সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রাত্রির পথে কে এমন বাঁশী বাজায় করুন সুরে?

বারোটা বাজার পর, রাত ক্রমশ বিপন্ন হতে শুরু করে। কারণ মধ্যরাতের চূড়া ছুঁয়ে তখন কাউণ্ট ডাউন শুরু হয় তমসা শেষের। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে রাত্রির অন্ধকার অগ্রসর হয় ভোরের আলোয় হারিয়ে যেতে। রাতের মতই বিপন্ন হতে শুরু করে রাত্রিজীবী মানুষজনও। এমনই এক বিপন্ন রাতে, একা বসে ছিলাম মহকুমা হাসপাতালের ঠিক সামনে দিয়ে চলে যাওয়া শুনশান রাস্তাটির উপর - একমাত্র খোলা সবেধন নীলমণি চায়ের দোকানের কাঠের বেঞ্চে। আকাশে, শুক্লা নবমীর মরা চাঁদ তখন ডুবু ডুবু করছে। শীতের রাত, তাই বাতি স্তম্ভের কুসুম-হলুদ আলোও কুয়াশার থকথকে সাদায় প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে। চায়ের গেলাসের ঠুং ঠ্যাং, সঙ্গে কখনো কখনো দোকানের চালায়, বটগাছের পাতা চুইয়ে পড়া শিশিরের টুপ টাপ - এই ছিল সেই অদ্ভুত রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গের প্রিলিউড যার মুল সুর বেজে ওঠে আরো খানিক বাদে; যখন ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে রাত, অথচ দেখা নেই রাতের যাত্রীদের।  বাতিস্তম্ভের নীচে প্যাডেল রিক্সার উপর কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে মোসলেম রাতের শেষ প্রহরে এসে তার বিপন্ন আশার ভার নামায় আড় বাঁশীর সাত ছিদ্রে করুন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফেলে। বিপন্নতার বিরল হাহাকার যেন ছড়িয়ে পড়ে মোসলেমের বাঁশীতে বেজে চলা বেহাগের সুরে।  অপেক্ষার প্রহর গোণা, তবু শেষ হয় না।
“এক কাপ চা হবে?” বহুক্ষণ বাদে একজন, সম্ভবত কোনো রোগীর আত্মীয়, কুয়াশা থেকে বাঁচতে মাথায় পাগড়ীর মত করে গামছা জড়িয়ে হাজির হন চায়ের তেষ্টা মেটাতে। আনমনে মোসলেমের বাঁশী শুনতে শুনতে হঠাৎ পূব দীগন্তে খেলে যাওয়া বিদ্যুল্লতার ঝিলিকে ঘোর কেটে যায়, আমার। ভাবি এ কিসের অশনি সংকেত?
ধীরে ধীরে তরল হতে থাকে রাতের অন্ধকার। বাইকে চড়ে মানুষজন চলে যায় দূর পাল্লার বাস ধরতে।  মর্নিং ওয়াকে বেরনো মানুষের ‘গুড মর্নিং’ জানানোর ঘটা চায়ের দোকানদার হরিপদের কানে ঠিক চলেই আসে। এবার যে তার দোকানদারী সারার পালা। মোসলেমেরও তাই। রাতের রিক্সা, রাতের রজনীগন্ধার মতন। কিন্তু আজ রাতে মোসলেম থেকে যায় অনাঘ্রাত!
বেলা বাড়লে আমি বাড়ি ফিরে আসি। ফিরেই সোজা উঠে যাই দোতলার বারান্দায়। সামনের তেজ পাতার গাছটায় তখনো কুয়াশার ভেজা দাগ শুকায়নি পুরোপুরি। দেরী না করে, খাতা কলম খুলে বসে পড়ি - গত রাতের সেই করুণ বিষ মেশানো কনসার্টের মুগ্ধতা খাতার পাতায় ছড়িয়ে খানিক ভার মুক্ত হতে। লিখে ফেলি একটি কবিতা। কবিতাটি পরে বন্ধু, সম্পাদক (‘দিশা’ পত্রিকা) তাজিরুল ইসলামের অনুরোধে উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত একটি মাসিক ম্যাগাজিনে পাঠাই এবং সেটা ছেপে বেরয়ও।  এখানে সেই কবিতাটির পুনর্লিখনের লোভ সামলাতে পারলাম না।

সেই বড় রাস্তার ধারে
দেবাশিস জানা

 
ঘুম ভাঙাও -
সুদূরের প্রিয় নিশা!
উঠোনে ডিঙিয়ে যাও -
কালো ম্লেচ্ছ পিঠে আরোহী হয়ে
দূরের জ্যোতির্দ্বারে।
রাত্রির আঁধার নলে,
প্রতীক্ষার দীর্ঘ নিঃশ্বাস..
কেঁপে কেঁপে কি সুর তোলে!
উজ্জ্বল বাতির নীচে
বড় রাস্তার ধারে।
ঘন ঘন অশনি সংকেত,
দূর আঁধার আকাশে।
রাত্রির সর্বাঙ্গে জাগে
সেই সুর শ্বাস সপ্তকে।
বুক নিংড়ানো, বিফল হাহাকারে!
সহসা এক পাগল হাওয়া
এলোমেলো বয়ে যেতে যেতে,
বাঁধা পড়ে সহস্র -
বিবর্ণ কাগজের ঘূর্ণাবর্তে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...