এযাবতকালের
সর্ব বৃহৎ কফি শপ চেন, সারা ভারতে যার শাখা রয়েছে প্রায় ৫০০ খানা। ভারতীয় কফি
বোর্ডের পরিচালনায়, ১৯৩৬ সালে কেরালার ত্রিশুর থেকে শুরু হয় এর পথ চলা। তার ঠিক ছয় বছর পরে অর্থাৎ ১৯৪২ এ যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে দিকচিহ্ন রচনা কারী ভারত ছাড়ো আন্দোলন দেশ
জুড়ে প্রায় দাবানলের আকার ধারন করেছে, কোলকাতার কলেজ ষ্ট্রীট এরিয়ায় ১৫, বঙ্কিম
চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরনীর ঐতিহাসিক অ্যালবার্ট হলের দোতলায় ছোট করে খোলা হয় এরই একটা শাখা
কফিশপ, যা আগামী দিনে আড্ডাবাজ বাঙালীর কাছে একটি অবশ্য গন্তব্য পীঠস্থান হয়ে উঠবে। ৪৭-এ স্বাধীনতার পর অ্যালবার্ট হলের ওই কফি শপ
পায় তার আজকের দিনে বাংলা সংস্কৃতির ল্যান্ড মার্ক হয়ে ওঠা কিংবদন্তী পরিচয় – ইন্ডিয়ান
কফি হাউস। ১৯৫৬ সালে কফি বোর্ডের থেকে কফি হাউস পরিচালনার দায়ভার চলে আসে কফি
ওয়ার্কার কোওপারেটিভ সোসাইটির কাছে। কোলকাতায় কলেজ ষ্ট্রীট ছাড়াও যাদবপুর (5, Jadavpur Central Road, Poddar Nagar, 700032) এবং
চাঁদনিচক এরিয়ায় (SS Chamber, 1st floor, 5 Chittaranjan Avenue, Esplanade) রয়েছে ইন্ডিয়ান কফি হাউসের শাখা। এছাড়াও গতবছর, ২০২২ এ প্রথম
কোলকাতা মহানগরী ছেড়ে কফি হাউস জেলা শহর শ্রীরামপুরে তার পা রেখেছে। এবং এই জেলা
সফরের দ্বিতীয় গন্তব্য এবার ডায়মন্ড হারবার। গত ৬ই জুলাই, ২০২৩ হীরক বন্দরের সি কে সেন্টারে
খোলা হয়েছে ইন্ডিয়ান কফি হাউসের ৫০১ তম শাখা।
“ডায়মন্ড হারবার, সপ্তান্তে ছুটি কাটানোর বেশ আকর্ষণীয় স্থান। কোলকাতার বাইরে অথচ
বেশী দূরে নয়, এরকম জায়গায় গিয়ে ইন্ডিয়ান কফি হাউসের ঐতিহ্যের ধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত
করার সুযোগ, এবং পাশাপাশি সেই বিখ্যাত কোল্ড কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আড্ডা
জমাবার দুর্দান্ত অবসর সহজে কেউ হারাতে চাইবে না,” ডায়মন্ড হারবারে ইন্ডিয়ান কফি
হাউসের শাখা খোলার পেছনে এমনই চিন্তা কাজ করছে বলে জানালেন কফি ওয়ার্কার
কোওপারেটিভ সোসাইটির বর্তমান সম্পাদক সরফারাজ আহমেদ।
প্রায় ৩,৫০০ বর্গ ফুট জায়গার উপরে নির্মিত সম্পূর্ণ শীততাপনিয়ন্ত্রিত এই কফি হাউসে
থাকবে চলমান সিঁড়ির সুবিধা। কফি হাউসের ব্যালকনি থেকে উপভোগ করা যাবে হুগলী নদীর ঘোলা
জলে নিরন্তর সাঁতার কেটে যাওয়া আর্দ্র হাওয়ার আল্পনা। আহমেদের মতে এটি একটি দারুন হ্যাং আউট জোন হবে এবং সব
বয়সী মানুষের কাছেই তা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেছেন।
বাঙালীর আড্ডা-ঐতিহ্যের স্মারক - বই পাড়ার কফিহাউসে যে যে জনপ্রিয় পদ গুলি পাওয়া
যায়, এখানে পাওয়া যাবে তার প্রায় সব গুলিই, সে চিকেন পকোড়া, ফিস ফ্রাই থেকে শুরু
করে মোগলাই পরোটা, ফিস ফিঙ্গার বাদ যাবে না কিছুই, এবং অবশ্যই সমস্ত আকর্ষণের
কেন্দ্রে থাকবে সেই ধূমায়িত কফি বা চির-ফেভারিট কোল্ড কফির কাপে তুফান তোলা তর্ক,
যার আবেদন বাঙালী জীবনে কোনোদিনই মলিন হবার নয়।
কলেজ ষ্ট্রীটের পরম্পরা অনুসারে ডায়মন্ড হারবারের এই কফি হাউসেও খাদ্য পরিবেশন করতে দেখা যাবে সেই চিরপরিচিত কালো কোমর বন্ধনী সহ সাদা পোশাকের
পাগড়ি পরা ওয়েটারদের।
একসময় বই পাড়ার কফি হাউসে নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের বহু
খ্যাতনামা দিকপালদের। সেই তালিকায় সত্যজিত থেকে শুরু করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কে নেই!
সব শেষে এটাই বলার - গত শতকের আটের দশকে গাওয়া মান্না দের সেই সুপারহিট গানে যে খেদ প্রকাশ পেয়েছিল, কফি
হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই বলে, হীরক বন্দরের এই নতুন পরিসর কি দেখাতে পারবে সেই আক্ষেপ প্রশমনের নতুন
কোনো দিশা; যা অদূর ভবিষ্যতে বাঙালীর আড্ডা সংস্কৃতির আকাশে উন্মোচিত করবে সম্পূর্ণ নতুন এক দীগন্ত। আশায়
রইলাম, এবং অবশ্যই যে আশায় চাষারা বাঁচে সেই আশায়।
জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন