সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন প্রায় ১০ বছরের বেশী। সশরীরে তাঁকে আর কোনোদিনই দেখা সম্ভব নয় এই পৃথিবীতে, এ কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ইনি কে, যাকে আমি এখন দেখছি! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনো যমজ ভাই টাই নয় তো। নাকি লেখকের কোনো ড্যামি – যিনি সবার অলক্ষে নরেন্দ্রপুরের কোনো এক অখ্যাত গলিপথ ধরে শ্রাবণের এই মেঘলা অপরাহ্ণে, হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। অবিকল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সেই সামনের দিকে ঈষৎ কাঁধ ঝুঁকিয়ে হেঁটে যাওয়া,
সরলতা পূর্ণ – মঙ্গোলীয় মুখাবয়ব, চওড়া কপাল, ব্যাক ব্রাশ করা চুল, চশমার আড়ালে এক
জোড়া সেই সুনীলীয় বিদগ্ধ চোখ, সুনীলের মতই প্যান্টের ওপর ছেড়ে পরা - সাদা হাফ
শার্ট, বোতাম খোলা বুক, এবং আরো আশ্চর্যের সেই এক আগ মার্কা শান্তিনিকেতনী ঝোলা, যেটা
তাঁর বাঁ কাঁধ থেকে নেমে হাঁটুর নীচ অব্দি ঝুলছে, সর্বোপরি একই ঢঙে বন্ধ ব্যাগের
মুখে উপুড় করে রাখা তাঁর হাত। যা দেখে যুগপৎ বিস্মিত এবং আহ্লাদিত না হয়ে পারি না; যেন কোনো স্বপ্ন
সত্যি হওয়া মুহূর্তের মুখোমুখি আমি, তাও কেমন ভূত দেখার মত হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করার
আগেই আড় চোখে তিনি একবার আমার দিকে তাকিয়েই পাশ দিয়ে চলে যান। যেতে যেতে শুধু তাঁর ঠোঁটের
কোণে লক্ষ করি এক টুকরো সুনীল-সুলভ হাঁসির ঝিলিক, যেন আমার লুকিয়ে চুরিয়ে টুক টাক
কবিতা লেখার গল্প উনার অজানা নয়। কিন্তু আমার সযত্নে লালিত গোপন প্রেমকে তিনি কোনো
ভাবে ধরে ফেলে তাকে ছোট করতে চান না; চান না মুগ্ধতার আবরণকে অনাবৃত করে দিতে। তাই
সব জেনেও তিনি যেন অনেকটা সেই শিক্ষকের মতন যিনি ছাত্রের সিগারেট খাওয়া দেখেও না
দেখার ভাণ করেন, সেইরকম নিবৃত্ত ভঙ্গীতে চলে যান আমার সামনে দিয়ে। সেবার, সেই পর্যন্তই।
অনেক
দিন পর এক সাধারন ধর্মঘটের দিন, শিয়ালদহ যাওয়ার পথে, সকাল ৮ টা ৫০ এর আপ ক্যানিং
লোকালে আবার আমরা মুখোমুখি হয়ে পড়ি। ঘটনাচক্রে, তিনি নরেন্দ্রপুর স্টেশনে ট্রেনে উঠে, আমার ঠিক সামনের সিটটায় এসে
বসেন। হরতালের দিন বলে হাতে গোণা কয়েকজন লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল
কামরাটিতে। বসেই যথারীতি জানালা দিয়ে উদাস হয়ে বাইরের দিকে
তাকিয়ে থাকেন। বুঝতে পারি, নিরন্তর কিছু একটার যেন খোঁজ চলেছে তাঁর চোখে। জানি না নীরার জন্য তাঁর প্রান এখনও আকুল হয়
কিনা। স্বপ্নের মত লাগে। ভাবতে পারি না ‘প্রথম আলো’র লেখককে কোনোদিন এতটা কাছে পাব যে
তাঁর উষ্ণ শ্বাসাঘাতে আমার খাড়া হয়ে যাওয়া লোমের প্রায় মূর্ছা যাওয়ার জোগাড় হবে। কিছু বলতে গিয়েও
আটকে যাই।
আসলে একজন পূর্ণ সময়ের লেখক তাঁর পার্থিব শরীর ত্যাগ করার পর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন
কারণ নিরন্তর সৃজনের কোনো দায় আর তখন থাকে
না তাঁর কাঁধে। এ যেন শরীরের ওপর চেপে
থাকা রাজকীয় আভরনের বিড়ম্বনা, খুলে ফেলতে না পারলে মহাজাগতিক আনন্দের খনিমুখ
উন্মুক্ত হবে না। তাই তো এক বিন্দুও কালক্ষেপ না করে খাঁচা মুক্ত পাখি, সটান চলে যেতে চায় তাঁর চির
