সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

'সখী, ভাবনা কাহারে বলে!'

ভাবনার বুকে আগুন জ্বলে সারাদিন রাবণের চিতার মতো! ভাবনার মুখে লেগে থাকে, বোকা বানানোর অমোঘ হাঁসি চোখের ইশারায় - ডুব দিয়ে মরার হাতছানি ভ্রু পল্লবে বিনিদ্র রজনী যাপনের রোমান্টিকতা ভাবনার কবলে পড়ার একটা আলাদা রোমাঞ্চ রয়েছে, যার মুখবন্ধে থাকে অপাপবিদ্ধ কৌমার্য হারানোর অ্যাডভেঞ্চারাস ঝুঁকি, আর উপসংহারে থাকে যাবজ্জীবন বন্দী থাকার কঠিন, নিষ্ঠুর নিয়তি যাকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য কারুর নেই

রবীন্দ্রনাথ যত সহজে, 'সখী, ভাবনা কাহারে বলে" 'লে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারেন, তত সহজে আম আদমি পারে না। ভাবনা অনেকটা, প্রথম পাতে পড়া স্যালাডের শসার মতো। সকলকে ভাবায়, কিন্তু নিজে ভাবার বেলায় একদম ভ্যাবাচ্যাকা, লবডঙ্কা। ভাবনা যদি বিষয় ভিত্তিক হয় তবে তার তল খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। কিন্তু ভাবনা যদি এলোমেলো হয়, হাইওয়ে দিয়ে, হুহু করে ছুটে যাওয়া বাসের জানালায় ভিড় করে আসা বাতাসের মতো - কখনো হালকা, কখনো রোদে পোড়া, কখনো বৃষ্টির ছাঁট বয়ে আনা, কখনো ধুলো ধোঁয়া মাখা কর্কশ আবার কখনো ফুড ফ্যাক্টরী থেকে ভেসে আসা বিস্কুটের গন্ধ মেশা সুমিষ্ট, তাহলে সেই ভাবনাগুলো বুকের ওপর জমে থাকা পাথরের মতো না হয়ে হরিলুটের বাতাসার মতো হয়ে যায়; কখনো তাকে কুড়োতে পারি আবার কখনো পারি না।

ভাবনা যখন সমস্যার মুক্তি খোঁজে, তখন ভাবনার দুয়ারে আবিষ্কারের জন্ম হতে দেখা যায়। রাজ আদেশে, আর্কিমিডিস, অলঙ্কারের খাদ খুঁজতে গিয়ে কখন যে মনের অজান্তে, জলভরা বাথটাবের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন; খেয়াল হলো উপচে পড়া জলের শব্দে। চেঁচিয়ে উঠলেন ইউরেকা বলে। খাদ খুঁজে বার করার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলেন প্লবতার কার্যকারণ, উদ্ভাবন করলেন তার নতুন সূত্র। ভাবনা এখানে জোড়া ফলা, এক কোপে দুটি প্রাপ্তি।

ভাবনা কখনো মূর্ত হয় না। তার ছায়া ছড়িয়ে থাকে সাহিত্যে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে। ভাবনার রূপায়ণ হয়, আর নিজে অলক্ষ্যে থেকে সকল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ভাবনা। অন্তর্নিহিত চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে যায়

ভাবুক ভাবেন; কখনো বিভিন্ন বিষয়ে আবার কখনো একটা বিষয়ে, গভীর ভাবনায় ডুবে থাকেন তিনি। ভাবুক আর ভাবনার মধ্যে অনেকটা প্রেমিক আর প্রেমিকার মতো সম্পর্ক। অহর্নিশ সেই ভাবনার সাগরে সাঁতরে যান ভাবুক প্রেমিক। অনেকটা চেন স্মোকারের ঠোঁটে জ্বলা সিগারেটের মতো। একটার পর একটা, বিরামহীন। সাগর শেষে তীরে ওঠার কোনোও ইচ্ছাই থাকে না।।

ভাবনার সঙ্গে ভাব হলে, তাকে ভাবুক বলে। কপট ভাবনার ছল আসলে, ভাবের ঘরে চুরি। আর বাস্তব পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবুক থাকেন ভাবের ঘোরে। ভাবনা ভাবার সুখে পেয়ে বসে তাকে। আদতে কি তা ভাবনার অসুখ!

পরিশেষে যেটা বলার সেটা হোল, ভাবনা যেন বোতল বন্দি শ্যাম্পেন। মুখ খুললেই ফেনিল ফোয়ারার উৎসার উঠে গিজগিজ করে। যেন তোপ মুক্ত গুলি। পিঞ্জর ছাড়া পাখির মতো ডানা মেলার আনন্দে ছুটে বেড়ায় এদিক ওদিক।

ভাবনা দুরকমের হয়। একটা পোষ্য, অনেকটা কুলবধূ টাইপ, আর দ্বিতীয় - বুনো; যাকে বিষয়ের নিগড়ে বাঁধতে পারা অনেকটা বাঘকে বৈঠকখানায় বেঁধে রাখার মতোই কষ্টসাধ্য। তবু তার মধ্যে ভাবনা, বাতাসে থাকা অক্সিজেনের মতোই আমাদের জীবনের বাঁচার রসদ জুগিয়ে যায় চিরকাল। কখনো কখনো ভাবনার ছেদ, বন্ধ হৃৎস্পন্দনের মতো জীবন সফরের খানিক বিরতি চিহ্ন হয়ে থেকে যায় মাত্র

তা যাক না!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...