সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিজন পথ এবং হঠাৎ বসন্ত!

বিজন পথ। দু পাশে বিস্তীর্ণ ধূধূ মাঠ। ছায়া হীন দ্বিপ্রহর। তপনতাপে কম্পিত দিকচক্রবাল। মেঘ ছায়া অভিলাষে  ত্রস্ত প্রাণ ভাবে, দীগন্তের ওপারে বুঝি জুড়াবে দগ্ধ পরান। দূরে কোথাও জলের সিক্ততা, পথের নিদারুন ছলনা বৈ কিছু নয়। একাকী পথিক তা জানে না এমন নয়। প্রকৃতি বিজ্ঞানে একেই বলে আলোকের অভ্যন্তরীন পূর্ণ প্রতিফলন। চলভাষের ক্যামেরায় ধরা থাকে পথের বুকে ক্রমশ অপস্রিয়মাণ সে মরীচিকার স্থিরচিত্র। ধরা থাকে না, ক্রমশ অপস্রিয়মাণ দীকবালিকা যে মায়াবী ছলনায় রৌদ্রবিলাসী এই পথ এবং তার পথিককে টেনে নিয়ে চলে ক্রমাগত অন্ত থেকে অন্তহীনতার পথে, সেই সোনার হরিণ শিকারের রূপকথা চিরকালই থেকে যায় অধরা।  
তাকে ছুঁতে গিয়েও ছুঁতে না পারার মধ্যে না জানি কোন জেদ কাজ করে, ক্লান্ত হয়েও ক্লান্ত না হওয়ার ভাণ করে যেন শেষ দেখেই ছাড়বে এমন ভাব নিয়ে পথিক ছুটে যায় আকাশ ও মাটির মিলিত শয্যায় শুয়ে থাকা ছায়া ছায়া সবুজের বিকিনি পরা দিককন্যার পানে।
এমনি করে কখন যে দুপুর গড়িয়ে সূর্য, মধ্য গগন ছেড়ে পশ্চিমের অলস বৈকালিক-কোণ থেকে আলোকসম্পাত করা শুরু করে পূবের মাচায় ঘটমান দৃশ্যপটের উপর, স্পষ্ট হয় পূব পানে অগ্রসর পথিকের ছায়া যখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হয় এবং এগিয়ে চলে পথিকেরও আগে আগে। পশ্চিমি সূর্যের মায়ারুন আলোক প্রক্ষেপণে তখন পূবের দিকবালা আরও সবুজ আরও রোমান্টিক। তার বৃষ্টি ধোওয়া স্নিগ্ধতায় সোনালী রশ্মীর অপরূপ আপতনে জেগে ওঠা উচ্ছ্বসিত শোভা সত্যিই নয়নলোভা। উপরি পাওনা জোটে ভেজা হাওয়ার সাথে পথিকের চোখে মুখে এসে পড়া বৃষ্টিচ্ছাসের বিন্দু বিন্দু শীতল পরশ; রটে যায় ওই প্রান্তে এক্ষনি হয়ে যাওয়া এক পশলা বৃষ্টি পাতের স্নিগ্ধ সংবাদ।
স্ফটিক স্বচ্ছ বৃষ্টি বিন্দুর মধ্য দিয়ে আপতিত সূর্যালোকের প্রতিসরণের কারনে বিচ্ছুরিত আলোকের পিচকারী আচম্বিতে আকাশের পূব দীগন্তে সূচনা করে অকাল বসন্ত উৎসবের। উত্থিত হয়ে পড়ে সাত রঙের অর্ধগোলাকৃতি তোরণ! যেন পথিককে স্বাগত জানানোর জন্য তার দীর্ঘ আগ্রহে অপেক্ষমাণ থাকার কথা ঘোষণা করে সদর্পে। বেগুনী, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা এবং লাল, সপ্তবর্ণের কোলাজ-বেনিআসহকলা!  ভিন্ন ভিন্ন সাত রঙা ফাগ ছড়িয়ে যেন আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা ধনুকাকার বসন্ত বর্ণালী; বৃত্ত সম্পূর্ণ করার আগেই - বিহ্বল আবেগে দীগন্ত ছুঁয়ে , সেঁধিয়ে যায় ধরার বুকে। "কে যেন আবির - ছড়িয়ে দিল …"। এমনই হঠাৎ বসন্ত - বিজন পথে হেঁটে চলা পথিকের চোখে!
কিন্তু কে এই পথিক? যে যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে নিরীক্ষণ করে চলেছে প্রকৃতির এই  অনির্বচনীয় শোভা বৃষ্টিধনুকে (RAINBOW)? কখনো পথিক তাকে দশরথ পুত্র রামচন্দ্রের ধনুকের (রামধনু) সঙ্গে তুলনা করেছে, কখনো দেবরাজ ইন্দ্রের (ইন্দ্রধনু)। আকাশে ওড়া পাখির চোখে কিন্তু তা ধনুকাকার নয় -  সাত রঙের সাতটি তরঙ্গের সম্পূর্ণ করা এক বৃত্তের।
ছোটবেলায় এক গ্রাস জল মুখে পুরে ফুঁ মেরে আকাশের জ্বলন্ত সূর্যের দিকে ছুঁড়ে দিতাম আর সহস্র শুভ্র জলকুচি সূর্যালোকের সাথে টক্কর খেয়ে হয়ে যেত রামধনুর রঙে রঙিন।
বাংলাদেশে কিন্তু রামধনু কে বলা হয় রংধনু। রংধনু তে খালি চোখে তিনটে রঙকে ভালো করে চেনা যায়। লাল, সবুজ এবং হলুদ। সপ্তদশ শতকে বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন যদি না আলো কে প্রিজমের মধ্য দিয়ে পাঠিয়ে দেখাতেন আসলে রংধনু তে তিন বা দুই নয় আছে সাত সাতটি রঙ, কেউই জানতে পারতো না বাকি রঙ গুলোর কথা। 
তাহলে নিউটনও কি একদা হেঁটেছিলেন একা ইংল্যান্ডের কোনো পথ ধরে? বৃষ্টি ধোওয়া  অপরাহ্ণে  আকাশের বুকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন হঠাৎ বসন্তকে? এ প্রশ্ন তোলা থাক আগামীর কাছে।  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...