাস্তায় প্রায় খালি গায়ে শুধু এক খন্ড কৌপিন পরনে তাঁর। মুখ ভর্তি সাদা দাঁড়ি, গোঁফ, কৃশকায় কঙ্কাল সার চেহারা।শুধু গলা থেকে কোমর ছাড়িয়ে ঝুলছে একটা লম্বা রুদ্রাক্ষের মালা।
এ তো ভয়ানক ব্যাপার গদা দা!
ভয়ানক বলে ভয়ানক!
আমি তো ঠক ঠক করে কাঁপতে লেগেছি, দেখি কি সাধু বাবা ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন।
ওরে বাব্বা। কি করলেন তাহলে?
আত্মারাম একেবারে খাঁচাছাড়া অবস্থা রে ভাই।
কি করলেন , কি করলেন তারপর?
দেখি কি, সাধুবাবা আমার দরজার একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন ।
তারপরে?
ওরে বাবা, তারপরে তো আরোও করুন অবস্থা!
দেখি সাধুবাবা তাঁর লিকলিকে হাতটাকে উঁচু করে ধরে প্রায় ভিক্ষা চাওয়ার মতো করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলছেন, কিছু খেতে দিবি বাবা?
সাধুবাবা বাংলায় কথা বলছেন?
হ্যাঁ। তারপরে, আপনি কি খাওয়ার দিলেন?
কিছুক্ষণ কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারপরে ভাবলাম কি আর হবে, কেবিনের কৌটায় কিছু মুড়ি আর চানাচুর রাখা ছিল তাই দেবো বলে, পুরো কৌটো সমেতই সাধুবাবার হাতে তুলে দিলাম।
সাধুবাবার মুখে সে কি আনন্দ।
আচ্ছা গদা দা, আপনার হেল্পার ছিল না।
না, হঠাৎ মায়ের অসুখ করাতে যেতে পারেনি। আমি একাই যাচ্ছিলাম।
কিন্তু শেষে যা হোল, সে আর কি বলবো!
কি হলো?
সাধুবাবা তৃপ্তি করে খেয়ে, কি বললেন জানো?বললেন, এই নে আমার এই মালা থেকে দুটো রুদ্রাক্ষ খুলে তোকে দিয়ে দিলাম। তুই রাখ। যত্ন করে রাখবি কিন্তু।
ইতিমধ্যে আরোও ঔষধ নেওয়ার লোকজন এসে ভিড় করেছে তাই গল্প থামিয়ে আমি ওদের ঔষধ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। গদা দা অনেকক্ষণ ঠায় বসেছিলেন। যতক্ষণে আমি একটু হালকা হয়ে এলাম গদা দা প্রায় গদগদ হয়ে বললেন, নাও একটা রুদ্রাক্ষ তুমি রেখে দাও। সঙ্গে সঙ্গে রাখবে।
গদা দা চলে গেলেন।
আজ ও সেই রুদ্রাক্ষ আমার কাছে আছে তবে গদা দা আর বেঁচে নেই।
প্রচ্ছদের রুদ্রাক্ষ কিন্তু শিয়ালদহ স্টেশনে বিক্রি হওয়া, একেবারে ডালা সমেত। ছবিটি তুলেছিলাম কয়েকদিন আগে।
রুদ্রাক্ষের সৃষ্টি নাকি শিবের চোখের জল থেকে, আজ শিব রাত্রির পুণ্য লগ্নে তাই গদা দা'র বলা রুদ্রাক্ষ পাওয়ার গল্পটা মনে পড়ে গেল। মনে পড়লো গদা দা কেও।
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------
পাঁপড়ি, তোমার সঙ্গে চ্যাট করতে করতে না আমার জীবন পুরো চাটনির মতো হয়ে গেছে।
কেন, কি হোল ডার্লিং?
দিনরাত ওই ফালতু প্রলেপ দিতে দিতে, একেবারে হাঁফিয়ে উঠেছি।
তাই? তুমি আসলে একটা বোকা হাঁদা!
কি বললে?
যা
শুনেছো! মানে? বোঝোনি তো?
আরে, পাঁপড়ির সাথে চ্যাট করতে যদি একান্তই হেদিয়ে যাও তাহলে একটু বাইরে বেরোও...!
মানে?
বেরোও তো! তাকিয়ে দ্যাখো, ফুটপাতে কি সুন্দর পাঁপড়ি চাট বিক্রি হচ্ছে। ওই তো কদম গাছের তলায়! বিহারী কাকার দোকানে।
হ্যাঁ, তো?
যাও না! মন পুরে একবার খেয়েই দ্যাখো না?
পাঁপড়ির সাথে চ্যাট করার স্বাদ পানসে হলে পাঁপড়ি চাট খেলে রূচি ফিরে আসে, বুঝলে!
দারুন আইডিয়া দিলে তো।
দাঁড়াও দাঁড়াও, এক্ষুনি আসছি ঘুরে একটু!
কিন্তু পাঁপড়ি, তুমি জানলে কি করে, এখানে পাঁপড়ি চাট বিক্রি হচ্ছে?
তাহলে কি তুমি ...?
(পাদটীকা: বাঙালী যবে থেকে কথা বলা ভুলে চ্যাট করা ধরেছে তবে থেকে পাশের জনের সঙ্গেও নীরবে শুধু চ্যাটিং ই করে। )
-------------------------------------------------------------------------------------------------
------------------------
দুজনের প্রথম পরিচয়, প্রকৃত অর্থেই ভার্চুয়ালি। একজন লেখক এবং তার লেখার গুণমুগ্ধ পাঠকের মধ্যে সম্পর্ক যেমন হয়, তেমনি। একজন লেখক লেখেন আর শত সহস্র অচেনা, অপরিচিত পাঠক সেই লেখা পড়েন আর তাদের মনের মধ্যে লেখকের জন্যে তৈরি হয় একটা গভীর শ্রদ্ধা ভরা অনুরাগ। কখনো সখনো দূর থেকে দেখার সৌভাগ্য হয় কারোর কারোর। হয়তো সুযোগ হয় অটোগ্রাফ নেওয়ার বা কিছু সৌজন্যমূলক কথা বার্তা বলার। কিন্তু সেই সম্পর্ক নিবিড় থেকে নিবিড়তর হতে হতে ক্রমশ তা ঘনিষ্ঠতায় রূপান্তরিত হচ্ছে, এরকম কাহিনী গল্প উপন্যাসে পাওয়া গেলেও বাস্তব জীবনে এর নজীর খুব একটা নেই বললেই চলে।
যদিও এখানে যিনি পাঠক, তিনি নিজেও একজন সফল লেখিকা। কিন্তু ব্যাপারটা তো শুধু
লেখক- পাঠক বা দুজন লেখকের মধ্যেকার আম সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ছাড়িয়ে
যায় সকল গণ্ডীর সীমানা। বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায় সম্পূর্ণ অচেনা এই সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে চর্চা চলছে,
নিরন্তর। চলছে বিতর্কও। কিন্তু এর আকর্ষণ কমার পরিবর্তে যত দিন যাচ্ছে হরিণের মাংসের মতই তত ভিন্তেজ ও
তত সুস্বাদু হয়ে উঠছে। কারণ এই সম্পর্ক রচনার যারা কারিগর তারা কেউ হেলাফেলার মানুষ নন। এক জন ভারতের
প্রথম এবং এখনো পর্যন্ত অদ্বিতীয় নোবেল বিজয়ী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর দ্বিতীয়
জন আর্জেন্টিনার প্রথিতযশা লেখিকা ভিক্টোরিয়া অকেম্পো। ভালো করে বোঝার জন্যে একটু
ফ্ল্যাশ ব্যাকে গিয়ে সম্পর্কের প্রেক্ষাপটটাকে জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
২৩ বছরের এক ঝরঝরে যুবতী, যার প্রাণের উচ্ছ্বাস আবর্তিত হতে চাইতো সাহিত্যের সুললিত কক্ষপথ ধরে। কিন্তু পারিবারিক রক্ষণশীলতার কারণে সে উৎসার তখনো বালি চাপা জলের ধারার মতোই অপ্রকাশিত। যার কামনার উদযাপন অবরুদ্ধ, বৈবাহিক সম্পর্কের ভাঙনে। সেই যুবতী একান্তই তখন তাঁর অবদমিত কামনার সৎকার করতে চাইছেন তারই এক কাজিনকে দিয়ে। ডিভোর্সি যুবতিকে তার জন্য তথাকথিত ‘অবৈধ সম্পর্কের’ লাশ বয়ে বেড়াতে হয় দিন রাত। সময়টা গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শুরুর দিক। ১৯১৩ সাল। আর্জেন্টিনীয় সমাজের সেই যুবতী, অবচেতন মনে প্রায়শই নীল হয়ে ওঠেন অপরাধবোধের চাপা ছোবলে। কিন্তু নিষ্কৃতির কোনো উপায় ছিল না তাঁর কাছে।
ল্যাটিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা থেকে কয়েক হাজার ক্রোশ দূরে অবস্থিত ব্রিটিশ
ভারতবর্ষের কবি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তির খবর সেই আর্জেন্টিনীয়
যুবতীর কানে নিশচই পৌঁছেছিল। তা না হলে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির ঠিক এক বছর পরে অর্থাৎ ১৯১৪ সালেই কি করে Andre Gide কৃত ‘গীতাঞ্জলি’
র ফরাসি অনুবাদ পৌঁছে যায় যুবতীর হাতে? পেয়েই পড়ে ফেললেন, কালক্ষেপ না করে। যেন
অপেক্ষাতেই ছিলেন। মরুর তপ্ত বালির মত শুষে নিলেন ‘গীতাঞ্জলী’র সব অমৃত সুধা। এবং পাঠ
অন্তে উদাত্ত ভঙ্গিতে, গলা ছেড়ে বলে উঠলেন তাঁর সেই তৃষ্ণা মুক্তির কথা, “আমার
যন্ত্রণা ক্লিষ্ট হৃদয়ে যেন স্বর্গীয় শিশির হয়ে এল এই জাদুকাব্য“ ‘It (Magical Mysticism) fell like celestial dew on my anguishing twenty
four year old heart’
ভিক্টোরিয়া অকেম্পো নামের
সেই আর্জেন্টিনীয় যুবতী নিতান্তই তখন এক মুগ্ধ পাঠিকা রবীন্দ্রনাথের লেখার। তাঁর
মুগ্ধতার বিস্ময় রবীন্দ্রনাথকে সেই রূপকথার মসিহায় পরিনত করেছে যিনি তাঁর অপরিমেয় কলমের
শক্তি দিয়ে মুছে ফেলতে পারেন তাঁর জীবনের সকল যন্ত্রণার ইতিহাসকে। কিন্তু পৃথিবীর
অন্য প্রান্তে থাকা ৫৩ বছর বয়সী প্রৌঢ় কবি রবীন্দ্রনাথ তখন এ সবের বিন্দু বিসর্গ ও
কিছু জানতেন না।
রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া অকেম্পোর মধ্যেকার যে সম্পর্ক নিয়ে এত কথা হয়, তার মূল
আকর্ষণ কিন্তু এই দুই অসম বয়স্ক নারী ও পুরুষের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ক কতটা
প্লেটোনিক অর্থাৎ কতটা শরীরী স্পর্শ বিবর্জিত ছিল এই জিজ্ঞাসার নিরিখেই। কারণ এই
নিয়ে আছে অনেক গুঞ্জন। প্রত্যেকটিকে আমরা
আতস কাঁচের তলায় ফেলে দেখবো, গুঞ্জনের নেপথ্যে আদৌ কোনো সঙ্গত কারণ ছিল কিনা।
---------------------------------------------------------------------------------
---------------------------------------------------------------------------------------------------
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
নাম না জানা ফুলের নাম! কোনোদিন যার নামই জানার চেষ্টা করিনি তার অপার সৌন্দর্য যে কখনো আমার দৃষ্টি পথে এত মুগ্ধতা তৈরি করতে পারে সে কথা আগে ভেবে দেখিনি। কিন্তু মুগ্ধতার ও তো একটা নাম থাকা প্রয়োজন। ভালোলাগা মুখগুলোকে যেভাবে আমরা নামের লালিত্যের সঙ্গে জুড়ে খানিক আত্মপ্রসাদ লাভ করি, আরে ও তো পল্লবিতা বা কুসুমিতা বলে, সেভাবেই জানার চেষ্টা করি সেই অলীক নান্দনিকতার কি নাম হতে পারে।
পরিচিত দের ডেকে ডেকে দেখাই, দেখিয়ে শুধাই এটা কি ফুল হতে পারে বটে!
কেউই ঠিক ঠাক বলতে পারেন না। শেষে ওই সকল নাম না জানা ফুল
যেভাবে বুনো ফুল উপাধি পায় এবং এই নামেই যুগের পর যুগ কাটিয়ে দেয় বিনা বাক্য ব্যয়ে এর ও ওই একই দশা হতে ভারী কষ্ট হোল মনে।
তাই একটা নাম দিতে হবে ভেবে বেশ কিছু শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে দেখি ভীষণ বিপত্তি। কোনোটাই ঠিক মনের মতো হয় না।
নাম দেওয়ার সংকল্পে এবারে যাকে বলে মাথায় ফেটি বেঁধে একেবারে নেমে পড়লাম ভাবনার বৃত্তে কাবাডি কাবাডি করতে করতে।
আচ্ছা এটা কিন্তু ফুল নয়। ফুলের বৃতি। ফুলগুলো হয় সাদা রঙের, ভারী মিষ্টি দেখতে। কিন্তু সে তো কবে ঝরে গেছে। রয়ে গেছে এই ফুলদানির মতো দেখতে, সুন্দর সুন্দর রক্তিম বৃতি পুঞ্জ গুলো। কেমন যেন হেমন্তের ভোরের মিঠে রোদ পোহানোর জন্য ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে শিশির ভেজা হয়ে।
কখনো কখনো সৃষ্টির থেকে সৃষ্টিকে যে ধরে থাকে সেই ধারককে বেশী সুন্দর লাগে।
অগত্যা কি নাম দেই ভাবতে ভাবতে - বৃন্ত কুঞ্জ বা বৃন্ত গুচ্ছ জাতীয় নাম গুলো আলগোছে মনে আসে। কিন্তু এগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগলেও কেউই এর গম্বুজের মতো আকৃতিকে ডিফাইন করতে পারে না। হঠাৎ করে সেই সময় - শিস মহল শব্দটা মনে এল একেবারে বিদ্যুৎ ঝলকের মতোই।
কেমন হয় কেমন হয় করে শেষে এর নাম বৃন্ত মহল রাখাই সাব্যস্ত করলাম।
কেমন হয়েছে,
আচ্ছা বলুন তো নামে কি যায় আসে?
-----------------------------------------------------------------------------------------
অন্য পুজোর গল্প!
শীর্ণকায় শরীর, আদুল গায়ে - বুকের ওপর ঝুলছে লক্ষী নারায়ণের ফটো, গলা থেকে দড়ি দিয়ে ঝোলানো। ওটাই বিদুর কয়ালের আইডেন্টিটি কার্ড।
মহাভারতে বিদুরের চরিত্রে একটা ট্র্যাজিক দিক ছিল। গভীর অরন্যের বুকে যেমন জেগে থাকে পত্র শূণ্যতার ধূসর রেখা তেমনি মহা জ্ঞানী বিদুরের জীবনেও ছিল এক নিয়তি নির্দিষ্ট বিয়োগান্তক চেতনা।
আর
এই বিদুর যিনি বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে সুরের এমন অনুপম লহরী তোলেন পথ চলতি মানুষের হৃদয়ে তিনি ক্র্যাচ ছাড়া চলতে পারেন না। ছোটবেলায় পোলিওয় আক্রান্ত হয়ে হারিয়ছেন চলৎশক্তি।
বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরে।
কে কে আছেন বাড়িতে?
স্ত্রী, দুই মেয়ে। বৃদ্ধা মা।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকটি মানুষের নাকি থাকে বিশেষ কোনো একটি প্রতিভা। বিদুর ছোটবেলায় তার বাড়ির মাটির দাওয়াতে বসেই আপন খেয়ালে, রেডিও তে শোনা নানা মন পসন্দ গানের সুর তুলতো বাঁশিতে। পরিনত বয়সে এখন সেটাই তার জীবিকা হয়ে গেছে।
সামনে পাতা গামছায় পড়ে থাকে পেট চালানোর পারিশ্রমিক। খুচরো পয়সা, কয়েকটি ১০ টাকার নোট, সঞ্চিত হতে থাকে বিদুরের উপার্জন।
সামনে পুজো। মহা পুজো।
নিউ গড়িয়া মেট্রো স্টেশনের সাবওয়ে তে কি তখনো বিদুর কে দেখা যাবে?
বাঁশিটাকে নামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বিদুর।
পুজোর দিন গুলোতে এখানেই থাকবো।
বাড়ি?
সবাই তো পুজায় বাড়ি ফিরবে।
না। কয়েকদিন আগে গিয়ে কিছু টাকা দিয়ে আসবো মেয়ে আর মায়ের জন্য কিছু কিনে দিতে হবে তো।
তাই তো ...!
পুজোর ছুটিতে বিদুরের ছুটি নেই।
এই শহরেরই এক জনাকীর্ণ সাবওয়ে তে বসে পুজা দেখতে যাওয় মানুষ জনের মনোরঞ্জন করে যাবে বিদুর।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে '
কেন জানি, আজকাল শিয়ালদহ স্টেশনে ঢুকতে গিয়ে মাঝে মাধ্যে মনে হয়, ভুল করে কোনো শপিং কমপ্লেক্সে ঢুকে পড়ছি না তো? ডেলি প্যাসেঞ্জার ( পড়ুন 'ডেলি পাষন্ড') হওয়ার সুবাদে শিয়ালদহ স্টেশনের এই বদলে যাওয়ার ছবিটা বেশ চোখে পড়ে। চারিদিকে রকমারি বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। ট্রেনের ছাড়া ও পৌঁছানোর বিল বোর্ড খুঁজি হন্যে হয়ে। কখনো কখনো তো নিজেকে পথ ভুলে এসে পড়া কোনো অচেনা আগন্তুক বলে মনে হয়। ভ্রম যেন সহজে কাটতে চায় না।
আর তখন ই
কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা কবিতার সেই লাইন গুলোকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে উঠতে দেখি। সেটাই বুঝি এ যাত্রার একমাত্র সান্ত্বনা।
"একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
…. তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।".
চলুন তাহলে দেখাই যাক পুরোদস্তুর মুখোশ না হলেও বিজ্ঞাপনের আচ্ছন্নতায় মোড়া শিয়ালদহ স্টেশন বিল্ডিং এর বাইরেটাকে ঠিক কেমন দেখতে লাগে!
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------
২০২৪, কালী পূজার দিন ফিরিঙ্গী কালী মন্দিরে!
পাঁচশো বছরের ও বেশি পুরনো
#ফিরিঙ্গি_কালী মন্দিরে আজ ভক্তদের ঢল। অঞ্জলী দেওয়ার সুদীর্ঘ লাইন মন্দিরের প্রবেশ পথ থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের ক্রসিং পর্যন্ত বিস্তৃত। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও মায়ের কাছে পৌঁছতে রাজি ব্রতীরা, কোনো অস্থিরতা নেই। এছাড়াও উৎসাহী মানুষজন, অগুনতি পথচারীদের প্রগলভ ভীড়ে মন্দিরের সামনের রাজপথ একেবারে থৈ থৈ আকুলতায় উপচে পড়তে চাইছে। যান নিয়ন্ত্রণ থেকে দর্শনার্থীদের ভিড় সামলাতে সদা ব্যস্ত পুলিশ কর্মী থেকে স্বেচ্ছাসেবকেরা। দম ফেলার ফুরসত নেই
মন্দিরের পুরোহিত, ব্রাহ্মণদের।
এমত অবস্থায় ফিরিঙ্গি অ্যান্টনি সাহেবের স্মৃতিধন্য এই মন্দিরে আজ শ্যামা পুজো উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছে বিশেষ পুজোর। ব্যস্ততার ফাঁকে এক পুরোহিত বললেন, পুজো চলবে অধিক রাত পর্যন্ত। স্বাভাবিক ভাবেই মায়ের পুজো দেখার উৎসাহ উদ্দীপনা আজ এককথায় বাঁধনহারা
আমিও পৌঁছেছিলাম খানিকটা আবেগের তাড়নায়, পাশাপাশি মায়ের কৃপা লাভের সুপ্ত বাসনার কথাই বা অস্বীকার করি কি করে।
যাই হোক মায়ের অশেষ কৃপা যে সে কাজে আমি আজ অনেকটাই সফল। এক্ষেত্রে এক সহৃদয় পুলিশ কর্মীর সহযোগিতা ও পেযে যাই কিছুটা অযাচিত ভাবেই। আর তাতেই একেবারে মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে দেখার সৌভাগ্য হযে যায় মাতৃ আরাধনার সেই অন্তরঙ্গ দৃশ্য। সে এক অন্যরকম অনুভুতি।
তবে মায়ের পদতল অবধি পৌঁছতে বেশ কয়েকটা পর্ব অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রথমে মন্দিরের বিপরীতে থাকা ফুটপাত, সময় যত গড়িয়েছে সেই নৈকট্য তত বেড়েছে । তাই সেই দৃশ্য পরম্পরায় বেশ একটা নাটকীয়তা রয়েছে। পুরো ভিডিওটি প্রথম থেক দেখলে সেটা ভালোই অনুভূত হবে।
শেষ অব্দি দেখার অনুরোধ রইল।
অনেক কথাই বলা হয়ে গেল । আর কথা না বাড়িয়ে এবার চলুন দেখা যাক।
ওঁ হ্যাঁ মন্দিরের ইতিহাস এবং এর সঙ্গে ফিরিঙ্গি কবিয়াল অ্যান্টনি হেনসম্যান এর চমকপ্রদ সম্পর্কের ইতিবৃত্ত জানতে পড়ে দেখতে পারেন আমার লেখা -
ফিরিঙ্গি কালী এবং অ্যান্টনি কথা!
------------------------------------------------------------------------
#ঠনঠনিয়_কালীবাড়িতে গিয়েছিলাম গত মঙ্গলবার, ত্রয়োদশীর সন্ধ্যায। কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে খানিকটা উত্তরে হাঁটলেই বিধান সরণীতে পড়ে তিনশো বছরেরও বেশি প্রাচীন এই ঐতিহ্যময় কালী মন্দিরটি।
কালী পুজো উপলক্ষে বিশেষ পুজো অনুষ্ঠিত হয় মন্দিরে। তার প্রস্তুতি নজরে পড়লো, ফুল এবং আলোক মালার বিশেষ সজ্জায়।
সবথেকে চমকপ্রদ মন্দির অধিষ্ঠাত্রী মাযের যে রূপ দেখার সৌভাগ্য হলো আমার যা এই সময় ছাড়া সচরাচর দেখা যায় না। কারণ প্রতি বছর এই কালী পুজোর ঠিক আগে আগে পুরনো মূর্তি সরিয়ে মায়ের নতুন
মূর্তি প্রতিস্থাপিত হয়। তাই মা এই সময়টাতে আটপৌরে লাল পাড় সাদা তাঁতের শাড়ি পরেই বিরাজ করেন বেদীতে। থাকে না অলংকারের কোনো সাজ ও। সর্বোপরি এই সময়ে মায়ের খড়্গ কিংবা নর মুন্ড কোনোটাই থাকে না তাঁর হাতে।
তাই মাতৃ মূর্তির সেই বিরল রূপ যা প্রত্যক্ষ করলাম নিজের চোখে তা কি না দেখালে চলে?
এই সূত্রে থাকলো মন্দির সম্পর্কে নানা জনশ্রুতি, ইতিহাস এবং রহস্যে মোড়া বিভিন্ন চমকপ্রদ কথকতা সম্বলিত অনুসন্ধানী লেখা।
পড়তে ক্লিক করুন নীচের লিঙ্কে
-----------------------------------------------------------------------------------------------
অপরাহ্নের বৈরাগ্য ভাব লেগে থাকে যে মন্দিরের গায়ে!
আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর দিকে নির্মিত হয়েছিল পোড়ামাটির প্রাচীন এই মন্দিরটি।
পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন বিধানসভার অন্তর্গত মোহনপুর এলাকায় জগন্নাথ বাড়ি বলে পরিচিত এই মন্দিরের গায়ে বা অন্য কোথাও সেভাবে কোনো প্রতিষ্ঠা সাল লেখা নেই। তবে গত বছর আর্কিওলজি দপ্তর থেকে পরিদর্শনে আসা সার্ভেয়াররা, মন্দিরের গঠন সৌকর্য পরীক্ষা করে এর আনুমানিক প্রতিষ্ঠা সাল পনেরশো
সালের প্রথম দুই দশকের মধ্যে হতে পারে বলে তাদের মতামত জানিয়ে গিয়েছে।
প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমির ওপর থাকা মূল মন্দিরের দুপাশে রয়েছে মহা লক্ষী, নৃসিংহ মহাপ্রভু ও দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দির। এছাড়াও মন্দিরের ডান দিকে, উত্তর দিকের প্রাচীর ঘেঁষে রয়েছে জগন্নাথ দেবের সুদৃশ্য স্নান মঞ্চ। ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া সেই স্নান মঞ্চে প্রতি বছর স্নান যাত্রার সময় স্বয়ং জগন্নাথ দেব তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরাম ও ভগ্নী সুভদ্রার সঙ্গে একসাথে স্নান করেন।
মূল সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে সুদীর্ঘ নাটমন্দির পেরিয়ে এগোনোর সময় চোখে পড়বে বেদীমূলে অধিষ্ঠিত জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার অপূর্ব সে মূর্তি ত্রয়ী। নিত্য পুজা এবং নিত্য ভোগদানের ব্যবস্থা রয়েছে মন্দিরে। তবে সন্ধ্যা আরতির সময়ে এখানে খোল, করতাল, কাঁসর ছাড়াও এক বিশাল ধামসায় বাজে দ্রিম দ্রিম ধ্বনি, যা অবশ্যই আপনাকে এক অন্য জগতে নিয়ে যাবে।
ও হ্যাঁ এই মন্দিরটির ও নির্মাণের পেছনে রয়েছে এক জমিদারের হাত।
পুরির রাজা মুচকুন্দ দেব হরিচন্দ্র নিযুক্ত সামন্ত জমিদার রামচন্দ্র করমহাপাত্রের পুত্র পিতাম্বর করমহাপাত্রের আমলে শুরু হয় এই মন্দির নির্মাণের কাজ। শেষ হয় তাঁর দুই পুরুষ পরে, শ্রী হরনারায়ণ চৌধুরীর সময়ে। মোঘলদের কাছ থেকে পাওয়া তাঁদের এই চৌধুরী উপাধিই বর্তমানে তাদের নামের শেষে ব্যবহৃত প্রচলিত পদবী হয়ে গেছে।
কথা বলছিলাম হরনারায়ণ চৌধুরীর সপ্তম পুরুষ উত্তরসূরি, অবসরপ্রাপ্ত পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক সুব্রত চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি কি বললেন পরে একদিন বলবো না হয়।
লেখা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে।
ওড়িশা সংলগ্ন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মোহনপুরে রয়েছে একটি বহু প্রাচীন জগন্নাথ মন্দির। আনুমানিক ৫০০ বছর পূর্বে, এখানকার সামন্ত জমিদার হরনারায়ণ চৌধুরীর আমলে, এই মন্দিরের নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হয়। পোড়ামাটির কারুকার্য শোভিত এই মন্দিরের বাম হস্তে রয়েছে লক্ষী ও ডান দিকে মহাদেবের মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য হলো ধামসা বাজিয়ে সন্ধ্যা আরতির সময়ে জগন্নাথ দেবের নামগান করা।
সেই সান্ধ্য বন্দনার অনুপম দৃশ্যই আজ শেয়ার করে নিলাম।ওড়িশা সংলগ্ন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মোহনপুরে রয়েছে একটি বহু প্রাচীন জগন্নাথ মন্দির। আনুমানিক ৫০০ বছর পূর্বে, এখানকার সামন্ত জমিদার হরনারায়ণ চৌধুরীর আমলে, এই মন্দিরের নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হয়। পোড়ামাটির কারুকার্য শোভিত এই মন্দিরের বাম হস্তে রয়েছে লক্ষী ও ডান দিকে মহাদেবের মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরের একটি প্রাচীন ঐতিহ্য হলো ধামসা বাজিয়ে সন্ধ্যা আরতির সময়ে জগন্নাথ দেবের নামগান করা।
সেই সান্ধ্য বন্দনার অনুপম দৃশ্যই আজ শেয়ার করে নিলাম।
--------------------------------------------------------------------------------------------
#কাঁথি শহর জুড়ে পোস্টার পড়েছে 'মা হঠাৎ কালী'র নামে। ২০২৪ সাল! তবে ভয় নেই, হঠাৎ কালীর নাম দিয়ে কোনো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার আশঙ্কার কথা বলার জন্য এই প্রচার পত্র সাঁটা হয়নি দেওয়ালে দেওয়ালে। বরঞ্চ 'মা হঠাৎ কালী' নামের যে একটি বাংলা সিনেমা রিলিজ করেছে গত ৩১ শে অক্টোবর বৃহস্পতিবার কালী পুজোর দিনে, সে কথাই ফলাও করে লেখা রয়েছে পোস্টারে। সিনেমাটি প্রযোজনা করেছে মা হঠাৎ কালীর সুধী ভক্ত বৃন্দ। তিনটে শোয়ে দেখা যাবে এই 'সুপার ডুপার হিট বাংলা' ছবিটি, তবে প্রবেশ
অবাধ, কোনো প্রবেশ মূল্য দিতে হবে না বলেই পোস্টারে বেশ বড় বড় করে লেখা রয়েছে।
ছবি যখন, নিশ্চিত কোনো সিনেমা হলেই মুক্তি পাবে সেটি। সেটা অবশ্য উল্লেখ করতে ভোলেনি ছবির প্রযোজকরা। পোস্টারে লাল লাল বোল্ড অক্ষরে লেখা রয়েছে সিনেমা হলের নাম - 'উদয়ন'। আর এখানেই তৈরি হয় বড় একটা খটকা।
কারণ বর্তমান শতাব্দীর শুরুর দিকে একটা নতুন সাংস্কৃতিক প্রবাহ শুরু হয়। আমরা জানি, তার ফলে সিনেমা হলে গিয়ে পছন্দের সিনেমা দেখার যে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ছিল তা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে পড়তে থাকে। সিনেমা হল মুখী মানুষজন ঘরে বসেই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের দৌলতে সিনেমা দেখে নেওয়ার ফলে সবথেকে বিপাকে পড়ে মফস্বলের একক পর্দার ছোট ছোট সিনেমা হল গুলি (বড় শহরের মাল্টিপ্লেক্স গুলি বাদে)। দর্শকের সংখ্যা দিনের পর দিন কমে যাওয়াতে বন্ধ করে দিতে হয় প্রেক্ষাগৃহ গুলোকে। সেই সংকট স্রোতে পড়ে কাঁথি শহরের সবথেকে প্রাচীন এই 'উদয়ন' সিনেমা হলটিও বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় এক দশকের বেশি সময় আগে। উল্লেখ্য সিনেমা হলের স্থলে বর্তমানে একটি বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, তাহলে? কিছুতেই যেন মেলাতে পারিনা!
রহস্য নিরসনে, পোস্টার দেখে সিনেমা হলের ঠিকানায় পৌঁছে দেখি সত্যি সত্যিই আমাদের কৈশোর ও যৌবন বেলার অনেক সুখ স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা সিনেমা হলটি তার নিজস্ব চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। হুবহু সেই গঠন শৈলী। রাজেন্দ্র হল লেখা প্রেক্ষাগৃহের সামনে দাঁড়িয়ে বিহ্বলতা কাটাতে কিছুটা সময় লেগেছিল আমার। আরো যখন চোখে পড়লো - হলের সামনে সেই বিখ্যাত ভীম দা দাঁড়িয়ে, ছোলা বাদাম বিক্রির দোকান নিয়ে, কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন ফিরে গিয়েছিলাম হারিয়ে যাওয়া সেই ধূসর স্মৃতির প্রিয় দিনগুলোতে। ধন্দ কাটলো যখন ভীম দা' র কাছে পৌঁছলাম। বুঝলাম নিস্পন্দ ভীম দা আসলে একটি মাটির মূর্তি। আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা উদয়ন' সিনেমা হলটিও একটি বাঁশ কাপড়ের তৈরি থিম পুজোর প্যান্ডেল।
হ্যাঁ, কাঁথি শহরের আউটডোর বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায় হওয়া এবারের কালী পুজোর থিম ছিল সিনেমা হল নিয়ে পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনা। বলাই বাহুল্য তারা সে কাজে যথেষ্ট সফল।
কারণ সিনেমা হলের পরিবেশকে সুচারু ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পুরনো দিনের হিট সুপারহিট ছবি গুলোর বড় বড় ফেস্টুন টাঙানো রয়েছে দেখলাম প্রবেশ পথের দু ধারে। দেখে মনে হতেই পারে কোনো সিনেমা উৎসব চলছে বোধহয়। যেখানে হয়তো পোস্টার প্রতিশ্রুত, সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি 'মা হঠাৎ কালী'র প্রিমিয়ার শো দেখা যাবে।
----------------------------------------------------------------------------------------
শিব, কালী, বিষ্ণু তিন দেবতার তিনটে পৃথক্ মন্দির। কে যেন বলেন শ্যাম আর শ্যামা ভিন্ন নন। তাহলে একই মন্দিরেই তো দিব্যি থাকতে পারতেন সকলে। আসলে দেবতাদের রুচি বোঝে কার সাধ্যি। তবে হ্যাঁ একান্নবর্তী না থাকলেও একই পরিসরে রয়েছেন। একেবারে, মুখোমুখি। মায়ের বাড়ী স্বাভাবিক ভাবেই দক্ষিণ মুখী, শিব পশ্চিম দিকে আর ভগবান বিষ্ণু পূর্ব দিকে মুখ করে বিরাজ করেন এখানে। কাল্পনিক রেখা দিয়ে যোগ করলে প্রায় একটি ত্রিভুজের মতো; মোটের উপর যার তিনটে কৌনিক বিন্দুতে তিনটে মন্দিরের অবস্থান বলে ধরে
নেওয়া যেতে পারে।
তবে মন্দির আলাদা আলাদা হলে কি হবে বসবাসের নৈকট্যে কিন্তু গভীর সখ্যতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়।
সকালের রোদ যখন বিষ্ণু মন্দিরের চূড়ায় এসে লাগে তার উদ্ভাস ছড়িয়ে পড়ে বাকি দুই মন্দিরের গায়ে। মধ্যাহ্নের প্রখরতা যখন মাঝের ঘেসো জমির সতেজতাকে ঝলসে দিতে চায় তিন মন্দিরই তখন তাদের ছায়া দিয়ে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। অপরাহ্নের অস্ত রাগ ও সবাই ভাগ করে নেয়; এবং দিব্যি সন্ধ্যার অন্ধকারকে কিছুটা সময়ের জন্য ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এ এক আশ্চর্য তালমিল।
নারকেল, সুপারি, বেল ও গোলাজ ফুলের গাছে ঘেরা এই মন্দির ত্রয়ী ছোটবেলা থেকেই আমার মনে গভীর বিস্ময়ে ভরা এক উদ্ভট উদাসীনতা জাগিয়ে তোলে। মনে হয় কত যেন রহস্য লুকিয়ে আছে, যে রহস্যকে আবার জাগিয়ে রাখতে অদ্ভুত এক বিষন্নতা যেন দিনরাত এক করে কাজ করে চলে।
--------------------------------------------------------------------------------------------
না- কোনো রাখঢাক করে নয় বরং মুক্ত কন্ঠে, কোনোরূপ দ্বিধা ছাড়াই এ কথা বলে দেওয়া যায় যে এ জগতে যত ফুল ফোটে তার অপরূপ শিল্প সুষমা কেবল নারীর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার লক্ষেই রচিত হয়। কিন্তু পৃথিবী তো পুরুষ আর প্রকৃতির যুথবদ্ধতায় গড়ে ওঠা একটি দিনরাত্রির একান্নবর্তী সংসার। সেখানে ফুল ফোটানোর প্রেরণা শুধু নারী দেহের লাবন্য থেকেই আহরিত হবে কেন! যাক গে, সে অনেক বিতর্ক। আর তর্কে আমি বরাবরই হেরো।
যেমন আজকের ফুলগুলি, ভালোলাগা নারীর কবরী সজ্জায় কি দারুন মানাবে বলুন তো! একটু কল্পনা
করে নিতে পারেন এই সুযোগে। কল্পনা করতে তো আর পয়সা লাগে না।
আর, কোথায় পাবেন?
পথের ধারেই, আগাছার মতো বেড়ে ওঠা অবাঞ্ছিত লতা পাতার শরীর জুড়ে এখন এমনই অলৌকিক ফুল সম্ভার দেখতে পাবেন ফুটে আছে তার পুষ্পিত পাঁপড়ি গুচ্ছ নিয়ে, ভালো লাগলে সংগ্রহ করতেই পারেন, পুরো বিনামূল্যে।
এইটুকুই।
----------------------------------------------------------------------------------------------
পাঁপড়ির রঙের বিন্যাসে শিল্পীর শৌখিনতার পরিচয় পাওয় যায় বটে তবে পাঁপড়ির আকৃতি কিংবা তার গঠন সৌকর্যের প্রশ্নে দৃশ্যতই তার কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে মিল থাকার দিকটাও নজর এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তবে কি শিল্পী আর আজকাল মৌলিক রচনা করতে পারছেন না? তাই কি তার এই পুনঃ সৃজন ?
নিজের সৃষ্টিকেই একাধিক বার পুনঃ সৃজন করার অর্থ, দুটো। প্রথমত, শিল্পীর নান্দনিক কল্পনা শক্তির সীমাবদ্ধতা এসে গেলে এমনটা হতে পারে আর দ্বিতীয় কারণ হলো শিল্পী যখন নিজেই নিজের সৃষ্টির মোহে পড়ে যান এবং নিজের চারিদিকে
একটি অনতিক্রম্য সৃষ্টি ব্যুহ রচনা করে ফেলেন, তখন। যেখান থেকে বেরোতে পারেন না শিল্পী বা বেরোতে চান না। হয়তো একেই শিল্পীর ঘরানা বলে।
তখন দেখা যায়, পারমুটেশন-কম্বিনেশনে পদ্ধতিতে প্রত্যেকটি সৃষ্টিই প্রত্যেকটির ছায়া হয়ে উঠছে। এখন প্রশ্ন, শিল্পী কি সেই অলীক ব্যুহ কে ভেঙে বেরোতে পারবেন কখনো? প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর জীবনেই এই চ্যালেঞ্জ আসে, তাকে ভাঙতে পারাটাই শিল্পীকে এনে দেয় অমরত্বের ঠিকানা।
যদিও এই ফুলের স্রষ্টা অলরেডি অমর হয়ে গেছেন। সৃষ্টির অমৃত রস ওঠে কল্পনার সমুদ্র মন্থনে। দেখা যাক, আগামীদিনে হয়তো শিল্পী আবার কোনো ছক ভাঙা সৃষ্টি রসে ডুবিয়ে ছাড়বেন সকলকে। সেই আশাতেই থাকি না হয়!
এইটুকুই।
-----------------------------------------------------------------------------------------
অরণ্য, পৃথিবীর আদি উপনিবেশ। ঊষর ভূখন্ডের ওপর গড়ে তোলা জাগতিক ইতিহাসের প্রথম সবুজ কলোনি। সীমান্তে, দিবানিশি বিশুদ্ধ বাতাসের অক্লান্ত প্রহরায় চরম নিশ্চিন্তি বিরাজ করে এখানে। পৃথিবীর প্রাচীনতম এই সাম্রাজ্যর স্থপতি আজও তার রাজত্ব রক্ষায় গাছগাছালির ছায়াগলোকে মায়াময় করে রাখতে সদা তৎপর।
সূর্য চন্দ্রের আলো অতিথি হয়ে আসে বটে, ঋতু চক্রের সুখ দুঃখও ছুঁয়ে যায় এর সবুজ আঁচলকে, কখনো ঝরা পাতায় ভরে যায় এর ছায়ামাখা, স্যাঁতসেঁতে জমিন ; অরণ্য কিন্তু মাথা তুলেই থাকে অপরাজেয়
সাম্রাজ্যের পালহীন মাস্তুল দন্ড হয়ে। ঝড়ে, ঝাপটায় কিংবা ভয়ঙ্কর বজ্র আক্রমণের সামনেও মাথা নোয়ায় না। গৃহযুদ্ধের দাবানল ও কখনো কখনো ধ্বংস করে দিতে চায় অরণ্যের একাধিপত্যকে, তাও অরণ্য অনড় থাকে তার স্থানে। অরণ্য আসলে অনাদি, ধরিত্রীর আদি উপনিষদের অমূল্য আকর গ্রন্থ।
যুগের পর যুগ ধরে, স্বমহিমায় সমুত্থিত থাকার জীবন দর্শনই ছড়িয়ে দিতে চায় পৃথিবীর এক গোলার্ধ থেকে আরেক গোলার্ধে। ভূমি থেকে ভূমার পথে যাওয়ার এই অসীম যাত্রাপথ তত্ত্ব দিয়েই অরণ্য দখল করতে চায় পুরো পৃথিবীকে। অরণ্য এই ব্যাপারে - সত্যিকারের সাম্রাজ্যবাদী। আর পৃথিবী যদি আসেই অরণ্যের এক ছাদের তলায় তো ক্ষতি কি?
অরণ্যের সুখদুঃখ, অরণ্যের শাসন অনুশাসন, অরণ্যের পাপ পুণ্য নিয়ে না হয় আরেকদিন বলবো।
---------------------------------------------------------------------------------------------------
শিল্পী নামজাদা নন, অখ্যাত। কিন্তু অনামী হলে কি হবে ধক আছে। উনার শিল্পকর্ম দেখতে তাই আপনাকেই খুঁজে খুঁজে যেতে হবে উনার স্টুডিও শালায়। স্টুডিও বলতে তো ওই চির পতিত কোনো ঘেসো জমির জলা জঙ্গল। আসলে সকলের অলক্ষ্যেই তিনি মেলে ধরতে চান তার অনন্য শিল্প কৃতিকে। স্থির বিশ্বাস কেউ তো একদিন দেখবেই আর দেখলেই মিলবে তার শিল্প প্রতিভার কদর। ওই যে কথা আছে না, রতনে রতন চেনে আর শিল্প চেনে সেয়ানে!
------------------------------------------------------------------------------------------------
১০ টার ফুল!
এত সময় থাকতে ১০ টায় কেন ফোটে, ফুলটি?
মা ১০টার রান্না সারতেন, দাদু ১০টার কাছারি ধরার জন্য ধুতি, হাফ শার্ট পরে তৈরি হতেন। আমরা দুই ভাই আর আমার ছোট দুই পিসি বারান্দায় বসে পড়তে পড়তে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিতাম তুলসী মঞ্চের ধার ধরে মায়ের হাতে পোঁতা সবুজ লতানো গাছটায় সেই গোলাপী লাল রঙের বিশেষ ফুলটি ফুটেছে কি না। স্কুলে যেতে হবে, ফুলটি তাই আমাদের কাছে দৃশ্যমান অ্যালার্মের মতো চুপিসারে জানিয়ে দিত- এবার চান খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়।
স্কুলে বেরোবার সময় প্রতিদিন ফুলটির
দিকে একবার নজর যেতোই। যেন কত স্নেহ তার পাঁপড়ি গুলোতে লেগে আছে।
এ তো সোম থেকে শনি। রবিবারেও কি ফোটে ১০টার ফুল। কখনো দেখা হয়নি। আজ ও।
----------------------------------------------------------------------------------------
"ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত" - তবে তা আসতে এখনও দেরী আছে। কিন্তু তর্কবাগীশদের আবার যুক্তির অভাব হয় না। তারা তাই বলতেই পারেন , উঁহু শীত যদি এসেই পড়ে তবে বসন্ত কি আর দূরে থাকে ভায়া! "If winter comes can spring be far behind."
কিন্তু নভেম্বরের এই শেষ লগ্নে এসে যা দেখতে পাচ্ছি তাতে তো মনে হচ্ছে, শীত আসুক না আসুক অন্তত কম্বল এসে গেছে বাজারে। তারপরে আবার সেই থরে থরে সাজানো কম্বলের পসরার ওপরে এসে পড়েছে অপরাহ্নের হালকা হলুদ আলো। যেন মনে হচ্ছে, দিনের শেষ ওম টুকু কম্বলের উলে
জড়িয়ে গিয়ে বেঁচে গেছে। দাঁড়ান দাঁড়ান। তুলে রাখি এই সুযোগে!।
-----------------------------------------------------------------------------------------
'বাল্মীকি প্রতিভা' গীতিনাট্যে রবীন্দ্রনাথ, বাল্মিকী সেজেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এটি প্রথম লেখা গীতিনাট্য এবং প্রথম অভিনয়ের হাতেখড়িও। জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই প্রথম মঞ্চস্থ হয় 'বাল্মিকী প্রতিভা'। তেতলার ছাদে, পাল খাটিয়ে, রীতিমতো মঞ্চ বেঁধে করা হয় নাটকের আয়োজন। দিনটি ছিল ১৮৮১ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি। ২০ বছরের তরুণ রবীন্দ্রনাথকে সেই প্রথম জোব্বা পরে সর্বসমক্ষে হাজির হতে দেখা গিয়েছিল। গলায় ছিল রুদ্রাক্ষের মালা।
জোব্বা পরিহিত কবির সেই অপূর্ব সাজের ছবিকে স্মৃতির পর্দায় অমলিন করে
রাখতে, রবীন্দ্র সরোবরে দেখা গেল 'বাল্মীকি' বেশে রবীন্দ্রনাথের একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি। মূর্তিটি স্থাপিত হয়েছে, ২০০৭ সালের ৯ ই মে, (২৫শে বৈশাখ) কবির জন্মদিনে।
ভাস্কর্য শিল্পী, শর্বরী রায়চৌধুরী।
রবীন্দ্র সরোবরে ঢোকার মুখেই বাঁদিকে রেলিং দিয়ে ঘেরা বেদীর ওপরে রবীন্দ্রনাথের এই মূর্তি দেখা যাবে। অনেকেই দেখেছেন হয়তো। যারা দেখেননি তাদের জন্য ছবি এবং কিছু খুচরা তথ্য শেয়ার করে নিলাম।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"পাঁচের পাঁচালী!"
----------------------
ধরা যাক একজনের নাম রমেশ। সে প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমানা নিয়ে বেশ বড় ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। একদিন সে ওদেরই এলাকার পাঁচু বাবুর কাছে দেখা করতে গেল এই নিয়ে। বিপদে আপদে এই পাঁচু বাবুই তাকে বুদ্ধি দিয়ে হেল্প করেন। "দাদা, কি করি, বটু যে কিছুতেই মানতে চাইছে না!" সব শুনে পাঁচু বাবু গম্ভীর মুখে বললেন, "পাঁচ জনকে ডাক, ডেকে বস। দেখি মানে না কেমন।" পাঁচের কথা শুনতেই হবে। তবে হ্যাঁ বাংলার পাঁচের কিন্তু একটা দুর্নাম আছে। কিন্তু তাতে কি! পাঁচকে
নিয়েই তো 'পঞ্চায়েত' গঠিত হয়, তারপরে সেই পঞ্চায়েতের দখল নিয়ে কম মারামারি, রক্তক্ষয় তো হয় না।
পঞ্চ নদীর দেশ, পঞ্চ পান্ডব এবং তাদের একমাত্র স্ত্রী দ্রৌপদীকে এই কারণেই বলা হয় পাঞ্চালি। পাঁচের কি মহিমা দেখুন, আমাদের ইন্দ্রিয় পাঁচটি।
বলতে নেই, সেই ইন্দ্রিয় পঞ্চের মায়ায় পড়েই আমাদের যত অনিষ্ট সাধন। কিন্তু এর থেকে মুক্তির উপায় ও সেই পাঞ্চ জন্য। মহাভারতে কৃষ্ণের হাতে দেখা যায় এই পাঞ্চ জন্যকে। স্কন্দ পুরানে অবশ্য পাঞ্চজন নামে এক দুরাচারী দৈত্যের কথা বলা হয়েছে। যাকে বধ করেছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ। সেই দৈত্যের নামেই কৃষ্ণের হাতে ধরা শঙ্খের এমন নাম। সে যাই হোক সেই পাঁচ ই তো হোল।
এদিকে রমেশ আবার পাঁচু বাবুর জন্য গাছের কটি ঝুনো নারকেল নিয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধি দেওয়ার জন্য দক্ষিণা তো কিছু দিতে হবে। কি মুশকিল, হাতের ব্যাগ হাতেই থেকে গেছে। মাঝ রাস্তায় এসে মনে পড়লো। "ইস্...!" "ঠিক ভুলে গেছি, এটা ওটা পাঁচ কথায়..!" এখানেও সেই পাঁচ কথা।
কেউ মারা গেলে পর্যন্ত সাধ করে বলা হয় পঞ্চ ভূতে বিলীন হয়ে গেলেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে আমাদের নশ্বর দেহের সৃষ্টির মূলেও নাকি রয়েছে এই পঞ্চ ভূত ও তাদের সমষ্টি তত্ব।
সর্বোপরি প্রকৃতির অপার সৃষ্টি রহস্যের সমস্ত সুলুক সন্ধান ও তো জানতে সেই পাঁচ ভূতের শরণাপন্ন হতে হয়। । ক্ষিতি, তেজ, অপো, মরূৎ ও ব্যোম, অর্থাৎ মাটি, আগুন, জল, বায়ু ও আকাশ। হাতের পাঁচটা আঙুল সমান না হলেও এই পাঁচ আঙুলেই নাকি এই পঞ্চ ভূত সমাহিত থাকে। যেমন- কনিষ্ঠায় জল, অনামিকায় আকাশ, মধ্যমায় পৃথ্বী, তর্জনীতে বায়ু ও বৃদ্ধাঙ্গুলে অগ্নি। বুঝুন একবার।
এবারে আসি কাজের কথায়।
রমেশ ফেরার সময় রাস্তার দুদিকে সব দেখতে দেখতে হাঁটছিল। কোথাও কোথাও আবার ইতিউতি ফুল ফুটে আছে। দেখে ওর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। ফুল বলতে, দেশে ঘরে যেমন হয় ওই পুকুরে পাড়ে রাঙা জবা, উঠোনে নয়নতারা। মিন্টুদের বারান্দায় আবার সাদা অপরাজিতার লতা বেয়ে গেছে সুন্দর। কিন্তু সবেরই ওই পাঁচ পাঁপড়ি। মোড়টা ঘুরেই অধিকারী দের বিষ্ণু মন্দির। বহু প্রাচীন। পঞ্চ রত্ন।
পাশের দিঘির জল থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগে রমেশের ঘর্মাক্ত কপালে। মন্দিরের গা বেয়ে প্রকান্ড একটা গোলাজ ফুলের গাছ উঠে গেছে প্রায় চূড়া ছুঁই ছুঁই। সারাবছর ফুলে ভর্তি থাকে তার ডালাপালা। গাছের পাতাগুলো বেশ লম্বাটে, পুরু। হাওয়ায় একটা ফুল একেবারে রমেশের পায়ের তলায় এসে পড়ে। কি অপূর্ব রক্তিম আভা পাঁপড়ির সুডৌল সীমান্ত জুড়ে। যেন কোনো শিল্পীর করা সুন্দর কারুকাজ। রমেশ গুণে গুণে দেখে এরও সেই পাঁচটিই পাঁপড়ি। সেটাই কি ফুলটির এত গুছিয়ে সুন্দর থাকার কারণ! রমেশ পা চালিয়ে হাঁটে বাড়ির দিকে। আসার সময় সবিতা পই পই করে বলে দিয়েছিল," মনে করে পাঁচফোড়ন নিয়ে এসো কিন্তু!" তাই তো - এখানেও সেই পাঁচ!
রমেশ প্রথমেই গ্রামের মোড়লের ঘরে ঢোকে। হাতের রেখায় পাঁচ হতে আর চার দাগ গুণতে হবে তাকে।
--------------------------------------------------------------------------------------------
ছেলেকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে, গোল পার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের পূর্ব দিকের ফুটপাতে একজনকে একদিন দেখেছিলাম CESC'র ইলেকট্রিক বক্সের ওপর রঙ তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে। উল্টো দিকের রাস্তায়, বাসে ছিলাম আমরা। দূর থেকে যতটা বুঝলাম, পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি আঁকছেন উনি। পরে কোলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় দেখলাম এরকম আরোও অনেক ছবি। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে শুরু করে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কে নেই। CESE'র ইলেকট্রিক বক্স গুলোর চৌকো ধাতব গায়ের ওপরেই শিল্পী পরম যত্নে ফুটিয়ে চলেছেন
বাংলা তথা ভারতবর্ষের স্বনামধন্য বিভিন্ন মানুষের প্রতিকৃতি। অসাধারণ শিল্প কৃতির নিদর্শন তথা আমাদের শিল্প সংস্কৃতির সুমহান ঐতিহ্যের স্বরূপ ফুটে উঠছে গোটা কোলকাতা শহরের বিভিন্ন রাস্তা জুড়ে।
এবার বলি, কে এই শিল্পী! তিনি রঞ্জিত দাশ। ছবির নীচে অবশ্য শিল্পীর সিগনেচার এ লেখা থাকে চিত্রকর আর ডি।
শিল্পীর কয়েকটি আঁকা, প্রচ্ছদে শেয়ার করে নিলাম। পরবর্তীতে আরোও ছবি আনবো আপনাদের সামনে। সঙ্গে অবশ্যই থাকবে শিল্পীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ভিত্তিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা।
প্রচ্ছদের ছবিগুলির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো ছবিতে ফুটে ওঠা বিখ্যাত মানুষগুলোকে তাঁদের এক বিশেষ মুডে আবিষ্কার করার আন্তরিক প্রয়াস।
কোলকাতার রাজপথে CESC ' র ইলেকট্রিক বক্সের ওপর আঁকা বিভিন্ন ক্ষেত্রের স্বনামধন্য মণীষীদের ছবি দেখে সে কথাই মনে হয় সর্বাগ্রে।
এই ছবিগুলো ফুটিয়ে তোলার নেপথ্য কারিগর যিনি, সেই চিত্রকর আর ডি অর্থাৎ শিল্পী রঞ্জিত দাশের শিল্প নৈপুণ্য সত্যিই তা করতে সফল হয়েছে।
পূর্বের এক পোস্টে রঞ্জিত দাশের কয়েকটি ছবি শেয়ার করে নিয়েছিলাম।
আজ আরোও নতুন কয়েকটি ছবি
পোস্ট করলাম। যার মধ্যে চিত্রাভিনেত্রী সুচিত্রা সেন, প্রখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্ত, কবি নজরুল, বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, সঙ্গীতকার বাপ্পী লাহিড়ী থেকে সদ্য প্রয়াত রাজনৈতিক নেতা তথা ভারতবর্ষের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ছবিও রয়েছে।
-----------------------------------------------------------------------------------------------
বৃক্ষ তোমার নামে পরিচয়।
তাই প্রথমেই বলে দেই এই গাছটির নাম, মুচকুন্দ। পাতাগুলি বেশ দীঘল ও পুরু। সবুজাভ বাদামী জেল্লা, লেগে থাকে রঙে। রোদ পড়লে বেশ ঝকঝক করে।
মুচকুন্দ গাছের পাতা দিয়ে নাকি বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে ঘর পর্যন্ত ছাওয়া হয়। ওইরকম ঘরে একদিনের হোম স্টে , মন্দ হবে না।
সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক গ্রামের হাটে, মুচকুন্দ গাছের পাতাতেই মুড়ে বিক্রি হয় তামাক এবং শীতের অমৃতান্ন নলেন গুড়। একেবারেই অরগ্যানিক। তাই একবার অন্তত মুচকুন্দ গাছ দেখা চাইই চাই।
প্রচ্ছদের মুচকুন্দ গাছটি রবীন্দ্রসরোবরের, একেবারে লেবেল সাঁটা। তাই ভুল হওয়ার কোনো বালাই নেই।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------
নৈকট্যের আবার দূরত্ব হয় নাকি! হয়।
কাছে এলাম অথচ ধরা দিলাম না গোছের। ছোঁয়াচ বাঁচানো সেই নিরাপদ নৈকট্যের সূক্ষ্ম ফারাক বোঝা অত সহজ নয়। ভুক্তভোগীরাই কেবল বোঝে।
নৈকট্যের সেই অদ্রাব্য ফাঁক, অনেকটা চায়ের কাপ আর ঠোঁটের মাঝখানে থাকা ছোট্ট স্পেসটার মতন। এক দীর্ঘ চুমুকের অপেক্ষা থাকে সেই স্পেস জুড়ে, যা পেরোতে হয়তো লেগে যেতে পারে অনেকটা সময়, অনেকগুলো বছর।
আসলে নৈকট্য একটা দূরত্ব সে যত সূক্ষ ই হোক না কেন। যতক্ষণ না দুই প্রাণ একাত্ম হচ্ছে, তা নিখাদ ছলনা ছাড়া কিছু নয়।
তা হোক।
যারা সে নৈকট্যের দূরত্ব কাটাতে চায় তারাই না হয় তা বুঝে নিক।
"চাঁদের গায়ে চাঁদ .....!, তা আমরা ভেবে করবো কি!"
তবে কখনো কখনো নৈকট্যের সহজ ভাব কিন্তু বেশ লাগে।
যেমন প্রচ্ছদের ছবিতে, দুটি নারী ও পুরুষের মূর্তির মধ্যে ফুটে ওঠা সহজ সান্নিধ্যের ছাপ কিন্তু বেশ মনে ধরে।
গঙ্গা পাড়ের মিলেনিয়াম পার্কে দেখা এই অনুপম ভাস্কর্যের নির্মাণ শিল্পী কে তা তো জানতে পারলাম না।
শুধু ছবিটাই তুললাম আর কিছু ফালতু কথা লিখে শেয়ার করে নিলাম।
-----------------------------------------------------------------------------------------
ফুলের আবার মেকআপের কি প্রয়োজন! স্বাভাবিক সৌন্দর্যেই তো ঝড় তুলেতে পারে বারো ভূতের মাঠে।
ভাগ্যিস ফুল হাঁটতে পারে না, তাই রক্ষে। নাহলে কবে বিশ্ব ফুল সুন্দরী খেতাব জেতার যুদ্ধে নামতে হোত, সে কথা মনে করলেই গায়ে কাঁপুনি আসে! তখন হয়তো মার্জার গমনে দেখা যেত মিস ডালিয়া কিংবা মিস চন্দ্রমল্লিকাদেরকে। রাম্পের দুদিকে অপেক্ষা করে থাকতো দুনিয়ার তাবড় ভ্রমর কুল!
চটুল শরীরী আবেদন খোর চোখে জাগাতে হোত সেই আদিম প্রেরণা, যার খোঁজে আজ ও ভ্রমরের মধু আহরণের আকাঙ্খা সম্পূর্ণ তৃপ্ত হতে পারে
না!
এইটুকুই।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
কথায় বলে, ফুলকে খুব কাছ থেকে দেখতে হলে মৌমাছির চোখ দিয়ে দেখতে হয়। ফুলের রূপ রস গন্ধের আস্বাদনে এমন তন্নিষ্ঠ তৃষ্ণা বোধহয় সারা প্রাণীকুলের মধ্যে আর কারুর নেই।
ভোগ আর উপ উপসর্গ যুক্ত উপ-ভোগ শব্দ দুটির মধ্যে বলা যায় আসমান জমিন ফারাক। আমরা কখনোই ফুলের অমন ভুবন ভুলানো রূপ কে ভোগ করি না, বলা ভালো পারি না। আমরা উপভোগ করি। সুন্দরী পরস্ত্রীর প্রতি যে মুগ্ধতা থাকে অনেকটা ফুলের প্রতি আমাদের ভালোলাগার ধরনটা সেইরকমই। আহা কি সুন্দর, অপরূপ দেখতে ইত্যাদি বলে হয়তো সাহিত্যের ভাষায় আরো
অনেক বিশেষণ যোগ করতে পারি খুব বেশী হলে। কিন্তু মৌমাছি, যে নাকি ফুলের মধু প্লাবনের একমাত্র লাইসেন্সধারী ভোক্তা, সে বেচারা কিন্তু থাকে নিশ্চুপ। ওই ফুলের কানের কাছে একটানা গুনগুন করা ছাড়া।
কে জানে মৌমাছি তার আত্মজীবনীতে ফুলের সম্পর্কে কিছু লিখে যাবে কিনা। অমন অতলে তলিয়ে ফুলের সৌন্দর্য ভোগ করার কৃতিত্ব তো আর কারুর নেই। সাহিত্যিক বিমল ঘোষ কি সেই কারণেই তাঁর ছদ্মনাম রেখেছিলেন মৌমাছি!
হয়তো বা।
প্রচ্ছদে গাঁদা ফুলের ছবি দেখে তাই মৌমাছি হতে মন চায়। কিন্তু কি করবো, এ জন্মে তো হওয়া হোল না। পর জন্মে মৌমাছি হয়ে ফুলের অন্দর কথা লিখবো। লিখবোই লিখবো।
-----------------------------------------------------------------------------------------
দৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
"সৃষ্টি সুখের উল্লাসে" কথাটা সঙ্গত ভাবেই স্রষ্টার স্বতোৎসারিত সৃজন সত্তাকে অপূর্ব এক মহিমা সুখে ভরিয়ে তোলে। কিন্তু আমরা যারা মুগ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করি সৃষ্টির এমন নান্দনিক সৌকর্যকে, সেই অবাক দর্শণ সঞ্জাত অবর্ণনীয় সে দীপ্তি লাভেরও তো চাই সম্যক গরিমা প্রাপ্তির সুযোগ।
কারণ সৃষ্টির তাবড় মহিমারা ও কালে কালে জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে। তাই মুগ্ধ দৃষ্টিপাতের আশা সকলেরই থাকে। সে কারণেই, সৃষ্টি যতটা মূল্যবান ততটাই অমূল্য তাকে দর্শণের অদম্য অভিপ্রায়। তাই
স্রষ্টার জন্য বরং সংরক্ষিত থাক সৃষ্টি সুখ, সমঝদার চোখের জন্য থাক দৃষ্টি সুখের উল্লাস।
কি বলেন!
-------------------------------------------------------------------------------------------
ইয়ার ফোন গুলোই আজকাল কথা বলে, গান শোনায়! নিঃসঙ্গ মানুষগুলোকে সঙ্গ দিয়ে ভুলিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে পারিপার্শ্বিকের রুক্ষতা থেকে। প্রকৃত অর্থেই ইয়ার ফোন আজ 'ইয়ার' (বন্ধু) ফোন হয়ে উঠেছে। আচ্ছা এর বাংলা করলে কেমন দাঁড়ায়! বন্ধু ভাষ? আমি বরং চলোরীনা ডাকবো।
অনেকদিন মনের মধ্যে এই নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া করেছি। তারপরে গিয়ে পেয়েছি চলোরীনার সুমধুর সম্মতি, চলমান রিনিঝিনি।
এমনিই কাঠের প্যানেলে ঝোলানো থাকে লাল, সবুজ, গোলাপী রঙের ইয়ার ফোন গুলি। অবশ্যই পছন্দের সাথীকে বেছে নেওয়ার
দায়িত্ব আপনার। আমার তো মনে হয় সবুজ গুলো প্রকৃতির গানই শোনাবে বলে মুখিয়ে আছে;, লাল গুলো হয়তো বিদ্রোহের আর হলুদ গুলো বিষন্নতার এবং গোলাপী গুলো নির্ভেজাল প্রেমের।
সত্যিই কি তাই!
আমি কিন্তু ভ্যান গগের "দা ভায়োলেট" ই চাই। বিষন্নতার বিরুদ্ধে জেহাদের রং ই আমার পছন্দ।
আর আপনাদের?
কি বলেন!
---------------------------------------------------------------------------------------------
এ যেন সমুদ্র ছেঁচে বর্ধমানের সীতাভোগ তুলে আনা হচ্ছে।
জোয়ারের সময়, জেলে মাঝিরা তাদের ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়েই বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রে; দাঁড় বেয়ে চলে যায় দু ঘন্টার ও বেশী দূরে। সমুদ্রে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা, সময় দিয়েই দূরত্ব মাপে।
প্রায় মশারির মতো দেখতে সূক্ষ্ম ফাঁসের জালে ধরা পড়ে সুরু সুরু সাদা ছোট ছোট চিংড়ি মাছ। পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল - কাঁথিতে এই চিংড়িকে মোহাল চিংড়ি বলা হয়। তবে এর পোষাকি নাম - লক্ষ্মী চিংড়ি। দেখতে অনেকটা বর্ধমানের সীতাভোগের মতো।
উপকূল অঞ্চলে বিশেষ করে পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার এমনকি কোলকাতা সংলগ্ন বেশ কিছু বাজারে এই চিংড়ি মাছের বেশ ভালোই চাহিদা। স্থানীয় চপ তেলেভাজার দোকানগুলোতে এই চিংড়ির বড়া বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও বাড়িতে লক্ষী চিংড়ির, পুরনো তেঁতুল দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি টক করার বহু পুরনো চল রয়েছে। এই চিংড়ির বড়া ও নারকেল দুধ দিয়ে বানানো মুখরোচক ঝোল এই অঞ্চলের মানুষ বেশ আমোদ করেই খায়।
শীতকালে এই মাছ ধরতে জেলে মাঝিরা নৌকা নিয়ে বেরোন সমুদ্রে। এই চিংড়ির বেশিরভাগই এখন শুকিয়ে গবাদিপশুর খাদ্যের সঙ্গে মেশানো হয়।
যাই হোক। অনেক কথা হলো। আর নয়।
এবার বরং দেখা যাক সমুদ্রের পারে নোঙর করা ডিঙি নৌকা থেকে কিভাবে টনটন সেই চিংড়ি মাছ ডাঙায় নিয়ে তোলা হচ্ছে তার সরজমিন ভিডিও চিত্র। দেখতে দেখতে কথা বলে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি আসল তথ্যকে।
চলুন তাহলে দেখাই যাক!
------------------------------------------------------------------------------------------------------
জলে কচি কলা পাতার আভা!
পুকুরের ওই প্রান্তে দুর্বা মান্ডির ছোট্ট চার চালার বাড়ি। খড়ের ছাউনি দেওয়া। উদয়াস্ত পুকুরের জলে যত শুকনো পাতা পড়ে, দুর্বা মান্ডি সব একা হাতে সরিয়ে পাড়ের ওপর তুলে দেয়। জোছনার আলোয় দুর্বা মান্ডি, যুৎ হয়ে আড় বাঁশি বাজায় পুকুর পাড়ে বসে। জলের বুকে পড়া চাঁদের আলোয় তার বাঁশিতে যেন প্রেমের জোয়ার ওঠে। সন্ধ্যের পরে, পাশের বাঁশ জঙ্গল থেকে ঘনঘন ডাহুকের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। দুর্বার বাঁশির সুরে মজে, তারাও তখন ডাকতে ভুলে যায়।
গত কয়েকমাস ধরে দুর্বা
লক্ষ করছে ওপারের মরা বেলগাছটি যেন যত দিন যাচ্ছে ক্রমশ জলের ওপর ঝুঁকে পড়ছে।
চিনে বাদামের ক্ষেত পেরিয়ে প্রতিদিন মাহিষ্য বাড়ির বৌ ঝিরা আসতো বেল পাতা ভাঙতে। পাতায় পাতায় তখন বেলগাছটির ডালাপালা একেবারে ভর্তি ছিল। দুর্বা, ত্রিনয়নী বেল পাতা পেড়ে দিত তাদের। খালি গায়ে, পরনের ছোট্ট গামছাটিকে প্রায় নেংটির মতো করে কাছা মেরে সে বেলগাছটিতে লপলপ করে উঠে যেতো। গায়ে বেল গাছের কাঁটা ফুটে গেলেও নীরবে তা সহ্য করতো।
"তোমার লাগে না, অমন করে গাছে উঠে যাও," হাত পেতে বেলপাতা গুলো নিতে নিতে মলিনার বুক ভারী হয়ে আসে কষ্টে। গায়ের রং কালো বলে মলিনার বিয়ে হয়নি। গ্রামের শিব মন্দিরে পুজোর ফুলপাতা সংগ্রহ করার দায়িত্ব বর্তেছে তার ওপরে। গাঁ ঘরে বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলে আইবুড়ো মেয়েদের পুজো আচচার কাজে লাগিয়ে দেওয়ার চল রয়েছে।
"কি গো কিছু বলছো না!" থুতনি ধরে সজোরে নাড়া দিতেই কেমন যেন হতভম্বের মতো তার দিকে তাকিয়েছিল দুর্বা। সে দৃষ্টিতে যাই থাকুক, ছলনা যে ছিল না মলিনা তা বিলক্ষণ বুঝেছিল।
দুর্বার মা তখন দাওয়ায় বসে বুনো নল ঘাসকে দড়ির মতন পাকিয়ে লক্ষী কুচো বানাচ্ছিল। ওর কথা কানে যেতেই একপ্রকার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে ছেলেকে। "দুববা, আয় বাবা। খাবিনে! বেলা কত হোল মালুম আছে!" মুহূর্তে মলিনা, দুর্বার জগদ্দল পাথরের মতো বুকের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পুকুরের ওপারে বসে থাকা তার মা'র দিকে চোখ ফেলতেই, দুর্বাও তার দেখাদেখি ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় ওদিকে তখন দুর্বার মা হাত নেড়ে নেড়ে ছেলেকে ঘরে আসার জন্য জোরেজোরে ঈশারা করে চলেছে ।
হঠাৎ একটা নেউল ছুট্টে পাশের ঘাস জঙ্গলে ঢুকতেই মলিনার বুক ছ্যাৎ করে ওঠে। কয়েকদিন আগে এখানেই একটা চন্দ্র বোড়া সাপ কে দেখেছিল গুটিয়ে শুয়ে থাকতে, সম্ভবত রোদ পোহাচ্ছিল।
জানি না লেখাটি গল্প হচ্ছে না অন্য কিছু! শুরু করেছিলাম, দু চার লাইন ছবিটাকে নিয়ে যাই হোক কিছু লিখবো এই ভেবে। কিন্তু ক্রমে ক্রমে দেখলাম তা কাহিনীর পূর্ণতা পেতে চাইছে। যথারীতি লেখা গড়াতে থাকলো। এখন দেখা যাক কোথায় গিয়ে শেষ হয়। তবে শীঘ্রই শেষ হবে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
সৌর সংসারের একমাত্র প্ল্যানেট, পৃথিবীতেই সূর্যের জন্মদিন পালিত হয়।
সেটা ২৫শে ডিসেম্বর।
রে রে করে উঠবেন, প্রমাণ দেখাতে বলবেন।
সটান বলে দিলাম পারবো না।
আজকে যার জন্মদিন বলে কথিত সেই প্রভু যীশুর, তারই বা প্রমাণ কোথায়!
আসলে
তখনকার প্রশাসন এতটা সতর্ক ছিল না তো, তাই জন্ম শংসাপত্র বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবে নি।
তাই নো সার্টিফিকেট। কিন্তু অনুমান চলতে পারে, এবং সেই অনুমান কে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পন্ডিতি ফলাবার ও লোকের অভাব হয় না। বাকি রইল, তথ্য ও তত্ত্বের জোগাড় সে তো বানানোই যায়।
কিন্তু এটা সত্যি, আজকের দিনে অর্থাৎ এই ২৫ শে ডিসেম্বর তারিখেই জন্ম হয়েছিল বিজ্ঞানী- আইজ্যাক নিউটনের। সালটা ছিল ১৬৪২।
ঠিক আছে, কিন্তু ১৬৪২ এই উদ্ভট সংখ্যাটাই বা এলো কোত্থেকে!
এখানেই অবধারিত ভাবে এসে যায় যে মানুষটির কথা বিশেষ করে তার জন্মের কথা তিনি হলেন যীশু।
সে তাঁর জন্ম দিন যতই আনুমানিক হোক আর না হোক এই পৃথিবীতে প্রবহমান সময়কে মোটামুটি দুভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এক - যীশুর জন্মের আগের সময় আর দুই হোল যীশুর জন্মের পরে।
এই হিসেবেই আমার জন্ম সাল নির্ধারিত হয় যীশুর জন্মের ১৯৭৪ বছর পরে।
তাই প্রভু যীশুর আনুমানিক ২০২৫ তম জন্মজয়ন্তী পালনের উৎসবে আমার পক্ষ থেকে সকলের উদ্দেশ্যে রইল ঢের সারি শুভকামনা। মেরি ক্রিসমাস।
পাদটীকা: এই এত জ্ঞান ফলাবার জন্য প্রভু যীশু নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবেন এই অর্বাচীনকে।
কারণ ক্ষমা এই গুণটার যে এত মাহাত্ম্য তার পেছনেও তো সেই সেই একই মানুষ। তিনি যীশু!
তাই নো টেনসন।
চলো বড়দিন মানাই।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
বড়দিনের কেক তো সর্বজনবিদিত। তবে বড়দিনের মিঠা পানের আকর্ষণ ও কিছু কম নয়। বিশেষ করে কোলকাতা, পার্ক স্ট্রিটের ক্রিসমাস ফেস্ট এ। ঝিকমিকে রাংতা কাগজে মোড়া মিঠা পাতার পান গুলো একেবারে মন্ডা সাজানোর মতো দোকানের রেকাবিতে ডাই করে সাজানো থাকে। বাইরে থেকে এই পানগুলোকে যতটা না দর্শণীয় লাগে তার থেকে সেই পান পাতার মধ্যে দেওয়া নানা রংবেরং এর সুদৃশ্য উপাদান গুলিকে দেখলে জিভে জল আসবেই আসবে।
অবাঙালীদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় এই বড়দিনের স্পেশাল মিঠা পান। তবে বাঙালীরাও অধুনা এই পান সেবায়
বেশ রসিক হয়ে উঠেছেন দোকানের সামনে খদ্দেরদের উৎসাহ দেখলে বোঝা যায় পার্ক স্ট্রিটের মিঠা পান - বড়দিনের উৎসবে, যাকে বলে একেবারে হট কেক।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
এ আই টেকনোলজিই কি আগামী দিনে সাহিত্য সৃষ্টির কারিগর হয়ে উঠবে?
শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ পরিতোষ মন্ডল এই ব্যাপারে জানালেন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মতামত। সত্যিই কি সাহিত্য সৃষ্টির কৃতিত্ব অদূর ভবিষ্যতে এ আই টেকনোলজির হাতেই সমর্পিত হবে?
পরিতোষ মন্ডলের পাশাপাশি এই নিয়ে কি বললেন গল্পকার- সম্পাদক সুদর্শন খাটুয়া? বিতর্ক তৈরি হতে পারে কিন্তু এই প্রশ্নের পেছনে থাকা প্রাসঙ্গিক উদ্বেগ কে কোনোভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না!
আজ বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক পরিতোষ মন্ডলের সঙ্গে কথোপকথনের তৃতীয়
তথা অন্তিম পর্ব পেশ করে যে কথাটি বলবো সেটা হলো এই পর্বেই রয়েছে সবথেকে আকর্ষনীয় শ্রদ্ধেয় পরিতোষ দা'র ছদ্মনাম প্রসঙ্গ। এত ছদ্মনাম এবং তাদের প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য থাকার গৌরব বুঝি বাংলা সাহিত্যের জগতে আর কারোর নেই।
এই কথোপকথনেই উঠলো কাঁথি মহকুমাকে ওড়িশা রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি করণের আলোড়ন জাগানো সিদ্ধান্তের কথা।
এই নিয়ে সারগর্ভ আলোকপাত করলেন সম্পাদক, শ্রদ্ধেয় সুদর্শন দা।
অবশ্যই আজকের পর্ব মিস করবেন না। দেখা ও শোনার অনুরোধ রইল সবার কাছে।
আলোচনায় উঠে এলো সাহিত্যের ভিন্ন দিক!
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক পরিতোষ মন্ডলের সঙ্গে কথোপকথনের আজ দ্বিতীয় পর্ব। আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন বিশিষ্ট গল্পকার তথা 'দীঘল পত্র'র সফল সম্পাদক সুদর্শন খাটুয়া।
সুদর্শনদা তুললেন তাঁর লেখা জনপ্রিয় গল্প 'বেড়াজাল' এর মূল চরিত্র, মিনাক্ষী মান্না, যিনি প্রথম মহিলা মাঝি হিসেবে পাড়ি জমিয়েছিলেন গভীর সমুদ্রে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের এখনোও অপ্রকাশিত অজানা কথা। মিনাক্ষী মান্না কি প্রচলিত বিশ্বাসের 'বেড়াজাল' ভাঙতে সক্ষম হয়েছিলেন? রজস্বলা
নারীর ক্ষেত্রে নৌকা যাত্রার সামাজিক বাধা কি কাটাতে পেরেছিলেন মিনাক্ষী?
জার্মান সরকারের দ্বারা সম্মানিত মিনাক্ষী কি পেরেছিলেন সেই সামাজিক 'বেড়াজাল' ভাঙতে?
সুদর্শনদা বললেন কিছু এক্সক্লুসিভ কথা।
এছাড়াও বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক সন্তোষ করের লেখা সমুদ্রজীবী মানুষের জীবনযাপনের ওপর উপন্যাস ' দাঁড় জাল মুক্তা মাছ' , যে উপন্যাস সম্প্রতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পাঠ্যসূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে তার প্রকাশক হিসেবে সুদর্শনদা বললেন অনেক না বলা কথা।
সাহিত্যিক পরিতোষ মন্ডলের সম্পর্কে দিলেন কিছু না জানা তথ্য!
আজ থাকলো আকর্ষণীয় এই কথোপকথনের দ্বিতীয় পর্ব। সকলকে দেখার এবং শোনার অনুরোধ রইল।
বিশিষ্ট সাংবাদিক, কবি, গল্পকার তথা প্রাবন্ধিক পরিতোষ মন্ডলের (
#Paritosh_Mondal) আজ (১৯৫৮, ১৮ ই ডিসেম্বর) শুভ জন্মদিন। জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলাম তাঁর কাঁথির চেম্বারে। প্রসঙ্গত তিনি পেশায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক কিন্তু তাঁর নেশায় সাহিত্য আর কবিতা প্রায় অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে অবস্থান করে আসছে সেই যৌবনকাল থেকে। তাঁর কথা শোনার আকর্ষণ বরাবরই আমার কাছে প্রায় দূর্লঙ্ঘ্য এক বিষয়।
পাশাপাশি আজ পেয়ে গিয়েছিলাম বিশিষ্ট গল্পকার তথা সম্পাদক সুদর্শন দা
কে। প্রসঙ্গত আমার লেখা এক অনুগল্প 'এক লক্ষ এক' এ সুদর্শন দা বলে যে এক চরিত্র ছিল তিনি এই সুদর্শন দা ই। স্বনামে এবং তাঁর নিজস্ব ভূমিকাতেই (পত্রিকা সম্পাদক) তিনি গল্পের একটি চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন।
তো এই দুই বিশিষ্ট সাহিত্য সেবীর সঙ্গে কথাবার্তায় উঠে আসে অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয়, অনেক না জানা প্রসঙ্গ এবং শ্রদ্ধেয় পরিতোষ দার স্বকন্ঠে স্বরচিত কবিতা পাঠের দূর্লভ মুহূর্ত।
তো চলুন দেখে নেওয়া যাক সেই কথোপকথনের প্রথম পর্ব।
তিনটি পর্বে বিভক্ত এই কথোপকথনের পরবর্তী দুটি পর্ব পাবেন ক্রমান্বয়ে।
দেখা এবং শোনার অনুরোধ রইল।
ধন্যবাদ।
------------------------
নব পরিণীতা!
স্বামীর ঘরে কয়েকদিন কাটানোর পর, নব পরিণয়ে আবদ্ধ মেয়েটি যখন প্রথমবার ফিরে আসে তার বাবার বাড়িতে, অপূর্ব এক আনন্দের আবেগ খেলা করে তখন তার মন জুড়ে।
শিল্পী ধনঞ্জয় জানা তাঁর সাবলীল তুলির টানে, অসামান্য সূক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন নব পরিণীতার সেই অনিন্দ্য সুন্দর মনের ভাব, যা তার চোখের কোণে বয়ে এনেছিল এক অদ্ভুত ভালোলাগার উদ্ভাস।
আজকের প্রচ্ছদে, অনন্য সুন্দর এই পেন্টিং টার সঙ্গে থাকলো ছবিটির সম্পর্কে শিল্পীর নিজস্ব বক্তব্য সম্বলিত একটি ছোট্ট ভিডিও ক্লিপিং।
শিল্পী ধনঞ্জয় জানার সঙ্গে কথোপকথনের দ্বিতীয় পর্ব!
যিনি তাঁর সহজাত শিল্পী সত্তায় অবাক করেছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন কে পর্যন্ত সেই জন্ম প্রতিভাধর ধনঞ্জয় জানার সঙ্গে কথা বলেছিলাম উনার বাড়িতে।
সেই কথোপকথনের আজ দ্বিতীয় পর্ব।
শিল্পী ধনঞ্জয় জানা ফিদা হুসেনের ছবি এমনকি তাঁর সই টা পর্যন্ত হুবহু নকল করে দিয়েছিলেন। সেই দেখে ফিদা হুসেনের কি প্রতিক্রিয়া ছিল সে কথা শুনুন ধনঞ্জয় বাবুর মুখ থেকেই। রোমহর্ষক সেই কাহিনী উন্মোচনে আজকের এই ভিডিওটি অবশ্যই মিস করবেন না।
ছবি আঁকার প্রথাগত কোনো প্রশিক্ষণ নেই তাঁর, কিন্তু ছবি এঁকে মকবুল ফিদা হুসেন এর কাছ থেকে প্রশংসা কুড়ান। আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর হয় এই নিয়ে।
বিয়ের তত্ব সাজানোর ব্যাপারে তাঁর পারদর্শিতা ছিল প্রায় অবিসংবাদিত। সাপ্তাহিক 'সানন্দা' য় এক সময় তাঁর এই দক্ষতার কথা ছাপা হয়েছিল ফলাও করে।
তিনি ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর মালিক অভীক সরকারের ভীষণ কাছের, পরম স্নেহধন্য, অবশ্যই তাঁর শিল্পী সত্তার কারণে। তাঁর জন্য আনন্দবাজার পত্রিকা দপ্তরে সর্বদা মজুত থাকতো ছবি আঁকার প্রয়োজনীয়
যাবতীয় সরঞ্জাম।
তিনি ধনঞ্জয় জানা। পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষ ধনঞ্জয় জানার বাড়ি দীঘার অনতিদূরে কাবরা গ্রামে। কথা হচ্ছিল, উনার বাড়িতে।
জানলাম তাঁর শিল্প কুশলতার আরোও অনেক দিক। সাধারণ কথাগুলোই উনার মুখে রূপকথা হয়ে গেল।
কিভাবে, জানতে অবশ্যই ভিডিওটি পুরো দেখুন।
দুটো পর্বে ভাগ করা ভিডিওটির দুটি অংশই সমান আকর্ষণীয়। মিস না করার অনুরোধ রইল।
--------------------------------
প্রচ্ছদের ছবিগুলির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো ছবিতে ফুটে ওঠা বিখ্যাত মানুষগুলোকে তাঁদের এক বিশেষ মুডে আবিষ্কার করার আন্তরিক প্রয়াস।
কোলকাতার রাজপথে CESC ' র ইলেকট্রিক বক্সের ওপর আঁকা বিভিন্ন ক্ষেত্রের স্বনামধন্য মণীষীদের ছবি দেখে সে কথাই মনে হয় সর্বাগ্রে।
এই ছবিগুলো ফুটিয়ে তোলার নেপথ্য কারিগর যিনি, সেই চিত্রকর আর ডি অর্থাৎ শিল্পী রঞ্জিত দাশের শিল্প নৈপুণ্য সত্যিই তা করতে সফল হয়েছে।
পূর্বের এক পোস্টে রঞ্জিত দাশের কয়েকটি ছবি শেয়ার করে নিয়েছিলাম।
আজ আরোও নতুন কয়েকটি ছবি
পোস্ট করলাম। যার মধ্যে চিত্রাভিনেত্রী সুচিত্রা সেন, প্রখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্ত, কবি নজরুল, বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, সঙ্গীতকার বাপ্পী লাহিড়ী থেকে সদ্য প্রয়াত রাজনৈতিক নেতা তথা ভারতবর্ষের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ছবিও রয়েছে।
ছবি নিয়ে শিল্পী রঞ্জিত দাশের সঙ্গে কথাবার্তার ভিডিওটির লিঙ্ক দিয়ে দিলাম নীচে।
------------------------------
ছবিতে সূর্যের অবস্থান দেখে বোঝার উপায় নেই যে তা ডুবে যাচ্ছে না ভেসে উঠছে। অত কম সময় ফ্রেমে, সত্যি সত্যিই তা ধরা বেশ শক্ত। প্রায় মোনালিসার হাঁসির কারণ বোঝার মতোই দুর্বোধ্য।
কিন্তু যা দেখছি, তাকেই যদি শব্দ দিয়ে বলার চেষ্টা করি তবে আমার চোখে এটি দিগন্তে সেঁটে থাকা একটি সুডৌল, অনলাভ গোলোক; আর তার চারিদিকে ঘিরে থাকা বেনু বনের শিখর পত্রমালা দেখে মনে হচ্ছে যেন তমলুকের গয়না বড়ি, কেউ চিলেকোঠার ছাদে রোদ খাওয়াতে - পেতে রেখেছে যত্ন করে।
আমার তো এও মনে হচ্ছে, বিয়ে করতে আসা রাঙা
বরকে যেন ঘিরে রয়েছে তার হবু বউয়ের দুষ্টু বোনেরা!।
কালচে বাঁশ পাতাগুলো সত্যিই যেন লাল সূর্যের চারিদিকে তাদের সুরু সুরু হাত পেতে, শীতের সকালের কিংবা শীতার্ত অপরাহ্নের উষ্ণ আঁচ পোহাবে বলে বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
সে যা মনে হচ্ছে হোক, আপনাদের কি মনে হচ্ছে সেটা আপানাদের নিজস্ব ব্যাপার।
আমি তাতে নাক গলাবার কে!!
---------------------------
https://www.ebanglalibrary.com/lessons/%e0%a6%ac%e0%a6%b8%e0%a7%81-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a1%e0%a6%bc%e0%a6%bf-%e0%a7%aa%e0%a7%ab/
-----------------------------------------------------
সৌন্দর্যের কি মহিমা, বাবা! ভালো লাগে বলে নির্ভেজাল দাসত্বকেও দুহাত তুলে মেনে নিয়েছি।
মুগ্ধতার আরেক নাম বুঝি বশ্যতা স্বীকার! বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি তাই চাকর বাকরের মতো রোজই কিছু না কিছু লিখিয়ে নাও। আমার ভালোলাগার মূল্য কি এতটাই মূল্যহীন?
ধূর! কি সব নাটুকে
কথাবার্তা বলছি আমি, সকালবেলায় এসব ছাইপাঁশ গেলার লোক বাপু বাজারের পথে থলে হাতে। দর দাম করে নধর রুই মাছটিকে ব্যাগস্থ করা ছাড়া আর কোনো লক্ষ নেই তাদের। তবে হ্যাঁ উচিত মূল্য সেখানেও চোকাতে হয়।
অর্থহীনের তাই ভালোবাসার মূল্য ক্রীতদাস হয়েই মেটাতে হয়। সকাল দুপুর সাঁঝে খালি তোমার আব্দার, তাগাদা - কই কবিতা লিখলে কিছু? ক্রীতদাস হয়ে তাই অ-কবিকেও কবিতা লিখতে হয়। মুগ্ধতার প্রথম প্রকাশ - আহ্ এই শব্দটাই তো কাব্যের মহাসাগর দর্শন করায়। সেই অপার সৌন্দর্যের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, কি আর বেরোবে কবিতা ছাড়া?
দিনরাত হাটে বাজারে পথে ঘাটে জনারণ্যে নিভৃতে কত যে কবিতা ফেরি হয়ে যায় ভালোলাগার ঘাটে ঘাটে তার খবর কে রাখে! মুগ্ধতাই একমাত্র পুঁজি। তাকে খাটিয়ে কেউ কবি হয়ে যায় কেউ হদ্দ ক্রীতদাস।
------------------------------------------------------------
রেলের আবার মন্দির গেট!
তবে শুধু মন্দিরই বলবো কেন, মন্দির মসজিদ গির্জা যে কোনো ঐতিহ্যবাহী নির্মাণেরই আর্ক বা খিলান হচ্ছে একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থাপত্য শৈলী। যেমন ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই রেল যাতায়াতের সুড়ঙ্গ পথটি, যার প্রবেশ মুখে চমৎকার এক খিলান স্থাপত্যের নজির
চোখে পড়ে। পার্ক সার্কাস স্টেশন থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে পড়ে এই রেল ব্রীজটি।
নিত্য যাতায়াতের পথে পড়া এই খিলান সৌন্দর্য কে তাই সবার সঙ্গে শেয়ার করে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
--------------------------------------------------------------
মূর্তিমান চুষি কাঠি! প্লাস্টিকে মোড়া। ছেলে ভোলানো এই দীর্ঘকায় চুষি কাঠি, জিহ্বার স্পর্শে ঠিক কি প্রকার মিষ্টত্ব নিঃসরণ করবে তা জানা না থাকলেও খালি চোখে যে বেশ উৎসাহের সঞ্চার করেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আসলে যতই এর আস্বাদন স্পৃহা শিশুসুলভ বলে
দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, জীবনের উপান্তে এসে এই ললিপপ ই কিন্তু একমাত্র প্রাপ্তি হয়ে দাঁড়ায়। বাকি সবই নাকি ঢপের চপ!
তবে এটাও তো সত্যি, ললিপপ না চুষে বড় হয়ে গেছে এমন কোনো মহাপুরুষকেও তো এই এত বড় মহাবিশ্বে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কিন্তু এইরকম দীর্ঘদেহী, বিচিত্র ললিপপ আগে দেখিনি, তাই ছবিটি এখানে শেয়ার করে নিলাম
---------------------------------------------------------------
'ফুল' কে 'কপি' করে ফুলকপি বানিয়েছিলেন যে অধম, শেষপর্যন্ত খানিক গৈরিক প্রলেপ দিয়ে কিছুটা সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করলেন বটে তবে রং বদলে ফেললেই কি আর নীল শেয়াল বাঘ হয়ে যায কখনো?
নাকি বোতলের পরিবর্তে কমন্ডলুতে ঢাললেই, মদ গঙ্গাজল হয়ে যায়!
ছিল সাদা, হল গেরুয়া; থেকে তো গেল সেই কপিই।
কি বলেন?
-----------------------------------------------------------------
খেজুর গাছের আত্মকথা!
------++-----+++----+++-----
আমার পাতাগুলো কাঁটার মতো সূচাগ্র, গায়ে এবড়োখেবড়ো ত্রিকোণাকার, পাদানীর ভাস্কর্য! তবু, শীতের অপরাহ্ন গুলোয় আমার গা বেয়ে উঠে আসে দোপেয়ে পিঁপড়ের দল; দা দিয়ে চেঁচে চেঁচে আমার দেহরস বয়ে নিয়ে যাওয়া কোমল
নালী পথ গুলোকে নির্মম ভাবে কেটে উন্মুক্ত করে দেয়। গা বেয়ে, টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ে শরীরের শ্বেত শোণিত ধারা। তা নাকি খুব মিষ্টি।
সেই অর্বাচীন গুলো আবার জাতে মানুষ ব্যবহারে সেই মরুপথের পীপাসার্ত উটের মতন। কলসীর হাঁ মুখ বাড়িয়ে রাখে একটি একটি করে যন্ত্রনার জলবিন্দু শুষে নেবে বলে। সারা রাত্রি ধরে আমার রক্ত রস নিংড়ে তার অপূর্ণ কামনার কলস পূর্ণ করে ফেলে। চাঁদ, তারা, ছায়াপথ - সব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অসহায় আকাশ থেকে। শুধু কুয়াশার অভেদ্যতা আমার বেদনার দুঃসহ যন্ত্রণা ঢেকে রাখে রক্ত লোলুপ নিশাচর শৃগালের লোভী দৃষ্টি থেকে। কিন্তু মুক্তি কি মেলে! সেই তো টলটলে কলস ভর্তি রস নিয়ে নেমে যায় ধান্দা সিদ্ধ দোপেয়ে কাঠঠোকরারা। তখন কাক ভোর!
তারপরে!
কত শখ করে কাটা হয় সুবিশাল সব আয়তাকার অগ্নি কুন্ড। জ্বাল দিয়ে দিয়ে রক্ত নিহিত অশ্রুজলের ইতিহাসকে চিরতরে খতম করে দিতে, দিনভর চলে বেদনার আহুতি পর্ব। সব শেষে সমাপ্তি ঘটে নলেন গুড় নামক এক কেতাবী মিষ্টান্ন নির্মাণের আধুনিক মধু যজ্ঞ। পাশেই, আমারই পাতায় ছাওয়া কুটিরে বাস করে সেই যজ্ঞের পুরোহিতেরা। যজ্ঞাহুত অবশেষের সুমিষ্ট সুবাসে আমোদিত হন কত মুণি ঋষি, রাজা মহারাজারা। শুধু অনাহূত থাকি আমি। যন্ত্রনার জ্বালা বুকে আধুনিক শিবের নীরবতায় বেঁচে থাকি বছরের পর বছর।
--------------------------------------------------------------------------------
মন চাঙ্গা, নো পাঙ্গা,
ডাল ভাঙ্গা, কামরাঙ্গা!
এই
প্রসঙ্গে আমার বাড়ির পুকুর ঘাট ঘেঁষে একটা কামরাঙ্গা গাছের কথা মনে পড়ে গেল।
পুকুরের জলে পাকা কামরাঙ্গা পড়ে হদ হয়ে যেত। দাদু বললেন জল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাই এর ডাল পালা ছেঁটে মুড়িয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু গাছটার শেকড় এতটাই গভীরে প্রোথিত ছিল যে সেই গাছটিকে পুরো নির্বংশ করা গেল না। সেই গোড়া থেকে কিছু ডালাপালা বেরিয়েই পড়লো। আজ ও সেই গাছ পুকুর পাড়ের মায়া ত্যাগ করে যেতে পারে নি। রয়েছে তবে ফল ধরে না। তাই কামরাঙ্গা পড়ার ও কোনো সুযোগ নেই।
প্রচ্ছদের কামরাঙ্গা গুলোর ইতিহাস অবশ্য আমার অজানা
------------------------------------------------------------------------------------
প্রস্তরীভুত মহামানবের তর্জনী ছুঁয়ে নিতান্তই এক সাধারণ ভাত শালিক; উড়ে যাওয়ার আগে, তার দূরতিলক্ষ্য গন্তব্যের দিশা ঠিক করতে থাকে।
সকালবেলায় অনেকেই এসেছিল মহামানবের স্থির মর্মর পাদতলে, কাঁড়ি কাঁড়ি ফুল মালা ছড়িয়ে গেছে; জোড় হাত করে, অবনত মাথায় মুহুর্মুহু
তুলেছে জয় হিন্দ ধ্বনি।
বিকেলে আজ, পাখিটাও এসেছে উড়ে; তবে তার ইচ্ছে নিতান্তই হা- ঘরে। কারণ তার কাছে উপহার কিংবা প্রশস্তির ডালি কিছুই নেই দেওয়ার মতো। সে শুধু একান্তে, মহামানবের কানে তাঁর শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা টুকু শুনিয়ে যেতে চায়।
উৎকর্ণ মহামানব, শালিকটিকে তাঁর চির উন্নত তর্জনী শিরে বসতে দেন অবলীলায়। উদ্দেশ্য, উদ্বেল প্রাণের নিঃশর্ত শুভেচ্ছা বার্তা শোনা।
কতদিনের অপেক্ষা.......!
কিচিরমিচির, কিচিরমিচির।
শুদ্ধ অন্তঃকরণ জুড়ে যার বেজে চলে শুভ জন্মদিন প্রিয় নেতাজী।
ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------------------------------------------
ছায়া যখন ছবি হয়!
ছায়া গুলো খালি ছবি হতে চায়। বলা নেই কওয়া নেই কখন যে আলোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়বে ঢঙ করে তার ঠিক নেই।
আলো কে আড়াল করে নিজেদের বিপণন করার কাজে সত্যিই এদের জুড়ি মেলা ভার।
আসলে আলোর ফুটেজ খেয়ে এরা নিজেদেরই প্রচার করে যায়।
এই দেখুন না, শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে টাঙানো এক বিজ্ঞাপনী বোর্ডে কেমন ছায়া এসে তার আল্পনা দিয়ে গেছে। সকলে শুধু সেটাই দেখছে।
বেচারা আলো আসলে নিরাকার। শর্ত ছাড়াই সব্বাইকে দৃশ্যমান করে তোলে। তার মধ্যে কখন যে পাশে থাকা বকুল গাছের পাতাগুলো বিজ্ঞাপনের বুকে তাদের সুললিত ছায়া ফেলে যায়, সে ব্যাপারে কোনো খেয়াল থাকে না আলোর।
তাই কত সহজে ছায়া, ছবি হয়ে যায়। আর আলো নিজে অদৃশ্য থেকে অপরকে কেবল আলোকিত করে যায়। কেমন বিচিত্র বিচার, তাই না!
----------------------------------------------------------------------------------------
কালো আঙ্গুরের শুকনো ঠোঁট!
বিগত দিনের আঙুরবালারা শীতের রুক্ষতা ঢাকতে নারকেল তেল ঘষে নিতেন ঠোঁটে, মুখে , গায়ে। দিন বদলেছে, এখন কোল্ড ক্রিম।
কিন্তু কালো আঙুরের একাল সেকাল সবই সমান। কোনো পরিবর্তন নেই।
তাই শীতের অপরাহ্নে, সাদা খড়ি ওঠা শুকনো ঠোঁট নিয়েই সে হাজির হয় বাজারে।
এক মাঘে শীত যায় না। কালের চক্রে আবারো ফিরে আসে মাঘ মাস। কিন্তু কালো আঙুর যে তিমিরে ছিল থেকে যায় সেই তিমিরেই।
উপসংহারে, মুখ ঝামটা দিয়ে কালো আঙুরের সতীন (সবুজ আঙুর) বলে ওঠে, যত্ত ন্যাকামো! কালোর আবার রূপচর্চা!
-------------------------------------------------------------------------------------
শীতের সময় বাজারে কমলালেবু বিক্রি হবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে। কিন্তু কমলালেবু গুলো যে প্লাস্টিকের নয় তার প্রমাণ দিতে গড়িয়ার এক কমলালেবু বিক্রেতা সটান কমলালেবুর গাছকেই এনে হাজির করেছেন তাঁর ঠেলায়।
মাটির টবে তাই শোভা পাচ্ছে সাক্ষাৎ একটি কমলালেবুর ঝিম,
চিকন গাছ। তার ডাঁটি থেকে ইতিউতি ঝুলে আছে গোল, হলুদ কমলা।
নাগপুর কিংবা দার্জিলিং যেতে হবে না আর। বিশ্বাস হচ্ছে না?
দেখেই নেবেন না হয়। দেখা, শোনা ফ্রি; আর জানেনই তো কেনাকাটা নিজস্ব ব্যাপার।
-------------------------------------------------------------------------------------------
পৌষের শেষ দিনে হয় মকর সংক্রান্তির পুণ্য স্নান। আর পরের দিন অর্থাৎ মাঘ মাসের পয়লা তারিখে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘরে ঘরে হবে বাস্তু দেবতার পুজা অর্চনা। বাস্তুর মঙ্গল কামনায় বাস্তু দেবতার পুজা। ঘরের উঠোনে তুলসী মঞ্চে অথবা মনসা গাছের গোড়ায় বাস্তু দেবতার মূর্তি
বসিয়ে পুজো করার চল এই অঞ্চলে বহু পুরনো। ফল, মিষ্টি ভোগ দিয়ে এই পুজো করতে হয় ব্রাহ্মণ ডেকে।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাস্তু দেবতার মূর্তি গুলো। উল্টানো মাটির কলসির ওপরে রঙ দিয়ে আঁকা হয় লক্ষী ও নারায়ণের মুখ। মাথায় থাকে পত্রাকৃতির চূড়া। দর্শণীয় এই সরা মূর্তি গুলো বাজারে বিক্রি হচ্ছে বেশ রমরমিয়ে।
রাত ফুরোলেই বাস্তু দেবতার পুজো যে।
-----------------------------------------------------------------------------------------
পুণ্য কারোর কাছে অর্জন আবার কারোর কাছে উপার্জন।
এমনই মনে হলো বারুইপুর সেবাব্রত ঘাটে এসে। আজ মকর সংক্রান্তির দিন। আদি গঙ্গার তীরে এই ঘাটে সকাল থেকে তাই মানুষজন আসেন পুণ্য স্নান করতে। স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে, কলা থোড়ের ওপর ফুল, ফল আতপ চাল দিয়ে ভাসিয়ে দেন
নদীর জলে। জ্বেলে দেন ধুপ, দীপ। সবশেষে ভক্তি ভরে মা গঙ্গাকে প্রণাম করে সাধ্যমতো খুচরো পয়সার অঞ্জলী দেন নদীর উদ্দেশ্য। কিন্তু এটি যদি হয় পুণ্যের অর্জন, কারোর কারোর কাছে বিশেষ করে অর্থহীন অসহায় মানুষের কাছে তাই আবার পুণ্যের উপার্জন ও বটে।
কি বিচিত্র পুণ্যের দুই দিক।
একই ঘাটে তাই দেখতে হলো এক থুড়থুড়ে, কোমর পড়ে যাওয়া বয়স্কা মহিলাকে জল থেকে সেই ফেলে দেওয়া কয়েনগুলো কে তুলে আনার জন্য বিচিত্র কসরত করে যেতে।
কি করছেন তিনি?
জাল ফেলার মতো করে, বারবার একটি দড়িকে ছুঁড়ে ফেলছেন জলে, তারপরে সেই দড়ি টেনে, দড়ির মাথায় লাগানো চুম্বকে জড়িয়ে যাওয়া খুচরো পয়সা গুলোকে প্রায় হালটে হালটে, খসিয়ে খসিয়ে তুলে রাখছেন কোমরে গুঁজে রাখা একটি পলিথিনের ব্যাগের মধ্যে।
পুণ্য অর্জন আর উপার্জনের দুই বিপরীত দৃশ্য পরপর তুলে ধরার একটা ছোট্ট প্রয়াস করলাম.
রাত ফুরোলেই সংক্রান্তির পুণ্য স্নান।
কয়েক লক্ষ পুণ্যার্থী আগামী কাল ডুব দেবেন গঙ্গাসাগরে। গঙ্গাসাগর যাওয়ার অন্যতম মূল যাত্রাপথ শুরু হয় শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রেল পথ ধরে।
ভিন রাজ্যের পুণ্যার্থীরা বেশিরভাগ এই পথেই গঙ্গাসাগরের পথে পাড়ি দেন। স্টেশন বিল্ডিংয়ের
বাইরে অস্থায়ী ক্যাম্পে প্রচুর মানুষকে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখে কথা বলে জানলাম তাঁরা ইতিমধ্যে গঙ্গাস্নানের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে।। বাড়ি উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে
রাত্রে এখানেই কাটাবেন কম্বল মুড়ি দিয়ে।
গঙ্গাস্নান করার সুযোগ না পেলেও স্নান করে আসা মানুষজনকে দেখলেই নাকি স্নানের পুণ্য অর্জন করা যায়। তাই এই ছবিটি এখানে শেয়ার করে নিলাম।
------------------------------------------------------------
বিকেলের মরা রোদ এসে লেগেছে শতাব্দী প্রাচীন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল ইমারতের গায়ে।
এমনিতে খাতায় কলমে এর প্রতিষ্ঠা সাল ১৮৫৭'র ২৪ শে জানুয়ারী। কিন্তু প্রায় চার দশক ধরে সেনেট হাউস থেকেই এর সমস্ত কার্য প্রণালী পরিচালিত হতো। একই ঠিকানায় বর্তমান
নির্মাণটি তৈরি হয় ১৯১২ সালে। সেনেট হাউসটির আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। ১৯৬০ সালে এটিকে ভেঙে ফেলা হয়।
দেশের প্রাচীনতম এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ার পেছনে ফ্রেডেরিক জন নামের এক ব্রিটিশ শিক্ষা সচিবের ভূমিকা স্মরণীয়। ১৮৫৪ সালের জুলাই মাসে তিনি এই সংক্রান্ত প্রস্তাবটি পাঠান লন্ডনের ব্রিটিশ শিক্ষা দপ্তরের মূল কার্যালযে।
৮৭/১ কলেজ স্ট্রিট, কোলকাতা -৭৩, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঠিকানা থেকেই একসময়ে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত কলেজ নিয়ন্ত্রিত হতো। বলা হয় কাবুল থেকে বর্তমান মায়ানমার, পুরোটাই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল।
ঐতিহ্যময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত আছে অনেক স্বর্ণালী ইতিহাসের গৌরবময় গাঁথা।
সে অন্য একদিন না হয় বলা যাবে।
------------------------------------------------------------------------
থেমে যাওয়া সময়!
১৮৮০ তে Cooke & Kelvey' র এই ঘড়িটি সুদূর লন্ডন থেকে আনা হয়েছিল জাহাজে করে। দম দেওয়া। ঘড়ির গোলাকার ডায়াগ্রামের নীচে, বিশালাকৃতির কাঁচের বাক্স, তার মধ্যে পেন্ডুলাম ঝুলতো। এখন বন্ধ আছে।
৫২, কলেজ স্ট্রিট, এই ঠিকানায় এই ঘড়ির বাস। পথচলতি
মানুষজন রাস্তা থেকেই দেখতে পান এই অতি দর্শন ঘড়িটিকে। দেওয়ালের এক বিরাট অংশ জুড়ে ঝুলে থাকে এটি, রাস্তার পশ্চিম পারে থাকা মেডিকেল কলেজের দিকে মুখ করে।
সম্প্রতি আমিও ওইভাবে দেখে ভীষণ আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ি ঘড়িটার ব্যাপারে। ঢোকার মুখে, ফলকে খোদাই করা রয়েছে দেখি - ডেন্টিস্ট, ডক্টর লাহা অ্যান্ড সন্স এর নাম। ১৮৮০ সালে প্রতিষ্টিত এই চিকিৎসা কেন্দ্রটি যে কোলকাতা শহরের অন্যতম প্রাচীন দাঁতের চিকিৎসালয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা বর্তমান ঘরটির একপাশে দাঁতের চিকিৎসা চলে এখনোও, অন্য পাশে রয়েছে জেরক্সের দোকান।
খালি ছবিই তুললাম। বেশি কিছু জানতে পারলাম না।
------------------------------------------------------------------------------------------------
'বিকেলে ভোরের ফুল'' নামে ১৯৭২ সালে সমরেশ বসু একটি উপন্যাস লেখেন ।
দুবছর পরে, এটি চলচ্চিত্রায়িত হয়। একই নামে। পরিচালক, পীযুষ বসু। উত্তম কুমার এবং সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় অভিনয় করেন নাম ভূমিকায়।
এসব মোটামুটি সকলেই জানেন।
আসলে ফুল সবসময় সকালেরই হয়। বিকেলের শুধু অপেক্ষা হয়। কখন সন্ধ্যা এসে টোকা দিয়ে বলবে, চলো এবার ঘরে চলো! আর নয়।
আসলে শীতল আঁধার তার নিশ্চিদ্র আহ্বানে কাছে টেনে নেওয়ার আগে ফুল আসে শুধুই ফেয়ারওয়েল জানাবে বলে।
আমার কাছে 'বিকেলে ভোরের ফুল' অন্য কিছু দ্যোতনা নিয়ে আসে না। এমনকি সে ফুলের সুবাস পর্যন্ত অরক্ষণীয় স্মৃতি হয়ে জমা হয় অসংরক্ষিত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
-------------------------------------------------------------------------------
--------------------------------------------------------------------------------
কথায় আছে, পড়াশোনা করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। স্বয়ং বিদ্যার দেবী যদিও রাজহাঁসের পিঠে চড়েই বিচরণ করেন চরাচরে।
কিন্তু কালের বিড়ম্বনায় দেবী সরস্বতীকেও শেষ পর্যন্ত
লরিতে চেপে মর্ত্যের বাজারে অবতীর্ণ হতে হচ্ছে। লরির পেছনে, খড়ের গাদার মধ্যে উপবেশন করে দেবী বীণাপাণি সোজা মৃৎশালা থেকে বাজারে এসে নামছেন বিদ্যার্থীদের করুনা বিলোবেন বলে। ভাবা যায়!
তবে অপরাধ নেবেন না মা, দিনে দিনে আপনার পসার ও প্রচার তো কম হয় নি, তাই ঘরে ঘরে আপনার মূর্তি কে পৌঁছে দিতে এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
------------------------------------------------------------------------------------
কথায় আছে বট গাছে কি আর তেঁতুল ফলে! কিন্ত এটাও তো সত্যি যে কোনোকিছুই শূণ্যে ফলে না।
তবে অতশত বিতর্কে না গিয়ে বরং এমন জলজ্যান্ত কাঁচা তেঁতুলকে দেখে যে কি বিপন্ন অবস্থা
হয় মুখ বেয়ে গড়িয়ে আসতে চাওয়া অবাধ্য লালার তাই নিয়েই চিন্তা করা ভালো।
কত রথী মহারথী যে কাঁচা তেঁতুলের সামনে নিজেদের লালা সংবরণ করতে না পেরে নাস্তানাবুদ হয়ে গিয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল একবার ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের শীতলা পুজা উপলক্ষে, কোলকাতার সুবিখ্যাত ব্যান্ড পার্টি মেহেবুব ব্যান্ডের বাজনা দল গিয়েছিল বাজাতে। তা আমরা তো সব হাঁ হয়ে দেখছিলাম তাদের বাজানোর কসরৎ। আমাদের মধ্যে লাল্টু বলে একটি ছেলে দিব্যি একটা কাঁচা তেঁতুল মুখে পুরে দেদার চুষে যাচ্ছিল। তাই দেখে যা হোল ব্যান্ড পার্টির বাঁশিওয়ালার সে কহতব্য নয়। তাঁর তো লালায় মুখ, একেবারে জবজবে! বাঁশি বাজাবেন কি, কাঁচা তেঁতুল খাওয়া দেখেই তার অবস্থা সারা। শেষে বাধ্য হয়ে ছেলেটিকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে হলো। যাই হোক।
আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
এইটুকুই।
--------------------------------------------------------------------------------------------
নাটকের ছোট গল্পঃ
ব্যর্থ স্বপ্ন যখন মৃত্যুর আরাম খোঁজে!
মুম্বাই এসেছিল হিরো হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। শেষে একটা সময় আসে যখন নিরবিচ্ছিন্ন ব্যর্থতার ক্লান্তি তাকে বলতে বাধ্য করে, আমি 'কাম' চাই না, আরাম চাই।
মর্মস্পর্শী কাহিনী সম্বলিত ' ব্লাডি বোম্বে 'নাটকের একটি ছোট্ট নাট্যাংশ এখানে শেয়ার করে নিলাম।
-----------------------------------------------------------------------------------------
শুক্লা পঞ্চমীর রং দেবীর দিব্য চোখে মুখে। চূড়ায় বিদ্যার্জিত সুমহান রত্ন সজ্জা। দেহ বিভঙ্গে সঙ্গীত সাধীকার সুশোভন দীপ্তি। বাম হস্তে তিনি বীণাপাণি; দক্ষিণ হস্তে অভয়
মুদ্রা সকল প্রেমিক প্রেমিকার তরে।
তবে সে প্রেম রবীন্দ্রনাথের না প্লেটোর নাকি বাঙালীর কেতাবী কিতাব প্রেমের তা ঠিক করার দায় যে যার নিজের নিজের।
------------------------------------------------------------------------------
ঠিক ওভাবে নেবেন না, দেবী সরস্বতী কখনো স্বয়ম্বর সভায় হাজির হয়েছিলেন কিনা, মানে পুরানের যুগে আর কি, আমার কাছে কিন্তু সেরকম কোনো তথ্য প্রমাণ নেই।
তবে এখন ঘোর কলি। তাই
সবই সম্ভব। আর একান্তই সম্ভব না হলে আমাদের দেখার দোষে সেটুকুও আর বাকি থাকে না।
তবে একটাই যুক্তি, সরস্বতী নিজে তো আর ইচ্ছে করে এই পুরান অসিদ্ধ পজিশন সৃষ্টি করেননি।
মৃৎ শিল্পীর এলেমে হয়ে গেছে।
মৃৎ শালা থেকে বার করে কেন যে সটান ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি তা স্বয়ং মা সরস্বতীও তাঁর বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারছেন না। হতে পারে রোদ খাওয়াতে, কিন্তু তাই বলে পাতি জামাকাপড়ের দোকানের ওই হাঘরে মডেল ছোঁড়া গুলোর সামনে! সাহস দেখুন। কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে সরস্বতীর দিকে। তবে! গল্প তো হবেই।
যদিও দোকানের মালিক অভয় দিয়ে রেখেছেন, অত ভাববার কিছু নেই কারণ ওগুলো সব কাষ্ঠবৎ পুতুল, থোড়িই ওদের প্রাণ আছে!
মৃৎ শিল্পীও কম যান না। তিনি ও ডাটিয়ে বলে দিয়েছেন সরস্বতী ও আমার মাটির পুতুল। প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে তবে তো!
কি বলেন, ও সব স্বয়ম্বর টয়ম্বর বাদ দেন তো। যত পাতি কথা।
চলুন। এইটুকুই থাক।
জয় মা সরস্বতী বলে শেষ করি এইখানে।
------------------------------------------------------------------------------
সত্যিই নির্জন রেলওয়ে স্টেশন, এই ললিতগিরি। সারাদিনে মাত্র একটিই যাত্রী ট্রেন আসে এই স্টেশনে। রেলের দক্ষিণ পূর্ব শাখার এই স্টেশনটি পড়ে ওড়িশায়, জাজপুর থেকে পারাদ্বীপ
যেতে। মাত্র পাঁচ বছর হয়েছে এই লাইনটি চালু হয়েছে।
--------------------------------------------------------------------------------
যে কয়েকটি হাতে গোনা
#সরস্বতীর_মন্দির রয়েছে বাংলায় তাদের মধ্যে কাঁথি শহরের হাতাবাড়ী মৌজায় অবস্থিত সরস্বতী মন্দিরটি অন্যতম। বলাই বাহুল্য মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলটিকে এই
কারণে
#সরস্বতীতলা বলা হয়।
প্রচ্ছদের সরস্বতীর মূর্তিটি,
#কাঁথির সরস্বতী মন্দিরের। সরস্বতী পুজা উপলক্ষে আজ মন্দিরে হচ্ছে বিশেষ পুজানুষ্ঠান। মর্মর মূর্তিটিকে সাজানো হয়েছে বিশেষ বাহারী ফুল এবং মালায়।
প্রসঙ্গত মন্দিরের গাত্রস্থিত ফলক অনুসারে, ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দিরটি। অর্থাৎ ইংরেজি, ১৯৩৯ সাল। তখন অবশ্য মন্দিরের দেওয়াল ছিল মাটির এবং মাথায় ছিল খড়ের চালা। কিন্তু তিন বছর পরে অর্থাৎ ১৯৪২ এর অক্টোবর মাসে হওয়া বিধ্বংসী ঝড়ে মন্দিরটি পুরো ভেঙে যায়। তারপরে তৈরি হয় বর্তমান মন্দিরটি। দালান স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত, চুন সুড়কির এই মন্দিরটির বর্তমানে প্রায় আশি বছরের বেশী বয়স। এবং বয়সের ভারে বেশ জরাজীর্ণ।
উল্লেখ্য, কাঁথির এই সরস্বতী মন্দিরটির নির্মাণের পেছনে জনৈক আইনজীবী তপন কুমার মাইতির অবদান স্মরণীয়। রাজস্থানের পুষ্কর ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার সরস্বতী মন্দির দেখে, বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হন তপন বাবু। এবং যথারীতি
#কাঁথি ফিরে বন্ধু আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে একটি সরস্বতী মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেন। শুধু তাই নয়, মন্দির নির্মাণ কল্পে বর্তমান জায়গাটিকে
#কাঁথি_সিভিল_বার_অ্যাসোসিয়েশনের নামে দান করে দেন। বলাই বাহুল্য মন্দির এবং মন্দিরের সামনের বিশাল প্রাঙ্গণের বর্তমান মালিক
#কাঁথি_সিভিল_বার_অ্যাসোসিয়েশন। বার অ্যাসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে, বর্তমানে মন্দিরে নিত্য পুজা ছাড়াও সরস্বতী পুজোর দিনে আয়োজিত হয় বিশেষ পুজো হোম যজ্ঞের। পূর্বে, সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যায় আয়োজিত হতো সদস্য আইনজীবীদের দ্বারা অভিনীত বিশেষ যাত্রানুষ্ঠান। এখন যাত্রা না হলেও আতস বাজী পোড়ানো হয়।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সরস্বতী মুর্তিটি ১৯৮৬ সালে রাজস্থানের জয়পুর থেকে আনানো হয়, তখনকার বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মনোজ কুমার রায়ের বিশেষ উদ্যোগে। প্রায় চার ফুট উচ্চতার এই মূর্তিটি সম্পূর্ণ মার্বেল পাথরের তৈরি। মূর্তির বাম হাতে শোভা পায় বীণা আর ডান হাতে থাকে আশীর্বাদ প্রদান ভঙ্গিমা!
কাঁথির সরস্বতী মন্দিরের পূজা এবং সেই সম্বন্ধে কথা বললেন মন্দিরের পরিচালন সমিতি, কাঁথি সিভিল বার অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সম্পাদক শ্রী শুভদীপ বেরা।
পুজো দেখা এবং কথা বলা
একসাথেই চললো।
দেখাই যাক তাহলে!
-------------------------------------------------------------------------------
সরস্বতী পূজা শেষ। এবার বিসর্জনের পালা।
হৈ হৈ করতে করতে স্কুলের ছাত্ররা, সদলবলে চলেছে প্রতিমা বিসর্জন দিতে।
'সরস্বতী মা কি জয়' ধ্বনি তে মুখরিত হচ্ছে ভ্যান রিক্সারূঢ় সরস্বতীর বিসর্জনী যাত্রা। পূর্ববর্তী বছরের মতো, পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠিত পুকুরে ডুবানো হবে বিদ্যার দেবী কে।
শোভাযাত্রায় থেকে থেকে স্লোগান উঠছে, আসছে বছর আবার হবে, বছর বছর এগিয়ে যাবে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এক গ্রামীণ স্কুলের প্রতিমা বিসর্জনী শোভাযাত্রার এমনই চিত্তাকর্ষক ছবি উঠে এলো।
------------------------------------------------------------------------------
ধুতরা, সাদা কিংবা নীলচে বেগুনী রঙের অনেক দেখেছি। কিন্তু এমন গোলাপী আভা যুক্ত প্রকান্ড ধুতরা- এই প্রথম চোখে পড়লো।
তাই দেখা মাত্রই, ছবি নেওয়ার জন্য যে মন একেবারে আকূল
হয়ে উঠেছিলো, সে কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই।
বিশেষ করে রাত্রি বেলায়, কলতলার পাশে অমন স্বর্গীয় শোভা দেখার পর নিজেকে ধরে রাখাই যেন মুশকিল হয়ে পড়ছিল। বলতে বাধা নেই, বিশাল একজন সৌভাগ্যবান বলেই মনে হচ্ছিল তখন নিজেকে।
রাত্রির কালো আকাশের নীচে, বাড়ির লনের অনুজ্জ্বল আলোয় এমন মায়াময় সৌন্দর্য দর্শণের অভিজ্ঞতা তো খুব একটা হয় না। তাও নিশি নিভৃতে, সর্বোপরি ধুতরার সুমিষ্ট ঝাঁঝালো গন্ধে চারিদিক যখন ম ম করছে, মনে হলো পৃথিবী নিপাত গেলে যাক, আমি যেন প্রাণ খুলে সে জাদুবাস্তব কে তুলে রাখতে পারি আপন করে।
----------------------------------------------------------------------------------------
সৌন্দর্য বাপু গাছে ফলে না। দাঁড়াও দাঁড়াও, একটু ভাবতে দাও। এই যে দিনরাত আহ্ ফুল, ওহ্ ফুল বলে এত শিহরিত হও, সেই ফুল কি গাছে ফলে নাকি ঘরের ওয়ার্ডরোবে!
খালি কথার কথা,
অতীতের কিছু বুড়ো হাবড়া চন্ডিতলা, শীতলাতলায বসে, থেলো হুঁকোয় টান মারতে মারতে এমন অনেক ভুলভাল কথার ফতোয়া দিয়ে গেছে। যত্ত সব ফুট কাটা গেঁয়ো কথা।
এখন হোয়াটসাপ, ফেসবুক, ইনস্টার যুগ। খালি বললেই হলো! এতদিন এসব ছিল না বলেই চলছিল, কিছু তো একটা বলতে হবে নাকি! শুধু কথাতে তো আর চিড়ে ভেজে না। কথার মাঝে একটু প্রবাদ প্রবচনের পাঁচফোড়ন না ছেটালে কি আর কথকতা জমে! এইভাবে মুখে মুখে বলতে বলতে কত এগোবেগো কথাই যে প্রবচন হয়ে গেছে তার হিসেব প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবীশের কাছেও নেই।
হিসেবের কথা যখন উঠলোই তখন হিসেব করে কি লাভ সে প্রশ্ন তো উঠবেই; কারণ কথাতেই তো আছে সব হিসেবই শেষ পর্যন্ত নাকি শূন্যতে এসে ঠেকে। দেখুন মজা। কতকগুলো হেদো মানুষ যাদের কাছে সঞ্চয়ের জন্য না ছিল কোনো রোকড়া না ছিল তাকে জমিয়ে রাখার কোনো সুব্যবস্থা। ব্যাংক, চিট ফান্ড কিংবা পোস্ট অফিস পর্যন্ত ছিল সুদূরপরাহত। ছিল কেবল মহাজনী কারবার। যখন সঞ্চয় না জানি কোন্ মুলুকের ভূত, কেবল ঋণের বোঝাই চেপে ঘাড় মটকাতো ওই ওগাবগা মানুষ গুলোর। তা দিনের শেষে, প্রেমিকার গালে আদরের চুমু লেপে দিতে দিতে এই টুক আপ্তবাক্য তো না বললেই নয়। অভাবেই তো মানুষের ভাবের উদয় হয়।
তবে অভাবে স্বভাব নষ্ট হওয়ার কথা বলে গেছেন বটে বনমালী জেঠু কিন্তু সারাজীবন তিনি একটিও ভাবের কথা বলেননি। এই নিয়ে জেঠিমার অনেক অনুযোগ ছিল। যাকগে বড়দের দোষ দেখতে নেই। ওতে নাকি পাপ হয়।
তা তো হবেই। বুড়ো গুলো কম রসিক তো ছিলেন না। মানুষকে ঋণের জালে ফাঁসিয়ে ও নিজেদেরকে মহাজন উপাধিতে ভূষিত করে রাখার কৃতিত্ব তো বড় কম ব্যাপার নয়। আলফ্রেড নোবেল জানলে চিটিংবাজীর নোবেল পুরস্কারটি নিশ্চিতভাবে আমাদের গ্রামের 'প্রখ্যাত মহাজন' রামেশ্বর দাদুকে দিয়ে যেতেন।
এই দেখুন, হচ্ছিল গাছে ফলার কথা, চলে এলাম মহাজনী কারবারে। যাকে বলে ধান ভাঙতে শিবের গাজন গাওয়া আর কি। তবে হ্যাঁ বুড়োদের এলেম ছিল বটে; দেখুন কোথায় জুতো সেলাই আর কোথায় চন্ডি পাঠ, কি অসাধারণ জৌলুস এই কথাগুলোর আজোও; উঠতে বসতে তথাকথিত এই'সোশাল' সমাজেও দিনরাত আমরা এই সব কথা আউড়ে চলেছি। হয়তো ভবিষ্যতেও করে যাবো। এইরকমই হয়তো কথার খই ফুটে যাবে আমাদের মুখে। আচ্ছা খই তো হাঁড়িতে ফোটে, এখন অবশ্য ভুজিয়াওয়ালার দোকানে ওঠে। কিন্তু সেই স্বভাব দার্শনিকদের আজ বড় অভাব। চন্ডিতলার সমাজ বর্তমানে 'সোশাল সমাজে' উঠে এসেছে ঠিক কিন্তু একটাও কথা প্রবাদ হয়ে উঠতে পারে নি। দেখা যাক আগামী দিনে কোনো অভাবের কালে যদি ভাবের উদয় হয় কি না।
----------------------------------------------------------------------------------------
বসতে দিলে যে শুতে চাইবে সে কথা আগে থেকেই জানতেন সোফা কাম বেডের নির্মাতারা। এবং বলতে বাধা নেই, ঘরোয়া সাজসরঞ্জাম এর ক্ষেত্রে এই বসা কাম শোওয়ার আসবাবটি প্রায় এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। বিশেষ করে, বাড়ির বৈঠকখানায় এর থাকাটা প্রায় অবধারিত। আসলে প্রয়োজন আর আয়োজনের এত ভালো সমন্বয় আর কোথায়!
যাই হোক, এবার খোদ কোলকাতা শহরের ফুটপাতে এসে গেল বেঞ্চ কাম বেডের কনসেপ্ট।
পৃথিবীতে থিসিস চুরি হলে ঢিঢি পড়ে যায়, আর কনসেপ্ট চুরি হলে মার্কনি হয়ে যায়। তবে বাণিজ্যিক হাউসগুলোয় নাকি এই কনসেপ্ট চুরির মাহাত্ম্য অনেক। কারণ তাদের কাছে বাণিজ্য পুঁজিতে নয় আইডিয়াতে চলে। কে জানে আগামী দিনে কি বিপ্লব না অপেক্ষা করছে।
----------------------------------------------------------------------------------------
থামুন, থামুন- মানুষ প্রোপোজ করবে আর ভগবান ডিসপোজ (নিস্পত্তি) করে দেবেন এই নিয়মটি কিন্তু আজকের দিনের জন্য বলবৎ হচ্ছে না। কেন, সেটা বলছি একটু পরে।
ম্যান প্রোপোজেস
এ্যান্ড গড ডিসপোসেস - এই কথাটির মধ্যে আসলে ভগবানকেই সবসময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী বলে দেখানোর চেষ্টা হয় এবং বলাই বাহুল্য মানুষের ইতিহাসে এই আপ্তবাক্যটি কোনোদিনই ইতিবাচক দ্যোতনা নিয়ে আসে না। তাহলে? আরে বাবা ভগবান ভগবান করে খালি নাকে কান্না না করে তুড়ি মেরে একবার বলে দিলেই তো হয়।
দেখো বাপু, রাধা কৃষ্ণ যদি রাজী থাকে তবে ভগবান খামোখা নাক গলিয়ে কি করবে শুনি? পাতি দর্শক হয়ে ভ্যালভ্যল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া, কোনো ভূমিকাই তো থাকবে না তাঁর!
গোদা বাংলায়, মিঁয়া বিবি রাজি তো কেয়া করেগা কাজী। ওই তো হলো, নাকি!
এদিকে ভগবান কিন্তু বড় চতুর, শক্তি ক্ষয় হলেও বুদ্ধি কিন্তু টনটনে। তাই তো আজকের দিনে নিয়মে খানিকটা শিথিলতা এনে মহান সাজার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেননি তিনি।
কারণ ভগবান জেনে গেছেন আজ প্রোপোজ ডে। তাই, আগাম নাক গলাবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। মানুষের ব্যাপার মানুষ বুঝে নেবে।
তাই হ্যাপি প্রোপোজ ডে, যাকে খুশী।
এই নিয়ে একটা মজার গল্প রয়েছে তবে আজ নয় পরে বলবো ক্ষণ।
ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------------------------
শেষ হয়ে গেল ৪৮ তম কোলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। ১২ দিন ধরে চলা এই বইমেলার আজ ছিল 'বিজয়া দশমী', যেমন বললেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক হিমাদ্রী কিশোর দাশগুপ্ত। রাত ঠিক ৯টা ১০
মিনিটে ঘন্টা ধ্বনি এবং তুমুল করতালি ও হর্ষ উল্লাসে বইমেলার সমাপ্তি ঘোষনা করলেন উদ্যোক্তা সংস্থা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের বর্তমান সম্পাদক সুধাংশু শেখর দে। উপস্থিত ছিলেন সংস্থার সভাপতি ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায়, শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু সহ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। ছিলেন সল্টলেক পুরসভার চেয়ারপারসন শ্রীমতী কৃষ্ণা চক্রবর্তী সহ বিনতা রায়চৌধুরী, অগ্নি রায়, প্রচেত গুপ্ত ও অন্য অনেক প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিকেরা।
আওয়াজ উঠলো আগামী বছর বইমেলার মেয়াদ আরোও একসপ্তাহ বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে। মানুষের ঢল এবং বই বিক্রির নিরিখে এবারের বইমেলা তার ৪৮ বছরের ইতিহাস গড়লো সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ রেকর্ড। গিল্ডের সম্পাদকের কন্ঠে এই নিয়ে শোনা গেল গর্বের ঘোষণা। প্রায় ২৭ লক্ষ মানুষ, ১২ দিন ধরে ২৫: কোটি টাকার বই কেনাকাটা করেছেন যা গতবারের ১৪ দিনের বইমেলার থেকেও ২কোটি বেশী।
সমাপ্তি ভাষণ রাখলেন এবারের বইমেলার থিম কান্ট্রি জার্মানির, ভারতে নিযুক্ত কনস্যুলেট জেনারেল। উল্লেখযোগ্য ভাবে তিনি তাঁর ভাষণ শুরু করলেন নমস্কার বলে।
বইয়ের 'কুম্ভ মেলা' থেকে বেরিয়ে আসার মুখে দেখা হয়ে গেল শিল্পী গোপাল মন্ডলের সঙ্গে। গোটা গায়ে তাঁর সোনালী রঙের ঔজ্জ্বল্য। পরনে সিল্কের গেরুয়া ধুতি, কোমরের সামনে ঝুলছে কালো কাপড়ের থলে। উল্লেখযোগ্য ভাবে তাঁর মাথায় ধরা একটা কাঠের ফ্রেম, যার চারদিকে বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ সহ বেশ কয়েকজন মণীষীর ছবি ।
যাইহোক ভালোয় ভালোয় মিটলো সব।
বাঙালীর বাসন্তী' দুর্গোৎসব' শেষ হলো যদিও এবারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না করা নিয়ে একটা খটকা কিন্তু থেকেই গেল শেষ পর্যন্ত।
৪৮ তম কোলকাতা বইমেলার সমাপ্তি মঞ্চে আজ ছিল ভরা চাঁদের হাট। তারমধ্যে বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব তথা রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বক্তব্য ছিল প্রকৃত অর্থেই ঋদ্ধ করার মতন।
এছাড়াও ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিমাদ্রী কিশোর দাশগুপ্ত, বিনতা রায়চৌধুরী, অগ্নি রায় ও প্রচেত গুপ্ত প্রমুখ। প্রত্যেকেই তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে কোলকাতা বইমেলা নিয়ে ব্যক্ত করেছেন তাঁদের মূল্যবান অভিমত।। শেয়ার করেছেন চমকপ্রদ, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।
সর্বোপরি বক্তব্য রাখতে গিয়ে কি বললেন এবারের থিম দেশ জার্মানির, কনসাল জেনারেল! সমস্ত কৌতুহলের নিরসন করতে বরং দেখেই নেওয়া যাক সমাপনী অনুষ্ঠানের এই ভিডিও প্রতিবেদনটি।
-------------------------------------------------------------------------------------
মূর্তিমান চুষি কাঠি! প্লাস্টিকে মোড়া। ছেলে ভোলানো এই দীর্ঘকায় চুষি কাঠি, জিহ্বার স্পর্শে ঠিক কি প্রকার মিষ্টত্ব নিঃসরণ করবে তা জানা না থাকলেও খালি চোখে যে বেশ উৎসাহের সঞ্চার করেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আসলে যতই এর আস্বাদন স্পৃহা শিশুসুলভ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, জীবনের উপান্তে এসে এই ললিপপ ই কিন্তু একমাত্র প্রাপ্তি হয়ে দাঁড়ায়। বাকি সবই নাকি ঢপের চপ!
তবে এটাও তো সত্যি, ললিপপ না চুষে বড় হয়ে গেছে এমন কোনো মহাপুরুষকেও তো এই এত বড় মহাবিশ্বে খুঁজে
পাওয়া দুষ্কর।
কিন্তু এইরকম দীর্ঘদেহী, বিচিত্র ললিপপ আগে দেখিনি, তাই ছবিটি এখানে শেয়ার করে নিলাম
--------------------------------------------------------------------------
রেলের আবার মন্দির গেট!
তবে শুধু মন্দিরই বলবো কেন, মন্দির মসজিদ গির্জা যে কোনো ঐতিহ্যবাহী নির্মাণেরই আর্ক বা খিলান হচ্ছে একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থাপত্য শৈলী। যেমন ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই রেল যাতায়াতের সুড়ঙ্গ পথটি, যার প্রবেশ মুখে চমৎকার এক খিলান স্থাপত্যের নজির চোখে পড়ে। পার্ক সার্কাস স্টেশন থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে পড়ে এই রেল ব্রীজটি।
নিত্য যাতায়াতের পথে পড়া এই খিলান সৌন্দর্য কে তাই সবার সঙ্গে শেয়ার করে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
-------------------------------------------------------------------
সৌন্দর্যের কি মহিমা, বাবা! ভালো লাগে বলে নির্ভেজাল দাসত্বকেও দুহাত তুলে মেনে নিয়েছি।
মুগ্ধতার আরেক নাম বুঝি বশ্যতা স্বীকার! বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি তাই চাকর বাকরের মতো রোজই কিছু না কিছু লিখিয়ে নাও। আমার ভালোলাগার মূল্য কি এতটাই মূল্যহীন?
ধূর! কি সব নাটুকে কথাবার্তা বলছি আমি, সকালবেলায় এসব ছাইপাঁশ গেলার লোক বাপু বাজারের পথে থলে হাতে। দর দাম করে নধর রুই মাছটিকে ব্যাগস্থ করা ছাড়া আর কোনো লক্ষ নেই তাদের। তবে হ্যাঁ উচিত মূল্য সেখানেও চোকাতে হয়।
অর্থহীনের তাই ভালোবাসার মূল্য
ক্রীতদাস হয়েই মেটাতে হয়। সকাল দুপুর সাঁঝে খালি তোমার আব্দার, তাগাদা - কই কবিতা লিখলে কিছু? ক্রীতদাস হয়ে তাই অ-কবিকেও কবিতা লিখতে হয়। মুগ্ধতার প্রথম প্রকাশ - আহ্ এই শব্দটাই তো কাব্যের মহাসাগর দর্শন করায়। সেই অপার সৌন্দর্যের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, কি আর বেরোবে কবিতা ছাড়া?
দিনরাত হাটে বাজারে পথে ঘাটে জনারণ্যে নিভৃতে কত যে কবিতা ফেরি হয়ে যায় ভালোলাগার ঘাটে ঘাটে তার খবর কে রাখে! মুগ্ধতাই একমাত্র পুঁজি। তাকে খাটিয়ে কেউ কবি হয়ে যায় কেউ হদ্দ ক্রীতদাস।
-------------------------------------------------------------------------------
ধুতরা, সাদা কিংবা নীলচে বেগুনী রঙের অনেক দেখেছি। কিন্তু এমন গোলাপী আভা যুক্ত প্রকান্ড ধুতরা- এই প্রথম চোখে পড়লো।
তাই দেখা মাত্রই, ছবি নেওয়ার জন্য যে মন একেবারে আকূল হয়ে উঠেছিলো, সে কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই।
বিশেষ করে রাত্রি বেলায়, কলতলার পাশে অমন স্বর্গীয় শোভা দেখার পর নিজেকে ধরে রাখাই যেন মুশকিল হয়ে পড়ছিল। বলতে বাধা নেই, বিশাল একজন সৌভাগ্যবান বলেই মনে হচ্ছিল তখন নিজেকে।
রাত্রির কালো আকাশের নীচে, বাড়ির লনের অনুজ্জ্বল আলোয় এমন মায়াময় সৌন্দর্য দর্শণের অভিজ্ঞতা তো
খুব একটা হয় না। তাও নিশি নিভৃতে, সর্বোপরি ধুতরার সুমিষ্ট ঝাঁঝালো গন্ধে চারিদিক যখন ম ম করছে, মনে হলো পৃথিবী নিপাত গেলে যাক, আমি যেন প্রাণ খুলে সে জাদুবাস্তব কে তুলে রাখতে পারি আপন করে।
-----------------------------------------------------------------------------
চলো ভ্রমর হই!
প্রথমেই স্বীকার করে নেই, এই শিরোনামটি লেখার নেপথ্য প্রেরণা হিসেবে শ্রদ্ধেয় কবি বিমান বিশ্বাসের লেখা সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'চলো আতশ হই' রয়েছে । এবছরই বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে এই বইটি। বইমেলার একেবারে শেষ দিনে ছেলেকে সাথে করে পৌঁছেছিলাম বইয়ের কুম্ভ স্নানে।
অত্যন্ত সচেতন ভাবেই কুম্ভ স্নান কথাটি বললাম। কারণ কুম্ভ স্নানে অমৃত লাভ হবে কি না জানা নেই তবে সবদিক থেকে ক্ষয় ধরা বর্তমান এই সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার অমৃত কিন্তু বইয়ের মধ্যেই গচ্ছিত রয়েছে।
বইয়ের মধ্যে
আমরা ছাপোষা মানুষ নিতান্তই যদি অমৃত আহরণ করতে ব্যর্থ ও হই, মধু সংগ্রহে অন্তত অসফল হবো না বলেই আমার বিশ্বাস ।
তাই বই যদি হয় ফুল তবে চলো আমরা ভ্রমর হই।
পরিশেষে, কবি বিমান বিশ্বাসেরই লেখা কবিতা 'চলো আতশ হই' এর শেষ তিন লাইন এখানে উদ্ধৃত করছি; যার প্রতিটা শব্দের সুমিষ্ট মধুরেণু, হারিয়ে যাওয়া জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে বেঁচে ওঠার তন্নিষ্ঠ রুচি।
"আর কিছুক্ষণ থাকো। বাকিটুকু নিংড়ে এসো ভালোবাসি। কিছু অপেক্ষা রেখে দু'জনে 'চলো আতশ হই'।"
----------------------------------------------------------------------------------
অর্গানিক ছোলা শাক!
আমার বাবা বাজারে গেলে, বিশেষ করে শাক কেনার ক্ষেত্রে বেছে বেছে সেই রংচটা শাকই কিনে আনেন যত্ন করে। দামে সস্তায় পাওয়া যায় বলে নয়, একটু বিবর্ণ শাক নাকি অর্গানিক হয়। তার মানে বাকি সব প্লাস্টিক সেরকমটাও ঠিক নয়। তাও। বাবার মতে টগবগে সবুজ শাকে নাকি কাঁড়ি কাঁড়ি সার আর কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।
প্রচ্ছদের ছোলা শাক দেখে আমি নিশ্চিত আমার বাবা এগুলোকে একেবারেই কিনতেন না । অমন সুন্দর করে সাজানো প্লাস্টিকের গামলায়, দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে - এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে।
কিন্তু এই শাক অর্গানিক হবে কিনা এই নিয়ে বাবার মনে কিন্তু প্রগাঢ় সন্দেহ থেকেই যেতো।
আমার মনে অবশ্য এই নিয়ে কোনো ছুৎমার্গ নেই।
যাই হোক শাক নেব বলে আমি যখন দরদাম করছিলাম ঠিক সেইসময় দুজন ভদ্রমহিলা কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলেন, ছোলা শাক দেখে তো একজন বলেই ফেললেন "এই দেখেছিস কি সুন্দর ছোলা শাক বিক্রি হচ্ছে"। "দেখে তো মনে হয় একেবারে অর্গানিক"!.
"হ্যাঁ আমার ঘরে খুব হয় এগুলো"!
"কি করে করে রে.."!
কিন্তু এখানেও সেই অর্গানিক আর ইনঅর্গানিক তত্ত্ব। শুনেই আমার মাথা এমন চটকে গেল যে ছোলা শাক রান্নার পদ্ধতিটা আমার কানে এল ঠিক কিন্তু ঘোড়ার খাদ্য কিছু বোধগম্য হলো না।
------------------------------------------------------------------------------------
বইমেলা শেষ হয়ে গেলেও তার রেশ এখনোও মুছে যায়নি মন থেকে। এবারের কোলকাতা বইমেলায় লিটলম্যাগ প্যাভিলিয়নে ছিল প্রায় ৩০০এর কাছাকাছি টেবিল। সেখানে উৎসাহী মানুষের ভিড় ও ছিল চোখে পড়ার মতো। সবথেকে আকর্ষনীয় এবারের থিম কান্ট্রি জার্মানির সুবিশাল বুক সেল্ফ আকৃতির সুদৃশ্য প্যাভিলিয়নটি।
প্রসঙ্গত বইমেলায় বই কেনার পাশাপাশি চলে দেদার আড্ডা, খাওয়া দাওয়া, হৈ হুল্লোড় সহ নানা কিছু । অগণিত বইপ্রেমী মানুষ ঘুরে বেড়ান তাঁদের পছন্দের লেখকের দেখা পাওয়ার আশায় । কেনা বইয়ের ওপর লেখকের
অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য পড়ে যায় তুমুল হুড়োহুড়ি। লেখকেরাও কোথাও কোথাও নিজেদের উদ্যোগে কবিতা গল্প ইত্যাদি পাঠ ক'রে বইমেলার আকর্ষণকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করেন।
বইমেলা শেষ হয়েছে গতকাল, মাত্র ২৪ ঘন্টা আগে।। কেমন ছিল বইমেলার শেষদিন, থাকলো একটি ভিডিও প্রতিবেদন।
----------------------------------------------------------------------------------
বসন্তেও পাতা ঝরে!
প্রকৃতির লীলা বোঝে কার সাধ্য। নব বসন্তের হাওয়ায় যখন বর্ণীল নব কিশলয়ের অভ্যুত্থান সূচিত হচ্ছে দিকে দিকে তখন কাঠ বাদামের পাক ধরা লাল পাতাগুলো, অবিরাম খসে খসে পড়ছে ধরাতলে। কবিগুরুর ভাষায় এ যেন "তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা"!
গতকালকেও গাছটির মাথায় যত পাতা দেখেছিলাম আজ যেন তার সিকি ভাগও নেই। দিনে দিনে মুড়িয়ে যাওয়া গাছটি যেন হাওয়ায় গতিতে হারাচ্ছে তার পত্র গৌরব। এদিকে কংক্রিটের ফুটপাত ভরে উঠছে মরিচা বর্ণ ঝরা পাতায়। সত্যিই বিচিত্র।
---------------------------------------------------------------------------------
সিরিঞ্জের আবার রঙ কি!
পৃথিবীতে ওই একটাই জিনিস যে কোনো রঙ মানে না। চামড়া সে কালো, সাদা, বাদামী, লাল যাই হোক না কেন সবাইকেই (ইনজেকশন) সিরিঞ্জের সামনে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে এবং সত্যি বলতে কি প্রায় দম বন্ধ করা অবস্থায়, চুপটি করে বসে থাকতে হয় বাবু হয়ে। কখন যে সে অপূর্ব দংশনাঘাত গায়ে এসে লাগে সেই অপেক্ষায়। ভেতরে যতই শিবের নাচন হোক না কেন বাইরে যেন লক্ষ্মীর সাইনবোর্ড খসে না পড়ে।
সে যাই হোক, সিরিঞ্জে সাধারণত কোনো তরল ঔষধি পুরে শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় ফুটিয়ে দেওয়াকে, ইনজেকশন
দেওয়া বলে। অবশ্যই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ মেনে। মুর্শিদাবাদে আবার গ্রাম্য ভাষায় একে ছুঁই দেওয়া বলা হয়ে থাকে।
'গ্রেট' আমেরিকানরা আবার ইনজেকশন নেওয়ার পর শট নিয়েছি বলে নিজেদেরকে ওভার স্মার্ট প্রমাণ করতে চায়। আরে বাবা সেই ইনজেকশন নেওয়াই তো হোল নাকি।
যাক গে এত ভাট বকার আসল কারণটা এবার একটু খুলে বলি।
প্রচ্ছদের ছবিতে যে লাল, হলুদ, সবুজ রঙের সিরিঞ্জ গুলো দেখছেন, প্রথম কথা তা দেখে ভয় পাবেন না। কারণ এর মধ্যে ঔষধ নেই আছে নানা স্বাদের জেলি, কোনটা কাঁচা আমের স্বাদ তো কোনটা পাকা আনারসের। মোট কথা এক শটে দ্রুত টিফিন সাঁটার পাকা ব্যবস্থা। বাচ্চাদের ইনজেকশন ভীতি কাটানোর এর চেয়ে আর ভালো কিছু হয় না।
আসলে জেলি বিক্রি করার এমন উদ্ভাবনী প্যাকেজিং আগে কখনো দেখিনি, তাই শেয়ার করে নিলাম।
----------------------------------------------------------------------------------
চলে গেলেন খালি গলায় মায়া ছড়ানো সে চিরদীপ্ত গানের নায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়। তাঁর কন্ঠে "আমি বাংলায় গান গাই" প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিল মাতৃভাষা দিবসের সিগনেচার টিউন। আর সেই মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে, তাঁর এইভাবে চলে যাওয়াটা রেখে গেল এক নাটকীয় মহা প্রস্থানের ইতিকথা।
গতকাল, ১৫ ই ফেব্রুয়ারী শনিবার সকাল ১১টায় এস এস কে এম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। সকালের আনন্দবাজারে পড়লাম মাত্র একমাস আগে জানা গিয়েছিল তাঁর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কথা ।
বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
অমর লিরিক শিল্পীর মৃত্যুশয্যায়, তাঁর পাশে ছিলেন স্ত্রী সর্বাণী দেবী।
ছবি - সৌজন্য আনন্দবাজার পত্রিকা!
বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে এই অমর আত্মার চির শান্তি কামনা করি।
-------------------------------------------------------------------------------
পৃথিবীতে যে কটি জায়গা রয়েছে যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই ছবি হয়ে উঠতে পারে, কোলকাতার ধর্মতলা অবশ্যই তাদের মধ্যে একটি। অনেকটা আলিবাবা চল্লিশ চোর গল্পের সেই খাজানা ভর্তি গুহার মতন, কোনটা ছেড়ে কোনটা নেব অবস্থা হয় এখানে এলে।
সিগন্যালের লাল সবুজ, এখানে যে ধরনের নাটকীয়তা আনে যানবাহনের গতি মুখরতায় তা এককথায় স্বর্গীয় অথবা নারকীয় ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। মানুষজনের তুমুল ব্যস্ততা দেখে মনে হয় কুম্ভমেলার মাহেন্দ্রক্ষণ বুঝি এই বেরিয়ে গেল হাত থেকে। সবাই ছুটে চলেছে নিশ্চিত অথবা
অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে। তার মধ্যেও দু একটা পাগল রয়েছে যারা কে সি দাশের মিষ্টি দোকানের সামনে দাঁড়িয়েও, অবলীলায় সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে টিপু সুলতান মসজিদের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে পারে। কতজন যে মেট্রো হলের সামনে, সান্ধ্য ভ্রমণের ঢঙে ফুটপাতের এ দোকান থেকে ও দোকানে ঘুরে বেড়ায়; তার মধ্যে কতজন কেনাকাটা করে আর কতজন শুধু দাম দস্তুর করতে করতেই সময় কাটিয়ে দেয় তার কোনো ইয়াত্তা নেই। ধর্মতলার প্রকৃত অর্থেই কসমোপলিটন সংস্কৃতি। এখানে যে কোনো ধর্মের যে কোনো বর্ণের এবং যে কোনো ভাষা ভাষী মানুষই চলাফেরা করেন অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে। । ধর্মতলা ধর্মেও আছে আবার জিযাফেও। মাঝে মাঝে বিপ্লবের আগুনেও হাওয়া দেয় এই ধর্মতলা। বহু আন্দোলন এবং মতবাদ তৈরীর আঁতুড়ঘর এই ধর্মতলা। কোলকাতার অন্যতমা ল্যান্ডমার্ক গ্র্যান্ড হোটেল থেকে শহিদ মিনার; ফুটপাতের তিরিশ টাকার আলুচোখা ডাল ভাতের হোটেল থেকে ডেকারস লেনে টুঁ মারা ধর্মতলা দিয়েই হয়। রাজস্থানী শরবতের রাজকীয় গ্লাসে অনায়াসে দুটি স্ট্র চুবিয়ে, প্রেমিক প্রেমিকা দুজনকে দেখা যায় এখানে ফলের রসের আস্বাদন নিতে। ধর্মতলায় তাই আর পাঁচটা ঋতুর মতন বসন্ত ও আসে তার পসরা সাজিয়ে।
ট্রাম রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শিমূল গাছটি তাই প্রতি বসন্তে হয়ে ওঠে লালে লাল।
এবারে ও তার ব্যত্যয় হয় নি। চোখে পড়তেই তুলতে গেলাম, মানে ছবি তুলতে গেলাম। । আমার উৎসাহ দেখে ডিউটিরত এক পুলিশ কর্মী জিজ্ঞাসা করলেন আমার বাড়ি কোথায়! পুলিশের কাছে আর ডাক্তারের কাছে নাকি নিজের নাম আর বাসস্থান লুকোতে নেই। তাই বলেই দিলাম। "আজ্ঞে নরেন্দ্রপুর"!
"সে কি নরেন্দ্রপুরে শিমুল গাছ নেই"?
যারপরনাই অবাক সেই পুলিশের প্রশ্নে আমার উত্তর যেন তৈরিই ছিল।
সবিনয়ে বললাম, "আজ্ঞে, আছে, ফুটেছেও বেশ; তবে ধর্মতলার শিমুলতলা কি পাওয়া যাবে সেখানে"?
শুনে পুলিশ মহোদয় তো বেজায় খুশি, এক মুখ হাঁসি নিয়ে বললেন, "তুলুন তুলুন, ভালোই বলেছেন"!
-----------------------------------------------------------------------------------
মোক্তার থেকে মক্কেল,
সক্কলে চড়ে সাইকেল!
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, শান্তিনিকেতনে খোয়াইয়ের পথ ধরে, সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই দৃশ্য আপামর বাঙালীর কাছে বিশেষ অপরিচিত নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাবে, ব্যাপারটা সবার সামনে আসে দু বছর আগে। ২০২৩ এর ১০ ই মে তারিখে সুইডিশ নোবেল কমিটি তাদের এক্স হ্যান্ডেলে একটি ছবি পোস্ট করে। ছবিটি ছিল সাইকেলারূঢ় অমর্ত্য সেনের। উল্লেখ্য ১০ই মে তারিখটি হলো রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ৯ ই মে'র ঠিক পরের দিন। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া দরকার
অমর্ত্য ব্যবহৃত সাইকেলটি কিন্তু বর্তমানে স্টকহোমের নোবেল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।
যাই হোক সাইকেল, অর্থনীতিতে কি পরিবর্তন এনেছে তা অমর্ত্য সেনের বিবেচ্য বিষয়, কিন্তু পায়ে ঠেলা এই দ্বিচক্রযান যে মানুষের ঘোরাফেরায় প্রভূত স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে সে ব্যাপারে মোক্তার থেকে মক্কেল সক্কলেই একমত।
অগত্যা বলতেই হয় রণে, বনে, জঙ্গলে সাইকেলই একমাত্র সহায়। বিশেষ করে, ভবঘুরেদের কাছে তো এটি প্রায় মোক্ষলাভের উপায়।
ধন্যবাদ।
------------------------------------------------------------------------------------
ফুটবল

, ব্যাট বল, বেসবল, বাস্কেটবল

কিন্তু ধাপাসবল?
বলাই বাহুল্য, সবজান্তা গুগলের নলেজেও নেই ধাপাসবলের কথা। আসলে সব বলই যদি ওই ইউরোপীয়দের কুক্ষিগত হয় আমাদের তো তাহলে বল কুড়োতে কুড়োতেই জীবন কাবার হয়ে যাবে। সেটা ভেবেছে ডায়মন্ড হারবারএর পদুমা শান্তি সংঘ। তাই তারা এ দেশীয়দের পায়ে তুলে দিয়েছে ধাপাসবল। প্লাস্টিকের তৈরি, ফুটবলের তুলনায় হালকা ও আকারে ছোট, ধাপাসবল। ধাপাস ধাপাস করে যত খুশী লাথি মারো কোনো বিকার নেই। কিন্তু এখানেই যদি পুরো ব্যাপারটার ইতি ঘটে যেতো তাহলে
তো মিটেই যেতো। মানে ওই স্থানীয়দের আদিখ্যেতা হিসেবেই থেকে যেতে পারতো ধাপাসবলের পরিচিতি। উঁহু, পদুমা শান্তি সংঘ রীতিমতো ধাপাসবলের নক আউট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেই এর সার্বজনীন স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল সম্প্রতি। এখানেই শেষ নয় আনসার গাজী নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা, ধাপাসবলের জোরদার প্রচারের উদ্দেশ্যে রীতিমতো টুর্নামেন্টের কথা লেখা টি শার্ট বিতরণ করেছেন জনে জনে।
জনৈক সাবির সর্দার, যিনি একজন খ্যাতিমান ধাপাসবল প্লেয়ার, সম্প্রতি লোকাল ট্রেনে তার পিঠে লেখা ধাপাসবলের কথা পড়ে উৎসাহী হয়ে খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি তাই শেয়ার করে নিলাম এখানে।
ধন্যবাদ।
-------------------------------------------------------------------------------------------
২১শে ফেব্রুয়ারী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ। বাংলাভাষী মানুষ হিসেবে বিশেষ গর্বের দিন। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ তাদের মাতৃভাষা বাঁচানোর শপথ নেবে; ভাবলে শিউরে উঠতে হয় এই মাতৃভাষা দিবস পালনের ভাবনা যা একান্তই আমাদের প্রাণের ভাষা, মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল । তাই আজ সেই মহান ভাষা শহিদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা সুমন অর্পণের দিন।
কিন্তু কেন এত গেল গেল রব চারিদিকে! মাতৃভাষা রক্ষায় কেন এত কথা, এত শোরগোল! তাহলে কি সত্যিই আজ বিপন্ন মাতৃভাষা, বাংলা?
এই নিয়েই আজকের এই গভীর অনুসন্ধানে মূলক লেখা - মাতৃভাষার জেনারেশন নেক্সট!
-----------------------------------------------------------------------------------------
মেট্রো রেলের কাজ চলছে তাই বর্তমানে কার্জন পার্ক (চৌরঙ্গী, ধর্মতলা) ভাষা উদ্যানের অবস্থা প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার পথে। চারিদিকে সীমাহীন অযত্ন আর আগাছার ভিড়ে একেবারেই পরিত্যক্ত দশা। সকালে ভাষা শহিদ বেদী তে নম নম করে সারা হয়েছে শহীদ তর্পণের কাজ। শুধু কিছু ফুল আরা গোটা কয়েক মালাই পড়ে আছে দেখলাম। ঘাস আর জঙলা গাছ আগেও হতো তবে তা প্রতি বছর ভাষা দিবসের আগে সাফ সুতরো করার ও রেওয়াজ ছিল। বর্তমানে তাও আর হয় না। কোথাও কোথাও, ভগ্নপ্রায় রেলিং এর গায়ে
মুক্ত প্রস্রাব খানা গড়ে উঠেছে। নেই কোনো বোর্ড বা ফলক ও। তবু ভালো এত অবহেলা অযত্নের মাঝেও ফুটে থাকতে দেখলাম এই শুভ্র সুন্দর ফুলটিকে। সেই ছবিই এখানে শেয়ার করে নিলাম।
তবে এত অস্তিত্ব সংকটে মধ্যেও, ভাষা উদ্যানের অন্য আর একটি চার্ম কিন্তু এখনোও স্বমহিমায় তার চমক ছড়িয়ে যাচ্ছে। ছবি সমেত, যেটার কথা বলবো পরের পোস্টে।
----------------------------------------------------------------------------------------
আরশিনগর!
কোনটা গোল, কোনটা ডিম্বাকৃতি, কোনটা আবার ঈষৎ আয়তাকার - প্রচুর আয়না এরকম পাশাপাশি সেঁটে পুনরায় তাকে একটা বড়, গোলাকার আয়নার রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
লাভ কি হচ্ছে, ক্লোজ সার্কিট টিভি দেখেছেন আপনারা, এক স্ক্রিনে অনেক জায়গার ছবি দেখা যায় তাতে। এক্ষেত্রে এই অভূতপূর্ব আয়নার সজ্জা আপনাকে ক্লোজ সার্কিট টিভির সার্ভিস দেবে।
কোন্ আয়নায় হয়তো কেবলের কালো তারে বসা কাকের করুন দৃষ্টি দেখতে পাচ্ছেন তো কোনোটায় হাবুদের ঘরের বারান্দায়, আরসার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট
মেয়েটাকে। কোনটায় হয়তো দেখতে পেলেন রোদে কাপড় মেলতে এসেছেন রাশভারী স্বভাবের মন্টু দা। ভালো করে দেখলে উনার বেজার মুখচ্ছবিটাও বেশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। কোনটায় হয়তো হাওয়ায় দুলে ওঠা ছাতিম কে দেখতে পেলেন। সবটাই চলমান। সামনে অপরিসর রাস্তা ও তার সামনের বাড়ি ঘর গেরস্থালি সব কিছুই দেখতে পাবেন যখন যেমন তখন তেমন; তার জন্য এদিক ওদিক ছুটে যেতে হবে না, এক জায়গায় বসে, এক কাঁচের পর্দায় সবটাই দেখতে পাবেন বিনা খরচে। অন অফ করার কোনো বালাই নেই। স্বাভাবিক আলো থাকলেই হলো।।
এমনকি আয়নার ক্লোজ সার্কিট পর্দায় যে চিত্র গ্রাহক ছবিটি তুলছে তাকেও পরিস্কার করে তুলে ধরে, বেশ অবলীলায়।
যাই হোক আর কথা না বাড়িয়ে বলে নিই পৃথিবীর এই নবতম আশ্চর্যটি ঠিক কোথায় দেখলাম।
বালিগঞ্জ, নরেশ মিত্র লেনের একটি ক্লাব ঘরের দেওয়ালে রয়েছে এটি। অবশ্যই তারিফ করতে হয় এই চমকপ্রদ আয়না সজ্জাটির।
--------------------------------------------------------------------------------------
সব্জী বিক্রেতা ইনি, নাম সাবির আলি। সাবির এমনিতে বেশী পড়াশোনা করেননি। কিন্তু বর্তমান ব্যবসার হালহকিকত তাঁর বিলক্ষণ জানা। এখনকার দিনে অফার ছাড়া যে ব্যবসা টেকে না তা তিনি ভালোই জানেন। আর সেই জন্যেই, তাঁর কাছ থেকে সব্জী কিনলে একদম মুখে রেডি ছড়া শুনিয়ে দেন তিনি, একেবারে নিখরচায়। চটুল, ছন্দ মাত্রা মিলিয়ে মুখে গরম ছড়া শোনার জন্য রসিক শ্রোতা কাম খরিদ্দারের ও অভাব হয় না তাঁর দোকানে। সবথেকে মজার ব্যাপার হলো তাঁর সব ছড়াই তাঁর দোকানে বিক্রি হওয়া সব্জী কে নিয়ে।
কখনো বলছেন,
"সারাতে গেল মনে ব্যাথা/ খেতে হবে সজনে পাতা"
একেবারে স্বভাব কবি সুলভ, এই সাবির। খই ভাজার মতো সর্বক্ষণ তাঁর মুখে ফুটছে ছড়া। তার মধ্যে, যেটা সবথেকে আমার সেরা লাগলো সেটা হলো, "ভালোবাসা ডট কম/বেগুন ভর্তা আলু দম"। যাকে বলে, ছন্দে, ব্যঞ্জনায় একেবারে চমৎকৃত করার মতন উপস্থাপন।
সত্যিই এ ধরিত্রীর পথে ঘাটে, হাটে বাজারে না জানি কত কবিতার প্রবাহ যে দিনরাত ফেরি হয়ে চলে মুগ্ধতার ঘাটে ঘাটে তার খোঁজ ক'জনে রাখে!
---------------------------------------------------------------------------------
দ্বিতীয় বার ভুমিষ্ঠ হলেন নাসা'র ভারতীয় বংশোদ্ভুত মহাকাশচারী সুনিতা উইলিয়াম।
প্রথমবার হয়েছিলেন ন মাস নয়দিনের মাতৃ গর্ভ বাস কাটিয়ে। দিনটি ছিল ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ সাল। ঊণষাট বছর বয়সী সুনিতা দেবী এবার দ্বিতীয় বারের জন্য ভুমিষ্ঠ হলেন; তবে এবার ভুমিষ্ঠ হলেন ন মাস ১২ দিনের সুদীর্ঘ (আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন - আই এস এস) স্পেসবাস কাটানোর পর। যাত্রা শুরু হয়েছিল গত বছর, ২০২৪ এর ৬ই জুন। এই নয় মাস সুনিতা ও তাঁর আর এক সহযাত্রী ব্রুচ উইলমোর কাটিয়েছেন পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থিত
প্রথম বসবাসযোগ্য মহাকাশ স্টেশন আই এস এসে। ভারতীয় সময় অনুসারে, আজ অর্থাৎ ১৯শে মার্চ বুধবার ভোররাত ৩টে ২৭মিনিটে ফ্লোরিডার উপকূলে স্পেস যান ড্রাগন থেকে অবতীর্ণ হন সুনিতা সহ আরোও তিন মহাকাশচারী। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই এই নমস্য মহাকাশচারীদের।
---------------------------------------------------------------------
দেবরাজ গান করে; স্বপ্ন দেখে, ভবিষ্যতে অনেক বড় হওয়ার। আর সেই স্বপ্ন সফল করতে, নির্দ্বিধায় সে গিটার হাতে বসে পড়ে কোলকাতার অন্যতম ব্যস্ত রাস্তায় - জহরলাল নেহরু রোড , The 42 - বহুতল আবাসের সামনের ফুটপাতে, দেবরাজের গান শুনে কার্যত থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন পথচলতি মানুষজন। তার সুমধুর কন্ঠের জাদুতে এক অপূর্ব মায়া ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে, ম্লান হয়ে যায় শহুরে ব্যস্ততার ভ্রান্ত অভিমান।
সামনেই দেখলাম হাতে লেখা একটা সাদা কাগজে লাল কালি দিয়ে লেখা রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা - চাইলে
অর্থ সাহায্য দিয়ে দেবরাজের স্বপ্নকে সম্ভব করে তুলতে পারেন, তাতে রয়েছে অর্থ প্রদানের UPI Code নাম্বার।
গান শুনতে শুনতে, দেবরাজের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করলাম আরোও কিছু জরুরী কথা।
চলুন দেখি পুরো ভিডিওটি, সহযাত্রী হই স্বপ্নপূরণ যাত্রার!
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------
খরমুজ পৃথিবী!
গোলাকার হলেই কি তা পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করা যায়! ঠিক আছে, বোঝার জন্যে মানলাম বোঁটার দিকটা অর্থাৎ বৃন্ত চ্যুতির স্থানটি যদি খরমুজের উত্তর মেরু বা সুমেরু হয় তবে এর ঠিক উল্টো দিকে আছে দক্ষিণ মেরু বা কুমেরু। বেশ, তর্কের খাতিরে না হয় এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু সুমেরু কুমেরু যদি থাকে, দ্রাঘিমা রেখা গুলি তবে কোথায়?
হুঁ হুঁ, সেটা দেখানোর জন্যই তো খরমুজের ছবি নিয়ে আসা। একেবারে সাদা চোখে, পরিষ্কার করে দেখিয়ে দেবো দ্রাঘিমা রেখা গুলোকে। কিন্তু সেটা কিরকম!
যতদূর জানি
পৃথিবীতে দ্রাঘিমা রেখার অস্তিত্ব তো বিমূর্ত। বিশাল এই ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন স্থানের অবস্থানগত তারতম্য বোঝানো যখন বেশ দুষ্কর হয়ে পড়েছিল তখনই দিকচিহ স্বরুপ পৃথিবীর উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুকে জুড়ে মনে মনে এই বিমূর্ত রেখা গুলোকে কল্পনা করতে হয়েছিল, যাকে দ্রাঘিমা রেখা বলা হয়ে থাকে। ।
খরমুজের ক্ষেত্রে অবশ্য খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে উপর থেকে নীচ বরাবর টানা সবুজ রেখা গুলোকে। খরমুজের সাদাটে খসখসে গায়ে অনেকগুলো হলদেটে ছোপ দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু সেগুলোর প্রকৃত অবস্থান বোঝাতে গেলে যেমন আপনাকে বিভিন্ন সবুজ রেখার অবস্থানের বিচারে কত ডিগ্রি পূর্বে অথবা পশ্চিমে বলতে হয় পৃথিবীর ক্ষেত্রেও কোলকাতা আর লন্ডনের অবস্থান ঠিক করতে গেলে দ্রাঘিমাংশ ধরে নির্ণয় করতে হয়। এখানেই শেষ নয়, খরমুজের এই সবুজ রেখা গুলি নাকি যত গাঢ় রঙের হবে তত নাকি মিষ্টি আর সুস্বাদু হবে খরমুজ। বুঝুন তাহলে, এই গরম পড়তে শুরু করেছে। খরমুজ খেয়ে খানিক উষ্ণতা প্রশমনের ইচ্ছে হলে আগে ভালো করে দেখে নিতে হবে খরমুজের সবুজ দ্রাঘিমা রেখার রং কতটা প্রগাঢ় নাকি ফিকে।
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------
টমেটো যেন কাঁচা পাকা, ঝাড়বাতির ঝুল্;
পথের ধারে অনাদরে, বসন্তের বুনোকুল!
এমনিই ঝোপ ঝাড় হয়ে পথের ধারে এদের বিস্তার। ভারী সুন্দর ছোট ছোট, নাকফুলের মতো সাদা ফুলও ফোটে বেশ চমৎকার। ভালো করে দেখতেই দেখি কি সুন্দর টমেটোর মতো লাল সবুজ ফল, ছড়াচ্ছে কি মরমী জ্যোতি; যেন গাছের সরু ডাটি থেকে ঝুলছে রাজার ঘরের ঝাড়বাতি।
ভালো যখন লাগলো, তুললাম একটি ছবি। দেখি ছোট্ট একটা বাচ্চা এসে, দাঁড়িয়েছে ঠিক আমার পাশে। বললো আজ রবিবার এই ফলগুলো তো খুব খেতে ভালো, সুন্দর টক মিষ্টি। শুধোলাম, তাহলে কি করবি
তুই? বললো শুনি গাল ফুলিয়ে- এই বেলাতেই তুলবো আমি সবই।
ধন্যবাদ।
----------------------------------------------------------------------------
এই তো কেমন চিকন সবুজ আম ধরেছে ডালে; স্কুল ফেরত শিশুরা এবার, জমবে গাছের তলে। ইঁটের ঘায়ে ঝড়িয়ে ফেলা - নয়কো সহজ কাজ! এলেম লাগে ভাই, লাগে নিখুঁত লক্ষ - নিখুঁত আন্দাজ। তবে মনে মনে এরা কেউ দ্রোণ কর্ণ, কেউ অর্জুন কেউ আরোও বড় তীরন্দাজ। ঝুড়ঝুড় করে মাঝে মধ্যেই উঠবে পাতার আওয়াজ। ঢুপ ঢুপ হয়তো গোটাকয়েক খসে পড়বে আম রাজ। কুড়িয়ে নিতে, সে কি ছুট - যেন ড্রাইভ মারছে বাজ। সটান চালান, মুখের মধ্যে- কুড়ুর কুড়ুর আওয়াজ! চৈত্রের পড়তি দুপুর, রোদ্দুরে জ্বলছে পুকুর। কাঁচা আমের সে কি
আহ্লাদ, হৈ হৈ আর ব্যাকুল হৃদয়, নেই কোনো বিস্বাদ। ব্যাগ গুলো সব গুছিয়ে রাখে, একা শতবালা, যেই না 'কে রে..' বলবে উঠে রাঘব কাকিমা, অমনি চেঁচিয়ে বলবে সে যে পালা সবাই পালা।
ধন্যবাদ।
লুকিয়ে আম পাড়ার সেই অমলিন স্মৃতি সকলেরই কমবেশি আছে। তারই টুকরো ছবি মনে পড়ে গেল গাছে টুকি টুকি আম ধরে থাকা দেখে।
------------------------------------------------------------------------------
আগামী কাল হোলি, কিন্তু স্লোগান চাই তো!
বাজারে বেরিয়ে রঙ আবিরের দোকানে পিচকারি, টুপির পাশে ঝুলে থাকা কতকগুলো সাদা টি শার্টের ওপর নজর পড়তেই যাকে বলে সেই আর্কিমিডিসের মতনই অনুভূতি হলো মনের মধ্যে। ওহ্ ইউরেকা। মানে, স্লোগান পেয়ে গেছি। টি শার্টের বুকে একেবারে জ্বলজ্বল করছে রঙদার সেই কথা কয়টি।
"খেলবো হোলি রাম খাবোনা তাই কখনো হয়"!
নিমেষে, ৮৭ তে রিলিজ করা সুপার হিট বাংলা ছবি 'একান্ত আপন' এর সেই বিখ্যাত গানের কথা মনে পড়ে গেল। "খেলবো হোলি রং দেবো না তাই কখনো হয়"। গীতিকার-সুরকার স্বপন চক্রবর্ত্তী লিখেছিলেন এই গানটি। হোলি আসলেই পাড়ার ক্লাব থেকে নাচের স্কুল সব জায়গাতেই প্রায় অবধারিত ভাবে বাজে এই গানটি। সবারই প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে, বিশেষ করে মুখড়ার কথাগুলি।
খালি 'রঙ দেবোনা'র জায়গায় 'রাম খাবোনা ' করা হয়েছে আর তাতেই যাকে বলে একেবারে হিপহিপহুরে বাজতে শুরু করেছে রসিক মানুষের হৃদয়পুরে। সত্যিই তো। এতবড় জাস্টিফিকেশন পাওয়ার পরে আনন্দে যে মন রাম রাম করবে তা অনেক নাস্তিকেও মানতে বাধ্য হবেন।
কি বলেন!
হোলির পক্ষে এরকম আদর্শ স্লোগান, যাকে বলে পুরো পিওর আদর্শ হিন্দু হোটেল। তুলে মাঠের বাইরে ছক্কা। তবে এই উদ্ভাবনী স্লোগানের স্রষ্টা কে, সেটা কিন্তু অজানাই থেকে গেল। কি আর করা যাবে।
ধন্যবাদ।
-------------------------------------------------------------------------------
কর্কট (কাঁকড়া পড়ুন) তুমি যতই কর ক্রান্তি, বেরিয়ে যেতে পারবে না।
এমনিতে মা দুর্গার দশটি হাত, দুটো পা। কাঁকড়ার কিন্তু ঠিক উল্টো। দুটি হাত (পড়ুন দাঁড়) আর দশটি পা। কিন্তু দশরথ হয়েই বা লাভ কি, ইচ্ছে করলে তো আর বেরিয়ে যাওয়া যায় না! পুরোহিতের দৌড় যেমন মন্দির পর্যন্ত, কাঁকড়ার ঐ জিইয়ে রাখা পাত্রের কিনারার বাইরে কোনোমতেই নয়। কেউ না কেউ পা ধরে ঠিকই টেনে দেবে।
গড়িয়া স্টেশনের নীচে কাঁকড়া বিক্রেতা তাই বস্তার মুখ খোলাই রেখে বহাল তবিয়তে কথা বলেন খদ্দেরদের সঙ্গে। কারণ
কাঁকড়া জানুক না জানুক বিক্রেতা ঠিকই জানেন সেই কর্কট ক্রান্তি (সীমা)রেখার কথা।
--------------------------------------------------------------------------------
নিম বসন্ত, তবে একটু ডায়াবেটিক!
তবে সে ডায়াবেটিক হোক কি নন ডায়াবেটিক, যদি পাওয়া যায় নরম বেগুন আর সজনে ডাঁটার সহায়তা আর সাথে থাকে ফুল বড়ির ভঙ্গুর চপলতা তাহলে দিনরাত পলাশ শিমুল করে করে গা মদকে যাওয়া বসন্তের আস্বাদনে একটু তিক্ত মধুর সংযোজন হয় আর কি। সর্বোপরি এর সাথে মায়ের হাতের সুমধুর রন্ধন কুশলতা যদি যুক্ত হয়ে তবে তো সোনায় সোহাগা; নিম-রুচি ও স্মৃতির সুরুচি হয়ে থেকে যায় আজীবন।
-------------------------------------------------------------------------------------
এখনোও টিকে থাকা বিগত সাম্রাজ্যের সৌধ মস্তকে, গোধূলির রঙে ডুবন্ত দিনের শেষ গৌরব গাঁথা লেখে সময়।
খানিক বাদে সন্ধ্যা নামলেই সব ইতিহাস! দিনের শৌর্য - প্রাক্তন প্রেমিকের মতো গা ঢাকা দেবে রাত্রির কানা গলিতে!
গোধূলি তখন নিতান্তই লুকিয়ে রাখা প্রেম পত্র হয়ে ঠাঁই নেবে বাতাস বন্দী বাক্সে; ছায়ায় ঢেকে, মুখ লুকোবে কৃষ্ণ আলিঙ্গনের সম্মুখে!
------------------------------------------------------------------------------------
মুসম্বি ম্যাজিক:
স্থাপন করার শৈলীই হলো স্থাপত্য শৈলী। মানুষ যবে থেকে বাসস্থান নির্মাণ করা শুরু করেছে তবে থেকেই কোনো না কোনো স্থাপত্য শৈলীর প্রয়োগ করে আসছে। বছরের পর বছর ধরে প্রস্তর খন্ড জমতে জমতে গড়ে ওঠা পাহাড়ের চূড়া হল অসাধারণ এক প্রাকৃতিক স্থাপত্য শৈলীর নমুনা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন রাজ প্রাসাদ থেকে ধর্মীয় উপাসনালয়; স্মৃতি সৌধ থেকে দুর্গ এমনকি সমাধি স্থল নির্মাণে বিশেষ বিশেষ স্থাপত্য সৌকর্যের ধারা গড়ে উঠতে দেখা গেছে যুগের পর যুগ ধরে। তাদের
মধ্যে রোমান গথিক, ইতালীয় রেনেসাঁ, ইন্দো সেরেসানিক, ইন্দো ইসলামী ও মুঘল স্থাপত্যের নাম জগৎজোড়া। কে না জানে গম্বুজ কিংবা খিলান মনুষ্য সৃষ্ট উজ্জ্বল স্থাপত্য কীর্তি গুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ তম। আমাদের দেশের আটচালার ঘর থেকে শুরু করে সুমেরীয় এস্কিমোদের গৃহ নির্মাণ - সবেতেই স্থাপত্য প্রকৌশলের সুনিপুণ প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। যেমন প্রচ্ছদের ছবিতে - মুসম্বি লেবু গুলোকে, শোকেসের মধ্যে, একটার মাথায় একটা সাজিয় রাখতে যে চমকপ্রদ কলাকৌশলের প্রয়োগ করা হয়েছে তাকে কি ধরনের স্থাপত্য রীতি বলে অভিহিত করা যায়। একনজরে অনেকটা মোজাইক এর মতো দেখতে লাগছে। পৃথিবীতে মোজাইক আর্ট অনেক পুরোনো। মেসোপটেমিয়া, বাইজেন্টাইন হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী সৌধ গুলির গায়ে এই মোজাইক আর্টের উৎকর্ষ দেখা গেছে। তবে মোজাইক সাধারণত বর্গক্ষেত্রেআকার এবং সমতল কাঁচ বা পাথরের টুকরোকে একটার পিঠে একটা বসিয়ে তৈরি করা হয়। কিন্তু মুসম্বি তো গোলাকার এবং বক্র তল বিশিষ্ট। তবে পৃথিবীতে গোল পাথর দিয়েও মোজাইক করার রীতি রয়েছে। যাকে নুড়ি মোজাইক বলা হয়ে থাকে। তাই সবদিক ভেবে একে মুসম্বি মোজাইক নামে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
যাই হোক এই অনবদ্য মুসম্বি মোজাইক দেখার জন্য দিল্লি বাগদাদ বা অন্য বেশিদূর যেতে হবে না। কোলকাতার ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলের সামনে শিমুল তলার ফলের জুসের দোকানে গেলেই হবে। অবশ্যই এর নির্মাতা রসের দোকানের মালিক স্বয়ং রসুল খান।
ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------------------------------------
সকাল দশটার শিয়ালদহ স্টেশন; কাতারে কাতারে মানুষ প্রতিনিয়ত ঢুকছে, বেরিয়ে যাচ্ছে।
একটা হজঘট ভিড়ের ছবি কখনোই মুছে যায় না দৃষ্টি পথ থেকে। স্রোতস্বিনী নদীর মতন নিত্য বহমান থাকে সে অসংখ্য মানুষের অবিরত পদক্ষেপ ধারা।
নিরন্তর চলমান এই ভিড়ের মাঝে খ্যাত অখ্যাত গেঁয়ো শহুরে ধনী দরীদ্র কৌশলী বোকা কারোরই কোনো আলাদা আইডেন্টিটি থাকে না।
তবু, এর মাঝেই কিছু ছবি যে কি অভূতপূর্ব তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয় তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বিশেষ করে কোনো বিশেষ দিনের প্রেক্ষাপটে সেই ছবি এতটাই
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে সহজে ভিড় তাকে গ্রাস করে নিতে পারে না।
যেমন প্রচ্ছদের এই ছবিটি।
এক অন্ধ গায়ক, তাঁর কাঁধে ঝুলছে স্পিকার লাগানো ভারী একটা কাঠের বাক্স। সকাল ৮টা ২০'র ক্যানিং লোকালে উঠেছিলেন গান করতে তালদী থেকে। শিয়ালদহ এ নেমেছেন, সঙ্গে স্ত্রী, তিনি আবার বা হাত দিয়ে ক্যাসিওটাকে এমন বুকের কাছে ধরে রেখেছেন যেন সরস্বতীর হাতে ধরা বই। ডান হাতে ধরা ছোট্ট মেয়ের হাত। কিন্তু তাতেই কি আর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়! হাত দুটো বন্ধ তো কি হয়েছে, কাঁধ তো রয়েছে। দৃষ্টিহীন স্বামীর যে ঐ কাঁধ ই ভরসা। ভিড়ের মধ্যে ঐ ভরসার কাঁধটাই যে তার শেষ সম্বল, এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র অবলম্বন।
সত্যিই তো, শুধুই কি তাঁর অন্ধ স্বামী , আন্তজার্তিক নারী দিবসের ঘনঘটায় এই নারীকেই যে পুরো সমাজের যোগ্য দিশারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখলাম আমি।। তাঁর না ঝুঁকে পড়া কাঁধ, দীপ্ত ভঙ্গিমা অসম্ভব এক আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছিল যেন। শুধুই প্রেরণা কিংবা করুনার পাত্র নয়; এই নারীই যেন সেই মুহূর্তের পুরো সমাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যথার্থ মশাল বাহক হয়ে উঠলো আমার চোখে।
তাই ছবি সহ কিছু কথা শেয়ার করে নিলাম।
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------------------
দেখুক লোকে ফেসবুকে,
কাঁঠাল ঝোলে গাছ থেকে!
আচ্ছা কাঁঠাল তো গাছ থেকেই ঝুলবে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?
হয়তো'কাঁঠাল গাছে জল দিতে দিতে কোমর ভেঙে গেল' বলে কেউ কেউ কাঁদুনে গান গাইবে। সেটাও তো স্বাভাবিক।
"কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়" লিখে রূপসী মায়াজাল বুনবেন কবি।
হয়তো কেউ প্রেমকে কাঁঠালের আঠার সঙ্গে তুলনা করে কাঁঠালের থেকে কাঁঠালের আঠাকেই বেশী গুরুত্ব দিয়ে ফেলবেন। কারণ তা নাকি 'লাগলে পরে ছাড়ে না'!
হয়তো যৌবনেই গাছ পাঁঠা বলে কেউ কেউ জবাই করবেন, গাছ থেকে পেড়ে। তবু সেই হলুদ কাঁঠাল খেতে অপেক্ষা করতে হবে জ্যেষ্ঠ পেরিয়ে আষাঢ় মাস আসা অব্দি।
রথের মেলায়, ভনভনে মাছির গুঞ্জন তুলে ছোট ছোট শাল পাতার ঠোঙায় যখন পরিবেশিত হবে, হলুদ চাঁপা ফুলের মতো রঙের পাকা কাঁঠালের খাস্তা খাজা কোয়া গুলো।
সেটাই না হয় হোক তবে।
কাঁঠাল এচোড়ে না পেকে গাছ পাকাই হোক না হয়।
---------------------------------------------------------------------------------------
হঠাৎ দেখে বনে,
বাসন্তী এল মনে!
তাই নাম দিলাম বন বাসন্তী। আসলে বসন্ত কাল বলে নয়; কেন যে হঠাৎ আমার ঠাকুমার নাম এতদিন পরে মনে পড়ে গেল। সেই গত শতাব্দীর আটের দশকে উনি চলে গেছেন অমরাবতীর বনে। খুব ছোট ছিলাম তখন; মায়ের কাছে শুনেছি এক সাপুড়েকে নিজের গয়না গাটি যা ছিল সব দিয়ে দিয়েছিলেন আমার জন্যে। বাড়িতে দাদু বা বাবা কেউ সেদিন ছিলেন না। সাপুড়ে বলেছিলেন তিনি একটা পুজো করবেন, তাতে উপকরণ হিসেবে লাগবে সোনার অলংকার। যত বেশী সোনা তত বেশী সোনার মত জ্বলজ্বল করবে ছেলে। ব্যাস্। ঠাকুমা
বাসন্তী দেবী হয়ে গেলেন ফিদা। আসলে খুব রোগা ছিলাম আর নানারকম রোগভোগ লেগেই থাকতো সারা বছর। একটা জল ভর্তি পেতলের ঘটির মধ্যে ঠাকুমার দেওয়া সব গহনা চুবিয়ে রেখেছিলেন ওই সাপুড়ে, ঘটির মুখে ছিল আমের পাঁচ পাতা। পুজোর শেষে বলে গেলেন তিনি ফিরে ঘটি থেকে গহনা বার করবেন। কেউ যেন উৎসাহ দেখিয়ে ঘটির মধ্যে হাত না ঢোকায় কারণ ওতে বিষাক্ত খরিস সাপের বাচ্চা রাখা আছে। উনি সেই যে বাজারে যাচ্ছি বলে বেরুলেন আর ফেরেননি। অনেক রাত্রে সাহস করে ঘটি উল্টাতেই বোঝা গেল সব নিয়ে তিনি চম্পট দিয়েছেন। সম্ভবত মা আর ঠাকুমা কে ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে বলে তিনি সেগুলিকে সেই সুযোগে সরিয়ে ফেলেছিলেন। ওতে মায়ের ও একটা কানের দুল ছিল। কি ভেবে যে মা তার আরোও গয়না দিয়ে দেননি সেদিন, তা কেবল ভগবানই বলতে পারবেন। ঠাকুমা যদিও তাঁর জীবদ্দশায়, ওই সাপুড়েকে কোনোরকম শাপ শাপান্ত তো দূরে থাক কখনো তার উদ্দেশ্যে একটা কটু কথাও বলেননি। খালি বলতেন সোনা নিয়ে গেছে , ভাগ্য তো নিয়ে যায় নি। ওর অভাব ছিল তাই নিয়ে গেছে।
ঠাকুমার উদারতার স্মৃতি এখনোও কাতর করে বৈকি!
----------------------------------------------------------------------------------------
উত্তম স্মৃতি পুরস্কার ছাড়াও আরোও অনেক সম্মানীয় পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। অভিনেত্রী হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন যদিও থিয়েটার দিয়ে। তারপরে সিনেমা এবং টেলিভিশনেও সুনাম কুড়িয়েছেন প্রচুর। বর্তমানে অভিনয়ের জগতে তিনি অত্যন্ত পরিচিত মুখ। সম্প্রতি তাঁর মুকুটে যুক্ত হয়েছে লেখিকা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের সম্মান। গতবছর বইমেলায় তাঁর লেখা বই অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে গুনমুগ্ধ পাঠকমহলে। হুড়মুড়িয়ে বিক্রি হয়েছে জীবনের প্রথম লেখা বই। একেবারে ফার্স্ট ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকানোর মতন।
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন আমি স্বনামধন্যা অভিনেত্রী তথা লেখিকা তনিমা সেনের কথাই বলছি।
দুদিন আগে কোলকাতা নেহেরু চিলড্রেন মিউজিয়ামে এসেছিলেন 'কবিতার কক্ষপথ' সাহিত্য পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে। শোনালেন জীবনের না বলা অনেক কথা; বিশেষ করে তাঁর লেখিকা হয়ে ওঠার কাহিনী সত্যিই অনুপ্রাণিত করার মতন।
এছাড়াও পাঠ করলেন নিজের লেখা ছোট গল্প।
আজকের ভিডিওতে রইল এ সবেরই মিলিত সংকলন।
'কবিতার কক্ষপথ' সাহিত্য পত্রিকার তৃতীয় বার্ষিক সংখ্যা প্রকাশের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত। নেহেরু চিলড্রেন মিউজিয়াম আয়োজিত অনুষ্ঠান মঞ্চে লেখক বললেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা। করলেন আত্ম মূল্যায়ন। শুনে নেব সেই কথা।
আনকাট হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত।
------------------------------------------------------------------------
রুদ্র পলাশ ফুল, কয়েকদিন আগে চিংড়িঘাটা ফুট ব্রিজের পাশে এক মধ্যাহ্ন বেলায় বেশ কয়েকটা ঢ্যাঙা গাছে দেখলাম, মাথায় ঝিম কালো পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে এই ফুলগুলি। দেখে, বলাই বাহুল্য মোবাইলের ক্যামেরায় সংগ্রহ করে রেখেছিলাম।
রীতিমত, রোদের তেজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে যেতে পারে এর রুদ্র শিখার লালচে কমলা পাঁপড়ি গুলি। লম্বা গাছগুলির একেবারে চূড়ায় ফুটে থাকা ফুলগুলি দেখলে এক ঝলকে মনে হতে পারে পাহাড়ী টিউলিপ ফুটে আছে গুচ্ছের। এর পাঁপড়ি বিন্যাস অনেকটাই টিউলিপ ফুলের মতন।
অবশ্য
ইংরেজিতে একে আফ্রিকান টিউলিপ ফুলই বলা হয়। আফ্রিকায় জন্মে সুদূর ভারত তথা এই বাংলায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অবশ্য ব্রিটিশ বাবাজীবনদের অবদান রয়েছে। নন্দি শিখা নামে এর আর একটা নামের হদিস পেলাম যদিও তবে বসন্ত বেলার ফুল বলে রুদ্র পলাশই বেশী জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত রুদ্র পলাশ এই নামটি দিয়েছিলেন বাংলাদেশের উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এবং প্রথিতযশা বিজ্ঞান লেখক প্রয়াত দ্বিজেন শর্মা।
--------------------------------------------------------------------------
বাইক বর বিন্দাস!
------------------------
সেই সাত সকালে, বেরিয়ে পড়ে; রণিতা ঘর ছেড়ে। চায়ের দোকান সাথে মুড়ি আর ঘুগনি, বিক্রি করে তিন মাথার মোড়ে।
দেখতে কালো, ডাগরডোগর, বেশ লাগে কামিজ আর সালোয়ারে; বয়স - মেরেকেটে পঁচিশের দোরগোড়ে। সকাল হতেই জমজমাট - চা খাওয়ার ভিড়ে, দিনমজুর থেকে অফিসের বাবু সকলেই প্রাতরাশ সারে।
"কি রে, রাজু তো গেছে সেই কবে! ভালোই আছিস বল্ স্বামীকে একা ছেড়ে"!
রোজ
রাতে রাজু ঘুমের ঘোরে, রিং করে চটুল গানের সুরে! তিনমাস হলো রাজমিস্ত্রির কাজে, রাজু গেছে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরে।
পাড়ার ছেলে নান্টু রোজই আসে; বাইক রেখে চা সিগারেট ধরে দাঁড়ায় গা ঘেঁষে; ঢুকে আসে ছেঁড়া পলিথিনে ঢাকা কালো চালার ভেতরে।
গত রাত্তিরে রাজু বলেছিল ফোন করে, আসছে হোলি সে ফিরবে এবার ঘরে!
বললো বেশ আদর মাখা স্বরে, এসেই তোকে কিনে দেবো জামদানি আর সাজাবো সাতনরী হারে।
কি ভাবছিস বল্, খুশী হয়ে এবার না হয়, দে না একটা চুমু ফোনেই আওয়াজ করে।
"দে দে একটা সিগারেট, রাজুর কথা ভাববি পরে।"
নান্টুর ডাকে রণিতার সম্বিৎ যেন ফেরে।
"ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, কি হবে ন্যাকামি করে"!
"তোর শ্বশুর আর তোর শাশুড়ি, ওই দুটো হাড় বজ্জাত- চিনি আমি হাড়ে হাড়ে। কেমন শেয়ানা, কচি বউটাকে একা ফেলে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে কোন সেই হদ্দ দূরে।
"কি যা তা বলছিস তুই, লজ্জা শরম নেই কি একেবারে"!
"সেই দোকান সেরে, খাওয়াতে তো হবে রেঁধে বেড়ে"!
কথাটা মন্দ বলেনি নান্টু, রণিতার মনে ধরে।
"ছাড় ছাড়, ও সব দাসিগিরি ছেড়ে আজ বিকেলে চল আমার বাইকে চড়ে; বেনুবনে নিয়ে যাবো, হেব্বি মজা করে"!
কথা শেষ হতে না হতেই, দেখে নান্টুর বাপ হারান বাবু আসছে চেকচেক লুঙ্গি পরে।
"এখন পালাই, আসবো একটু পরে। "
নান্টু চলে গেলে রণিতা চেয়ে থাকে দূরে গাছের কাঁডে। শিমুল গাছটায় বেশ ধরেছে লাল ফুল, পাখিরা এসছে বেশ উড়ে।
হঠাৎ ফোনটা উঠতে বেজে, রণিতা দেখে ওরে, এই অসময়ে রাজুটাই বা কেন ফোন করে। হ্যালো বলে যেই না রণিতা ফোনটা কানে ধরে, চিৎকার করে রাজু বলে দারুন একখান স্বপ্ন দেখেছি আজকের কাকভোরে।
কি বলবো কি তোরে, স্পষ্ট দেখছি এবার দোলে - তুই আর আমি, উড়ছি বাইকে চড়ে!
--------------------------------------------------------------------------------------
মা কি ছিলেন,
------------------ আর মা কি হয়েছেন!
তবে কথাতেই তো আছে এক মাঘে শীত যায় না। তাই আসছে বছর ফের মা'র গায়ে চড়বে লাল শাল!
তবে
এই প্রেক্ষিতে মায়ের একটি খুব পপুলার বাণী, যেখানে মা বলেছেন - 'আমি সতের ও মা, অসতের ও মা' কে যদি এইভাবে বলি আমি শীতের ও মা, বসন্তের ও মা, মনে হয় খুব মন্দ হবে না।
ছবি দুটি বেলেঘাটার সরকার মাঠে প্রতিষ্ঠিত সারদা মায়ের মর্মর মূর্তির। এক মাসের ব্যবধানে তোলা দুটি ছবি।
-------------------------------------------------------------------------
ভগবান রাম যে তাঁর বুকের মধ্যেই আছেন সেটা দেখাতে স্বয়ং হনুমানকেও তাঁর বুক চিরে তার প্রমাণ দিতে হয়েছিল।
আর এ তো ফলের বাজারের পাতি তরমুজ ব্যাপারী। সে তুমি যতই চেঁচাও তরমুজের বাইরেটা সবুজ হলেও ভেতরটা আসলে ডগডগে লাল; কিন্তু শুধু মুখে কে শুনবে ভাই সে কথা।
অন্দরের লাল অস্তিত্বের কথা যতক্ষণ না নিজের চোখে দেখছি বিশ্বাস নেই। হুঁ হুঁ আমরাও খদ্দের, কিনে খাই। চালাকি চলবে না। দেখবো তারপরে হবে দরাদরি।
অগত্যা...!
অন্তে, বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: কাটা ফল স্বাস্থ্যের পক্ষে বিষতুল্য হানিকর।
-----------------------------------------------------------------------
পদ্মপুকুর, বটতলার বটেশ্বর বাবা। সারাবছর বটগাছের গোড়াতেই তাঁর বাস। আজ তাঁর পুজো তাই সেজেগুজে সস্ত্রীক, বাহন ষাঁড়ের পিঠে চেপে বসেছেন ভদ্রাসনে। পাশে একমাত্র গণেশকেই রেখেছেন, ছেলেমেয়েদের মধ্যে।
বটতলা, রাঙানো হয়েছে গাঢ় গেরুয়া রঙে। মাথার ওপরে বসেছে গোল দেওয়াল ঘড়ি। ত্রিশূলপাণী শিব এমনিতেই করুনার সাগর, আজকের দিনে আবার তিনি সাক্ষাৎ বরদাপ্রসাদ।
বাবার কাছে তাই একটাই প্রার্থনা - সবার মঙ্গল কর বাবা। সবার মনে সুবুদ্ধি দাও।
-------------------------------------------------------------------------
ভগ্নপ্রায় একটি শিব মন্দিরের ছবি। সরু নদী একখানা, নীল জলের - ঐ যে দেখা যাচ্ছে মন্দিরের পেছনে। বুড়ো শিরিষ গাছের ছায়ায় বেশ লাগছে না! বাদামি মোরাম বেছানো রাস্তা ধরে, ডালা হাতে মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছেন এক কাকিমা। শিব চতুর্দশীর ব্রত রেখেছেন। আজ শিব পুজো না!
আঁকা শেষ করে, ছবিটাকে আমার চোখের সামনে মেলে ধরে, এই কথাগুলোই আজ সকালে আমাকে বললো আমার ছেলে। মানে, ছবির পরিচিতি আর কি!
"ভালো হয়েছে না?"
আমি তো বললাম, খুব ভালো হয়েছে।
ব্যাস, এইটুকুই।
শুভ
শিব চতুর্দশীর আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই সকলকে।
--------------------------------------------------------------------------
ঈশ্বর সব মানুষকেই নাকি সুতোয় নাচান। গাছগুলোকে নোঙর করে রাখেন বছরের পর বছর ধরে, একই জায়গাতে।
মনটার মধ্যে সর্ষে বীজ বুনে স্বপ্ন গুলোকে, ঘুমের ঘোরে পাঠিয়ে দেন আমৃত্যু।
জিওল মাছের মতো শুধু জিইয়ে রাখেন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকে। অনিবার্য তার দংশনাঘাত সয়েও বেঁচে থাকার সুখটুকু ঠিক বেঁচে থাকে জ্বরের পরে জ্যান্ত মাছের ঝোল খাওয়ার মতো।
কেমন মায়াময রাজনীতি; তবু মৃত্যুকে ভুলিয়ে রাখা তো অত সহজ কাজ নয়।
চরম শূন্যতার সেই হাতছানি উপেক্ষা করবে কার সাধ্যি। সাঁকোর এপারে থাকা লোকজন তা ঠিকই
বোঝে। যুগের পর যুগ ধরে সাঁকোর নীচে বয়ে চলা নিস্তরঙ্গ বৈতরণী, সব জেনেও না জানার ভান করে মুখ বুজে থাকে!
যার দুই পারে নিত্য চলে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের খেলা।
এরই নাম বুঝি জীবনের লীলা।
---------------------------------------------------------------------
পহেলে দর্শনধারী ফির স্বাদ বিচারী। হ্যাঁ আমি কুমড়ো ফুলের কথাই বলছি, কুমড়ো বড়ার কথা কিন্তু নয়।
এমন সুন্দর লালিত্য তার গঠনে আর রঙে যে সুকুমার রায় কি বলতেন, খুব জানতে
ইচ্ছে করে। কারণ কুমড়ো ফুলের প্রোডাক্ট হিসেবে বাংলায় কুমড়োর ভারী বদনাম। চেহারা মোটাসোটা, বেঁটে হেদো মার্কা তো তাকে কুমড়ো পটাশ বলতে জিভ কাঁপে না আমাদের। এমন একটি জম্পেশ শব্দবন্ধ কয়েন করে গেছেন 'আবোল তাবোল' এর স্রষ্টা যে তার তুলনা মেলা ভার।
মানছি ঠাকুর পুজোয় লাগে না; তবে পেট পুজোয় কুমড়ো ফুলের ব্যসন চোবানো অঞ্জলী কিন্তু সপ্ত ব্যঞ্জনীয় আহারের আয়োজনে একেবারে ভূবনভোলানো আইটেম।
আচ্ছা শুঁয়োপোকা থেকেও তো প্রজাপতির সৃষ্টি হয়, তাহলে এমন ললিতকলা একাডেমীর ফার্স্ট পুরষ্কার পাওয়া কুমড়ো ফুল থেকেই যদি কুমড়ো মানে ওইরকম ধ্যাবড়া চেহারার কুমড়ো পটাশের জন্ম হয় তো দোষ কি!
তাই আমি বলি কি একটু কাব্যি টাব্যি হোক না হয়, আজ তো আবার বিশ্ব কবিতা দিবস।
সত্যিই তো, কুমড়ো যদি 'কুমড়ো পটাশ' হয়
কুমড়ো ফুল তবে কুমড়ো বিকাশ কেন নয়!
সর্বোপরি কুমড়োর বিকাশ ই তো হয় কুমড়ো ফুল থেকে।
-------------------------------------------------------------------------------
গাছটিকে সারাবছরই দেখি ঢাকুরিয়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাবুবাগান লেনের মুখটায় বেশ লম্বাটে, সবুজ ডালাপালায় ছেয়ে - জায়গাটাকে বেশ মায়াময় করে রাখে। ছেলেকে নিয়ে স্কুলে
যাওয়া আসার পথে, আজ হঠাৎ নজরে পড়লো - গাছটির ডালাপালা, কান্ড ফুটে বেরিয়েছে অসংখ্য লালচে কমলা রঙের ফুল। ফুলগুলোর পাঁচ খানা পুরু পাঁপড়ি, গোল হয়ে ঘিরে রাখে মাঝের হলদেটে সোনালী রঙের পুংকেশর দন্ড গুলোকে। অপূর্ব তার শোভা। স্বভাবতই ছবি তুলতে গেলাম। কাছাকাছি যেতেই নাকে এলো অসম্ভব সুন্দর একটা গন্ধের মাদকতা। ছেলে বললো, বাবা এই গাছে কিন্তু সাপ থাকে। তাই! পাশেই বাড়ি, বাড়ির জানালার একেবারে পাশ দিয়েই - ঋজু কান্ডের গাছটি সোজা উঠে গেছে মাথার ওপরে।
আমাদের উৎসাহ আর কথোপকথন শুনে বাড়ির জানালায় মুখ বাড়িয়ে এক ভদ্রলোক বললেন, "ঠিকই বলেছে ও, এই গাছে কিন্তু সাপ আসে" ওরে বাব্বা, তাই। "হ্যাঁ, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে যখন ফুল ফুটে যায় গাছে তখন দেখা যায়"!
তাই!
হ্যাঁ গাছটার নামই তো ওই জন্য নাগকেশর। তবে এর অন্য নাম ও রয়েছে যেমন নাগেশ্বর বা নাগচম্পা ইত্যাদি। ভিন্ন মতে এগুলো আলাদা প্রজাতির। যাই হোক, কেউ কিন্তু নাগ অর্থাৎ সাপ কথাটিকে বাদ দিতে পারেন নি।
বেশ এই পর্যন্ত।
------------------------------------------------------------------------------------------
বাইক চালাতে না পারি, লজেন্স তো খেতে পারি!
----------------------------------------------------------------
হঠাৎ কয়েকদিন আগে অফিসের এক মহিলা সহকর্মী আমার হাতে বাইকটা তুলে দিতেই আমি তো অবাক! চোখ দুটোকে যতটা সম্ভব বড় বড় করে, গম্ভীর স্বরে বললাম, এটা?
হ্যাঁ, নিন না। দিলাম তো!
আমার থেকে দুতিন বছরের বড় ওই দিদি দেখি, মুখ টিপে টিপে হাসছেন, আর চোখগুলো মিটমিটে তারার মতো খুশীতে পিটপিট করছে।
আমাকে..?
আপনাকে নয়, আপনার ছেলেকে দিলাম।
ওহ্! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম এবার।
ভালো করে দেখতেই দেখি বাইকটির চাকায় ঢোকানো রয়েছে লাল, নীল সব লজেন্স গুলো; কোনোটা গোল, কোনোটা আবার ওভাল সাইজের।
একেবারেই বাচ্চাদের জন্য বড়দের উপহার। ছেলের হাতে এনে দিতেই ছেলের কি খুশী। বাকিটা চুষে খাওয়ার ইতিকথা।
ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------------------------------------------------
এইতো গতকালকের কথা, ঢাকুরিয়া মধুসূদন মঞ্চের সামনে - সিঁড়ি ভেঙে, ফুট ব্রিজে উঠছি দেখি মুখের কাছে এক কোনায়, সুন্দর একটা বটের চারা, সাকুল্যে গোটা ছয়েক পাতা হবে, মৃদু
হাওয়ায় আলতো আলতো আন্দোলিত হচ্ছে; কেমন যেন আদুরে আদুরে ভাব। খানিক দূরে দুটো শালিক, ব্রিজের রেলিং এর ওপর ঝিম মেরে বসে আছে। তা বসুক গে, তখন তো বুঝিনি।
তাই স্বভাব মতো, মোবাইল বের করে যথারীতি ছবি নেবো বলে ক্যামেরা অন করেছি, কিন্তু যেই না মোবাইলটাকে বটগাছের মাথার কাছে নিয়ে গিয়ে খানিক ঝুঁকে দাঁড়িয়েছি, ব্যাস্। অমনি সেই শালিক গুলো একেবারে কিচিরমিচির শব্দে উত্তাল করে ফেললো - আমার কান!
বুঝলাম শালিক গুলো ভীত হয়ে পড়েছে। কি জানি, এরাই হয়তো ঠোঁটে ধরে, কোন মুলুক থেকে বটফল নিয়ে এসে এখানে, ফেলেছিল কোনোদিন। নিশ্চিত ভাবে, এই চারা গাছটি বটের ডালায় ধরা কোনো গোলাকৃতি, লাল বটফল থেকেই সৃষ্ট, তবে শালিকেরও তো এটি ঠোঁটে ধরা সন্তান। অমলিন সেই অপত্য স্নেহের অংশিদার তাই এই শালিক দম্পতি ও।
কিন্তু ফুট ব্রিজে জন্মানো এই অবাঞ্ছিত বটগাছটির ভবিষ্যত পরিনতির কথা চিন্তা করে শালিক গুলোর মতোই আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।
এই প্রসঙ্গে, বট বৃক্ষ রোপণে যিনি প্রায় বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠেছেন, সেই মাস্টার মশাই শ্যামল জানার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রায় ১০ হাজার বট রোপণ করার মিশন নিয়ে তিনি, যাক বলে সাড়া ফেলে দিয়েছেন সর্বত্র। তাঁর নজরে পড়লে হয়তো এই বট চারাটির একটি সদগতি হতে পারে। শালিক গুলোও সঙ্গে সঙ্গে থাকবে না হয়। বড় হলে তার ছড়িয়ে পড়া ডালাপালায় না হয় একটু আশ্রয় খুঁজে পাবে।
-------------------------------------------------------
https://archive.roar.media/bangla/main/history/origin-and-evolution-of-bengali-language
https://bengali.indianexpress.com/lifestyle/kolkata-curzon-park-dire-situation-satyajit-ray-film-shot-here-54036/
-----------------------------------------------------------------------------------------
চিংড়িঘাটা ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে, খানিক হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। একেবারেই রেলিং এর গা ছুঁয়ে ছড়িয়ে থাকা ডালাপালায় ঝুলে আছে এই বড় বড় পটলের মতো দেখতে, কলাপাতা রঙের
ফলগুলো। নজর এড়িয়ে যাওয়া, খুবই শক্ত। ঠিকই ধরেছেন এগুলি শ্বেত শিমুলের ফল। বসন্ত রাঙানো লাল শিমুল আর এই শ্বেত শিমুল - এরা কিন্তু একই গোত্রের গাছ; তবে ভিন্ন প্রজাতির। বসন্তকালেই এর ফুল ফোটে তবে শ্বেত বর্ণ এবং এতটাই ছোট ছোট যে সচরাচর চোখে পড়ে না। তবে ঝরে পড়া ফুলকে প্রায়শই গাছ তলে বিছিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
একসময় ফল পাকে, ফেটে চৌচির হয়ে যায় বাহিরের আস্তরণ; তারপরেই ফুরফুর করে উড়তে বেরিয়ে পড়ে এর মধ্যে থাকা ছোট ছোট তুলিকা খন্ড গুলো। যেন ডিম ফুটে ঝাঁকে ঝাঁকে পক্ষী শাবক বেরিয়ে পড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তা ঘাটে, মানুষের মাথায়, গাছের পাতায়; এসব পেরিয়ে, মাটিতে - কমই পড়তে দেখা যায়।
শ্বেত শিমুলের এই ফলগুলি আসলে শিমুল তুলোর সূতিকাগার। যেখান থেকে ফুটে বেরোনো তুলতুলে সাদা তন্তু গুচ্ছ কে সম্বল করেই পাড়ায় পাড়ায় হাঁক পাড়বে ফেরিওয়ালারা - লেপ বালিশ বানাবে...., মাঝে মাঝে, নারদ মুনির বেহালার মতো দেখতে তুলো ভিনার যন্ত্র থেকে বার করবে টঙ টঙ ...আওয়াজ !
-----------------------------------------------------------------------------------------
সারি সারি রঙীন ছাতা, হঠাৎ দেখলে মনে হবে কোনো সমুদ্র সৈকতে এসে পড়েছি। তবে শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরেটা তো এমনিই একটা সমুদ্রের মতো। জন সমুদ্র। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।
প্রতিনিয়ত ব্যস্ত মানুষের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে আবার ফিরেও যাচ্ছে যথারীতি। রঙীন ছাতাগুলি থেকে প্রতি মুহূর্তে শোনা যাচ্ছে রেডিমেড জামাকাপড়, জুতো বিক্রির লোভনীয় দর ঘোষণার হাঁক ডাক। "একশো করে" দুটো শার্ট কিংবা দুশোয় নামী কোম্পানির জুতো। চাকা লাগানো ঠেলায় ঢেলে রাখা আছে জুতো, জামা কিংবা জিন্সের প্যান্ট - পছন্দ মতো বেছে নিতে পারলেই হলো। ঠেলার মাঝখানে, লম্বালম্বি দাঁড় করানো নলাকৃতি, অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাটের ওপর মেলা ছাতার ধার থেকে আবার ঝুলছে বৃত্তাকার ঝালর। খোঁজ নিয়ে জানলাম এই ঝালরকে, পরিভাষায় ছাতার ক্যান্টিলিভার বলা হয়। ছাতা যখন আছে, জল ছত্র থাকবে না তাই বা কি করে হয়। পুদিনা পাতা দিয়ে কিংবা লেবু চিনির বরফ মেশানো শরবতের বিস্তর চাহিদা এখানে। ঠেলার ওপরে লাল শালু দিয়ে মোড়া জলের পাত্র, সামনে লেবু আর পুদিনা পাতার তরতাজা প্রদর্শন, রোদে পোড়া সময়ে, প্রায় অমৃত পানের তৃপ্তিতে, হিমেল শরবত পূর্ণ প্লাস্টিকের গেলাসে চুমুক দেন এখানে ঘর্মাক্ত মানুষজন। এখানেই শেষ নয়। রঙীন ছাতার তলাতেই বসে ইয়ার ফোন কিংবা গরিলা গ্লাস বিক্রির পসরা। কোনোটায় হয়তো বিক্রি হচ্ছে নানা কিসিমের বেল্ট, সঙ্গে নানাধরনের মানিব্যাগ ও পাওয়া যাচ্ছে, ঠেলার ওপরে ডাই করা।
চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মানুষজন কে। চলে দরাদরি, নেওয়া না নেওয়ার কথা কথকতা। প্রিয়জনের জন্য কোনো পছন্দের জিনিসটি কেনার পরে যে মুগ্ধতার দীপ্তি খেলে যায় ক্রেতার চোখে মুখে তা এককথায় দেখার মতো।
কেনাকাটা, নেড়ে চেড়ে দেখা, কেতাবী কথা - এ সব কিছুর নীরব সাক্ষী থাকে এই রঙীন ছাতা গুলি। বিকিকিনির নয়া রুপকথা। ঘুরে ঘুরে বেড়ানো ফেরিওয়ালারা হয়তো ধীরে ধীরে থিতু হচ্ছে এইভাবে রঙীন ছাতা গুলোর নীচে। দাঁড়াতে না দিলে চাকা তো রয়েইছে।
-----------------------------------------------------------------------------------------
ঈষদুষ্ণ, তন্বী তন্ডুল রাশির উপরিভাগে কিঞ্চিৎ আদর পূর্বক ডাগর এবং পূর্ণ আর্দ্র গন্ধরাজ লিম্বু এক খন্ড নিঙড়াইয়া তাহার সুবাসিত রস বিন্দু এক পশলা বৃষ্টি ধারার ন্যায়
ঝরাইতে পারিলেই ভোজন পূর্ব মুখবন্ধ পর্ব বেশ আহার উন্মুখ হইয়া উঠে। ইহার সঙ্গে সুললিত গব্য ঘৃত ঈষৎ লেপটাইয়া লইতে পারিলে তো কথাই নাই।
এই চৈত্রের প্রখর রৌদ্রে ইহা যে কেবল ভোজনেচ্ছা বাড়াইবে তাহা নহে ইহার সুঘ্রাণে আহারে আসিবে এক বিরল অনুরাগ; পরিশেষে পাত পার্শ্বে যথেষ্ট অনাদরে পড়িয়া থাকিলেও বিদ্রোহ করিবে না। এমন সরস সুবাস, নির্দয় ভাবে নিঙড়াইয়া লইয়া প্রকাশ্যে ফেলিয়া রাখিবার দায়ে কোনোরূপ অভিমান করিবে না। ইহাই সান্ত্বনার।
----------------------------------------------------------------------------------------
সাম্প্রতিক সুপ্রীম কোর্টের রায় নিয়ে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে এর ফলে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক শিক্ষিকা - তাঁদের শিক্ষা দানের কর্তব্য থেকে
নিযুক্তির ঠিক ন বছরের মাথায় অপসৃত হওয়ার খবরে প্রায় সমস্ত মহলেই কমবেশী শোকের পরিবেশ লক্ষ করা গেছে। মাননীয় বিচারপতিরাও তাদের রায়ে অযোগ্যদের মধ্য থেকে যোগ্যদের আলাদা করতে না পারার কথা বলেছেন যদিও এর জন্য রাজ্য সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের গাফিলতি এবং তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু গাফিলতি বা মতান্তরে দূর্ণীতিকে দায়ী করলেও, কোনো ভাবে যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকাদের বাঁচানো কিন্তু সম্ভব হয়নি। সকলেই স্বীকার করবেন, নির্দোষ ব্যক্তির শাস্তি পাওয়ার মধ্যে কোনোরকম গৌরবের অনুভব থাকে না, উল্টে বিচার ব্যবস্থার দূর্বলতাই পরিস্ফুট হয়ে পড়ে।
সুপ্রীম কোর্টের এই রায়ের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ থেকে বিদগ্ধ জন অনেকেই অনেক কথা বলছেন। সেগুলোর বেশিরভাগই হয় পক্ষে নাহয় বিপক্ষে বলা নানা কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক এই রায়ের প্রকৃতিকে যদি বোঝার চেষ্টা করি তাহলে এর সঙ্গে কেবলমাত্র, বর্তমানে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকেরই মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
কথাটি কি একটু বিসদৃশ শোনালো? একটু বুঝিয়ে বললে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। কারণ যে কোনো সমস্যারই তার সঠিক প্রকৃতি নিরূপণ করা ছাড়া প্রকৃত সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
প্রথমেই তাই অ্যান্টিবায়োটিক আসলে কি বা কাকে বলে সেটা ভালো করে জেনে নেওয়া জরুরী। যদিও অ্যান্টিবায়োটিক শব্দটি প্রায় সরষে তেল বা নুন লবনের মতো আরোও অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের নামের তালিকায় ঢুকে পড়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে স্পষ্ট ধারণা অনেকেরই নেই। তাই সংক্ষেপে একটু বলে নেই। সর্বাগ্রে, অ্যান্টিবায়োটিক হলো একটি জৈব উপাদান যদিও এখন তা কৃত্রিম ভাবে ল্যাবরেটরিতে তৈরি হচ্ছে কিন্তু এটি নির্দিষ্ট ভাবে কোনো ব্যাকটেরিয়াকেই কেবলমাত্র প্রতিরোধ বা পুরোপুরি সংহার করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো শরীরের মধ্যে ঢুকে, অ্যান্টিবায়োটিক কিন্তু ভালো খারাপ বাছতে পারে না। তাই মন্দ ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাচন তন্ত্রে থাকা ভালো ভালো ব্যাকটেরিয়াকেও যথেচ্ছ নিধন করে ফেলে। যার ফলে, অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরে দেখা যায় প্রচুর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, যা অনভিপ্রেত। এই সমস্যা দূরিকরণে ব্রতী হয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত জৈব রসায়ন বিজ্ঞানী ভেঙ্কটেশ রামকৃষ্ণণ। লক্ষ ছিল, অ্যান্টিবায়োটিককে কিভাবে সিলেক্টিভ ভাবে ব্যবহার করা যায় অর্থাৎ কেবলমাত্র খারাপ ব্যাকটেরিয়া গুলোকেই যাতে মারতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক। ভালোগুলোর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
প্রসঙ্গত রামকৃষ্ণণ, এই নিয়ে নোবেল পুরস্কার ও পেয়েছিলেন, ২০০৯ সালে।
কিন্তু ভারতীয় বিচারব্যবস্থা কি আগামী দিনে দোষী নির্দোষী বাছতে সিলেক্টিভ অ্যান্টিবায়োটিক ফর্মুলা প্রয়োগ করবে?
সেটা যদিও লাখ টাকার প্রশ্ন।
-----------------------------------------------------------------------------------------
স্লোগান শ্লাঘা!
একটা অদ্ভুত স্লোগান লেখা ফেস্টুন দেখলাম, গতকাল; গড়িয়াহাট থেকে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ মুখী রাস্তায়, ডিভাইডারের রেলিং এ ঝুলে থাকা সেই ফেস্টুনটির নীচে লেখা
আছে এক ভক্তের নাম, অবশ্যই তিনি নিজেকে রাম ভক্ত বলে উল্লেখ করেছেন। তা করুন।
কিন্তু স্লোগান যেটা লেখা ছিল সেটি কিন্তু বেশ সুদুরপ্রসারী ভাবনার ইন্ধন বহন করে। যদিও তাতে বুদ্ধির খুব একটা ছাপ নেই তবে তাতে স্ব-আরোপিত শ্লাঘার মহিমা কিন্তু বেশ জ্বলজ্বলে। সাসপেন্স না বাড়িয়ে বরং বলেই ফেলি সেই স্লোগানটিতে ঠিক কি লেখা ছিল, বেশী নয় মাত্র চারটি শব্দের কথা - হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই।
কিন্তু এতো অতিসাধারণ কথা!
আচ্ছা এর মধ্যে আহামরির কি আছে?
ভাই-ভাই ই তো বলেছে। ভাতৃত্ব বোধের রসে চোবানো একেবারে; যাকে বলে জবজবে ভাব উপচে উপচে পড়ছে। এতে আবার অন্যায়ের কি আছে, শুনি?
যাই থাক, গোল বাঁধলো আসলে অন্য জায়গায়। স্লোগান দেখে একজন বললেন, তাহলে বাকিরা কি দোষ করলো?
বাকিরা মানে?
ওই শিখ, মুসলিম, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ,,জৈন, ঈশাই! এরা!
ওহ্ এরা, দেখো এতজনকে ঘরে জায়গা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একোমোডেশন প্রবলেম। দেখছো না একান্নবর্তী পরিবার গুলো কিরকম নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রন, প্রোটোনের সংসারে পরিনত হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক হও ভাই। দেশ এগুচ্ছে না।
সেসব তো ঠিক আছে, কিন্তু এরা কোথায় যাবে? এদের সঙ্গে কি কোনো সম্পর্ক থাকবে না?
থাকবে, থাকবে।
পাশ থেকে একজন অভয় দিয়ে উঠলেন। দেখেই মনে হলো বেশ দয়ার শরীর উনার।
কিরকম?
এরা ভাই না হোক, ভায়রা ভাই হয়ে থাকবে।
হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই,
বাকি সব ভায়রা ভাই!
মানে? ঠিকই শুনেছেন, রসিকতা নয়, সম্মানীয় অতিথি হয়ে থাকবেন এঁরা।
কার একটা মোবাইলে বুঝি তখন ফোন এসেছিল, রিং টোনে কন্টিনিউ কে একজন আহাম্মক বকবক করে চলেছেন- 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'।
লোকটা দেখি তুলছেনই না। আসলে লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছেন।
-----------------------------------------------------------------------------------------
সেই নরেন্দ্রপুর থেকে ভবানীপুরের দিকে যেতে - মসজিদ মোড় পেরোলেই পড়বে একটা বিশাল ঝিল; নাম, শঙ্কর তারকের ঝিল। ঝিলের পশ্চিম দিকের পাড় ধরে নেমে যাওয়া পাশের মাঠটাতে পুরো
আদিগন্ত ছেয়ে আছে পুদিনার ঘন সবুজ বিস্তার। দেখার মতন একেবারে। এমনি এমনিই হয়েছে, চাষের পরিচর্যা ছাড়াই। কত জন যে দা দিয়ে কেটে নিয়ে যায়, বলছিলেন ভবানীপুরের পরান বৈরাগী। শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে পুদিনা -জল বিক্রির ঠেলার সামনে দাঁড়িয়ে, পরান বৈরাগীর কন্ঠায় শোনা গেল বেশ গর্বের সুর।
জল শরবতের দোকানে, আগে থাকতেই পুদিনা পাতা থেঁতো করে বার করে রাখা হয় পুদিনার পান্না রঙা থকথকে ক্কাথ। তার থেকে এক চামচ নিয়ে বরফ মেশানো ঠান্ডা জলে মেশালেই শরীর মন একেবারে চাঙ্গা। এই গরমে ভীষণ চাহিদা পুদিনা পাতা মেশানো ঠান্ডা জলের।
লাল শালু মোড়া অ্যালুমিনিয়াম পাত্রের মাথায় পাতা ভর্তি পুদিনার ডালা গোঁজা রয়েছে, দেখতে বেশ লাগে। মন ভালো হয়ে যায়, এই ঝাঁঝালো রোদেও পুদিনা পাতাগুলো কেমন প্রাণচঞ্চল।
যদিও দোকানদার মাঝে মাঝে জল ছিটিয়ে দেন তবে পুদিনা পাতার রোদ বিট করার শক্তি কিন্তু সত্যিই অগাধ।
-----------------------------------------------------------------------------------------
এল পি জি স্কোর বনাম আই পি এল স্কোর!
রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে, জেনে গেছে ভারতের সব পিছিয়ে পড়া সংসার। শুধু জানে না এগিয়ে থাকা, এগিয়ে রাখা সকালের আনন্দবাজার। তাই তো ছাপেনি, ছেপেছে আই পি এল স্কোর, নষ্ট করে নি নিউজ প্রিন্ট বেকার বেকার।
এই তো গেল মাসে, নাসা মহাকাশচারী সুনিতা উইলিয়াম দীর্ঘ ন মাস মহাকাশ যাপনের পরে নামলেন ফ্লোরিডার উপকূলে, ভারতীয় সময়ে তখন রাত তিনটে কুড়ি মিনিট- কিন্তু তাতে কি সকালেই আনন্দবাজার ছাপলো ছবি সহ পুরো ডিটেইলস, দারুন চমৎকার। এমনকি টাইমস অফ ইন্ডিয়া পিছিয়ে ছিল, খবরে চিহ্ন ছিল না সুনিতার। তবে? ভাগ্যিস আনন্দবাজার পড়েছিলাম সেদিন, নাহলে কতটা পিছিয়ে থাকতাম, ভাবুন একবার।
আসলে এ জগৎ মায়ার, বৃথাই করো হাহাকার। এল পি জি স্কোর বাড়লে তাই দিব্যি আনন্দে থাকে আনন্দবাজার।
----------------------------------------------------------------------------------------
কুলফিওয়ালা, একটু সন্ধি বিচ্ছেদ করে দেখি কি পাই - কুল যদি ঠান্ডা হয় তবে ফি - এই কথাটির অর্থ হলো প্রতি সময় তাহলে কুল-ফি-ওয়ালা হলো প্রতি সময় যিনি ঠান্ডা বিলিয়ে
বেড়ান।
তবে এটি সম্পূর্ণ ভাবে আমার ব্যাখ্যা। একটু মজার ছলে বলা, যদিও সাধারণ ভাবে কুলফিওয়ালা বলতে আমরা যাদের কে বুঝি সেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কুলফি মালাই বিক্রি করা লোকগুলো তো ঠান্ডাই বিলি করে বেড়ান। যদিও কুলফি এই কথাটি একটি ফারসি শব্দ যার অর্থ হলো ঢাকা কাপ। আর সেই ঢাকা কাপ বা কুলফি ভর্তি ক'রে - জ্বাল দেওয়া দুধ আর চিনির মিশ্রণ কে মালাই হিসেবে পরিবেশন করার ভাবনা কিন্তু প্রথম শুরু হয় সেই সপ্তদশ শতাব্দীতে। দিল্লিতে তখন মোঘল শাসনকাল। মোঘলদের পরে শুরু হয় ইংরেজদের সাম্রাজ্য কাল; তাও শেষ হয়ে গেছে সেই কবে কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে কুলফিমালাই এর চাহিদা বিশেষ করে গরমের দিনগুলোতে যাকে বলে অপ্রতিরোধ্য।
প্রচ্ছদের ছবিতে এই কুলফিওয়ালা ভাই সাইকেলে করেই কুলফি ফেরি করেন, পেছনের কেরিয়ারে লাল শালু মোড়া মালাই রাখার পাত্র, সামনে মালাই পরিবেশনের কুলফি গুলো প্লাস্টিকের মধ্যে একটার মধ্যে একটা ঢোকানো থাকে এবং অবশ্যই সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলতে দেখা যায় একটি বড় পেতলের ঘন্টিকে। দুপুরের পিচ গলা রোদ্দুরে ঢং ঢং আওয়াজ শুনলেই জানালার পর্দা সরিয়ে বাড়ির মেয়ে বাচ্চারা মুখ বাড়িয়ে দেখে এই বুঝি কুলফিওয়ালা এলো।
----------------------------------------------------------------------------------------
বহুদিন আগে 'তকদিরওয়ালা' বলে একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিলাম, তাতে জনপ্রিয় চরিত্রাভিনেতা কাদের খাঁন যমরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ছবিতে, সর্বক্ষণ একটা গদা কাঁধে করে,
জমকালো পোষাক পরা কাদের খানের সেই বিখ্যাত সংলাপ, "হাম হ্যায় যম" আজোও মনের মধ্যে গেঁথে বসে আছে।
তবে যমরাজ, সে যতই সবসময় গদা কাঁধে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ান না কেন, গদাধর উপাধি কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর জন্যই শুধু বরাদ্দ থাকে।
আর সেই গদাধর বিষ্ণুকে দেখে কে না ভক্তিতে গদগদ হয় বলুন। তবে বিষ্ণুর গদা কখনো কাঁধে শোয়ানো থাকে না। গদার গজাল যুক্ত গোলাকার, মুগুর সদৃশ অংশটি যদি মাথা হয় এবং দন্ডাকার ধাতব অংশটি যদি পায়ের দিক হয় তবে বিষ্ণুদেবের বাঁম হাতে ধরা গদাটি সর্বদাই হেঁট মুন্ড ঊর্দ্ধ পদ অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ যুদ্ধ নয় যুদ্ধ বিরতির আভাস থাকে তার মধ্যে।
তবে গদা থাকবে অথচ গদার প্রহারে দুর্যোধনের উরু ভাঙার কথা হবে না সেটাই বা কি করে হয়। আমাদের পাড়ার কাশীদা আবার মহাভারত বিশেষজ্ঞ বিশেষ করে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা উঠলেই তিনি আর কাউকেই কোনো কথা বলতে দেবেন না। উনার মুখে দুর্যোধনের উরু ভঙ্গের পালা শোনার একটা বড় মজা হলো তিনি যদি গদা হস্তে ভীমের পরিবর্তে ভীম হস্তে গদা এলেন বলে বজ্র নির্ঘোষ ছাড়েন তো তাই মুখ বুজে মেনে নিতে হবে। কারণে এটা উনার মুদ্রাদোষ, উদ্দেশ্য আর বিধেয় ঠিক থাকে না। উনার গল্প বলার মধ্যে যদি কেউ এসে পড়েন তাহলে তিনি যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বলে উঠবেন এই গান আইলেন গোড়া থেকে দিদি গাও।
এনি ওয়ে, বর্তমান দিনে গদার মতো এমন মাথা মোটা অস্ত্রের চল যে আর নেই সে কথা বলাই বাহুল্য। তবে একটু ছিমছাম শরীরের হকি স্টিক কিন্তু গদার আধুনিক সংস্করণ বলেই মনে হয়। চিন্তা করুন বর্তমান দিনে পুলিশকে যদি আইন শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সেই পবন পুত্র, ভগবান হনুমানের মতো ইয়া বড় ভারী একখানা পেতলের গদা নিয়ে চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে হতো তাহলে ব্যাপারটা কিরকম হতো। তবে গদা সে যতই ব্যাকডেটেড অস্ত্র হোক না কেন, কাউকে মেরে মাথা ভেঙে দেওয়ার হুমকি কিন্তু সেই গদার কথা মাথায় রেখেই করা হয়ে থাকে। পুরানে রয়েছে ভগবান বললাম জরাসন্ধকে বধ করেছিলেন গদা দিয়ে, তার মানে তিনি গদা চালনায় যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন কিন্তু তাতে কি, জনমানসে কিন্তু তাঁর সেই হলধর হয়ে থাকার ভবিতব্য কেউ কাটাতে পারে না।
তবে গদা নিয়ে বলছি মানে ভাববেন না যে গদা শুধুই শক্তি বা পৌরুষকারের প্রতীক, কারণ বিষ্ণু পুরানে আবার গদাকে দেবী হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে।
গদা দেবী। ভাবুন একবার।
প্রচ্ছদের ছবিতে, যে ছেলেটি গদা কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে নরেন্দ্রপুর স্টেশনে সে তারকেশ্বর যাবে শিবের মাথায় জল ঢালতে। যদিও শিবের সঙ্গে গদার সম্পর্ক খুঁজে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ ভ্রমণ করে ফেললেও কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।
জিজ্ঞাসা করলাম ভাই শিবের তো ত্রিশূল, তা তুমি গদা নিয়ে যাচ্ছো।
বললো, গদাটাই এখন ট্রেন্ড।
তা যাই হোক, ট্রেন্ড যখন মানতেই হবে।
জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে কি এটি, কোনো যাত্রা পার্টি থেকে ভাড়ায় নিয়ে এসেছো? কারণ পৌরাণিক যাত্রা পালায় এখনোও সাজঘরে গদার উপস্থিতি অনিবার্য। উত্তরে বললো না এটা ওদের নিজেদের।
তবে এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা না বললেই নয়, সেটা হলো - শিব গদা নেন না ঠিক, তবে ভগবান বিষ্ণু গদা নিলেও যে সে গদা কিন্তু হাতে ধরেন না। যেমন তাঁর হাতে ধরা শঙ্খ হলো - পাঞ্চজন্য শঙ্খ, চক্র - সুদর্শন চক্র তেমনি তাঁর হাতে থাকে স্পেশাল গদা - যার নাম কৌমদকী। কুমুদ বা নিলোৎপল থেকে কৌমদকী কথাটি এসেছে।
যাক গদার কথা বলতে গিয়ে গাদা গাদা ফালতু কথা বলা হয়ে গেল। তো আর বকবক না করে শেষ করছি এখানে।
ধন্যবাদ।
----------------------------------------------------------------------------------------
এমন উদাত্ত, প্রাণ ঢালা ভক্তি কতদিন দেখিনি।
আজ
নীল ষষ্ঠী; মায়ের সঙ্গে শিবের মন্দিরে আসা এই ছোট্ট মেয়েটির তাই শিব লিঙ্গ কে ছুঁয়ে প্রণাম করার আকুতি যেন সকল আগল খুলে বাঁধনহারা হতে চাইছে।
মা, যাতে মেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে না যায় তাই তাকে ধরে রেখেছেন। খুব স্বাভাবিক।
ছলনা হীন, এই ভক্তির প্রাপ্তি ভগবান শিব নিশ্চয়ই পূরণ করবেন।
সবার মঙ্গল হোক, জীবের মধ্যে শিবের ভাবনা সার্থক হোক। শুভেচ্ছা রইল।
ধন্যবাদ।
----------------------------------------------------------------------------------------
শুভ নববর্ষ!
জল রঙে আঁকা এই ছবিটিতে, মূল উপজীব্য কিন্তু গাছপালা, পথ, মাঠ এমনকি ক্যানভাসের অনেকটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাহাড় শৃঙ্গ দুটিও নয়। বরং পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে
উঁকি দেওয়া, নব প্রভাতের নব আলোক সঞ্চারে উদগ্রীব, রক্তিম আভার নবোৎপল, নবারুণই আসল।
আজ বঙ্গাব্দের নতুন বছর ১৪৩২ সালের শুরুর দিন, শুভারম্ভ।
তাই নববর্ষের শুভেচ্ছা সকলকে, সকলের জীবনে নববর্ষের এই নব সূর্যোদয় নিয়ে আসুক নতুন আশা ও নতুন সম্ভাবনার আলো।
----------------------------------------------------------------------------------------
জাতে তাল, তালে কাঁদি - কাঁদি!
সবে তো বৈশাখের দুই তারিখ আজ। জ্যেষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ যাবে; ভাদ্র মাস আসলে তবে তাল পড়ার প্রশ্ন। তখন যদিও তাল বদলে যাবে, মাটিতে তখন শুধুই
ধপাস ধপাস করে তাল পড়ার শব্দ শোনা যাবে, দিনরাত।
সে এখন অনেক দেরী। অনেকটা গাছে তাল আর এখন থেকে দা তে ধার দিয়ে রাখার মতো ব্যাপার।
তবু গাছে কাঁদি কাঁদি সবুজ কাঁচা তাল দেখে তাল না ঠুকে স্থির থাকতে পারলাম না।
---------------------------------------------------------------------------------------
অর্কিড হেজ, বাখারির ঝুড়ির মধ্যে এমন সুন্দর করে ফুলেল অর্কিড গুলোকে একটার পিঠে একটা সাজানো রয়েছে যে দেখতেই ছবি তোলার বাসনা চেপে বসলো মাথায়। পার্ক সার্কাস স্টেশনে,
বিকেলের ট্রেন ধরার রুদ্ধশ্বাস ভিড়। তার মধ্যেই বিক্রেতা তার অর্কিড ভরা ঝুড়িটিকে প্লাটফর্মের চাতালে রেখে দিয়েছেন যত্ন করে। জিগ্যেস করলাম, বললো এটা অর্কিড হেজ। অর্থাৎ অর্কিডের বেড়া। তাও চার চারটে ভিন্ন রঙের। সাজিয়ে রাখার এমন শিল্প নিশ্চিত ভাবে বিক্রেতার সৌন্দর্য বোধের পরিচায়ক।
---------------------------------------------------------------------------------------
শিব দুর্গা ঘুরছেন, বাজারে। দুপাশে দোকান, মাঝখানে যেটুকু পথ রয়েছে তাতে আবার পাতাই পেতে সারিবদ্ধভাবে ফল, সব্জী আবার কোথাও কোথাও গামছা, কাপড় নিয়ে বসেছে খুচরো
দোকানদারেরা।
দুপুরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই কাঁথি সুপার মার্কেটের ভেতরকার রাস্তাগুলো - ধুলো জলে মাখামাখি হয়ে বেশ কাদা কাদা হয়ে গেছে। শৌখিন ক্রেতারা তাদের জামা কাপড় গুলোকে পা থেকে খানিকটা ওপরে তুলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তার মধ্যেই কেনাকাটা, দরদাম চলছে বেশ। একশো করে কিলো, মিষ্টি বেগুনফুলি আম - দোকানদারের হাঁক ডাকে সরগরম হয়ে উঠেছে বাজার। এক আধটা রিক্সা, সাইকেল ঢুকে পড়লে বেশ গোলযোগ বেধে যাচ্ছে। মশলা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে, বাখারির মড়ার ওপরে রাখা গোল ঝুঁড়িতে সাজানো রয়েছে ছোলা, মটর, ঝুরি ভাজা, আঁচার তেল, পেঁয়াজ লঙ্কা কুঁচির বিভিন্ন আকৃতির কৌটা গুলো। খুব ব্যস্ততা; দোকানের চারিদিকে ইয়ং ছেলে মেয়েদের ভিড় জায়গাটিকে আরোও সংকীর্ণ করে দিয়েছে। এইরকম হজঘট পরিস্থিতির মধ্যে যদি শিবঠাকুর একেবারে সস্ত্রীক মা দুর্গাকে নিয়ে হাজির হন তো কেমন হয় ব্যাপারটা। বাজারে উপস্থিত ধনী, গরীব, খ্যাত, অখ্যাত, উঁচু, নীচু যত যেই থাকুন, শিব আর দুর্গার থেকে তো বড় কেউ নন। তাই সকলেই শিব দুর্গাকে দেখতে ব্যস্ত। আমিও সকলের মতো উদগ্রীব হয়ে হাঁক পাড়লাম, 'ও শিবদা' বলে।
একটু দাঁড়ান প্লিজ। শিব ঠাকুর থামতেই দুর্গা ও দাঁড়িয়ে পড়লেন পাশাপাশি। স্বাভাবিক।
সামনে পেছনে সন্ন্যাসী ভক্তদের লাইন। সাদা ধুতির ওপরে কায়দা করে গামছা আঁটা। কাঁধ বেয়ে পৈতের মতো সুতোর গাছা ঝুলছে পেটের ওপরে। একজন ভক্তর হাতে দেখি - জরিকাগজ, ফুল ছাড়াও অনেকগুলো গামছা বাঁধা একটা মস্ত বাঁশের দন্ড ধরা, একে দেউল বলে। মার্কেটের বড় বড় দোকানের সামনে, সেই দেউলকে কাঁধ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখছেন সন্ন্যাসীরা। তারপরে দোকানদারের মঙ্গল কামনায় ফুল পাতা তন্ডুল নিবেদন করছেন মহাদেব শিবের উদ্দেশ্য। সঙ্গে রয়েছেন এই সঙ সাজা শিব দুর্গা দুজন; এছাড়াও রয়েছেন, বাঁকা বেল গাছের ডালকে ঘোড়ার মতো করে, বাজনার তালে তালে নাচ দেখান যিনি সেই গদাধর ভুঁইয়াও। অনেক কাল ধরে করছেন। কাঁথি শহরের অদূরে, বিল চালতি গ্রামের প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দিরে, দু মাস ধরে চলে গাজন। এই সময়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সন্ন্যাসীরা ঘর ঘর ঘুরে মাধুকরী করেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সব জায়গাতে চড়ক হয়ে গেলেও, এখানে হয় নি। যেদিন হবে, স্থানীয় ভাবে তাকে বড়ভোগের দিন বলা হযে থাকে। সেদিন মন্দির প্রাঙ্গণে বসবে মেলা, গাজন গান হবে এবং সন্ন্যাসীদের নানারকম কষ্টকর কসরৎ দেখা যাবে, তার মধ্যে আগুনে গড়াগড়ি খাওয় থেকে শুরু করে বটি কাতান, দায়ের ওপর ঝাঁপ দেওয়ার রোমহর্ষক ব্রত খেলাও রয়েছে।
তা বেশ, শিব দুর্গা যেই না পাশাপাশি দাঁড়িয়েছেন, সটান শুরু হয়ে গেল ফটো সেশনের পালা। ক্লিক ক্লিক শব্দে, সঙ সাজা শিব দুর্গা দুজন, মোবাইলের ইমেজ গ্যালারীতে ঢুকে পড়লেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, নাম কি?
শিব বললেন তাঁর নাম দিবাকর ঘোড়াই। দুর্গাকে জানতে চাইলাম, আপনার নাম ? রামপদ ঘোড়াই। আপনারা কি একই পাড়ার? হ্যাঁ আমরা দুজন বন্ধু।
সঙ সাজায় এখনোও পর্যন্ত পুরুষ লোকেরাই মহিলা সাজেন। আগের দিনে যাত্রা পালা গুলোয় এমনটা দেখা যেতো। সেই চল এখনোও রয়ে গেছে চৈত্র মাসের এই গাজন যাত্রায়।
এত কথা শোনার পর, দুর্গা বেশী রামপদ ঘোড়াই বললেন কি, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও হেভি লাইক কমেন্টস পাবে।
অগত্যা, তাই করলাম। দুর্গা মা থুড়ি দুর্গা বাবার আদেশ অমান্যি করবো অত সাধ্যি কোথায়!
---------------------------------------------------------------------------------------
কাজুবাদাম খেতে যতটা ভালো মূল্যটাও কিন্তু মন্দ কিছু নয়। তবে কিনা কাজুবাদাম বলে কথা। ছোটবেলায়, ভুগোল বইয়ের পাতায় যখন পড়লাম সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল হিসেবে কাঁথির
ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য গুলোর কথা - যার মধ্যে সমুদ্র, ঝাউবন, সামুদ্রিক মাছ, বালিয়াড়ি ছাড়াও সেই সর্বজনবিদিত সুদীর্ঘ ও সুস্বাদু কাজুবাদাম ও তার জঙ্গলের কথা - তখন যাকে বলে গর্বে একেবারে ষাঁড়াষাড়ির জোয়ার বয়ে যেতো বুকের মধ্যে।
কারণ আমার বাড়ির কাছেই যে কত অযত্নে বেড়ে ওঠা কাজুবাদামের জঙ্গল ছিল, একেবারেই প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা, কে কবে সে গাছ লাগিয়েছিল কেউ বলতে পারে না। উঁচু উঁচু বালিয়াড়ি - একেবারে পাহাড়ের মতোই তার সুউচ্চ চূড়া, আর তার কোলে পিঠে গজিয়ে যাওয়া কাজুর নাতিদীর্ঘ গাছ ও তার চতুর্দিকে বিস্তৃত ডালায় পালার ঘনিয়ে আসা ছায়া আঁধারি ঝোপ।
কেউ কখনো বেড়া দেওয়ার কথা ভাবতোই না।
আমি আমার একটা গল্পে লিখেছিলাম সেই বালিয়াড়ি আর কাজুবাদামের জঙ্গলের কথা। গল্পটির নাম ছিল
#খেলা। ছোটবেলায়, বালির পাহাড় গুলোই ছিল আমাদের প্রিয় ক্রিড়া ক্ষেত্র।
গ্রীষ্ম কাল এলেই, প্রচন্ড রোদে যখন বালি উত্তপ্ত হয়ে উঠতো, বড়দের দেখেছি মট মট করে বাদাম পাতা গুলো ছিঁড়ে বালির ওপরে ফেলতো আর তার উপরে পা রেখে রেখে হেঁটে এগিয়ে যেতো সামনের দিকে। আর এই গরম কালেই ধরে বাদাম। লাল, কমলা, হলুদ রঙের বাদাম ফলগুলো বরের টোপরের মতো দেখতে, অকথ্য ভাবে ঝুলে থাকতো গাছের শাখা প্রশাখাতে। যেহেতু কাজুবাদাম একটি ব্যক্তবীজী ফল, বীজ গুলো থাকে বাইরে, ফলের ঠিক নীচে। সেই কিডনি বা বৃক্কের মতো দেখতে বীজের মধ্যে থাকা শাঁসই আমরা কাজুবাদাম হিসেবে খাই।
আমার বাড়ির অনতিদূরেই ছিল কাজুবাদামের একটা ঘন জঙ্গল, জনৈক দেবেন মাইতি ছিলেন তার মালিক। সকলে আমরা বলতাম দেবেন মাইতির জঙ্গল। তাতে কাজু ছাড়াও শ্যাওড়া, বকুল, শিরীষ সহ নানা কিসিমের গাছ ও ছোট ছোট ঝাটু কুলের ঝোপ ঝাড় থাকতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেমন গা ছমছমে ভাব। লুকোচুরি খেলায় কেউ কেউ ওখানে গিয়ে লুকোলে আর তাকে খুঁজে পাওয়ার যো ছিল না। জঙ্গলটির মাঝখানে একটা অগভীর পুকুর ছিল। গরমের সময় দু এক আঁজলা ঝরা জলই কেবল পড়ে থাকতো তলায় । আমরা খুব ভোরে উঠে দল বেঁধে সেই জঙ্গলে যেতাম কাজু কুড়োতে। রাতে বাদুড় খেয়ে ফেলে দিয়ে যেতো, সেইগুলোই তুলে নিয়ে আসতাম আমরা। পাকা কাজুর রং হয় কালচে বাদামী। কিন্তু কাঁচা অবস্থায় একেবারে ডিপ সবুজ। মাঝে মাঝে, দু একটা কাঁচা বাদাম ছিঁড়ে নেইনি সে কথা বলবো না।
প্রচ্ছদের ছবিতে তাই বুঝতেই পারছেন একটি কাঁচা বাদাম ঝুলে আছে গাছে।
কাঁচা বাদাম খাওয়ার পদ্ধতি কিন্তু বেশ জমকালো। একটা ইঁটের ওপর কাঁচা কাজুটিকে রেখে আর একটি আধলা ইঁট দিয়ে থেঁতো করলে কষাটে দুধ-সাদা শাঁস ছিটকে বেরুতো, ছোটবেলায় তাই ছিল অমৃত।
আস্তে আস্তে বালিয়াড়ি কেটে পরিষ্কার হয়েছে, লোকসংখ্যা বেড়েছে তাই জঙ্গল কেটে ঘরবসতি গড়ে উঠেছে সেই জায়গায়। এখন কাজুর গাছকে তাই বেড়া দিয়ে সর্বক্ষণ নজরে নজরে রাখার বন্দোবস্ত করে গাছমালিকেরা।
গোয়ায় পর্যটকদের কাছে কাজুবাদাম থেকে তৈরি পানীয় ফেনি খুবই জনপ্রিয়।
কাঁথি, কাজুবাদামের জন্য বিখ্যাত হলেও এ নিয়ে কোনো কথা শোনা যায় না।
লোকে বলে, কাঁথি নাকি তিনটে 'ব' এর জন্য বিখ্যাত। বালি, বালিকা আর বাদাম। কিন্তু কাঁথির নিজস্ব কাজু গাছের আজ বড়ই আকাল। সেই তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ আবার কখনোও কখনোও বিদেশ থেকে আমদানি করে আনা হয় কাজু, কাজু প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে অনেক মানুষের রুটি রুজি নির্ভর করে কাঁথি তে। তবু কাজু আজ সুন্দরবনের মধুর মতোই কাঁথির মানুষের কাছে অধরা, সহজলভ্য নয় মোটেই।
ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------------------------------------------
এমনিই একটি ছবি।
--------------------------
খাকি প্যান্ট ও কমলা শার্ট গায়ে এক কর্তব্যরত লাইনম্যানের, রেল লাইন ধরে তিনি হেটে চলেছেন লাইন মেরামতির কাজে। ছায়াহীন দ্বিপ্রহর, তাই মাথায় একটা ছোট টুপিই সহায়। জলপাই ছাপের ছোট সাহেবী টুপি। পিঠে ব্যাগ, এক হাতে লম্বা হাতুড়ি আর অন্য হাতে একটা বড় রেঞ্জ। রেললাইনের নিরাপত্তা রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী। আমাদের যাত্রাপথকে নিত্য কন্টকমুক্ত রাখতে এই লাইনম্যানদের অবদান কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের যাত্রা পথ সর্বদা শুভ হোক এই কামনা করি।
ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------------------------------------------
"তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ"
কবি নজরুল যদি এমন কথা লিখতে পারেন তবে আমি কোন ছার!
তাই তো প্রাণ খুলে, ফুলগুলোকে মোবাইল বন্দী করার সময়, কখন যে মুখ ফস্কে গেয়ে উঠি, তুমি সুন্দর তাই ছবি তুলে রাখি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ, তা আর ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবো না।
তবে আর কথা নয়; নো মোর টক্ টক্! এবার বরং মন খুলে, ছবিগুলো দেখা হোক!
---------------------------------------------------------------------------------------
একটু আড় পেতে শুনুন, পাতার নুপূর শুনতে পাবেন কানে। সঙ্গে বিহঙ্গ ললনাদের কলকলনাদ আপনার মনে যে এক সুখপ্রদ আবহ সৃষ্টি করবে সে কথা হলফ করে বলতে পারি।
--------------------------------------------------------------------------------------
কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, "Stop here, or gently pass!"
অর্থাৎ দাঁড়াও নইলে সরে পড় চুপটি করে।
পথে অবিরাম ঝরে পড়ছে হলুদ কনকচূড়া ফুল; দেখতে চাইলে খানিক দাঁড়িয়ে যেও, আর যদি ব্যস্ততা থাকে তবে কেটে পড় মানে মানে।
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------
হাওয়ায় ভেসে, হেলে দুলে পড়লো প্রিয় জারুল,
পড়েই জলে বললো ঢলে আমি তোমার পারুল !
যা গরম, তাতে এই রোদে কতক্ষন আর ডালায় ঝুলে থাকা যায়; অসহ্য! তাই জল দেখে অবগাহনের ইচ্ছে যদি হয় তবে আমাকে আবার ওই ডাল মানে দলবিরোধী বলো না যেন!
--------------------------------------------------------------------------------------
কাবেরী, তিস্তা, সিন্ধু, ভাগীরথী;
পানি-পথের যুদ্ধে তৃষ্ণা মেটাতে ,
কুঁজো তলার, খানিক বিরতি !
বকুলতলার ঘন সান্দ্র ছায়ায়, এমন জলভরা মাটির কুঁজোর শোভা কোলকাতার ফুটপাতেই বোধহয় দেখা যায়। প্রবল দাবদাহে, ক্লান্ত পথচারীর কাছে এমন মায়াবী জলসত্র যে কতটা আকর্ষণীয় তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন।
জলসত্র, তবে সেল্ফ সার্ভিস। আপনা হাত জগন্নাথ। তবে সেটাই বা কম কি!
ধন্যবাদ!
--------------------------------------------------------------------------------------
কই হে ফটাশ জল, নিরম্বু গোটা গোষ্পদ!
তৃষ্ণার মুখে তুমি কিনা হেঁট মুন্ড ঊর্দ্ধ পদ?
গ্রীষ্মের দিনে, লোকাল ট্রেনেগুলোয় জল পিপাসা মেটানোর অনেক রকম ব্যবস্থা থাকে। বোতল বন্দি ঠান্ডা জল থেকে শুরু করে পাউচ ভর্তি আম পোড়া আমের শরবত; পাওয়া যায় ঠান্ডা দই লস্যিও। নিত্য ফেরিওয়ালাদের হাঁক ডাকে একরকম সরগরম থাকে ট্রেনের কামরাগুলো। তবে সবথেকে আকর্ষনীয়, গাঢ় সবুজ কাঁচের বোতলে ভরা সোডা জলের কথা না বললেই নয়। রোদ ক্লান্ত ট্রেন যাত্রীদের কাছে লেবুর টক মেশা এই সোডা জলের আস্বাদন প্রায় অমৃত পানের সমান। বোতলের ছিপি খুলতে গিয়ে ফটাশ ফটাশ করে আওয়াজ হয় বলে চালু কথায় ফটাশ জল বলা হয়ে থাকে।
যাই হোক, এই গরমের সময় বোতলগুলো যদি এরকম উপুড় হয়ে থাকে হেঁট মুন্ড ঊর্দ্ধ পদ হয়ে তাহলে কারই বা ভালো লাগে।
তৃপ্তির চুমুক দিতে যে মুখ তুলে তাকাতেই হবে। ফেরিওয়ালা বললেন সোডা জল ভর্তি করতেই নিয়ে যাচ্ছি খালি বোতলগুলোকে।
একটু সবুর করো, সবুরে মেওয়া ফলুক না ফলুক ফটাশ জল ফাটবেই।
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------
অক্ষয় দীপ।
শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য দিনে বাৎসরিক দ্বারোদ্ঘাটন হয় ছয় মাস ধরে বন্ধ থাকা, হিমালয়ের গাড়োয়ল পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী মন্দিরের।
ভারী তুষারপাত এবং তাপমাত্রার তীব্র অবনমনের কারণে প্রতিবছর ভাতৃ দ্বিতীয়ার দিনে মন্দিরের দ্বার রূদ্ধ করে দেওয়া হয়। গর্ভ গৃহে, দেবী মূর্তি সম্মুখে জ্বালিয়ে আসা হয় প্রদীপ।
দ্বার উন্মুক্ত হলে দেখা যায়, ছয় মাস আগে জ্বালিয়ে রাখা সেই প্রদীপ তখনো দীপ্তমান, টলটলে শিখায় সমুজ্জ্বল; মন্দির মধ্যে তার অমলিন আলোক ছটা, পরম মহিমায় তখনো বিকিরিত হচ্ছে সমান গৌরবে। উপস্থিত সকলে সেই অক্ষয় দীপ অবলোকন করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন।
ধন্যবাদ।
শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার অক্ষয় দীপ, সকলের জীবনে আনুক অক্ষয় প্রজ্জ্বলন।
--------------------------------------------------------------------------------------
সূর্য খেলছে আগুন নিয়ে,
মেঘ ভুলেছে মায়া!
জল মাপছে হাওয়া!
হঠাৎ করে, 'জল মাপছে হাওয়া' এই লাইনটা মাথায় আসতেই ওপরের তিনটে লাইন লিখতে হলো। আচ্ছা সত্যিই কি জল মাপছে, হাওয়া? এই কূট প্রশ্নটি যদি একান্তই আপনার সরল মনকে বিব্রত করে ফেলে তবে বেশি না ভেবে নিতান্তই এটিকে একটি কথার কথা ভেবে সটান ভিড়িয়ে দেন কোনো বেকার ফালতু কথার ভিড়ে। তবে একটা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ যেটা না দিলেই নয়, সেটা হলো এর সঙ্গে কিন্তু বর্তমানে চলা কোনো প্রাকৃতিক কিংবা রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে কোনোরকম মিল নেই।
ব্যাস্ কেল্লাফতে।
ধন্যবাদ
ছবিটি, শিয়ালদহ স্টেশনে তোলা; একটি মশলা মুড়ির দোকানে, পেঁয়াজ লঙ্কার কুচির মধ্যে পোঁতা এই ঘুরঘুরিটি দেখছিলাম, হাওয়া এলে বেশ একটু ঘুরে নিচ্ছে আবার হাওয়া বন্ধ হলে থেমে যাচ্ছে। ছোটবেলায় হাওয়ার সামনে এইরকম ঘুরঘুরি ধরে খুব আনন্দ পেতাম। তবে সেটা বাঁশের খাচির ওপর তালপাতা দিয়ে তৈরি হোত।
--------------------------------------------------------------------------------------
"একই বৃন্তে দুটি কুসুম" এর কথা বলেছেন কবি নজরুল। কিন্তু এ তো দেখি একই বৃতির মধ্যে দু দুটো ধুতরা, একটার মুখে আর একটা ঢোকানো রয়েছে পরপর, যেন দুটো কলকে সাজানো রয়েছে ওপর
নীচে করে; আলতো ধরে টানলেই আলাদা হয় যাবে। সাদা পাঁপড়ি গুলোর গায়ে হালকা বেগুনি রেখার এমন চমৎকার বুলান; দেখলেই তাক লেগে যায়। তাই চটপট, ধুতরা শট।
--------------------------------------------------------------------------------------
জীবন শুরু করেছিলেন আঁকিয়ে হিসেবে। ডি কে গুপ্তর সিগনেট প্রেসে, যোগ দিয়েছিলেন (১৯৪৩) প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে। করতেন ইলাস্ট্রেশন বা অলংকরণের কাজও। পরে লেখালেখি,
চলচ্চিত্র নির্মাণ, সঙ্গীত পরিচালনা থেকে শুরু করে চিত্রনাট্য লেখা, শিল্প কলা সংস্কৃতির বহু দিকেই তাঁর পারদর্শিতা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। গড়েছে অবিস্মরণীয় সব নজির। তিনি সত্যজিৎ রায়। ১৯২১ সালের আজকের দিনে তাঁর জন্ম।
সত্যজিৎ রায়, তাঁর নিজের লেখা কাহিনী গুলোতে, বেশিরভাগ সময় নিজেই অলংকরণ করতেন।
১০৪ তম জন্মদিনে, এই মহিরুহ সমান মহান ব্যক্তিত্ব কে যথাযোগ্য সম্মান জানাতে তাঁরই আঁকা দুটি অলংকরণ এখানে শেয়ার করে নিলাম।
'জয় বাবা ফেলুনাথ ' গোয়েন্দা উপন্যাসের এই, অলংকরণ দুটি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে।
--------------------------------------------------------------------------------------
লতা পাতায় ডাইনোসরের আদল!
একটা বড় লম্বা গাছ - তার ডালা পালা, গুঁড়ি পুরো আবৃত হয়ে আছে, আপাদমস্তক বেষ্টন করে থাকা লতা পাতার ঘন আচ্ছাদনে। এমনকি গাছটির স্বরূপ বোঝার ও
কোনো উপায় নেই, তবে আমার যেমন অভ্যাস, কয়েকদিন আগে কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে লতা গাছের এমন আকাশচুম্বী স্পর্ধা দেখে ছবি নিয়েছিলাম। তারপরে, ঘরে এসে ছবিটিকে কি ভেবে খুলে দেখতেই দেখি, আরে এ তো পুরো ডাইনোসরের আদল ফুটে উঠেছে। তাতেই ছবিটিকে শেয়ার করে নিলাম।
আর একটা কথা একটু জুড়ে দিতে চাই এর সঙ্গে, সেটা অবশ্য আমার ছেলের বলা।
ওর কথায়, পৃথিবীর বৃহত্তম প্রজাতির ডাইনোসররা নাকি তৃণভোজী ছিল। লতাপাতা খেত। তা লতা পাতা খেতে খেতে কি লতা পাতার রূপ ধরে আবার ফিরে এলো ডাইনোসর ! যাই হোক এ কথার অবশ্য ফ্যাক্ট চেক করিনি।
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------
ডালিম ফুল যে এত সুন্দর হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। যেমন টুকটুকে রং তেমন তার পাঁপড়ি সজ্জা। ডালিম ফুল এমনিতেই খুব দূর্লভ তার ওপরে বছরে সবসময় ফোটেও না। এমনিতে
পুজোয় লাগে না; মালা অথবা স্তবক নির্মাণেও এর ব্যবহার দেখা যায় না। কিন্তু তাও সুন্দরের মহিমা তাতে কিছুমাত্র ম্লান হয়ে যায় না।
--------------------------------------------------------------------------------------
তেঁতুল বৈরাগী; তার মানে তেঁতুলে বিরাগ বা অনীহা ওরকম কিন্তু নয়। আসলে এটি তাঁর নাম। পুরো নাম যদিও তেঁতুল চন্দ্র দাস বৈরাগ্য, তবে প্রচলিত ভাবে যেমন বন্দ্যোপাধ্যায় ছোট
হয়ে বাড়ুজ্যে হয়ে যায় আবার চট্টোপাধ্যায়কে সংক্ষেপে চাটুজ্যে ডাকা হয় তেমনি তিনিও নামে চন্দ্র আর সারনেমে দাস বিবর্জিত হয়ে কেবল তেঁতুল বৈরাগী হিসেবেই পরিচিত সকলের কাছে। ওনার আবার মিষ্টির দোকান, বাজারের পুরোনো মিষ্টি দোকান বলতে তেঁতুল বৈরাগীর। একেবারে সুবিখ্যাত মিষ্টান্ন ভান্ডার। ওনার স্পেশালিটি, বিশেষ করে রসগোল্লার ক্ষেত্রে ঐ তল্লাটে তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে না কেউই।
যেমন স্বাদ তেমন তুলতুলে। দামে কিন্তু বেশ ক্রয়সুলভ। ছোট বড় সকলেই তেঁতুলের রসগোল্লা বলতে ফিদা। তা যিনি এই তেঁতুল তত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত নন, মানে নতুন আনকোরা আর কি, সেই সমস্ত লোকের ক্ষেত্রে আবার একটু গোলমেলে।
যেমন সেবার ভোট করতে এসে, প্রিসাইডিং বাবুকে কোনোভাবেই মানানো যাচ্ছিল না যে তেঁতুলের রসগোল্লা কিভাবে অত মিষ্টি হতে পারে। প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনি অত সহজে মানবেন কেন! তেঁতুলে টারটারিক অ্যাসিড আছে, তাহলে তেঁতুলের রসগোল্লা টক না হয়ে মিষ্টি কি করে হতে পারে, এই যুক্তির সামনে গ্রামের বড় বড় এমনকি রাজনৈতিক দলের অনেক পোড় খাওয়া কেষ্ট বিষ্টুরাও হার মানতে বাধ্য হচ্ছিলেন। যাই হোক পরে অনেক কষ্টে স্বয়ং তেঁতুল বৈরাগী নিজে এসে মাস্টার মশাইকে তার বিখ্যাত রসগোল্লা খাওয়াতে পেরেছিলেন।
তেঁতুল বৈরাগী নিজেও এই সমস্যার সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিলেন। এফিডেফিট করে নাম বদলে ফেলার ব্যাপারে একবার মনস্থ করেও শেষপর্যন্ত পিছিয়ে এসেছিলেন কারণ তার দোকানের সামনে দিয়ে যত বাস যায় সকলেই তার দোকানটার সামনে এসে একবার করে দাঁড়ায়; রীতিমতো প্যাসেঞ্জার নামা ওঠাও করে।
তেঁতুলের মিষ্টি দোকান বলে হাঁক পাড়ে বাসের প্যাসেঞ্জার থেকে শুরু করে হেল্পার কন্ডাক্টর সবাই।
পুরোদস্তুর স্টপেজের মতো
এ হেন জীবন্ত কিংবদন্তি, তেঁতুল বাবু কিন্তু তাঁর এই নাম বিড়ম্বনার জন্যে সরাসরি এবং কোনোরকম রাখঢাক না করেই দায়ী করেন তার জন্মদাত্রী মা কে। তাঁর মা সরলা দেবী তেঁতুল খেতে খুব ভালোবাসতেন কিনা, তাই পাঁচ মেয়ের পর যেই তাঁর কোল আলো করে এই ছেলের জন্ম হলো তিনি আদর করে নাম রেখে দিলেন তেঁতুল বলে।
স্কুলে অঙ্কের মাস্টারমশাই ছিলেন ভীষণ বদরাগী। কিন্তু তেঁতুল যত ভুল করুক তিনি কোনো রাগ দেখাবেন না। উল্টে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে, কৌতুকের স্বরে বলতেন, তেঁতুল তুই বড্ড কাঁচা। আমার আবার পাকা তেঁতুল ভালো লাগে না একদম। কি বলবে, তেঁতুল হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো।
পঞ্চায়েত প্রধান, কোকিল বিশ্বাস একদিন তেঁতুল বৈরাগীর দোকানে বসে সে কি ফুটানি! রসগোল্লার রসে পাউরুটি চুবিয়ে খেতে খেতে, বল্লো- বুঝলে তেঁতুল দা সরকারের ঘরে তোমার নাম চলে গেল। প্ল্যান হয়ে গেছে, এখানে একটা বিশ্রামাগার তৈরি হবে। তার নাম রাখা হবে তেঁতুল বৈরাগীর মিষ্টি দোকান।
তেঁতুল বৈরাগী কি ভাবে কি জানে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তুমি প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে গেলে গো তেঁতুল দা। এরকম সৌভাগ্য কয়জনের হয়, বলো। দেশের মধ্যে একমাত্র নরেন্দ্র মোদী, যার নামে আমেদাবাদে- ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নাম রাখা হয়েছে। আর তুমি এইখানে।
তেঁতুল, তার মা গত হয়েছেন বছর খানিক হয়েছে। বেঁচে থাকলে নিশ্চিত খুশী হতেন।
প্রচ্ছদের ছবিটি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ক্যাম্পাসে থাকা এক প্রাচীন তেঁতুল গাছের। গুঁড়ি জুড়ে অনেকগুলো ছোট বড় কোটোর; ঝড়ে হেলে পড়া এই তেঁতুল গাছটির নীচে সিমেন্টের চাতাল ও বসার বেঞ্চ রয়েছে। তেঁতুল তলায় বসে রোদ পোহানোর আমেজ গ্রীষ্মের বিকেলে নুন মাখা কাঁচা তেঁতুল খাওয়ার থেকে কম তৃপ্তিদায়ক নয়।
--------------------------------------------------------------------------------------
রবীন্দ্রনাথের আঁকা এই প্রতিকৃতিটি ঠিক কার, এই নিয়ে শিল্পী স্বয়ং পরিস্কার করে কিছু বলেননি
ছবিটির নীচে, এক কোনায় শুধু লেখা 'রবীন্দ্র ১৯৩৮'।
মুগ্ধ হরিনীর মতো, বিদগ্ধ দৃষ্টি হেনে এই সপ্রতিভ মহিলাটি কে, এই নিয়ে অবশ্য কারোর মধ্যে কোনো মতানৈক্য নেই। তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবনে আসা অন্যতম প্রেরণাদাত্রী ললনা, আর্জেন্টিনিয় লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকেম্পো। রবীন্দ্রনাথের বিজয়া।
বর্তমানে এই ছবিটি সংরক্ষিত আছে, একদা রবীন্দ্র সচিব লেনার্ড এলমহার্স্ট প্রতিষ্ঠিত বহুমুখী লেখ্যাগার Dartington হলে। ইংল্যান্ডের ডেভনশায়ার অঞ্চলে অবস্থিত এই হলে রবীন্দ্রনাথ নিজে এসেছেন। পরিদর্শন করতে এসেছেন ভিক্টোরিয়া ওকেম্পো পর্যন্ত।
কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। যেটা বলার, সেটা হোল রবীন্দ্রনাথ এই ছবিটি কিন্তু বিজয়া কে সামনে বসিয়ে আঁকেন নি। এঁকেছিলেন সম্পুর্ন ভাবে মানসলোকে প্রবিষ্ট বিমূর্ত কল্পনার আলোয়। ছবিটিকে তাই বলা যায় রবীন্দ্র মানসে বিজয়া। কারণ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিজয়ার শেষ সাক্ষাৎ হয় ১৯৩০ সালে, প্যারিসে।
দীর্ঘ আট বছর বাদে ঠিক কোন তন্নিষ্ঠ উদ্দীপনে আবিষ্ট হয়ে বিজয়ার প্রতিকৃতি আঁকতে প্রবৃত্ত হলেন সেই গল্প অন্য আর একদিন হবে ।
ছবিটি, কেতকী কুশারী ডাইসন প্রণীত 'রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকেম্পোর সন্ধানে' শীর্ষক বইয়ের পাতায় প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে এবং তারপরে যথারীতি সর্বসমক্ষে আসে ছবিটি।
--------------------------------------------------------------------------------------
বিকেলের শ্রান্ত রোদ এসে পড়েছে পদ্ম পুকুরে। শত সহস্র - দীঘল, উতরোল পদ্ম পাতার ভিড়ে কিঞ্চিৎ মাত্র জলও দেখা যায় না। দীর্ঘকায় পদ্ম নল মুন্ডে কমলাভ শ্বেত পুন্ডরিক গুচ্ছ
কোথাও প্রস্ফুটোন্মুখ নিটোল কোরক আবার কোথাও অর্ধ বা পূর্ণ বিকশিত। পাঁপড়ি গুলো যেন পরম উল্লাসে, পরস্পর হাত ধরাধরি করে বৃত্তাকারে আপন বক্ষ সমূহকে, সাগ্রহে মেলে ধরেছে সুদূর আকাশের পানে। সুলম্ব কোরক দন্ড যেন সদ্য অভিষিক্ত রাজ দন্ডের ন্যায় ঋজু ও সটান উত্থানে পরম গৌরবান্বিত। তুলনায় বিকশিত পাঁপড়ি গুলো, রোদের ঘায়ে খানিক ম্রিয়মাণ।
আচ্ছা, অনেক কিছু কি বলে ফেললাম? তবে আর বেশি নয়। ছবিগুলোই বরং দেখা যাক।
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------
এক এন আর আই বাবা তার একমাত্র ছেলে, যে তখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, ভীষণ ব্রাইট কেরিয়ার তার সামনে; মাথায় হাত রেখে ছেলেকে বট গাছ হওয়ার পরামর্শ
দিচ্ছেন। "বট গাছ হও!"
বট গাছের মতো ছায়া ছড়িয়ে দাও। দিনান্তে, কারো কারোর ফিরে আসার ঠিকানা হয়ে ওঠো।
হঠাৎ কয়েকদিন আগে, বট গাছের ডালায় পালায় ধরে থাকা চেরি ফলের মতো লাল লাল বটফল দেখে মনে হোল সেই এন আর আই বাবা যেন মূর্ত হয়ে উঠেছেন বটগাছটার মধ্যে। যে তার শত সহস্র সন্তান বটফল গুলোর মধ্যে, আগামী দিনের বটগাছ হয়ে ওঠার স্বপ্ন পুরে দিচ্ছে।
বট গাছ হও।
ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------------
সমুদ্র,অরণ্যানী, গিরি, গুহা সুড়ঙ্গ ব্যপ্ত আলোক রশ্মী,
আমি আঁজলা পেতে পঞ্চামৃতের মতো
ধারন করতে চাই আমার জন্মান্ধ কণ্ঠ কলসে।
সাগরের সামনে অগস্ত্য মুনির মতো হাঁ মুখে
তাকিয়ে দেখবো সেই সুবিস্তৃত ফেনিল সুধা রাশি।
সাহিত্য কৃতির অভিসারী সঙ্গম, শিল্প সঙ্গীতের তীর ধরে
চুইয়ে পড়বে আতশ কাঁচের মধ্য দিয়ে, টুপ টুপ করে।
সম্ভোগের তুঙ্গ বিন্দু মুলে, জ্বলে উঠবে দীপ্ত হোমাগ্নি
হে কবি, তুমি নিরাশ করো না আমায়, হয়ো না কো উন্নাসী।
অকৃপণ দানে সদা উন্মুখ থাক তোমার পূর্ণ গ্রীবা কোশাকুশি!
একবার আসিস শ্সলক্ষণে,
রেল লাইন ধরে হাঁটবো
দুজনে!
দুইদিকে- দুই পারে! মাঝ খানে
সতী নদী শুয়ে রবে
নির্জনে!
ঢেউ যদি ওঠে মনের
গোপনে,
জল ছোঁব তবু বেনী ভেজাবোনে!
হাওয়া যদি ধায় দিগন্ত পানে
খোলা চুল ওড়ে আকুল নয়নে!
তর্জনী ছুঁয়ে থাক খাদের সিথানে
টলটলে পায়ে ভেসে ঊর্মি নাচনে!
খোলা বুকে পাল তুলে ব্যাকুল প্রানে
মুক্ত গ্রীবা তটিনী বক্ষ বিভাজনে!
সম্মতি চেয়ে চুমু সংগোপনে
ভাষা যাবে ভেসে বায়ে আর ডানে!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন