কবিগুরুর অন্তিম যাত্রার সেদিনকার সে অলৌকিক ভিড়কে সশরীরে উপস্থিত থেকে চাক্ষুষ করেছিলেন সেসময়ের অনেক কৃতবিদ্য ব্যক্তিই। কেউ কেউ আবার ব্যস্ত ছিলেন বেতার কেন্দ্রের বিশেষ শোক জ্ঞাপনী অনুষ্ঠানে। আবার কেউ তা অবলোকন করেছিলেন রাস্তার পাশের বাড়ির ছাদ থেকে। কবির অমৃত লোকে যাত্রার সেই অমূল্য ক্ষণের কিছু খণ্ড চিত্র নিয়েই এই প্রতিবেদন।
বিশিষ্ট সম্পাদক সজনী কান্ত দাস ছিলেন অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তি- যিনি সেদিন সশরীরে উপস্থিত ছিলেন কবির অন্তিম শোভাযাত্রায়। সেই সুবাদে তাঁর ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যাতে বেশ রসমিশ্রিত টিপ্পনী করেছিলেন সেদিনকার সে ক্রেজি ভিড়ের সম্পর্কে বলতে গিয়ে, “সেদিন এত ভিড়ে বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব মৌলভি ফজলুক হক, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, শরৎচন্দ্র বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়রা ভিড়ের মধ্যে মিশে বত্রিশ ভাজার মতো হয়ে গেছিলেন। তবে বাকী আমজনতার কথা না বলাই ভালো।"বীভৎস ভিড়ের চাপে অসুস্থ হয়ে মাঝ পথেই বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ। ফলে তাঁর পক্ষে আর পিতার মুখাগ্নি করা সম্ভব হয় নি। মুখাগ্নি করেছিলেন কবির ভ্রাতুষ্পুত্র সৌরিন্দ্রনাথ।
কিন্তু এইরকম এক ভয়ঙ্কর, পরাক্রমী ভিড়ে ঠাসা শোক যাত্রায়, শুনলে অবাক হবেন উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের আকাশে যার সুনীল দীপ্তি সবাইকে আচ্ছন্ন করে রাখবে আগামী কয়েক দশক ধরে সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও। আরও অনেকেই ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বয়স সুনীলের মত এত ছোট ছিল না। মাত্র সাত বছর বয়স তখন সুনীলের। ক্লাস টু- য়ের ছাত্র তিনি। সুনীল তখন রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেনও না। সুনীল তাঁর আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ এ সে কথা লিখেছেন সবিস্তারে। “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে? তিনি বিশ্বকবি। বিশ্বকবি - মানে কে? জানি না।“
রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে তখন তাঁর ধারনা বলতে স্কুলের বইতে পড়া ‘আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।‘র লেখক হিসেবে। বাকি - স্কুলের বার্ষিক পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে সকলে বিশ্বকবি বলে অভিহিত করছে এই পর্যন্তই ছিল তার রবীন্দ্র পরিচিতির দৌড়। এমনকি তাঁর বাড়িতেও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে কোনো আলোচনা হতে শোনেন নি তিনি। এ হেন সুনীল কোনো বিশেষ আগ্রহ ছাড়াই সহপাঠীদের সাথে রবীন্দ্রনাথের অন্তিম শোভাযাত্রা দেখতে বিবেকানন্দ রোডস্থ এক বন্ধুর আত্মীয়ের বাড়ির ছাদে উঠে পড়েছিলেন। কি দেখেছিলেন, শোনা যাক সুনীলের নিজের ভাষায়। “রাস্তায় সব বাড়িরই ছাদ এবং বারান্দা মানুষে মানুষে ছয়লাপ। বেশ কিছুক্ষণ প্রতীক্ষার পর দেখা গেল, সমুদ্রের ঢেউয়ের মত এগিয়ে আসছে মানুষ। একটা খাট শুধু ফুলে ভরা, সেটা যেন জনতার মাথার ওপর দিয়ে দুলতে দুলতে চলে যাচ্ছে। সব বাড়ি থেকে আরও ফুল ছোড়া হচ্ছে সেই খাট লক্ষ করে।" কিন্তু এ ছিল বালক সুনীলের চোখে দেখা বিশ্বকবির অন্তিম শোভাযাত্রার ছবি।
১৮৯৯ এ জন্ম নেওয়া,
৪২ বছররের - কবি নজরুল তখন একান্তই সৃষ্টির
মধ্যগগনে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদে এতটাই শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন যে
নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারেন নি নিজের আহত আবেগকে। মুক্তি খুজেছিলেন কবিতার অশ্রুজল
মাখা লেখনীর মধ্যে।
‘দুপুরের
রবি ঢলে পড়ছে অস্তপারের কোলে’ এর
মত শোক সিক্ত লাইন লিখেও তৃপ্ত হতে পারেন নি। থামিয়ে রাখতে পারেন নি তাঁর শোক সন্তপ্ত লেখনীকে। লিখে ফেলেছিলেন সেই অমর,
আইকনিক রবীন্দ্র স্মরণ সঙ্গীত –
“ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে/ জাগাও না জাগাও
না”।
কিন্তু দিনের সবথেকে বড় ঘটনাটি ঘটলো এর পরে। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের উদ্যোগে কবি নজরুল এলেন আকাশবানীর কোলকাতা কেন্দ্রে। বেতার কেন্দ্রের মাইকে তাঁর আবেগকম্পিত কণ্ঠে শোনা গেল সেই করুন আর্তি, “ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে...।“ ইথার তরঙ্গে ভেসে গেল কবির সেই শোক আর্দ্র মরমী বারতা।
কিন্তু দিনের সবথেকে বড় ঘটনাটি ঘটলো এর পরে। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের উদ্যোগে কবি নজরুল এলেন আকাশবানীর কোলকাতা কেন্দ্রে। বেতার কেন্দ্রের মাইকে তাঁর আবেগকম্পিত কণ্ঠে শোনা গেল সেই করুন আর্তি, “ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে...।“ ইথার তরঙ্গে ভেসে গেল কবির সেই শোক আর্দ্র মরমী বারতা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন