সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শিকাগো থেকে শিয়ালদহঃ বিস্মরণের পথে ইতিহাস?

 

১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে উন্মোচিত হয়েছিল এক অপরাজেয় বিজয়পথের। সারা পৃথিবী ছড়িয়ে পড়া এই পথের নীল নকশা যিনি রচনা করেছিলেন তিনি এক ভারতীয় সন্ন্যাসী। শিকাগোর The Permanent Memorial of Art Palace (অধুনা যেটি The Art Institute of Chicago নামে পরিচিত) এর Fullerton Hall এ অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম বিশ্ব ধর্ম মহাসভার সূচনা দিবস অর্থাৎ ১১ই সেপ্টেম্বরের পুণ্য তিথিতে তার তেজদীপ্ত এবং চির কিংবদন্তী সেই বক্তৃতা দানের পর, কার্যতই সেই বীর সন্ন্যাসী সওয়ার হয়েছিলেন ভারতীয়ত্বের বিজয় কেতন উড়িয়ে অগ্রসর হওয়া এক দুর্দম বিজয়রথের। দীর্ঘ চার বছর তার রথের চাকা আমেরিকা, ইউরোপের পথে পথে রেখে গেছে ভারতীয় আধ্যাত্মিক মহিমার  কত অমলিন সাক্ষর। ঐতিহাসিক সেই যাত্রাপথ, শিকাগো থেকে শুরু হয়ে কোলকাতার শিয়ালদহ ষ্টেশনে এসে পৌঁছায় ১৮৯৭ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি। বিশ্ববিজয়ের পর, ঘরের ছেলের ঘরে ফিরে আসার সেই গৌরবময় ইতিহাস আজ ১২৫ বছর অতিক্রান্ত।    
 
কোলকাতার সিমলাপল্লীর বীরেশ্বর দত্ত ওরফে নরেন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিক ভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৪ বছর। গুরু রামকৃষ্ণ দেব প্রয়াত (১৮৮৬, ১৬ই আগস্ট)  হয়েছেন প্রায় চার মাসবরানগরের মঠে, সেদিন প্রজ্বলিত বিরজা হোমের পাবকানলকে সাক্ষী রেখে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে সন্ন্যাস নেন তাঁর আরও কয়েকজন গুরুভাই। সেই থেকে জগতের কাছে তাঁর নরেন্দ্রনাথ নামটি হয়ে যায় একান্তই পূর্বাশ্রমের। নতুন নাম পান-স্বামী বিবিদিষানন্দ; শুরু হয় বহতা নদীর মত বয়ে যাওয়া- এ ঘাট থেকে ও ঘাটে তরী নিয়ে রমতা সাধুর পুণ্য পারাপার। পরিব্রাজকের জীবনচর্যা - পরিব্রজ্যা। তাই ১৮৯০ এর জুলাইয়ে তাঁর প্রানাধিক প্রিয় মঠের আঙ্গন ছেড়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন ভারত পরিভ্রমনে। চলে ১৮৯৩ এর প্রথমার্ধ অবধি, প্রায় তিন বছর -সমগ্র ভারত পরিক্রমা, সে অর্থে এটি তাঁর সন্ন্যাস জীবনের প্রথমবার; গভীর ভারত জিজ্ঞাসা এবং তার উত্তর অনুসন্ধানের লক্ষে ছুটে বেড়ানো দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। ভারত পরিভ্রমন কালে তিনি কখনো কখনো নিজের পরিচয় দেন স্বামী সচ্চিদানন্দ নামে, আবার কখনো স্বামী বিবেকানন্দ নামে। গরিবের পর্ণ কুটির থেকে রাজার রাজপ্রাসাদ, তুষারাবৃত হিমালয় থেকে মহাসাগরের তীর - নামবদলের ভ্রান্তিবিলাস বাদ দিলে, ভারত পথিকের ভারত যাত্রায় এ সবই বাঁধা পড়ে একই গ্রন্থিতে। উন্মোচিত হতে থাকে অনাবিষ্কৃত ভারত তীর্থের নতুন নতুন দিক, নতুন মহিমা, নতুন বিস্ময়। আর সে বিস্ময়ের ঘোর পুরোপুরি কাটার আগেই, পরিব্রাজকের জীবনে এসে পড়ে এক বিশেষ দিন - ৩১শে মে, ১৮৯৩। যে দিন ভারত পরিক্রমা শেষ করে মুম্বাই বন্দর থেকে প্রায় নিঃসম্বল সেই সন্ন্যাসী পেনিনসুলার জাহাজে করে যাত্রা করেন এক অজানা অনিশ্চিতের পথে, স্বদেশভূমি ভারত ছেড়ে সুদূর শিকাগোয় অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম মহাসভার উদ্দেশ্যে, যেখানে তখনো তিনি আমন্ত্রতিতই ছিলেন নাসুদীর্ঘ সেই ‘কালাপানী’র পথে – এক এক করে তিনি পেরিয়ে যান কলম্বো, পেনাঙ, সিঙ্গাপুর, হংকং, ক্যাটন, নাগাসাকি, কোবি, ওসাকা, কিয়াটো, টোকিও এবং সবশেষে ইয়াকহামা হয়ে পরিবর্তিত জাহাজ - এম্প্রেস অফ ইন্ডিয়ায় ৫৫ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৫ শে জুলাইয়ে তিনি পৌঁছান কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে। আর সেখান থেকে পাঁচ দিন পর রেল পথে, ১৮৯৩ এর ৩০ শে জুলাই তিনি পা রাখেন শিকাগোতে। দীর্ঘ যাত্রা (সমুদ্রেই বেশী) শেষে বিশ্বের দরবারে সন্ন্যাসী নিজের পরিচয় দেন স্বামী বিবেকানন্দ নামেই যে নাম তিনি আর কখনো পরিবর্তন করবেন না। এবং যে নামে তিনি আগামী দিনে হয়ে উঠবেন জগৎবন্দিত। 
১৮৯৩ এ শুরু হওয়া ঐতিহাসিক বিজয়যাত্রা যার শুভ সূচনা শিকাগো থেকে হয়ে শিয়ালদহ পর্যন্ত বিস্তৃত; শিকাগো থেকে শিয়ালদহ, সে যাত্রাপথে ছড়িয়ে আছে অজস্র স্মরনীয় ঘটনার মণি মুক্তো, ভারতীয় ইতিহাসে যার মূল্য অপরিসীম। ইতিহাসের সেই অমূল্য উপাদান গুলি কতটা সুরক্ষিত নাকি হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে, তারই উত্তর খোঁজার এক ছোট্ট চেষ্টা করবো এই নিবন্ধে, আশা করি পাঠকদের কাছে এই অনুসন্ধান উপভোগ্য হয়ে উঠবে।
ভুবনজয়ী বক্তৃতা দানের পর, তিন বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, তখনো বিবেকানন্দের দেশে ফেরা হয় নি। বিদেশের মাটিতে তাঁকে নিয়ে উৎসাহ উদ্দীপনাও যেন কোনো ভাবে শেষ হতে চায় না। কিন্তু তাঁকে যে তাঁর মাতৃভূমির কাতর আহ্বান ক্রমশই ভেতর থেকে অস্থির করে তুলছিল, যা তিনিও আর গোপন রাখতে পারছিলেন না।  সঙ্গী সেভিয়ার দম্পতিকে একদিন অকপটে স্বামীজী জানান তাঁর মনের কথা। “আমি এখন তাকিয়ে আছি ভারতের অভিমুখে – শুধু ভারতের দিকে”
শেষ পর্যন্ত, স্বামীজীর ঘরে ফেরার দিন সমাগত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর, ১৮৯৬  - লন্ডন ত্যাগ করে স্বামীজী  স্বদেশাভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। প্রায় এক মাস পরে অর্থাৎ ১৮৯৭ এর ১৫ই জানুয়ারি, ভোরে তিনি পৌঁছান কলম্বো বন্দরে। কলম্বো তখন রাজনৈতিক ভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত। কলম্বোর পর ক্যান্ডি তারপর অনুরাধাপুরম এবং সবশেষে জাফনা হয়ে তিনি সিংহলের (অধুনা শ্রীলঙ্কা) মাটি ছাড়েন। তারপর জলপথে, পঞ্চাশ মাইল দূরবর্তী পাম্বানের দিকে রওনা দেন স্বামীজী  ২৬ শে জানুয়ারি, ১৮৯৭ বিকেল ৫ টায় তিনি পৌঁছান পাম্বানেপাম্বান ভারতের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত একটা প্রান্তিক দ্বীপ। সে অর্থে পাম্বানই ভারত ভূখণ্ডের সেই পুণ্যভূমি, যেখানে বিশ্ববিজয়ী সন্ন্যাসী স্বদেশে ফেরার পর প্রথম তাঁর পা রেখেছিলেন। শিকাগো থেকে শিয়ালদহ এই যাত্রাপথের ইতিহাসে তাই স্বামীজীর পাম্বানে পদার্পণ এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।  রামদানের রাজা ভাস্কর সেতুপতি এখানে স্বামীজীকে অভ্যর্থনার যে রাজকীয় আয়োজন করেছিলেন তা এককথায় অভাবনীয়। এছাড়াও সেখানকার নাগরিকদের তাঁকে ঘিরে তুমুল উৎসাহ, রাজা সহ অমাত্য-সভাসদদের নত শির শ্রদ্ধাপূর্ণ অভিবাদন এবং তাঁর শকটকে ঘোড়ার পরিবর্তে রাজা স্বয়ং কিছু সভাসদদের সাহায্য নিয়ে প্রায় এক মাইল দূরত্ব টেনে নিয়ে যাওয়া শুধু স্বামীজীকে নয় অভিভূত করেছিল সারা বিশ্বকে। পাম্বানে স্বামীজী ও রামনাদ রাজের প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব এবং স্বামীজীকে দেওয়া অভূতপূর্ব সংবর্ধনা প্রসঙ্গে মাদ্রাজ মেলের ৪ ঠা ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ য়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছিল তা পড়লে রোমাঞ্চিত না হয়ে থাকা যায় না। “রামনাদ রাজ ভাস্কর সেতুপতি পরম শ্রদ্ধায় সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে স্বামীজীকে অভ্যর্থনা জানালেন, তারপর সুসজ্জিত একটি সিংহাসনতুল্য আসনে তাঁকে বসালেন। শ্রদ্ধায় আপ্লুত রাজা তারপর স্বামীজীর পদযুগলে পাদুকা পরিয়ে দিয়ে বললেন নিজের মাথায় সবচেয়ে মূল্যবান মুকুট ধারন অপেক্ষা এই কাজকে তিনি উচ্চতর সম্মান ও সৌভাগ্য বলে মনে করেন”।  অভিভূত হওয়ার বাকি ছিল আরও। কারণ ঠিক পরের দিন ২৭শে জানুয়ারি পাম্বানে প্রায় চল্লিশ ফুট উচ্চতার একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয় এবং তাতে যা লেখা হয় তা এইরকমঃ “সত্যমেব জয়তে। পশ্চিম দেশে বেদান্ত ধর্ম প্রচারে অশ্রুতপূর্ব সফলতা লাভ করিয়া পূজ্যপাদ শ্রী শ্রী স্বামী বিবেকানন্দ স্বীয় ইংরেজ শিষ্য গনের সহিত ভারতভূমির যে স্থলে প্রথম পদার্পণ করিয়াছিলেন, সেই পবিত্র স্থান নির্দেশ করিবার জন্য রামনাদাধিপতি ভাস্কর সেতুপতি কর্তৃক এই স্মারক স্তম্ভ প্রোথিত হইল। সন ১৮৯৭, ২৭ শে জানুয়ারি”।
পাঠক লক্ষ করবেন, শিকাগো থেকে শিয়ালদহ এই যাত্রাপথের ইতিহাস নির্মাণের কাজ এইভাবেই শুরু হয় পাম্বানের সৈকতে ভূমিতেইতিহাসের দেওয়াল লিখন আজও কি সমান ভাবে উজ্জ্বল নাকি ক্রমশ ফিকে হতে হতে বিস্মরণের পথে! প্রখ্যাত বিবেকানন্দ গবেষক শঙ্করী প্রসাদ বসু, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে গবেষণার সূত্রে রামনাদ ও পাম্বানে গিয়েছিলেন। স্থানীয় অধিবাসিদের কাছে তিনি শুনেছিলেন, স্মৃতি স্তম্ভটি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। সেটার পুনর্নির্মাণের কোন খবর এখনো পর্যন্ত নেই। তবে আশার কথাও রয়েছে, দেরীতে হলেও স্বামীজীর ভারত পদার্পণের পুণ্য স্মৃতিতে পাম্বাণের কুঁথাকাল সৈকতে ২০১০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি তারিখে উদ্বোধন হয়েছে বিবেকানন্দ মেমোরিয়ালের।
 আমি অত্যন্ত নৈর্ব্যক্তিক ভাবে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করবো ইতিহাস-অলংকৃত অভূতপূর্ব সেই বিজয়যাত্রার পথ বর্তমানে কতটা সুদৃঢ় আছে নাকি অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণুতা কবলিত। এ কথা মনে রাখতে হবে, স্বামীজী তাঁর মহান প্রত্যাবর্তনের সময়ে দেশের সর্বত্র যে অভ্যর্থনার আতিশয্যে চমকিত হয়েছেন তেমনটি নয়, সয়েছেন অবজ্ঞার উদাসীনতাও। অগ্রসর হতে হতে দেখবো ইতিহাসের বুকে লুকিয়ে থাকা চোরা সে ফল্গুধারাকে। 
২৭শে জানুয়ারি, স্মৃতি স্তম্ভ প্রোথিত হয়ার পর পাম্বানে স্বামীজী কাটান আরো দু দিন। ২৯ শে জানুয়ারি ভোর ৪ টায় তিনি যাত্রা শুরু করেন রামনাদের উদ্দেশ্যে। রামনাদে রাজা ভাস্কর সেতুপতির আন্তরিক আতিথেয়তায় স্বামীজী সেখানে কাটান আরও দুই দিন। তারপর ৩১ শে জানুয়ারি স্বামীজী মধ্যরাত্রে রামনাদ ছেড়ে মাদ্রাজের (বর্তমানে চেন্নাই, এই নিবন্ধে সর্বত্র ‘মাদ্রাজ’ - এই পূর্ব নামেই উল্লেখিত থাকবে) দিকে রওনা দেন। মাদ্রাজের পথে তাঁর প্রথম বিরামস্থল পরমকুদি, পরমকুদির পর মনমাদুরা। সেখানে মনমাদুরা এবং শিবগঙ্গার জমিদার ও অন্যান্য অধিবাসিরা স্বামীজীকে অভিনন্দন পত্র প্রদান করেন। ২রা ফেব্রুয়ারি মনমাদুরা থেকে স্বামীজী মাদুরাই পৌঁছান। অভিনন্দনের ঢেউ এখানেও স্বামীজীকে অভিভূত করে। তিনি যারপরনাই আপ্লুত হয়ে এর উত্তরে বলেন, “হৃদয় সমুদ্রবৎ গভীর অথচ আকাশবৎ প্রশস্ত হওয়া চাই”। সেইদিন সন্ধ্যায় তিনি মাদুরাই থেকে ট্রেনে পৌঁছান কুম্ভকোনম। কুম্ভকোনমেও স্বামীজীকে দেওয়া হয় প্রবল উৎসাহে পরিপূর্ণ বিজয়ীর সম্মান। গৌরবময় অভিনন্দন। যার উত্তরে স্বামীজী সেখানে বেদান্তের উদ্দেশ্য নিয়ে এক সুদীর্ঘ এবং তথ্যবহুল বক্তৃতা দান করেন। যার পর প্রায় তিন দিন তিনি কুম্ভকোনমে কাটান খানিকটা বিশ্রাম করে। কারণ এর পরেই তাঁকে পৌঁছতে হবে মাদ্রাজ নগরীতে। যেখানে তিনি জেনেই ছিলেন তাঁর বিন্দুমাত্র অবকাশের সুযোগ থাকবেনা। অবশেষে ৬ই ফেব্রুয়ারি ট্রেনে করে স্বামীজী মাদ্রাজের এগমোর ষ্টেশনে এসে পৌঁছান। ষ্টেশনে তখন মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি সুব্রহ্মণ্য আয়ারের নেতৃত্বে অভ্যর্থনা সমিতি স্বামীজীকে  সমুচিত সংবর্ধনার জন্য প্রস্তুত, সঙ্গে শত সহস্র উৎসাহী নাগরিকের বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস, যা এক কথায় অভূতপূর্ব। পরের দিন এক বিখ্যাত সংবাদপত্রের পাতায় লেখা হয়, “সুপ্রাচীন কাল হইতে মাদ্রাজে আর কখনো কেহ এভাবে কোন দেশীয় বা ইউরোপীয় ব্যক্তিকে সংবর্ধনা জানাইতে দেখে নাই। সরকারি ভাবে যত অভ্যর্থনার আয়োজন হইয়াছিল, তাহার কোনটিই স্বামী বিবেকানন্দের সংবর্ধনার সমকক্ষ নহে। মাদ্রাজের বৃদ্ধতম ব্যক্তিও এরূপ সাদর সম্ভাষণের কথা স্মরণ করিতে পারে না এবং আমরা সাহসভরে বলিতে পারি, আজিকার দৃশ্যাবলীর স্মৃতি বর্তমান প্রজন্মের চিত্তে চিরকাল দৃঢ় ভাবে অঙ্কিত থাকিবে”। মাদ্রাজের সংবর্ধনাটিই যে ছিল শিকাগো থেকে শিয়ালদহ -স্বামীজির ভারত প্রত্যাবর্তনের সুবিশাল যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। স্বামীজীকে মাদ্রাজে, ইংরেজি, সংস্কৃত, তামিল, কানাড়া, তেলেগু ভাষায় মোট চব্বিশটি অভিনন্দন দেওয়া হয়। স্বামীজী সেখানে ছিলেন নয় দিন।  
স্বামী গম্ভিরানন্দ তাঁর “নিদ্রিত ভারত জাগে” প্রবন্ধে স্বামীজির নয় দিনের মাদ্রাজ যাপনকে নবরাত্রির উৎসবের সঙ্গে তুলনা করে লিখেছেন, “স্বামীজী যে নয় দিন মাদ্রাজে ছিলেন, সেই দিনগুলিতে যেন নবরাত্রির উৎসব লেগে গেছিল। এমনই বিপুল ছিল লোকসমাগম, ধুমধাম, অভিনন্দন ও বক্তৃতা”।
মাদ্রাজে স্বামীজীর মহামূল্যবান বক্তৃতার বিষয় এবং বক্তৃতা প্রদানের সময় সারনি ছিল এই রূপ ঃ     
১) আমার সমর নীতি (৯ই ফেব্রুয়ারি), ২) ভারতীয় মহাপুরুষগণ (১১ই ফেব্রুয়ারি), ৩)জাতীয় জীবনে বেদান্তের কার্যকারিতা (১৩ই ফেব্রুয়ারি), 8)ভারতের ভবিষ্যৎ (১৪ই ফেব্রুয়ারি)।
মাদ্রাজে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতা গুলি, বিশ্ববিশ্রুত ফরাসী কথা শিল্পী রোঁমা রোঁলার ভাষায় এক ‘জলপ্রপাত’ এর সৃষ্টি করেছিল। যার মধ্য থেকে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করেছিল এক নবজাগ্রত ভারতবর্ষের। 
মাদ্রাজ পর্ব সেরে স্বামীজীর এবার কোলকাতা ফেরার পালা। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভোর ৫ টায় তিনি মোম্বাসা জাহাজে করে মাদ্রাজ থেকে জন্মভূমি কোলকাতার উদ্দেশ্য রওনা দেন। এবং চার দিনের সমুদ্র যাত্রা শেষে ১৯ই ফেব্রুয়ারি, শুক্র বার, ভোর রাতে স্বামীজীর জাহাজ পৌঁছায় বজবজ বন্দরে। দীর্ঘ সাত বছর পর আবার প্রিয় জন্মভূমি বাংলার কোলে ফিরে আসার আনন্দে উদ্বেল স্বামীজী জাহাজেই অধীর  আগ্রহে অপেক্ষা করেন ভোরের আলো ফোটার। সকাল হতেই জাহাজ থেকে নেমে স্বামীজী এবং তাঁর সহযাত্রীরা পুরনো বজবজ ষ্টেশন থেকে এক স্পেশাল ট্রেনে করে রওনা দেন শিয়ালদহ ষ্টেশনের উদ্দেশ্য। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে বজবজের মাটিতে স্বামীজীকে সেদিন স্বাগত জানাতে কোনো আয়োজন বা মানুষের উপস্থিতি ছিল কিনা সে ব্যাপারে কোনো সংবাদপত্রেই কোনো খবর পাওয়া যায় না। বজবজ হচ্ছে সেই স্থান, যেখানে স্বামীজী শিকাগো থেকে ফিরে প্রথম ছুঁয়েছিলেন তাঁর মাতৃভূমি বাংলার মাটি। কিন্তু কলম্বো থেকে শুরু করে রামনাদ, মাদ্রাজ সব জায়গায় স্বামীজীকে দেওয়া হয়েছে সুমহান রাজকীয় সংবর্ধনা, বিশ্ববিজয়ী বীর সন্ন্যাসীর পায়ের নিচে পেতে দেওয়া হয়েছে অভ্যর্থনার রেড কার্পেট। কোথাও তাঁর পা মাটিতে ফেলতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু ঘরের মাটিতেই বীর নায়কের প্রত্যাবর্তনের মত ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল সবার অলক্ষে। নিদারুন ছন্দপতন ছাড়া কি! ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়- সপার্ষদ স্বামীজী জেটি থেকে অগ্রসর হচ্ছেন বজবজ পুরনো ষ্টেশনের দিকে; শিয়ালদহ মুখি স্পেশাল ট্রেনের উদ্দেশ্য, অথচ কোথাও কেউ নেই ঘরের ছেলেকে বিশ্বজয়ের অভিনন্দন বার্তা টুকু পৌঁছে দেবে। বজবজের মাটিতে স্বামীজীর এমন নীরব প্রস্থানের কথা ভেবে অবাক হওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকে না। গুম মেরে থাকা সেদিনকার সেই অদ্ভুত শীতের ভোর যেন আদর্শ প্রেক্ষাপট হয়ে থেকে যায় এমন ঐতিহাসিক উদাসীনতার। 

সেই যাত্রায়, শিয়ালদহ অবশ্য ঘরের ছেলেকে নিরাশ করেনি। সকাল সাড়ে সাত টায় স্বামীজীকে নিয়ে স্পেশাল ট্রেন পৌঁছায় শিয়ালদহে। ২০,০০০ এরও বেশি মানুষ- তাদের উত্তাল উচ্ছ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছিল শিয়ালদহ ষ্টেশনে। বিশ্ববিজয় করে ফেরা ঘরের ছেলের ঘরের মাটিতে পা রাখার সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকার উদ্দেশ্যে।  বিপুল জনতার এমন উদ্দাম সংবর্ধনার মধ্যে স্বামীজী বেরিয়ে আসেন শিয়ালদহ ষ্টেশনের বাইরে। যেখানে অপেক্ষা করছিল বিশেষভাবে সজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। সেই পাম্বান থেকে মাদ্রাজ – বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে বীর সন্ন্যাসীর রথ সহর্ষে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও রাজা সহ তাঁর সভাসদ আবার কোথাও সহস্র শ্রদ্ধাপ্লুত মানুষ।  এখানেও তার অন্যথা হল না। গাড়ির ঘোড়া খুলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই স্বামীজির গাড়িকে টেনে নি্য়ে চলল রিপন কলেজের (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) দিকে। পেছনে স্বামীজীর গাড়ি অনুসরন করে চলল অসংখ্য আবেগাপ্লুত মানুষের সুবিশাল শোভাযাত্রা।
স্বামী শুদ্ধানন্দ সেই অবিস্মরনীয় ঘটনার সাক্ষী। তাঁর লেখায় সুন্দর ভাবে ফুটে উঠতে দেখবো স্বামীজীর শিয়ালদহ ষ্টেশনে পদার্পণের সেই  ঐতিহাসিক ক্ষণের স্মৃতি। “আজ স্বামী বিবেকানন্দ শিয়ালদহ ষ্টেশনে তাঁহার কলিকাতা নগরীতে পদার্পণ করিবেন। আজ তাঁহার শ্রী মূর্তি দর্শনে চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হইবে, তাই প্রত্যুষে উঠিয়াই শিয়ালদহ ষ্টেশনে উপস্থিত হইলাম। এত প্রত্যুষে স্বামীজির অভ্যর্থনায় বহু লোকের সমাগম হইয়াছে। অনেক পরিচিত ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ হইল। তাঁহার সম্বন্ধে কথাবার্তা করিতে লাগিয়া দেখিলাম ইংরেজিতে মুদ্রিত দুইটি কাগজ বিতরিত হইতেছে। পড়িয়া দেখিলাম, তাঁহার লন্ডনবাসী ও আমেরিকাবাসী ছাত্র বৃন্দ বিদায়কালে তাঁহার গুন-গান বর্ণনা করিয়া তাঁহার প্রতি কৃতজ্ঞতাসূচক যে অভিনন্দন পত্রদ্বয় প্রদান করেন, ঐ দুইটি তাহাই। ক্রমে স্বামীজির দর্শনার্থী লোকসমূহ দলে দলে সমাগত হইতে লাগিল। ষ্টেশন- প্লাটফর্ম লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল। সকলেই পরস্পরকে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, স্বামীজির আসিবার আর কত বিলম্ব? শুনা গেল তিনি একখানা স্পেশাল ট্রেনে আসিবেন। আসিবার আর বিলম্ব নাই। ঐ যে, গাড়ির শব্দ শুনা যাইতেছে। ক্রমে সশব্দে ট্রেন প্লাটফর্মে প্রবেশ করিল। স্বামীজী যে গাড়ি খানিতে ছিলেন সেটি যেখানে আসিয়া থামিল, সৌভাগ্যক্রমে আমি ঠিক তাহার সম্মুখেই দাঁড়াইয়াছিলাম। যেই গাড়ি থামিল, দেখিলাম স্বামীজী দাঁড়াইয়া সমবেত সকলকে করজোড়ে প্রনাম করিলেন। এই এক প্রনামেই স্বামীজী আমার হৃদয় আকর্ষণ করিলেন। তখন ট্রেন-মধ্যস্থ স্বামীজীর মূর্তি মোটামুটি দেখিয়া লইলাম। তার পরেই অভ্যর্থনা সমিতির শ্রী যুক্ত নরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ ব্যক্তিগণ আসিয়া তাঁহাকে ট্রেন হইতে নামাইয়া কিছু দূরবর্তী একখানি গাড়িতে উঠাইলেন। অনেকে স্বামীজীকে প্রনাম ও তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিতে অগ্রসর হইলেন। সেখানে খুব ভিড় জমিয়া গেল। এ দিকে দর্শকগণের হৃদয় হইতে স্বতঃই “জয় স্বামী বিবেকানন্দজী কি জয়”, “জয় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কি জয়” – এই আনান্দ ধ্বনি উত্থিত হইতে লাগিল”।
শিকাগো থেকে শিয়ালদহ –  ধারাবাহিক সমাদর এবং  সংবর্ধনায়, স্বামীজির এই যাত্রাপথ ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। ‘হিন্দু’ পত্রিকা তার রিপোর্টে লিখেছিল, “এমনকি ভাইসরয়ের ভাগ্যেও তা কদাচিৎ ঘটে”। কিন্তু ঐতিহাসিক এই স্মৃতি রক্ষায় কতটা প্রযত্নবান আমরা, দেখবো এবার অ্যালবামের পাতা উল্টে।
 ১৯৯৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর (১০২ বছর পর) বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক বক্তৃতার স্মৃতিতে The Art Institute of Chicago, Fullerton Hall এর বাইরে স্থাপন করে একটা ব্রোঞ্জ প্রশস্তি ফলক। যা পুনঃস্থাপিত হয় ২০১২ সালের ২৮ এ জানুয়ারি। ফলকে বলা হয় ১৮৯৩ এর ১১ থেকে ২৭শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই স্থলে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে বিবেকানন্দই প্রথম ভারত থেকে আগত হিন্দু সন্ন্যাসী যিনি আমেরিকায় বেদান্ত শিক্ষা প্রদান করেন তাঁর অভূতপূর্ব সাফল্য প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের ধর্মগুলির মধ্যে কথোপকথনের পথ উন্মুক্ত করেছে বলেও ফলকে উল্লেখ করা হয়। ওই একই সাল অর্থাৎ ১৯৯৫ এরই আর একটা তারিখ ১১ই নভেম্বর, বিবেকানন্দ ভক্ত কোটি কোট মানুষের স্মৃতিতে যেদিনটির স্থান চির অমলিন থাকবে কারণ ওই দিন শিকাগো শহরের সেই বিখ্যাত The Art Institute of Chicago এর সামনে দিয়ে চলে যাওয়া মিশিগান Avenue এর একটা প্রান্তের নাম রাখা হয় Swami Vivekananda Way. 
এ তো গেল শিকাগোয় বিবেকানন্দের স্মৃতি রক্ষার প্রচেষ্টাগুলির এক ঝলক। ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি, পাম্বানে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভের সমুদ্রে চলে যাওয়ার কথা। বজবজের জেটিতে, শিকাগো থেকে শিয়ালদহ – সারা পথে যা হয়নি, বিশ্ববিজয়ী সন্ন্যাসীর প্রতি অর্পিত ধারাবাহিক অভ্যর্থনায় অভাবিত তালভঙ্গের কথা।
যদিও এই তালভঙ্গের বেদনায় কিছুটা প্রলেপ পড়ে অনেক পরে, ১৯৮৬ এর ১৯ শে ফেব্রুয়ারি। ৮৯ বছর বাদে। দেরীতে হলেও স্বামীজীর, শিকাগো-জয়ের পর বাংলার মাটিতে ফিরে আসার বিশেষ দিনটিকে উদযাপন করার মাধ্যমে ইতিহাসের এক অমূল্য স্মৃতিকে সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বিশিষ্ট সমাজসেবী গনেশ ঘোষের উদ্যোগে এবং পূর্ব রেলের সহযোগিতায় ঐ বিশেষ দিনটির উদযাপন শুরু হয় পুরনো বজবজ ষ্টেশনে। বজবজে, সম্বৎসর ১৯ শে ফেব্রুয়ারি দিনটি একটা অবশ্য পালনীয় দিন।  শুধু তাই নয়, স্বামীজীর সেদিনের সেই বিশেষ ট্রেনে করে বজবজ থেকে শিয়ালদহ পৌঁছানর স্মৃতিতে, ঐতিহাসিক ট্রেন যাত্রার ১২২ তম বছরে অর্থাৎ ২০১৮ এর ১৯ শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব রেল  বজবজ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত একটি বিশেষ ট্রেন চালাবারও সিদ্ধান্ত নেয়। 
কিন্তু শিয়ালদহ ষ্টেশন? শিয়ালদহে স্বামীজির ফেরার কোনো স্মৃতি তো নজরে পড়ে না -বর্তমানে। জগজ্জয়ী সন্ন্যাসীর ঘরে ফেরার দিনটি ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরনীয় হয়ে থাকলেও, শিয়ালদহ ষ্টেশনে তার চিহ্ন মাত্র নেই। শুধু শিয়ালদহ ষ্টেশনের ইতিহাসে নয়, বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে দিনটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ, তাকে  রক্ষা করার প্রশ্নে এত অনীহা কেন। রোঁমা রোঁলার ভাষায় যে বিজয় যাত্রা বিশ্ব আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে এক অভ্যুথান স্বরূপ,  এবং সেই অভ্যুত্থানের নায়ককে যিনি আখ্যায়িত করেন “অধ্যাত্মরাজ্যের নেপোলিয়ন” বলে, তাঁর সুমহান ঐতিহাসিক স্মৃতির শরিক হতে আমাদের নিশ্চেষ্ট থাকাটা যে যথেষ্ট পীড়াদায়ক, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও, কয়েক বছর আগেও কিন্তু, শিয়ালদহ ষ্টেশনের সাউথ সেকসনে- ট্রেন থেকে নেমে, পশ্চিম মুখি যে যাতায়াতের পথ, তার মাথার উপরে শোভা পেত প্রচীন খিলানের স্থাপত্য-নির্মাণ। এবং দুটি খিলানের মাঝখানে থাকতো চুন সুরকির তৈরি মোটা চৌকো থাম।  এবং এই থামগুলির কোনো একটির গায়ে অলংকৃত ছিল একটা মর্মর ফলক, যে ফলকে সগর্বে লেখা থাকতো ঘরের ছেলের শিকাগোয় বিশ্বজয়ের পর এই পথ দিয়ে  ঘরে ফেরার কথা। তারিখ - ১৮৯৭ এর ১৯শে ফেব্রুয়ারি। রোমাঞ্চিত করার মত সেই ফলক কোথায় উধাও! সম্প্রতি ষ্টেশন অট্টালিকার সংস্কার পর্বের পর, আর দেখা যায় না যাতায়াত পথের সেই সুদৃশ্য স্থাপত্যশৈলীকেও। নিরুদ্দিষ্ট ইতিহাস কি তবে বিস্মরণের পথে? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের পেতেই হবে। না হলে সমকাল এবং আগামী কেউই আমাদের ক্ষমা করবে না যে। 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...