সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

"পথের পাঁচালী" র লেখক বিভূতিভূষণের কি এটাই প্রাপ্য ছিল?

 "প্রেম নেই, কেচ্ছা কেলেঙ্কারি নেই,  এমনকী খুন জখমও নেই, শুধু গ্রামের বর্ণনা - ওসব চলবে না।" জনৈক প্রকাশক "পথের পাঁচালী" কে বই হিসেবে ছাপার প্রশ্নে এই ভাষাতেই তার বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। আর একজন তো, "না মশাই কোন পাঁচালী ছাপানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে" বলে এড়িয়েছিলেন। এখন এত দিন পরে, সেদিনকার কতিপয় প্রকাশকের "পথের পাঁচালী"র সঠিক মূল্যায়ন না করতে পারার অক্ষমতা নিশ্চিত ভাবেই আজকের সমগ্র প্রকাশক সমাজকে পীড়িত করে। 

লেখক জীবনের একেবারে বেড়ে ওঠার বেলাতেই এমন প্রত্যাখ্যান আর দ্বিরুক্তি বিভূতিভূষণের মনে যে দুরপনেয় ক্ষত তৈরি করেছিল, হয়তো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা উপন্যাসের স্রষ্টা হিসেবে এটা তাঁর  প্রাপ্য ছিল না। বিভূতিভূষণ যিনি তিন-বছর ধরে অনেক কষ্ট করে "পথের পাঁচালী" লিখেছিলেন এবং শেষমেশ উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত 'বিচিত্রা'র পাতায় তারও বেশ কিছু দিন পরে পনেরোটা কিস্তিতে ছাপাতে সমর্থ হয়েছিলেন - সে কথা আমি আমার পুরনো একটা লেখায় লিখেছিলাম "পথের পাঁচালী" এবং তার তিন বছরের প্রকাশ-যন্ত্রণা" এই শিরোনামে।
 এ কথা ঠিক, "পথের পাঁচালী" ধারাবাহিক ভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর বিভূতিভূষণ  ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিলেন সাহিত্য বোদ্ধাদের কাছ থেকে, আর তাই আগের সব তিক্ততা ভুলে তিনি আশায় কোমর বেঁধেছিলেন পরবর্তী পর্যায়ে এটিকে বই হিসেবে বের করার লক্ষে। এমনকি ভাগলপুরের চাকরী ছেড়ে তিনি চলে এসেছিলেন কোলকাতায়,  এই আশায় যে "পথের পাঁচালী" কে মলাট -বন্দি করতে তিনি পুরো সময় দিয়ে তদ্বির - তদারকি চালাতে পারবেন। আশাহত হয়েছিলেন। প্রকাশকদের দোরে দোরে ঘুরে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন এ যাত্রায় তাঁর স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। বিভূতিভূষণ তাই তাঁর আগের সিদ্ধান্ত বদলে পুনরায় ভা্গলপুরে ফিরে যাবার ব্যাপারে মনস্থির করেছিলেন, এবং বলাই বাহুল্য সেটা করেছিলেন একদম অনন্যোপায় হয়েই। মির্জাপুরের মেসে সেদিন তিনি ছিলেন একা, শুয়ে; সাথে ছিল শুধু পড়ন্ত বিকেলের মরা রোদ। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে কব্জিতে অনুভব করেছিলেন অজান্তে গড়িয়ে পড়া চোখের জলের শীতল স্পর্শ। 
আজকের দিনে ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়, "পথের পাঁচালী" কে কোন এক প্রকাশক বিনে পয়সায় পেলে ছেপে দেখতে পারেন বলে উদারতা দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। ভাবখানা এইরকম, যে চলবেনা, তাও...।!  খালি একজন প্রকাশক, মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিয়ে "পথের পাঁচালী" কিনে নিতে চেয়েছিলেন। আজকের দিনে যেটাকে নিখাদ ঔদ্ধত্য ছাড়া কি বা মনে হতে পারে! সেদিন কিন্তু "পথের পাঁচালী" র স্রষ্টা বিভূতিভূষণের কাছে একটা অসাধারন অনুকম্পা রূপেই বিবেচিত হয়েছিল এটি।
   তাহলে কি বিভূতিভূষণকে প্রকাশকদের অনুকম্পার উপরেই ভর করে তাঁর লেখক সত্তাকে টিকিয়ে রাখতে হবে? কোটি টাকার এই প্রশ্নের উত্তর কেবল কালের কাছেই ছিল গচ্ছিত। কারণ সাহিত্য-সৃষ্টির মূল্যায়নে কালের বিচারই আসল বিচার।  যার বিচারে "পথের পাঁচালী" উত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ।
বিধাতা পুরুষ যে কোন সৃষ্টি কর্মকেই কালের দরবারে পাঠান, কালের কষ্টি পাথরে তার গ্রহণযোগ্যতা পরখ করার জন্য। কিন্তু "পথের পাঁচালী" কে কালের পরীক্ষাগারে কেই বা নিয়ে যাবে। কোন প্রকাশকই তো ছাপতে রাজী হচ্ছিলো না। শেষমেশ বিধাতা তার দূত করে পাঠালেন নীরদ সি চৌধুরী কে। সেই নীরদ সি যিনি, বিভূতিভূষণ যখন "পথের পাঁচালী" লেখা শুরু করেন, সেদিন থেকে লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত শুধু নয় তারপরে লেখাটিকে পাঠকের সমক্ষে উপস্থিত করার জন্য প্রায় সবসময় এবং সব ব্যাপারে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে লেখককে উৎসাহ, সাহস এবং সমর্থন জুগিয়ে এসেছেন। এবারেও তিনি প্রায় ত্রাতার ভূমিকায় হতাশ বিভূতিভূষণকে একরকম টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলেন 'প্রবাসী' পত্রিকার সজনীকান্ত দাসের কাছে। গায়ে কাঁটা দেবে এর পর যা ঘটল তা শুনে। সজনীকান্ত তার অনাগত সন্তানের নামে -রঞ্জন প্রকাশনালয় নামে আস্ত একটা প্রকাশনী সংস্থাই খুলে ফেললেন "পথের পাঁচালী" কে বই হিসেবে বের করবেন বলে। তিনশ পঁচিশ টাকা পাবেন লেখক - এই মর্মে সম্মতি চুক্তি হল লেখক বিভূতিভূষণ ও প্রকাশক সজনীকান্তের মধ্যে। সাক্ষী হিসেবে সই করলেন নীরদ সি এবং গোপাল হালদার।
                                                                    
 এবং সবশেষে এল সেই শুভ মহরৎ। ১৯২৯ সালের ২ রা অক্টোবর বুধবার মহালয়ার পুন্য লগ্নে বই হিসেবে প্রকাশিত হল "পথের পাঁচালী"। তারপরেরটা ইতিহাস।
কিন্তু বিভূতিভূষণ কি ভুলতে পারবেন "পথের পাঁচালী" এই নামটি নিয়েই কত জনের কত ব্যঙ্গ বিদ্রূপ কি ভাবে তাঁকে বিদ্ধ করেছিল। কারণ 'পাঁচালী' শব্দটি নাকি ভীষণ গেঁয়ো, সেকেলে শব্দ। ওই শব্দ দিয়ে উপন্যাসের নাম একেবারেই অচল। এমন ও তাঁকে শুনতে হয়েছে ও সব পাঁচালী ফাচালী চলে না। নীরদ সি উপায় বাতলেছিলেন নাম হোক "নিশ্চিন্দপুরের কথা"। মানতে পারেন নি বিভূতিভূষণ। কালের আধারে এটা প্রমানিত "পথের পাঁচালী" কত বড় সুপারহিট নাম। পরবর্তী কালে ১৯৫৫ সালে বিশ্ব বরেণ্য চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় ও যখন বিভূতিভূষণের এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানাতে যান,  তিনিও "পথের পাঁচালী" এই নামটি বদলাবার সাহস দেখাননি। এটাও বিভূতিভূষণের কম প্রাপ্তি নয়।                                                 


তথ্য সূত্র - অপু ও দুর্গার খোঁজে, পুলক চট্টোপাধ্যায়।     
    
                      

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...