১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে। বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যায় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট।
এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ্ঞের অন্যতম প্রধান পুরোহিত, যিনি মুক্তিপিপাসু দেশবাসীর মুখে ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’র মতো অগ্নি স্পর্শী শপথ মন্ত্র জুগিয়েছিলেন, যিনি গগনভেদী হুঙ্কারে ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ বলে পরাধীন দেশবাসীর নেতিয়ে পড়া চেতনায় প্রতিস্পর্ধার শক্ত দেওয়াল খাড়া করেছিলেন, সেই মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী কোথায় ছিলেন, কোথায় ছিলেন তিনি এই মহা সমারোহ কালে? আসলে তিনি তখন দিল্লিতেই ছিলেন না।
দিল্লি থেকে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে - কোলকাতায়, বেলেঘাটার মিয়াঁবাগান অঞ্চলে অবস্থিত একটি জীর্ণ পোড়ো বাড়িতে ছিলেন, উপবাস রত। ১৫০/বি ঠিকানার সেই বাড়ি ‘হায়দরি মঞ্জিল’ এ সারাদিন উপবাসের ক্লেশ আর প্রার্থনা করেই কাটিয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের পিতামহ ভীষ্ম, মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী। কিন্তু কেন? তিনি কি খুশি ছিলেন না নাকি কোনোভাবে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন দেশ ভাগের বিড়ম্বনা ক্লিষ্ট স্বাধীনতা লাভের সেই মহা আড়ম্বর থেকে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গান্ধীজীর সেবার বাংলায় আসার তারিখটি খুবই লক্ষণীয়। কারণ দিনটি ছিল, ৯ই আগস্ট, অর্থাৎ স্বাধীনতার ঠিক ছয় দিন আগে। গান্ধীজী তাঁর কয়েকজন অনুগামীকে নিয়ে প্রথমে, সোদপুরে এসে পৌঁছান। উদ্দেশ্য ছিল দাঙ্গা বিধ্বস্ত, অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখালী তে যাওয়ার। কিন্তু নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাংলার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দ্দী তাঁকে নোয়াখালী যাওয়া থেকে বিরত করেন। তখন তিনি কোলকাতায় আসার কথা মনস্থ করেন এবং সুরাবর্দ্দীকে কোলকাতার কোনো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে থাকার বন্দোবস্ত করতে বলেন। পাশাপাশি তাঁর কোলকাতায় অবস্থান কালে, সুরাবর্দ্দীকে তাঁর সঙ্গে থাকার জন্যও বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেন। প্রসঙ্গত সুরাবর্দ্দী তাতে সম্মতও হন। কিন্তু যে প্রশ্নটি অনুচ্চারিত থেকে যায় সেটা গান্ধীজীর কোলকাতায় আসার কথিত সময় নির্বাচন নিয়ে। কারণ আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৫ই আগস্ট তারিখটিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল অনেক দিন আগে থেকেই। কিন্তু কি এমন কারন হোল যার জন্যে তিনি ১৫ তারিখের মাত্র ছয় দিন আগে, স্বাধীনতার মূল উৎসব স্থল দিল্লি পরিত্যাগ করে চলে এলেন সুদূর বাংলাতে। তাহলে কি স্বাধীনতার আনন্দে যে দেশ ভাগের যন্ত্রণা মিশে ছিল তা গান্ধীজী কে মনে মনে ব্যথিত করে তুলেছিল? তাঁর কাছে এই স্বাধীনতা কি অঙ্গচ্ছেদের শর্তে জীবন লাভের সমতুল ছিল? যে কারণে তিনি নিজেকে আলাদা রাখতে চেয়েছিলেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাওয়া দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির মেকি আনন্দ থেকে? যে কারণে তিনি স্বাধীনতার আগের দিন, ১৪ ই আগস্ট এর সন্ধ্যায় এক প্রার্থনা সভায় ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর মনের দ্বিধা জর্জর অবস্থার কথা, “আগামী কাল হর্ষ ও বিষাদের দিন। কারণ স্বাধীনতা যেমন আসছে তেমনি দেশ ও দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে।" যদিও ইতিহাসের পাতায় এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত থাকে ওই সময়কার দেশভাগের করুন পরিনতি ও সেই কারণে সারা দেশের বিশেষ করে বাংলা এবং পাঞ্জাবের রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষের সাম্প্রদায়িক লাঞ্ছনায়। দেশভাগের ফলে দুই দেশের হিন্দু ও মুসলিম দুই জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল সাম্প্রদায়িক হিংসা। যার কবলে পড়ে নোয়াখালী থেকে কোলকাতা – বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছিল হানাহানি ও রক্ত ক্ষয়। গান্ধীজী এসেছিলেন দুই দেশেরই হিংসা উন্মত্ত মানুষের কাছে শান্তির আর্জি জানাতে। স্বাধীনতা উৎসবের আনন্দে যোগ দেওয়ার চেয়ে তাঁর কাছে সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ করাটাই ছিল বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এবং তিনি এই কাজে সফল ও হয়েছিলেন দারুন ভাবে। সমর্থ হয়েছিলেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রাজ্যপাল চক্রবর্তী রাজা গোপালচারী, গান্ধীজীর এই সফলতাকে ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা মিরাকেল’ বলে অভিহিত করেছিলেন। অভূতপূর্ব সম্মান জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ভারতের শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ২৬ শে আগস্টে লেখা তাঁর চিঠিতে গান্ধীজীকে ‘সীমান্তের একা এক প্রহরী’ বলে অভিহিত করে বলেছিলেন, পাঞ্জাবে পঞ্চান্ন হাজার সৈন্য দিয়েও যা তিনি করতে পারেন নি, গান্ধী একা তা করতে পেরেছেন। সমর্থ হয়েছেন শান্তি ফেরাতে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো গান্ধীজীর ৯ ই আগস্ট তারিখে বাংলায় আসাটা ছিল তাঁর ৬৪ তম বাংলায় আগমন। বলাই বাহুল্য, পরের বছর জানুয়ারি মাসের ৩০ তারিখে নাথুরাম গডসের গুলিতে তাঁর মৃত্যুর পূর্বে এটাই ছিল গান্ধীজীর শেষ বাংলা সফর। শেষ সফর যদিও মোটেই সুখকর ছিল না গান্ধীজীর জন্য। এর প্রধান কারণ ছিল তিনি বেলেঘাটার যে অঞ্চলে থাকবেন বলে ঠিক করলেন সেটি দাঙ্গা পীড়িত হলেও মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যাধিক্য থাকার কারণে বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যে বাড়িটিতে তাঁর থাকার বন্দোবস্ত হোল সেই হায়দরি মঞ্জিল এর মালিকানা ছিল সুরাট থেকে আসা দাউদি বোহরা সম্প্রদায়ের জনৈকা হোসেইনা বাঙালী নামের মুসলিম মহিলার কাছে। যিনি উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর বাবা শেখ আদমের কাছ থেকে এই সম্পত্তিটির মালিক হন। দি টেলিগ্রাফ এর একটি রিপোর্ট অনুসারে মিসেস হোসেইনা বাঙালী, কারোর কারোর মতে হায়দারি বাঙালীর নামেই এই বাড়ির নামকরণ হয় হায়দরি মঞ্জিল। আর মুলত এই মুসলিম সংযোগের কারণেই হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল গান্ধীজীকে। এমনকি যেদিন তিনি বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিল এ পা দিলেন সেই ১৩ ই আগস্ট এর দিন তাঁকে দেখানো হয়েছিল কালো পতাকা। দেওয়া হয়েছিল বিরুদ্ধ শ্লোগান।
যাই হোক, সুরাবর্দ্দীর নির্দেশে আট কক্ষ বিশিষ্ট সেই হায়দির মঞ্জিল এর একটি ঘরকে ঝাড় পোঁছ করে পরিষ্কার করা হয়েছিল গান্ধীজী থাকবেন বলে। গান্ধীজী ১৩ ই আগস্ট থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর প্রায় ২৫ দিন ছিলেন হায়দরি মঞ্জিলএ। আগস্ট মাসের শেষের দিকে কোলকাতা শহরে দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়লে, ১লা সেপ্টেম্বর এর দিন গান্ধীজী আমরন অনশনে বসেন। ৭৩ ঘণ্টা ধরে এই অনশন করেছিলেন গান্ধীজী। একমাত্র দাঙ্গা কারীরা তাঁদের অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে গান্ধীজীর কাছে এসে আত্মসমর্পণ করলে এবং যুযুধান দুই সম্প্রদায়ের একাধিক নেতা দাঙ্গা বন্ধের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিলে ৪ ঠা সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি অনশন ভঙ্গ করেন।
বর্তমানে বাড়িটিকে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার হেরিটেজ বাড়ির মর্যাদা দিয়েছে। যদিও পরিত্যক্ত এই বাড়িটিকে সরকারি ভাবে প্রথম সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৮৫ সালে। তখন কেন্দ্রে জনতা দলের সরকার এবং রাজ্যে বামেদের। সেই সময় বাড়িটিকে সরকার অধিগ্রহণ করতে চাইলেও বাড়ির মালিকানা নিয়ে কিছু সমস্যার কারণে সম্ভব হয় নি। তবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পূর্ব কোলকাতার গান্ধী স্মারক সমিতির ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং বাড়িটির নাম রাখা হয় মহাত্মা গান্ধী জাতীয় স্মারক ভবন। এর পরে অনেক দিন তেমন বিশেষ কিছু হয়নি। ২০০৪ সালে গান্ধীজীর পৌত্র গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়ে এলে প্রধানত তাঁর উদ্যোগেই ২০০৭ সালের ১৫ আগস্টের দিন একটি প্রদর্শশালা উন্মোচিত হয় বাড়িটিতে। এর পরে নতুন করে আবার সরকারি ভাবে উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয় ২০১৮ সালে। ওই বছরই ২ রা অক্টোবর বাড়িটিকে হেরিটেজ বাড়ি ঘোষণা করা হয় এবং সমস্ত জটিলতা কাটিয়ে সরকার বাড়িটিকে অধিগ্রহণ করতে সমর্থ হয়। পরের বছর ২০১৯ এর ২ রা অক্টোবর, গান্ধী জন্ম জয়ন্তীর দিনেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ বাড়িটিতে একটি অত্যাধুনিক মিউজিয়াম উদ্বোধন করে। গান্ধীজীর স্মৃতি সম্বলিত বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ সহ বিভিন্ন দুর্লভ ছবি, চিঠি ও বিশেষ করে যে ঘরটিতে গান্ধীজী থাকতেন সেখানে গান্ধীজীর খড়ম সমেত তিন জোড়া জুতো, তাঁর বিছানা, বালিশ, চরকা, যে গেলাসে করে ফলের রস খেয়ে অনশন ভঙ্গ করেছিলেন সেই গেলাসটিও সংরক্ষিত রয়েছে। বিছানার মাথায় রাখা আছে সে সময়ের একটি হ্যারিকেন ও। ২০১৯ সাল থেকে গান্ধীজীর স্মৃতি সম্বলিত মিউজিয়াম টি জনগনের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে, যা বর্তমানে গান্ধী ভবন হিসেবে পরিচিত। সোম থেকে শনি, সকাল ১০ থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত গান্ধী ভবনে সাধারন মানুষ ঘুরে দেখতে পারেন। তবে বাড়ির ভেতরে কোনোরকম ছবি নেওয়া নিষেধ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন