কথা নয়। নীরবতার সাথে মূক হৃদয়ের অ-বাক সংলাপ। নীরবতার উদযাপন। আকণ্ঠ নীরবতায় ডুবে পুকুর ঘাটের পথ বুঁদ হয়ে শোনে জলের নগ্নতায় বাতাসের ফুরফুরে সন্তরণে বেজে চলা জলতরঙ্গ। জলকে চারদিক থেকে আগলে রাখা পাড়ের কাছে তা পরকীয়া। তাই পুকুর ঘাটের পথ উৎকর্ণ নীরবতায় অপেক্ষা করে, কখন বাতাসের সে কোমল শৃঙ্গার রাগ পাড়ের বুকে সলজ্জ ছলাৎ হয়ে বাজবে। অনেকটা কামরাঙার ডালে বসা মাছরাঙার মতন। নিষ্কম্প চোখ, নিথর ডানা যেন পটে আঁকা ছবি। নীরবতা যে এখানে নির্নিমেষ সম্ভোগ! কখন যে মীনপুচ্ছের চটুল খুনসুটিতে নিটোল জলের গালে পড়বে এক টুকরো শরমের টোল। কে জানে! পুকুর ঘাটে আসা পথের বুকে খালি নীরবতার মদিরা ঝরে যায় অবিরাম।
নীরবতার ভোজবাজীতে, ভেজা ডুমুর পাতার গা গড়ানো ফোঁটা ফোঁটা জল পুকুরের ডাগর বুকে ফুটিয়ে তোলে সুডৌল স্তন বৃন্ত, চারিদিকে যার আলুলায়িত বৃত্তাকার ঢেউ; যেন জলের উপর আঁকা নিবিড় স্রোতের আলপনা।

এ পথে নীরবতার সূত্রে বাঁধা পড়ে পুকুর, পুকুরের কচি কলাপাতা-রঙা জল, জল ছুঁয়ে থাকা লাল শান বাঁধানো ঘাট, ঘাটের ধাপ, ধাপে ধাপে তার পাড়ে উঠে যাওয়া সহ সেই নৈর্ব্যক্তিক পথ, সবুজ ঘাস মাড়িয়ে যেটি ঘাটে পৌঁছায়। পুকুর ঘাটের পথ; সুললিত সবুজের ছায়ায় লালিত তার রাজ্যপাট। যেখানে পাশ থেকে হামলে পড়া কোচ পাতার ঢলাঢলি চলে নিত্য; শোনা যায় খসে পড়া খুদে খুদে তেঁতুল পাতার খসখস। ভর দুপুরেও সেই পথে বাজে নিশি পোকার নূপুর। গজগামিনীর ছন্দে।
মহাকবি কালিদাসের জীবনে পুকুর ঘাটের পথ দুই বিপরীত ভাবের ব্যাঞ্জনা নিয়ে আসে। প্রথমটি, ফুলশয্যার রাতে স্ত্রীর কাছে নিজের বোকামির জন্য যারপরনাই অপমানিত হওয়ার পর, জলে ডুবে মরতে গিয়ে এমনই এক পুকুর ঘাটের পথ যা তার কাছে চরম বিমর্ষতার দ্যোতক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তার ঠিক অব্যবহিত পরে যখন তার মাটির কলসীতে পাথরের ক্ষয়ে যাওয়া দেখে বোধোদয় হয় যে মাটির কলসী যদি ঘাটের পাথর ক্ষইয়ে দিতে পারে, লেগে থাকলে কি না হতে পারে। এবং যথারীতি তিনি আত্মহননের চিন্তা ছেড়ে তখন ফিরে যাচ্ছেন সেই একই পুকুর ঘাটের পথ ধরে, সেই পথ তার কাছে সেদিন ছিল এক মহা বোধোদয়ের পথ; বোকা কালিদাস থেকে ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা কবি - মহাকবি কালিদাস হয়ে ওঠার মহা-পথ। সেদিন মহাকবি কালিদাসকে, পুকুর ঘাটের পথ নীরবতায় কাতর হতে যেমন দেখেছিল, দেখেছিল নীরবতায় উদ্ভাসিত ও হতে।
ছোট শিশুদের কাছে পুকুর ঘাটের পথ একপ্রকার নিষিদ্ধ, বড়রা সবসময় চোখে চোখে রাখে আদুল কচি কচি পা যেন কখনো এই পথ না মাড়ায়। কারণ নির্জনতা নিরাপদ নয়।
কিন্তু অতলস্পর্শী নীরবতায় ডুব দিতে চাওয়া মন যে অবাধ্য। বারবার তাই বৈরাগী নীরবতার খোঁজে উদাসী হাওয়া বয়ে যায় এই পথে।
এ পথে নীরবতার আকর্ষণ এতটাই, মনে হয় কোন সুন্দরী রমনীর হাতে হাত রাখার পরও তার নীরব থেকে যাওয়ার মত মাদকতায় পরিপূর্ণ।
কল্পনার তরীকে সামলে, এবার বরং স্মৃতির ভাঁড়ারে বেশ উজ্জ্বল এমন এক পুকুর ঘাটের পথের কথা বলি, প্রত্যহ গোবর জলে নিকানো হত যে পথ। দু পাশে তার সমত্ত সুপুরির সারি। সুপুরির গা বেয়ে গোলমরিচের লতা- গাঢ় সবুজ LOVE-SHAPED পাতার নাচনে উচ্ছল। পথপ্রান্তে বাঁধানো পাকার ঘাট, অনেক দিনের পুরনো। পলেস্তারা খসা, রঙের কোন বালাই নেই। মাথার উপর ফলন্ত বাতাবি লেবুর সুগন্ধি ছায়া। বাস্তবের পথে পরাবাস্তবতার মায়া।
আমার বাড়ির পেছনে একটা ছোট পুকুর আছে, অনেক কালের পুরনো। খিড়কির দরজা খুলে সেই পুকুরে যাওয়ার পথ। সারা পাড় জুড়ে নানা কিসিমের গাছ গাছালী। নারকেল, তেঁতুল, বকুল, দেবদারু থেকে ভেটকানি, ডুমুর, কাঁঠালি কলা। নারকেলের গা বেয়ে ওঠা মাকাল লতা এবং তার টুকটুকে গোল গোল লাল ফল পুকুরের জলে পড়ে ভেসে থাকে ইতি উতি। ছোটবেলায় প্রায় মার্জারি কায়দায় পা টিপে টিপে ওই পুকুর ঘাটের পথ পেরুতাম। বেশ অভিযানে যাওয়ার মত। আসলে পুকুর ঘাটে বসে রোদ- সাঁতারের বিস্ময় নিরীক্ষণ করার ঘোর কিছুতেই মাথা থেকে নামত না। বড় হয়ে তাই একটা কবিতাই লিখে ফেলেছিলাম "রোদ সাঁতার" নাম দিয়ে। প্রকাশ পেয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনের পাতায়। কি হত, ঘন ডাল পালা ভেদ করে যে টুকু রোদ ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়তো পুকুরের জলে, ঘাটে বসে ছোট-বড় মাটির ঢেলা ফেলে পুকুরের স্থির জলটাকে একটু আলোড়িত করতে পারলেই শুরু হয়ে যেত রোদের সাঁতার; দুলকি চালে, রোদের খেয়াগুলির ভেসে বেড়ানো। কিন্তু এটা তো ভূমিকা। আসল চিত্রটা ফুটে উঠত পাড়ে থাকা কোচ পাতার দীঘল ক্যানভাসে। যেখানে প্রতিফলিত হত রোদ পরীদের সাঁতরে যাওয়ার সেই জাদু-জলছবি। চুম্বকের কেন্দ্র ছিল এটাই। শিশুবেলার বিস্ময় আজও আমায় ছাড়ে না, তাড়িয়ে বেড়ায়। বারবার ফিরে যেতে চায় সেই পুকুর ঘাটের পথে; ফিরে পেতে চায় নীরবতার সে অমোঘ সম্মোহন। সেই ভীষণ সুন্দর তাড়না থেকে লেখা এই কবিতাটি হয়তো এখানে বেমানান হবে না।

চাঁদের আলোয় পুকুর ঘাটের পথ এখনো আমার কাছে অপরিচিত। কারণ সে নীরবতা আমার অসহ্য। তাই যেতে যেতে জ্যোৎস্নালোকিত পুকুর ঘাটের পথের কাছে একটিই প্রশ্ন, পূর্ণিমার রাতে কি জোছনারাও একই ভাবে সাঁতার দেয় ছায়া বিকিনিতে? নীরবে। নীরবতার উদযাপনে!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন