সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দূর পথে দীপ্যমান অরন্য শিখা!

If winter comes can spring be far behind! বজ্রপাতের অশনি সংকেত যদি পড়া যায় আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা বিদ্যুৎ লেখায়, আকাশ ভাঙার শব্দে কি কোনো চমক বাকি থাকে? মাঘের শীত যদি এসেই পড়ে দাওয়ায়, ফাগুনের গুঞ্জন কি থাকে দূরের হাওয়ায়? হেঁয়ালি হদ্দ বাঙালি শীতের হাজত বাস কাটায় দূর পথে দীপ্যমান অরন্য শিখায় ফুটে ওঠা শোণিত ধারায় হেদিয়ে যাওয়া হৃদয়ের নীল ধমনীতে রঙের উৎসব পালনের একান্ত বাসনায়।
বছর কাটে – রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, দিনান্তিকে ঘরে ফেরা পাখিদের কলরবে, হয়তো বা মধ্যাহ্নে বাউলের রৌদ্র দগ্ধ কণ্ঠে গানের চাতকীতে – সময় যে এখানে কখন ঝড়ের মুখে কখন জাবর কাটে পালক বোলানো পবনের সুখে – কেউ জানে না।
কালের খেয়ালে-একদিন এসে পড়ে বুড়ো মাথার খুসকি ওড়ানো পৌষ-মাঘের পর্ণ মোচনের সেই রুক্ষতার দিন গুলো, ঝড়ে ওড়া খড় হীন চালার মত ওরা দাঁড়িয়ে থাকে পথেপ্রান্তরে; ধূসর কাণ্ডের ওপর পত্র হীন ডালা পালার কঙ্কাল মাথায়- সকল তরুবাসী আশ্রিতের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে  রঙচটা রৌদ্র-প্রবাসে।
রাত্রি শেষে শিশির সিক্ত বৃক্ষ তলে সকালের নরম রোদ যেন অবাধ প্রেমবারি, কখন যে বেলা গড়িয়ে বিকেলের পথে পড়ে থাকা ছিন্ন হলুদ পত্রের উপর এসে পড়ে আলোক শূন্যতা, সন্ধ্যার আলকাতরা লেপা আকাশের বুকে ফুটে ওঠা তারারা হয়তো এভাবে জানান দেয় শুষ্ক তরু শাখে রক্তমুখী নব অনল কুসুম প্রজ্বলিত হবার  দিন সমাগত প্রায়।
সেবার ঈদ ছিল দোল পূর্ণিমার আগের প্রতিপদে। ঈদের সেই ফিনফিনে কাস্তের মত চাঁদখানি তখন অপরাহ্ণের পশ্চিম আকাশে প্রায় ডুবে যাওয়ার মুখে।
কৃষ্ণনগর ষ্টেশনের ১ নং প্লাটফর্মে তখন বিকেল ৫ টা ২০ র শিয়ালদহ যাওয়ার ট্রেন ধরার ভিড়। এক বর্ষীয়ান চিকিৎসক, বয়সে তরুন এক ভেষজককে (ফার্মাসিস্ট) রসিকতা করে বলেছিলেন ঈদের চাঁদ এক দর্শনেই স্মৃতি হয়ে যায়। ভেষজক তার উত্তরে বলেছিল, এই কারনেই ঈদের চাঁদ সবার ভাগ্যে জোটে না। তবে চাঁদ উঠুক না উঠুক আজ কিন্তু ঈদ।  এদিকে দক্ষিণা হাওয়ায়, ষ্টেশনের পশ্চিমে কারশেডের মাথায় টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়ার সম্ভাষণী হিন্দোল  তখন অনেককে সম্মোহিত করে ফেলেছিল। প্রবীন চিকিৎসক তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মন্দ্রতা-ঋদ্ধ কণ্ঠে ভেষজকের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "একেই বলে The Flame Of Forest - মানে অরন্য শিখা।"  
 
"এই সেই কৃষ্ণচূড়া, যার তলে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ, হাতে হাত, কথা যেত হারিয়ে" - বহু পরিচিত এই গানের লাইন, কৃষ্ণচূড়াকে প্রায় The Flame of Love এ পরিনত করেছে, যার তাপ কখনো বয়ে আনে মিলনের মৌতাত, কখনো সাক্ষী থাকে বিরহের দুঃসহ দহন যন্ত্রণার।
পুরুলিয়া সংলগ্ন ঝাড়খণ্ডের মাল্ভুমি অঞ্চলে এক বন্ধুর কাছে গিয়ে কয়েকদিন থাকার সুবাদে আমার বেশ ভয় মিশ্রিত অনুরাগ জন্মেছিল ওখানকার জায়গা গুলির প্রতি। বন্ধু ওই অঞ্চলের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম গুলিতে এক এন জি ও র হয়ে কাজ করতো। তখন মাওবাদীরা ওখানে বেশ সক্রিয় ছিল। ওদের গতিবিধি সম্পর্কে বন্ধু আমাকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল এবং বারন করেছিল সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরুতে না। রাত্রিতে ওখানকার পথ, প্রান্তর, পাহাড়, জঙ্গল সব চলে যায় মাওবাদীদের দখলে। এরই মধ্যে এক দিন ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাতে দেখলাম বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমির বুকে ফুলে ফুলে ছয়লাপ এক পলাশ গাছ কে। আরো দেখলাম মেঘেদের ছায়ার পেছন পেছন জ্যোৎস্নাগুলো দল বেঁধে চলে আসছে পলাশ গাছের তলায় গোপন মিটিং সারতে। সবই অবশ্য স্বপ্নে দেখা। কারণ স্বপ্ন ভেঙ্গে শুনি দরজায় কারা যেন জোর জোর লাথি মারছে। পাশে শুয়ে থাকা বন্ধু দেখি বিছানায় উঠে বসেছে, রাজ্যের ভয় যেন ওর চোখে মুখে আতঙ্কের পাহাড় হয়ে চেপে বসেছে। নির্বাক এবং দৃশ্যতই ঠক ঠক করে কাঁপছে। প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মত অবস্থা। এদিকে বাইরে, দরজা প্রায় ভেঙ্গে ফেলার জোগাড়। উপায় না দেখে, বন্ধু কোনোরকম দরজার কাছে গিয়ে ছিটকিনি খুলতেই একদল উত্তেজিত মানুষ, মুখে কালো কাপড় বাঁধা, হুড়মুড়িয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকেই আমার দিকে প্রায় ধাওয়া করে চলে আসে এবং বলতে থাকে কোলকাতা থেকে গোয়েন্দা গিরি করতে আসা হয়েছে না। কোনো কিছু বলার আগেই, আমাকে প্রায় চ্যাং দোলা করে বাড়ির বাইরে ওই আদিগন্ত ফাঁকা মাঠে নিয়ে চলে আসে। এবং ফেসে যাওয়া ধামসার মত মাটিতে ফেলে দেয়। বুঝে যাই, যমদূতেদের হাতে পড়েছি।
আকাশ ফাটা পূর্ণিমার আলোয় তখন দিগ্বিদিক হারা লাল মাটির চরাচর। মাটি ফুঁড়ে সারি সারি কমলা বর্ণের অগ্নিশিখা সজ্জিত হিমায়িত পলাশের ফুলদানি, নিস্পন্দ; যেন কোনো মায়াবী জাদু কাঠির স্পর্শে থেমে গেছে তাদের তপ্ত লেলিহান অভিযান। নির্ঘাত মৃত্যুর মুখে শুয়ে আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম দূর প্রান্তরে দীপ্যমান অরন্য শিখার দিকে। হঠাৎ বন্ধুর ডাকাডাকিতে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে দেখি মাঠে নয়  বিছানাতেই ছিলাম এতক্ষণ। চারিদিকে প্রভাতী আলোর ভৈরবী হানা। খোলা জানালা দিয়ে চোখ চলে যায়, দূরের উঁচু শিমূল গাছটার মাথায় ফুটে থাকা অজস্র লাল 
আগুনে পাপড়ির মায়াবী আগ্রাসনের দিকে। সম্বিৎ ফেরে, স্বপ্ন ভাঙ্গাটাও আসলে স্বপ্নেরই অংশ ছিল। স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প আর কখনো শুনেছেন নাকি? 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...