“আলো ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে/ মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ” –
রবি ঠাকুরের এই জনপ্রিয় গানের কথায় যে প্রাণের যাচনা শুনতে পাই, তারই যেন
প্রতিধ্বনি, আক্ষরিক ভাবে না হলেও, সম্প্রতি কোলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া এক
কর্মশালায় শোনা গেল নিউ ইয়র্কের বায়ু গুনমান বিশেষজ্ঞ V Faye Mc. Neill এর গলায়।
Switch
ON Foundation
আয়োজিত এই কর্মশালায় আলোচনার মূল উপজীব্য ছিল “কোলকাতা শহরের শ্বাস যোগ্য বাতাস।” এই
বিষয়ে বলতে গিয়ে কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি ও পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা এবং
আমেরিকার Association for Aerosol
Research এর
উপাধ্যক্ষা V Faye Mc. Neill স্পষ্টতই বায়ু দূষণ রুখতে কোলকাতার রাস্তায় আরো
ট্রাম চালানোর পক্ষে সওয়াল করলেন। এ যেন সেই আরো আরো আরো দাও প্রাণের বদলে বরং বহু
মূল্যের সেই প্রাণটি যাতে শ্বাস নিতে পারে দূষণ মুক্ত শুদ্ধ বাতাসে তার জন্যে উঠে
আসা প্যারোডি সঙ্গীত – ‘পথে আরো আরো আরো
দাও ট্রাম’, হয়ে শোনা গেল ভাবুক বাঙালীর কর্ণকুহরে।
এর কারণ শহরের বাতাসে মাত্রা ছাড়া দূষণ। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ এ আমেরিকা ভিত্তিক
স্বাস্থ্য সংস্থা SOGA (State of Global
Air) তাদের
যে বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে সারা পৃথিবীতে বায়ু দূষণের নিরিখে
দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে আমাদের এই কোলকাতা শহর। কোলকাতার বাতাসে (2.5 Particulate Matter অর্থাৎ 2.5
micrometer বা তার
বেশী ব্যাসের ভাসমান থাকা কণার নিরিখে) বার্ষিক
গড় দূষণের পরিমান পাওয়া গেছে 84
microgram/ m3, যা WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) নির্ধারিত বার্ষিক সহনশীল
মাত্রা 5
microgram/m3 এর
প্রায় ১৭ গুন। বোঝাই যাচ্ছে কোলকাতার বাতাসে দূষণ কমিয়ে আনাটা কতটা প্রয়োজনীয়। এমত
অবস্থায়, শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া ট্রাম পরিষেবা বাড়ানোর যে
সুপারিশ উঠে এসেছে এই কর্মশালায়, তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিৎ বলে
মনে হয়।
কারণ শুরুর দিন থেকে অর্থাৎ ১৮৭৩ সালে যখন প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলল কোলকাতার রাস্তায় তখন থেকে আজকের দিনের বৈদ্যুতিক
ট্রাম, মাঝখানে ১৯ বছর (১৮৮৩ থেকে ১৯০২) স্টিম ইঞ্জিনে চলা ট্রামের কথা বাদ দিলে, তার দীর্ঘ যাত্রা পথে ট্রাম কখনোই কোলকাতার বাতাসকে কলুষিত করেনি। শিয়ালদহ থেকে
আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত প্রায় 3.9 কিমি পথ ছিল কোলকাতা শহরের প্রথম ট্রাম লাইন। ক্রমে
ক্রমে তা প্রসারিত হয় শহরের বিভিন্ন রাস্তায়। ১৯৬০ সালে দেখা যায় সব থেকে বেশী ৩৭
টি ট্রাম রুট, যা আজ কমতে কমতে মাত্র দুটি রুটে এসে ঠেকেছে। এখন যা অবস্থা
কোলকাতার ট্রামকে শুধু হেরিটেজ হিসেবে বাঁচিয়ে না রেখে পরিবেশ বান্ধব এই যান ব্যবস্থাকে কি করে শহরের যাত্রী
পরিবহনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য বাহন হিসেবে গড়ে তোলা যায় সেটা ভাবার সময় এসে গেছে।
কারণ V Faye Mc. Neill এর মতে বায়ু দূষণ যে শুধু জন স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে
তা নয়, কৃষি উৎপাদনেও এর কু-প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী প্রায়
২০০ জন স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রী কে তিনি ছোট ছোট দল করে একেবারে পাড়া স্তরে
দূষণের উৎস গুলিকে খুঁজে বার করার পরামর্শ দেন। যেমন রাস্তায় যে সকল খাওয়ারের
দোকান বা জামাকাপড়ের ইস্ত্রি খানা অথবা ছোট খাটো শিল্প, যাদেরকে অচিরাচরিত শক্তি
ব্যবহারে উৎসাহিত করতে পারলে বাতাসের শ্বাস যোগ্যতা বাড়বে বলে তিনি মত প্রকাশ
করেন।
V Faye Mc. Neill এই সূত্রে জানান, আমেরিকার কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
আগামী দিনে এখানকার বিভিন্ন স্কুলে বাতাসের গুনমান তত্ত্বাবধানের যন্ত্র বা Clean Air Tool Box লাগানোর পরিকল্পনা করেছে। আয়োজক সংস্থার পক্ষে বিনয় যাজু সর্বত ভাবে এই উদ্যোগের
সাথে শামিল হবার আশা ব্যক্ত করেন। অধ্যাপিকা Mc. Neill ট্রাম
ছাড়াও শহরে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে Electric
Vehicle (EV) এর উপর
নির্ভরতা বাড়ানোর কথা বলেন। নিউ ইয়র্কের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে বেশিরভাগ
মানুষ ব্যক্তিগত পরিবহনের পরিবর্তে গণ পরিবহন ব্যবহার করেন। অনেকেই আবার সেখানে
সাইকেলে অথবা হেঁটে যাতায়াত করতে পছন্দ করেন। কিন্তু কোলকাতায় কিছু ব্যস্ত রাস্তায়
সাইকেল নিষিদ্ধ শুনে Mc. Neill তাঁর খেদ প্রকাশ করেন।
একথা ঠিক, কোলকাতার ট্রামের ইতিহাসে কবি জীবনানন্দের মৃত্যু একটা অনপনেয় ক্ষত হয়ে
থেকে গেছে। সেই অনাকাঙ্খিত দায় হয়তো কোলকাতার ট্রাম কোনোদিন এড়াতে পারবেনা, কিন্তু
কোলকাতার দূষিত বাতাসে বেঁচে থাকা জীবনের লুপ্ত আনন্দকে কি ট্রাম ফিরিয়ে দিতে
পারবে? অন্তত কর্তৃপক্ষ কি এরকম একটা সুযোগ করে দেবে? সেই প্রশ্ন রইলো, সংশ্লিষ্ট
সবার কাছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন