"প্রেম নেই, কেচ্ছা কেলেঙ্কারি নেই, এমনকী খুন জখমও নেই, শুধু গ্রামের বর্ণনা - ওসব চলবে না।" জনৈক প্রকাশক "পথের পাঁচালী" কে বই হিসেবে ছাপার প্রশ্নে এই ভাষাতেই তার বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। আর একজন তো, "না মশাই কোন পাঁচালী ছাপানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে" বলে এড়িয়েছিলেন। এখন এত দিন পরে, সেদিনকার কতিপয় প্রকাশকের "পথের পাঁচালী"র সঠিক মূল্যায়ন না করতে পারার অক্ষমতা নিশ্চিত ভাবেই আজকের সমগ্র প্রকাশক সমাজকে পীড়িত করে।
এ কথা ঠিক, "পথের পাঁচালী" ধারাবাহিক ভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর বিভূতিভূষণ ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন সাহিত্য বোদ্ধাদের কাছ থেকে, আর তাই আগের সব তিক্ততা ভুলে তিনি আশায় কোমর বেঁধেছিলেন পরবর্তী পর্যায়ে এটিকে বই হিসেবে বের করার লক্ষে। এমনকি ভাগলপুরের চাকরী ছেড়ে তিনি চলে এসেছিলেন কোলকাতায়, এই আশায় যে "পথের পাঁচালী" কে মলাট -বন্দি করতে তিনি পুরো সময় দিয়ে তদ্বির - তদারকি চালাতে পারবেন। আশাহত হয়েছিলেন। প্রকাশকদের দোরে দোরে ঘুরে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন এ যাত্রায় তাঁর স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। বিভূতিভূষণ তাই তাঁর আগের সিদ্ধান্ত বদলে পুনরায় ভা্গলপুরে ফিরে যাবার ব্যাপারে মনস্থির করেছিলেন, এবং বলাই বাহুল্য সেটা করেছিলেন একদম অনন্যোপায় হয়েই। মির্জাপুরের মেসে সেদিন তিনি ছিলেন একা, শুয়ে; সাথে ছিল শুধু পড়ন্ত বিকেলের মরা রোদ। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে কব্জিতে অনুভব করেছিলেন অজান্তে গড়িয়ে পড়া চোখের জলের শীতল স্পর্শ।
আজকের দিনে ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়, "পথের পাঁচালী" কে কোন এক প্রকাশক বিনে পয়সায় পেলে ছেপে দেখতে পারেন বলে উদারতা দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। ভাবখানা এইরকম, যে চলবেনা, তাও...।! খালি একজন প্রকাশক, মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিয়ে "পথের পাঁচালী" কিনে নিতে চেয়েছিলেন। আজকের দিনে যেটাকে নিখাদ ঔদ্ধত্য ছাড়া কি বা মনে হতে পারে! সেদিন কিন্তু "পথের পাঁচালী" র স্রষ্টা বিভূতিভূষণের কাছে একটা অসাধারন অনুকম্পা রূপেই বিবেচিত হয়েছিল এটি।
তাহলে কি বিভূতিভূষণকে প্রকাশকদের অনুকম্পার উপরেই ভর করে তাঁর লেখক সত্তাকে টিকিয়ে রাখতে হবে? কোটি টাকার এই প্রশ্নের উত্তর কেবল কালের কাছেই ছিল গচ্ছিত। কারণ সাহিত্য-সৃষ্টির মূল্যায়নে কালের বিচারই আসল বিচার। যার বিচারে "পথের পাঁচালী" উত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ।
বিধাতা পুরুষ যে কোন সৃষ্টি কর্মকেই কালের দরবারে পাঠান, কালের কষ্টি পাথরে তার গ্রহণযোগ্যতা পরখ করার জন্য। কিন্তু "পথের পাঁচালী" কে কালের পরীক্ষাগারে কেই বা নিয়ে যাবে। কোন প্রকাশকই তো ছাপতে রাজী হচ্ছিলো না। শেষমেশ বিধাতা তার দূত করে পাঠালেন নীরদ সি চৌধুরী কে। সেই নীরদ সি যিনি, বিভূতিভূষণ যখন "পথের পাঁচালী" লেখা শুরু করেন, সেদিন থেকে লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত শুধু নয় তারপরে লেখাটিকে পাঠকের সমক্ষে উপস্থিত করার জন্য প্রায় সবসময় এবং সব ব্যাপারে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে লেখককে উৎসাহ, সাহস এবং সমর্থন জুগিয়ে এসেছেন। এবারেও তিনি প্রায় ত্রাতার ভূমিকায় হতাশ বিভূতিভূষণকে একরকম টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলেন 'প্রবাসী' পত্রিকার সজনীকান্ত দাসের কাছে। গায়ে কাঁটা দেবে এর পর যা ঘটল তা শুনে। সজনীকান্ত তার অনাগত সন্তানের নামে -রঞ্জন প্রকাশনালয় নামে আস্ত একটা প্রকাশনী সংস্থাই খুলে ফেললেন "পথের পাঁচালী" কে বই হিসেবে বের করবেন বলে। তিনশ পঁচিশ টাকা পাবেন লেখক - এই মর্মে সম্মতি চুক্তি হল লেখক বিভূতিভূষণ ও প্রকাশক সজনীকান্তের মধ্যে। সাক্ষী হিসেবে সই করলেন নীরদ সি এবং গোপাল হালদার।
এবং সবশেষে এল সেই শুভ মহরৎ। ১৯২৯ সালের ২ রা অক্টোবর বুধবার মহালয়ার পুন্য লগ্নে বই হিসেবে প্রকাশিত হল "পথের পাঁচালী"। তারপরেরটা ইতিহাস।
কিন্তু বিভূতিভূষণ কি ভুলতে পারবেন "পথের পাঁচালী" এই নামটি নিয়েই কত জনের কত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ কি ভাবে তাঁকে বিদ্ধ করেছিল। কারণ 'পাঁচালী' শব্দটি নাকি ভীষণ গেঁয়ো, সেকেলে শব্দ। ওই শব্দ দিয়ে উপন্যাসের নাম একেবারেই অচল। এমন ও তাঁকে শুনতে হয়েছে ও সব পাঁচালী ফাচালী চলে না। নীরদ সি উপায় বাতলেছিলেন নাম হোক "নিশ্চিন্দপুরের কথা"। মানতে পারেন নি বিভূতিভূষণ। কালের আধারে এটা প্রমানিত "পথের পাঁচালী" কত বড় সুপারহিট নাম। পরবর্তী কালে ১৯৫৫ সালে বিশ্ব বরেণ্য চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় ও যখন বিভূতিভূষণের এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানাতে যান, তিনিও "পথের পাঁচালী" এই নামটি বদলাবার সাহস দেখাননি। এটাও বিভূতিভূষণের কম প্রাপ্তি নয়।
কিন্তু বিভূতিভূষণ কি ভুলতে পারবেন "পথের পাঁচালী" এই নামটি নিয়েই কত জনের কত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ কি ভাবে তাঁকে বিদ্ধ করেছিল। কারণ 'পাঁচালী' শব্দটি নাকি ভীষণ গেঁয়ো, সেকেলে শব্দ। ওই শব্দ দিয়ে উপন্যাসের নাম একেবারেই অচল। এমন ও তাঁকে শুনতে হয়েছে ও সব পাঁচালী ফাচালী চলে না। নীরদ সি উপায় বাতলেছিলেন নাম হোক "নিশ্চিন্দপুরের কথা"। মানতে পারেন নি বিভূতিভূষণ। কালের আধারে এটা প্রমানিত "পথের পাঁচালী" কত বড় সুপারহিট নাম। পরবর্তী কালে ১৯৫৫ সালে বিশ্ব বরেণ্য চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় ও যখন বিভূতিভূষণের এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানাতে যান, তিনিও "পথের পাঁচালী" এই নামটি বদলাবার সাহস দেখাননি। এটাও বিভূতিভূষণের কম প্রাপ্তি নয়।
তথ্য সূত্র - অপু ও দুর্গার খোঁজে, পুলক চট্টোপাধ্যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন