সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পুরুলিয়া থেকে প্যালেস্টাইন!

হ্যাঁ তিনিই পারলেন। আবেগ কম্পিত উচ্চারণে, ভারত আত্মার - গোপন মনের কথা তিনি শুনিয়েই দিলেন।  বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিলেন সেই বার্তা, যা প্রতিটি ভারতীয়ের হৃদয়ে এক অপ্রকাশিত করুন সুরের মতো প্রতিনিয়ত বেজে চলে, তাকে বিব্রত করে; তবু সে আওয়াজ অস্ফুট থেকে যায়। ৬ই সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যায়, ভারত থেকে ৭০০০ কিলোমিটার দূরে, ইতালির জল নগরী ভেনিসের মাটিতে আয়োজিত ৮২ তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ২০২৫ এর মঞ্চে তখন তিনি পাদপ্রদীপের আলোয়। লাল পাড় সাদা শাড়িতে, তিনি পুরুলিয়ার নারায়নপুর গ্রামের মেয়ে। একান্তই এক স্বপ্নের পেছনে ধাওয়া করা, অদম্য উচ্ছলতায় বয়ে যাওয়া পাহাড়ী ঝর্নার মতো তাঁর ব্যক্তিত্বের ঝলক, উপস্থিত সকলকে তখন বাকরুদ্ধ করে ফেলেছে।


৮২ তম ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অনুপর্ণা রায়!

নামটা বলে না দিলেও, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন এই মেয়েটি সত্যিই তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তাঁর সাফল্যের ব্যাপ্তি দিয়ে। জীবনের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র, আর তাতেই একেবারে সৌরভ গাঙ্গুলির অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকানোর মতো জিতে নিয়েছেন সেরা পরিচালকের সম্মান। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের, Orizzonti (Horizon) বিভাগে এই প্রথম কোনো ভারতীয় এই পুরষ্কার জিতলেন। প্রসঙ্গত, ১৯৩২ সাল থেকে চলে আসা বিশ্বের প্রাচীনতম এই চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে, সর্বপ্রথম যে বাঙালী চিত্র পরিচালক তাঁর বিজয় কেতন উড়িয়েছিলেন, তিনি আর কেউ নন, সর্বকালের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী সত্যজিৎ রায়। ১৯৫৭'য়, তাঁর ছবি - 'অপরাজিত' সেবার, সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার স্বরূপ গোল্ডেন লায়ন জিতেছিল। এছাড়াও, ১৯৮২ তে, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষ সত্যজিৎ কে তাঁর বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে অমূল্য অবদানের স্বীকৃতি জানাতে, স্পেসাল গোল্ডেন লায়ন তুলে দিয়েছিল তাঁর হাতে। তারপরে কেটে গিয়েছে লম্বা সময়। প্রায় চার দশক অতিবাহিত হওয়ার পরে, আবার একবার বাঙালীর বিশ্বজয় সম্পন্ন হতে দেখা গেল ভেনিসে। এবারে ছবির নাম - Songs of Forgotten Trees. এক ঘন্টা ১৭ মিনিটের এই হিন্দি ছবিতে দুই ভিন্ন শহর থেকে আসা দুই মহিলার একই ছাদের তলায়, এক সাথে থাকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় কাহিনীর গতিপথ। ব্যস্ত শহরের আত্মদীর্ণ যাপনের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা তাদের সম্পর্কের গাঢ় গভীরতা, এমন সুন্দর সুললিত ভাবে কাহিনীর পরতে পরতে বোনা হয়েছে যে সম্মানীয় বিচারকেরা ছবিটির পরিচালক তথা চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে, পুরুলিয়ার অনুপর্ণা রায়ের হাতেই সেরার শিরোপাটি তুলে দেওয়ার কথা ভেবেছেন।

ছবিটির মূল দুই নারী চরিত্র, যথাক্রমে ফুটিয়ে তুলেছেন নাজ শেখ সুমি বাঘেল। এছাড়াও অভিনয় করেছেন প্রীতম পিলানিয়া, লাভলি সিং রা। প্রখ্যাত প্রোডিউসার অনুরাগ কাশ্যপ এই ছবির অন্যতম প্রযোজক। কিন্তু এই সব তথ্যের চর্বিত চর্বন কিংবা মুম্বাই এর আজাদ নগর অঞ্চলের যে ভাড়া বাড়িতে অনুপর্ণা ছিলেন (২০২২ থেকে) সেই বাড়িতেই ছবির পুরো ইনডোর শুটিং করেছেন বা তিনি মুম্বাই আসার পূর্বে দিল্লির নয়ডায়, আই টি সেক্টরে চাকরি করতেন বা তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছেয় বিন্দুমাত্র সায় ছিল না তার বাবা মায়ের এই সব বহু চর্চিত টপিক নিয়ে আজকের নিবন্ধ ভরানোর কোনো ইচ্ছা নেই আমার।

মানছি, অনুপর্ণা চিত্রনাট্য লিখেছেন। মানছি তিনি দিল্লিতে মাস কমিউনিকেশন সাংবাদিকতা নিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে পড়াশুনাও করেছেন। কিন্তু তিনি কবিতা লিখেছেন কিনা জানি না। কিন্তু ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তাঁর কথিত বক্তৃতা যে রীতিমতো কবিতা হয়ে যাবে তা বোধহয় তিনি নিজেও ভাবেন নি।

সেই কবিতার প্রথম লাইন ছিল -

এই মুহূর্তটি একটি পরাবাস্তব মুহূর্ত।

The moment is surreal.

আবেগে জড়িয়ে আসে তাঁর কন্ঠস্বর। কাঁপা কাঁপা গলায়, সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্দেশ্যে জ্ঞাপন করেন তাঁর বিনম্র ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা

ভোলেননি পুরুলিয়ার কথাও। প্রিয় গ্রামবাসী তথা দেশবাসীর উদ্দেশ্যেই নিবেদন করেন তাঁর পুরষ্কার প্রাপ্তির সাফল্যকে।

এরপরেই আসে সেই সুররিয়াল কাব্যিক পাঞ্চ

I know, I am shaking..

আমি জানি, আমি কাঁপছি।

কিন্তু সেই কাঁপন যে এমনভাবে সঞ্চারিত হবে, তা কে জানতো!

প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত শ্রোতৃমন্ডলী শুধু নয়, ইথার তরঙ্গে যেখানে যেখানে তাঁর এই অকপট সোচ্চার কাব্যকথা পৌঁছে যাবে সেখানে সেখানেই সেই কাঁপনের অনুভব অনুভূত হবে তীব্র ভাবে।

হ্যাঁ এমনটাই সুদূরপ্রসারী সে ঝাঁকুনির প্রভাব।

তিনি বলে চলেন -

সম্মানীয় দর্শক, আমি এখন প্যালেস্টাইনে ঘটে চলা, ভয়ঙ্কর সেই ধ্বংসলীলার কথা স্মরণ করাতে চাই আপনাদেরকে।

কারন, এই পৃথিবীর সকল শিশুরই স্বাধীন নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। প্যালেস্টাইনের শিশুরাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাঙালী মেয়ে অনুপর্ণার মনে, নিশ্চিত ভাবে তখন গুঞ্জরিত হচ্ছিল কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা সেই অবিস্মরণীয় পঙক্তিমালা। নিষ্পাপ শৈশব রক্ষায়, জীবনকে বাজি রেখে লড়াই করার, এমন মুখর প্রণোদনা আর কোথায়!  
“প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল।
 এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি -
 নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।"

হাততালিতে ফেটে পড়ে হল।

সকলকে সতর্ক করে বলেন, এটা করতালি দেওয়ার বিষয় নয়।

নিরীহ প্যালেস্টিনিয়ানদের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের আশু কর্তব্য।

হয়তো এতে বিব্রত হবে আমার দেশ, কিন্তু আমি এই নিয়ে আর বিচলিত বোধ করি না।

হ্যাঁ এক বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হলো। ভেনিসের আন্তর্জাতিক মঞ্চে, শেষমেশ জুড়ে গেল পুরুলিয়া আর প্যালেস্টাইন।

কুর্ণিশ জানাই তাঁকে; বিজয়ের আনন্দেও তিনি অত্যাচারের লাঞ্ছনার কথা ভুলে যাননি!  



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...