পছন্দের সেই অজ্ঞাতবাস, ‘নিশ্চিন্দিপুরে’! সারা জীবদ্দশায় যা তিনি শত চেষ্টা করেও যেতে পারেননি। কারণ যে
কোনো লেখক তাঁর জীবনকালে একবার অন্তত তাঁর লেখক বর্মটাকে তুলে রাখতে চান স্মৃতির
ওয়ারড্রবে, আসলে হাফিয়ে ওঠা জীবনে ফিরে দেখার জন্য চাই একটা বিরামের ব্যালকনির। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আপন
কৃতিত্বের জাবর কাটার ফুরসত একটা লেখকের আজন্মকাল হয়ে ওঠে না। তাঁর লাগে
জন্মান্তরের এই অজ্ঞাতবাস। ভীষণ রোমাঞ্চিত লাগে, এই সব ভেবে।
২}
আসল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি অনেক আগে দেখেছিলাম, বই মেলায়। তখন বই মেলা হত ময়দানে। মঞ্চ আলো করে সুনীল সেদিন সঞ্চালকের দায়িত্বে; এক এক করে কবিকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন আর প্রায় প্রত্যেকের কবিতা পাঠের শেষে দিচ্ছেন তাঁর মূল্যবান টিপ্পনী।
একই
মঞ্চে সেদিন ছিলেন কবি জয় গোস্বামীও। সারাক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করে তিনি বসেছিলেন
অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। সুনীল তখন বাংলা সাহিত্যের আকাশে শিখরে থাকা
মহা তারকা। কিন্তু, সুনীলের কোনোরূপ কমপ্লেক্স ছিল না। সম্ভবত তিনি তাঁর তারকা
সত্তাকে কখনো মাথার মুকুট বানিয়ে ফেলার চেষ্টা করেননি। তাই এত মাটির কাছাকাছি মনে হয়েছিল সেদিন তাঁকে। নির্লিপ্ত, পক্ষপাত
হীন, জ্ঞানের পূর্ণতায় দীপ্তিমান।
৪}
২০১২ সালের ২৩ শে অক্টোবর, দুর্গা নবমীর ভোর,
সন্ধি পূজা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে নির্দিষ্ট সময়ে। নবমীর আরাধনায় ধীরে ধীরে জেগে উঠেছে
গোটা বাঙালী জাতি, আর ‘অর্ধেক জীবন’এর লেখক তখন তাঁর জীবন সম্পূর্ণ করে পাড়ি দিচ্ছেন
চির বিশ্রামের দেশে। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু, বাঙালীর সাহিত্য সাধনার ইতিহাসে এক বিষাদময় যুগ
সন্ধি ক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। সুনীল
যুগের পর সূচনা হয় সুনীল পরবর্তী যুগের। সুনীলকে নিয়ে যে নোবেল প্রত্যাশা তৈরি
হয়েছিল বাঙালীর মনে, অবসান হয় তারও।
খবরটা দেন, আমার এক সাহিত্যিক বন্ধু। ফোনে। আমি তখন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির ঠাকুর
দালানে। মায়ের প্রতিমার সামনে, নতজানু। পূজার রাজকীয় উপকরণ, মন্দির গাত্রের অনুপম
পৌরাণিক ভাস্কর্য এবং নহবতে বেজে চলা সানাইয়ের করুণ সুরে প্রায় মোহাবিষ্ট। এমন
সময়ে সুনীলের এই প্রয়ান সংবাদ যেন এক লহমায় সব এলোমেলো করে দিয়ে যায়। রক্তিম
বস্ত্র পরিহিত তন্ত্রধারক পুরোহিত তাঁর আসনে বসে তখনো মায়ের ধ্যানরত। কিন্তু সেই
মুহূর্তে কেন জানি না মায়ের মুখকে এক অসম্ভব বেদনার আর্দ্রতায় দ্রব হয়ে যেতে
দেখেছিলাম, আমি। ঢাকের তালে অনিবার্য ভাবে বেজে উঠতে শুনেছিলাম বিসর্জনের সুর।
সেবারের মত সাঙ্গ হয়ে যায় দুর্গা পূজা। আর একাদশীর দিন অর্থাৎ ২৫ শে অক্টোবর - দুপুরে জন্ম হয় আমার
পুত্র সন্তানের। যার বয়স এখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর বয়সের থেকে ১ দিন কম।
৫}
ইতিমধ্যে ট্রেন বালিগঞ্জ স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছে।
আশে পাশে বসা আরো কয়েকজন লোক নেমে গিয়ে কামরাটি প্রায় রাত ১২ টা ৫ এর শেষ ডাউন লোকালের
চেহারা নিয়েছে। আর এই সুযোগে ভদ্রলোককে একা পেয়ে, আমতা আমতা করে শেষমেশ পেড়েই ফেলি
কথাটা। “কিছু যদি মনে না করেন, একটা কথা বলবো?” মন্দ্র স্বরে উত্তর আসে, “হ্যাঁ,
বলুন!” “আপনি কি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ হন?” প্রশ্ন শুনে, ভদ্রলোক
যেন কিরকম বিগলিত হয়ে পড়লেন। হাত দুটিকে জড়ো করে প্রনাম করার ঢঙ্গে কপালে ঠেকিয়ে
বললেন, “না, না! একেবারেই নয়। তবে আপনি একা নন, অনেকেই আমাকে এই প্রশ্ন করেন।“ “উনি নমস্য ব্যক্তি, উনার মত আমাকে দেখতে বলে, আমাকে
লজ্জা দেবেন না প্লিজ”।
পার্ক সার্কাস স্টেশন আসতেই ভদ্রলোক হাঁসি মুখে, হাত নেড়ে নেমে পড়েন। যেতে যেতে
বলে যান, “আবার দেখা হবে!”
একই পাড়াতে থাকার সুবাদে প্রায়ই দেখা হয়। দেখা হলে হাঁসি বিনিময় ছাড়াও কেমন আছেন,
শরীর কেমন, অনেক দিন দেখি না গোছের খেজুরে কথাও হয় দুজনের মধ্যে।
দাদার কাছে শুনেছিলাম ভদ্রলোকের নাম রতন চক্রবর্তী। বাবা সংস্কৃতের
পণ্ডিত ছিলেন; দেশভাগের পরে চলে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে। যদিও রতন বাবুর জন্ম,
শিক্ষা বড় হওয়া সব এ দেশেই, কোলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে। বাবাই পরে নরেন্দ্রপুরে
চলে আসেন। সেই থেকে এখানেই।
৬}
অনেক দিন পরে, পার্ক সার্কাস ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে লোহা পুল সংলগ্ন বাজারের মধ্য
দিয়ে কোনো মতে হেঁটে যাচ্ছিলাম চিত্তরঞ্জন মেডিক্যাল কলেজের দিকে। দুদিকে-আনাজের পসরা
রাস্তার উপরে এমন ভাবে এসে পড়েছে যে রাস্তাটি সংকীর্ণ হতে হতে প্রায় কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে
যাওয়ার অবস্থা। তার মধ্যে আবার বাজারের থলে হাতে লোকজন, পথচারী ছাড়াও রয়েছে
প্রতিনিয়ত চলা ঠেলা, সাইকেল, বাইকের গুঁতো। দরাদরি, হাঁক ডাক, হম্বি তম্বি, মাল
গাড়ির ঘড় ঘড়, লোকাল ট্রেনের ত্রস্ত পোঁ, এ সব তো আছেই। সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি
তাকে হজম করা খুব সহজ কাজ নয়। যাই হোক, একটা জায়গায় ভালো লাল লটে শাখ দেখতে পেয়ে,
দাঁড়িয়ে পড়ি দুই আঁটি নেব বলে। কত করে আঁটি জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে দোকানদারের দিকে
তাকাতেই দেখি লুঙ্গী পরে, গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে বসে আছেন রতন চক্রবর্তী। “এ কি
আপনি, রতনদা ......!” কিন্তু অবিকল রতন দার মত দেখতে লোকটা বিহারীদের মত হিন্দি
টানে কথা বলছেন কেন! ঠোঁটের কোণে তির্যক
হাঁসি নিয়ে, ভদ্রলোক তারপর হাত নেড়ে নেড়ে বললেন
“ইহা রতন টতন কেও নাই”।
তারপর, পাশে সিঙ্গাপুরি কলা বিক্রি করছিল ছেলেটির দিকে
তাকিয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন, “ আসিফ, ইহা রতন নাম কা কোই আদমি হ্যায় কেয়া?”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পর্কে আরও লেখা পড়ুনঃ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন