কয়েকদিন আগে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পথে, ঢাকুরিয়া ষ্টেশনের ১ নং প্লাটফর্ম থেকে বাঁ দিকে নেমে বাবুবাগান লেনের মধ্য দিয়ে হাঁটছিলাম ঢাকুরিয়া ব্রিজের দিকে। দু পাশে বাড়ি ঘর দেখে মনে হয় বেশ অভিজাত পাড়া। দোকানবাজারের কোলাহল সেরকম নেই। যাও বা আছে শিষ্টতার গণ্ডীর মধ্যে। মেরে কেটে দশ থেকে বারো ফুট চওড়া হবে রাস্তা। তাই গাড়ি ঘোড়ার দাপাদাপি একেবারে নেই। পথচারীরাই এই পথের আসল হিরো। যাই হোক, এই ধরনের পথে আমাদের মত লোক যারা দু দিকের সব কিছু জরিপ করতে করতে যায় তাদের হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে। কোলকাতা শহরে এখন জীর্ণ পুরনো বাড়ি, রাস্তায় বেরুলে খুব একটা দেখা যায় না। Promoter দের নেক নজর এড়িয়ে যে কটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে, সে গুলি “শহীদ মিনার”। এটি আমার একদম নিজস্ব মত। কেমন যেন আমার মনে হয় বাড়ি গুলি এক প্রকার শ্লাঘা, দ্যাখো আমি এখনও দাঁড়িয়ে আছি -ধরনের বীরত্বপূর্ণ বলিদানের দেমাক কে ছেঁড়া শালের মত গা থেকে ফেলতে দেয় না। তাতে কিছু অসুবিধা নেই। বরং আমার বেশ ভক্তিই হয় ওই বাড়ি গুলো কখনো নজরে এলে।
“কি গো বাবা, তুমি দাঁড়িয়ে গেলে?” কখন পথ চলতে চলতে থেমে গেছি, বাঁ দিকের একটা
মেরুন রঙের দোতলা বাড়ির বারান্দায় লাগানো প্রস্তর ফলকে আমার চোখ আটকে গেছে, ছেলের
হাতের ঝাঁকুনিতে আমার হুঁশ হয়। “না চল, স্কুলে ঢুকতে দেরী হয়ে যাবে," বলে সামনের
দিকে এগোই। মনে মনে ঠিক করে রাখি ফেরার পথে অত তাড়া থাকবে না। তখন ফলক সমেত পুরো
বাড়ি্টাকে সেল ফোনের ক্যামেরায় বন্দী
করে রাখা যাবে ক্ষণ।
বাড়িটা কেমন যেন সিজফ্রেনিক। বিষাদের স্মৃতিতে তিতকুটে। শীতের সকালে জানালা
বন্ধ থাকাটা কোন অবাক করা ব্যাপার নয়। কিন্তু কেন জানি না, মনে হয় কত কাল যেন কেউ
জানালা দরজা খোলেনি। দেওয়ালের রঙে বিগত দিনের গরিমার ছাপ বেশ স্পষ্ট। কিন্তু জানালার
রঙ চটা পাল্লা, বারান্দার জং ধরা শিক,
তাতে ঝোলা ঝুরঝুরে প্লাস্টিক তারও পেছনে ফেলে রাখা অব্যবহৃত টেবিল চেয়ারের
ডাঁই দেখে বাইরে থেকে যত টুকু বোঝা যায়, যেন কল্পনায় দেখা কোন লাশ গায়েব করে রাখা
বাড়ির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
কিন্তু যাবতীয় কৌতূহলের কেন্দ্র বাড়িটি নয়, বাড়িতে লাগানো ওই প্রস্তর ফলকটি।
যেটি আমার মনে হয়েছে এক করুণ বিষাদ-গাথা কে পথচারীদের গোচরে নিয়ে আসার
প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সত্যিই এটি একটি বিষাদময় ফলকনামা। কোনো বাড়ির গায়ে এরকম
ফলক, আমি কেন অনেকেই দেখেনি।
আজ থেকে পনেরো বছর আগে ঘটা একটা ঘটনা, সে সময় মিডিয়ার কল্যানে বাংলার জনমনে বেশ
আলোড়ন ফেলেছিল। মধ্যবিত্ত, শিক্ষার আলোয় থাকতে চাওয়া বাঙালী, ছেলে মেয়েকে পড়া শুনা
করিয়ে উপযুক্ত চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা বাঙালীর মননে এই ঘটনার
অভিঘাত ছিল সুদূরপ্রসারী। ঘটনা ঘটার
পরের দিন সকালে প্রায় সমস্ত বাংলা এবং ইংরেজি খবরের কাগজের প্রথম পাতায় জায়গা করে
নিয়েছিল ঘটনাটি। দিন টি ছিল ২০০৮
সালের ৯ই এপ্রিল। তাইওয়ানে থাকা বাঙালী বিজ্ঞানী উজ্জ্বল শূরের কাছে একটা ফোন আসে। ছোট ভাইয়ের গাড়ির
চালক স্বপন সাঁতরা ফোনটি করেছিল। ফোনে খবরটা শুনে, উজ্জ্বলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ভাবতে পারে না যে তার ছোট ভাই আর নেই। গত কাল রাত্রে সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা
করেছে। সকালে নিজের সরকারী বাসভবন থেকে তার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
The Indian Express এই মৃত্যুকে mysterious 'suicide' বলে খবর করে। খবরে আরও জানা যায় 'আত্মহত্যাকারী'র বয়স মাত্র ৩০। এবং 'আত্মহত্যাকারী' পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর -২ নং
ব্লকের B.D.O। মৃত্যুর দিন তিনি S.D.O, ঘাঁটাল এর সঙ্গে রাত ১১ টা পর্যন্ত প্রশাসনিক মিটিং করেছেন। যদিও তখনকার জেলা শাসক, পশ্চিম মেদিনীপুর N.S Nigam এটাকে অন্য কিছু বলে মানতে চাননি। তার মতে B.D.O মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, যার ফল এই আত্মহত্যা। কিন্তু মানতে পারেননি তার বৃদ্ধ বাবা। ৭২ বছর বয়সী দিলিপ শূর তার ছেলের কাছ থেকে মৃত্যুর ঠিক এক দিন আগে ফিরেছেন ঢাকুরিয়ার বাড়িতে। অবসাদের কোন কিছু তার চোখে অন্তত পড়েনি!
খবরে প্রকাশ, নিহত B.D.O কল্লোল শূর সি পি এম শাসিত এক পঞ্চায়েতের একশ দিনের কাজে হওয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল ভাবে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তৈরি হয়েছিল প্রচন্ড রাজনৈতিক চাপ। আর এই চাপের মুখেই কি তিনি এইভাবে ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য হলেন? কিন্তু মজার ব্যাপার হল বাবা দিলিপ শূর কোথাও ছেলের এই আকস্মিক মৃত্যুর জন্য কারোর বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ তোলেননি। প্রথম থেকেই তিনি দাবী করছেন ছেলে কে পরিকল্পিত ভাবে খুন করা হয়েছে। দরবার করেছেন সংশ্লিষ্ট সব মহলে অভিযুক্তদের উপযুক্ত শাস্তির জন্য। কিন্তু প্রথম থেকেই তার খুনের অভিযোগকে পাত্তাই দেয় নি বাম প্রশাসন। ছেলের মৃত্যুর পর এমনকি তার অভিযোগ পত্র নিতে অস্বীকার করেন দাসপুর থানার ওসি বিশ্বজিত সাহা। কিন্তু তাতে দমে যান নি তিনি; ঘুরেছেন ক্ষমতার ছোট বড় অলিন্দে। দাবী জানিয়েছেন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার। ঘটনার পরম্পরায় রীতিমত শোরগোল পড়ে যায় সেই সময়। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবী করেন বিচারবিভাগীয় তদন্তের। চরম অস্বস্তিতে পড়ে যায় তদানীন্তন বাম সরকার। আর মৃত কল্লোল শূর রাতারাতি হয়ে যান শহীদ Celebrity। যার বাড়ির সামনে এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি; দেড় দশক আগে মিডিয়ার শিরোনামে উঠে আসা একটা ঘটনার কেন্দ্রে যে ব্যক্তি তার বাড়ির একেবারে দোরগোড়ায়, বেশ রোমাঞ্চ যে অনুভব করছি, বললে ভুল বলা হবে না। কিন্তু রোমাঞ্চের তখনো বাকি ছিল। যখন দেখি বৃদ্ধ বাবা-মা'র বয়ানে লেখা ফলকের একেবারে নীচে ফলক নির্মাণের সাল দেওয়া আছে, ৮ই এপ্রিল ২০১০ সাল, ছেলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর দিন। বিচারের বানী সত্যিই নীরবে নিভৃতে কাঁদে। তাই মৃত্যুর দুই বছর পরেও বৃদ্ধ বাবা-মা ফলকে নিজেদেরকে অসহায় বলে উল্লেখ করেন। অভিযুক্তদের তখনো কোন শাস্তি হয়নি যে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিষণ্ণতার অন্ধকার শেষ আলো খোঁজার চেষ্টা করে, ঈশ্বরের কাছে দোষীদের শাস্তি চেয়ে অসহায় বাব-মার কাতর অনুনয়ে। 'ওপরওয়ালা' কি (ফলকের বয়ানে যে ভাবে ঈশ্বর কে উল্লেখ করা হয়েছে) এই বিষাদ-ফলকের বয়ান পাল্টাতে পারবেন। মেঘে মেঘে যে কেটে গেছে আরও তেরটা বছর। জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হচ্ছে বিষাদের করুণ বিষ মাখা সে ফলক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন