১৯৩৯ এ শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। কোলকাতা শহরে তখন হামেশাই ব্ল্যাক আউট হচ্ছে জাপানী বোমারু বিমানের হাত থেকে বাঁচতে। কিন্তু কোলকাতার মানুষকে সেদিন নামতেই হবে রাস্তায়। একদিকে বিশ্বযুদ্ধের ভ্রূকুটি অন্যদিকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ধারায় প্যাচপ্যাচে পথঘাট – কিন্তু এ সব কিছুকে উপেক্ষা করেই সেদিন লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল রাস্তায়। যেন ঠাকুর বিসর্জনের কাতার নেমেছে পথে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মাথা, এক ঝোঁকে হেঁটে চলেছে গঙ্গার ঘাটের দিকে। ঠাকুরই বিসর্জন দিতে যাচ্ছিল কোলকাতার মানুষ সেদিন। কারণ তারিখ টা ছিল ৭ই আগস্ট, ১৯৪১ সাল, যে তারিখটি কালের আধারে ২২ শে শ্রাবণ হিসেবে চির স্মরনীয় হয়ে আছে এক অমোঘ মহাপ্রস্থান কালের স্মৃতি চিহ্ন হয়ে। কারণ ওই দিন, দুপুর ১২ টা ১০ মিনিটে প্রয়াত হয়েছেন স্বয়ং ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ। আর যে কারণে তৈরি হয়েছে ঠাকুর বিসর্জনের এই অকাল মহরৎ।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ কবি দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর প্রস্টেট গ্রন্থির সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে, ২৫ শে জুলাই - চিকিৎসার অসুবিধার কারণে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় শান্তিনিকেতন ছেড়ে জোড়াসাঁকোর জন্মভিটেতে ফিরে এসেছেন। উদ্দেশ্য, কোলকাতায় প্রস্টেট গ্রন্থির অস্ত্রোপচার করানো। শান্তিনিকেতনে তাঁর প্রিয় বাসভবন উদয়ন ছেড়ে ২৫ শে জুলাই, শুক্রবার অপরাহ্নে বোলপুর থেকে রেলের এক বিশেষ কোচে করে তিনি পাড়ি দেন জোড়াসাঁকোর পৈত্রিক ভিটের উদ্দেশ্যে।
সেই শেষ। তারপরে - আর তাঁর শান্তিনিকেতনে ফেরা হয়নি। আর এবারে তাঁর নিজের জন্ম এবং বেড়ে ওঠার সেই স্বর্ণ চারণক্ষেত্র থেকেও চিরকালের মত বিদায় নিতে হোল সুসজ্জিত পালঙ্কে শায়িত হয়ে । পালঙ্কের ওপরে পাতানো হয়েছিল সোনালী বুটি দেওয়া সুদৃশ্য চাদর। ছড়ানো হয়েছিল বেল, জুঁই, রজনীগন্ধা ও শ্বেত পদ্ম সমেত সুললিত, শুভ্র ও সুশোভন পুষ্প সম্ভার। প্রসঙ্গত, প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু ছিলেন কবির এই অন্তিম শয্যা সাজানোর দায়িত্বে। গরদের সাদা পাঞ্জাবী এবং সাদা বেনারসীর ধুতি পরিয়ে কবিকে শোয়ানো হয়েছিল তাঁর অন্তিম শয়ানে। ঠাকুর বাড়ির নিয়ম অনুসারে মৃত্যুর সময় ধরে মৃতদেহ বার করা পর্যন্ত কখনোই যেন তা তিন কাল অতিক্রম না করে। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহকে বিকেলের মধ্যেই বের করে নিয়ে যেতে হত। তাই হাতে বিশেষ সময় ছিল না। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো সেই সময়ে বড় কোনো ইভেন্টের আজকের মত প্রতি মুহূর্তের আঁখো দেখা হাল রেডিও বা টিভি থেকে সম্প্রচারের কোনো ব্যবস্থা তো দূর অস্ত ভাবনাই ছিল না। এর মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মৃতদেহ বের করে নিয়ে যাওয়ার তাড়া। সাত তাড়াতাড়ি তাই দোতলার ঘরে কবিকে শেষ বারের মত স্নান করানোর পালা চলছিল জোরকদমে।
হঠাৎই বেখাপ্পা মানুষের ভিড় ঢুকে পড়লো সেখানে।
মেন গেটের ওপর হামলে পড়া উৎসাহী মানুষের চাপে
ভেঙে পড়েছিল গেট, তারপরেই লাগামছাড়া মানুষ নির্লজ্জ ভাবে ঢুকে পড়লো মৃত
কবির শেষবেলার সেই নিভৃত স্নানের সময়েও। এখন প্রশ্ন এত কম সময়ের মধ্যে কবির এই মৃত্যুর
খবর মানুষের কান অব্দি পৌঁছল কি করে। এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে আকাশবানী
কোলকাতা কেন্দ্রের তরফ থেকে নেওয়া এক বিশেষ ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মধ্যে। প্রসঙ্গত,
এই সিদ্ধান্তের পেছনে যার অবদান সব থেকে বেশী তিনি হলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু
কি ছিল সেই সিদ্ধান্ত? এবং কিভাবেই বা তা জনমানসে এমন বাঁধনহারা আবেগের সঞ্চার করেছিল? এটা জানতে
গেলে একটু প্রেক্ষাপট দেখে নেওয়া দরকার। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক ৩০ শে জুলাই, কোলকাতায় কবির
অস্তোপচার হয়, তবে জেনারেল নয় লোকাল এনাস্থেসিয়া দিয়ে। অস্ত্রোপচার সফল ভাবে সম্পন্ন হলেও নিয়তি নির্দিষ্ট
পরিনতি কে আটকানোর সাধ্য বোধহয় কাররই ছিল না। তাই অস্ত্রোপচারের পরের দিন থেকেই কবির
শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। কথা বার্তা বন্ধ হয়ে যায়। গভীর আচ্ছন্নতায়
প্রায় অসাড়ত্ব প্রাপ্তির দিকে অগ্রসর হয় কবির সামগ্রিক চেতনা। মৃত্যুর আগের দিন
রাত থেকে বাড়ির লোকেরা বিশেষ করে পুত্রবধু প্রতীমা দেবী বুঝতে পারছিলেন শেষের সে
দিন সমাগত প্রায়। পরের দিন সাতসকালে
মুমূর্ষু কবিকে দেখতে এলেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় ও ডাক্তার ললিত
বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরাও বিশেষ আশার কিছু দেখতে পেলেন না। আশার রবি যেন ক্রমশই
স্তিমিত হয়ে আসছিল। খবর পৌঁছল বেতার কেন্দ্রে। সম্প্রচারিত হোল সে খবর।
সম্প্রচারিত হওয়ার মতোই খবর।
কিন্তু একবারের খবরে ব্যাপারটা থেমে গেল না। আম জনতাকে প্রতি মুহূর্তে কবির
শারীরিক অবস্থার খবর দিতে প্রতি ১৫ মিনিত অন্তর কবির স্বাস্থ্য সংক্রান্ত স্পেশাল বুলেটিন
সম্প্রচারিত হতে লাগলো বেতার কেন্দ্র থেকে। রবির ক্রমশ নিঃশেষিত হয়ে আসা আলোয়
ভারাক্রান্ত আম বাঙালীর মধ্যে প্রবল আগ্রহ তৈরি হোল। উদগ্রীব জনতার কাছে শেষ পর্যন্ত - দুপুর ১২ টা ১০
মিনিটে এল কবির শেষ নিশ্বাস ফেলার সংবাদ। অনেকটা তৈরিই ছিলেন মানুষ। তাই খবর পাওয়া
মাত্র জনগনের ভিড় আছড়ে পড়তে বিশেষ সময় লাগে নি। প্রসঙ্গত কবির প্রয়ান সংবাদ
প্রচারিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ঠিক করলেন কবির অন্তিম যাত্রার
ধারাবিবরনী দেবেন তিনি। উল্লেখ্য তাঁরই
নেওয়া পরিকল্পনা অনুসারে সেই প্রথম শুরু হোল কোনো বিশেষ ব্যক্তির অন্তিম
যাত্রার ধারাবিবরনী দেওয়ার। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ তাঁর জলদ মন্দ্র কণ্ঠে, বেতার সেটে
কান পেতে থাকা অসংখ্য মানুষকে শোনাতে লাগলেন রবির অস্তাচলে যাত্রার আবেগ সিক্ত
কাহিনী, “দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী
সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান
অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হল এক মহপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল
অস্তাচলে...।”
পাগলের মত ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়লো মানুষ। পালঙ্কে শায়িত কবির নিথর দেহ যেন জন
প্লাবনে ভেসে যেতে লাগলো নিমতলা ঘাটের দিকে।
রাস্তার দু পাশে - বাড়ির ছাদ, বারান্দা থেকে বৃষ্টির মত ঘন ঘন ঝরে পড়তে
লাগলো শুভ্র পুষ্প চূর্ণ। অজস্র ফুলের স্তবক ও মালায় চাপা পড়ে যেতে লাগলো কবির শরীর। মুখটাকেই কোনো রকম দেখা যাচ্ছিল, উপর থেকে। অসংখ্য মানুষ যারা পাশাপাশি হাঁটছিল তাদের দেখা যাচ্ছিল তাল পাতার পাখা দিয়ে কবিগুরুর শরীরে ক্লান্তিহীন হাত নেড়ে নেড়ে পাখা করে যেতে। অরোরা ফিল্ম কোম্পানির তোলা সেই বিরল তথ্য চিত্র যা
ইন্টারনেটে সহজেই সার্চ করে দেখে নেওয়া যায়, দেখলে বোঝা যাবে সেদিনকার কবির অন্তিম
যাত্রায় অংশগ্রহণকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের উত্তাল করা আবেগের ঢেউ কতটা নিখাদ এবং
গভীর ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো কবির অন্তিম যাত্রায় এমন স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের ঢল
বোধহয় আর কোথাও দেখা যায় নি।
ছবি - আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন