ঢাকুরিয়া ষ্টেশনের ১ নং প্লাটফর্মের উপরে দেখেছিলাম, তাদের! উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত প্লাটফর্মটির মাথা যদি শিয়ালদার দিকে হয়, তবে তার একেবারে লেজের দিকটায়, প্রথম যে সিঁড়িটা ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে নেমে গেছে ধাপে ধাপে, দেখতে যেটাকে অনেকটা পুরনো দিনের পুকুর ঘাটের মত লাগে, তার ঠিক মাথায়। দেখেছিলাম, দুজনে দাঁড়িয়ে আছে, একসাথে। একই বেদিমূলে। ত্রিভঙ্গ ঢঙ্গে, মুখোমুখি। ইট- সিমেন্টের উপর লাল রঙ লেপা একটা গোলাকার অনুচ্চ ঘেরাটোপের মধ্যে পাশাপাশি, যেন নৈকট্যের নৈশব্দ ভেঙ্গে আলিঙ্গনের আগ্রহে উন্মুখ, বিমূর্ত কোনো ভাস্কর্য জুটি!
একজনের পরনে ধুলোবালিতে ভরা সরু পাড়ের, মলিন একখানা সাদা ধুতি। আর একজনের, লাল ছাপা শাড়ী। সিঁদুর-চন্দন চর্চিত দেহ কাণ্ডের মাথায় ঘন পল্লবে ঢাকা নিবিড় যৌথ যাপন, তাদের। মৃদু বাতাসেও মনোরম গা ঘেঁষাঘেঁষি সঙ্গে কখনো রিমঝিম কখনো ফুরফুরে খুনসুটি। গেরস্থালীর উপকরণ বলতে ঝুলে থাকা দুচারটি মাটির কলসী। পায়ের কাছে ছড়ানো গাঁদা, মালতী, বেল, তুলসী। আর পুড়ে যাওয়া ধূপের ছাই। ট্রেন লাইনের যাত্রী থেকে পথচলতি মানুষজন সবাই এদের সামনে একবার অন্তত কপালে হাত ঠেকিয়ে ঠুকে যান প্রনাম-সেলাম। আমি একদিন, পাশেরই এক বুড়ি মাসীর মনোহারী দোকানে গিয়ে সোজা এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে, মাসী বড় বড় চোখ করে, হাত দুটোকে বুকের কাছে নমস্কার করার ঢঙ্গে জড়ো করে বললেন, "ওরে বাবা, এরা দুজন তো এখানে স্বামী - স্ত্রী।" সত্যি? বিস্ময়ে আর আনন্দে যেন কথা হারিয়ে গেল আমার। কিছুটা এগিয়ে, আপন মনে দাঁড়িয়ে পড়লাম মনের মধ্যে ভিড় করে আসা হাজারো প্রশ্নের সামনে।
কারা এই অভিনব দম্পতি? কি তাদের পরিচয়? যারা নিত্য রচনা করে চলেছে - একই আকাশের নীচে বেড়ে ওঠা, একই রোদ-ঝড়-জলে লালিত দুই স্থিরপদ-উদ্ভিন্ন জীবনের এমন রোমাঞ্চকর দাম্পত্য যাপনের ইতিবৃত্ত!
কথায় আছে, বিবাহের পরিকল্পনা রচিত হয় স্বর্গে। এমনকি লিভ-ইন কিংবা বিবাহ বহির্ভূত কোনো সম্পর্ক, যেখানেই দুজনের একসঙ্গে থাকার গল্প সবেতেই নাকি স্বর্গের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক থাকে ঘটনার পেছনে। তবে কি রেল লাইনের ধারে, কাঁটা মনসা গাছের রূপ ধরে দেবী মনসার এ হেন দাম্পত্য যাপনও বিধাতার ইচ্ছাধীন ছিল?
'পুতুল নাচের ইতিকথা'য় সূত্রধর চাইলে সবই সম্ভব। আর এখানে তো সূত্রধর নিজেই নেমেছেন মঞ্চে, পদ্মাবতী ওরফে মনসার পতিদেবের ভূমিকায়, অশ্বত্থ গাছের রূপ ধরে। স্কন্দ পুরান অনুসারে অশ্বত্থই ভগবান বিষ্ণুর প্রতীক। তাই এর পূজার মাধ্যমে মূর্তি ছাড়াই ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা সম্ভব। শুধু তাই নয়, স্বয়ং কৃষ্ণ, ‘গীতা’র দশম অধ্যায়ে বিভূতি যোগ বর্ণনা কালে, সখা অর্জুনকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়েছেন সে কথা, "গাছেদের মধ্যে আমিই অশ্বত্থ।" এ হেন বিষ্ণুদেব তথা তাঁর অবতার কৃষ্ণের, দেবী মনসার সঙ্গে এই উদ্ভিদ রূপি দাম্পত্য বাস কিন্তু বিরলতম একটা ঘটনা। সেই পুরানের আমল থেকে আজ পর্যন্ত যার জুড়ি মেলা ভার। বিশেষত ঢাকুরিয়ার মত মামুলি এক ষ্টেশনের ততোধিক মামুলী এইরকম এক প্লাটফর্মের বুকে তো ভাবাই যায় না। সম্পর্কের কোন রসায়নে অশ্বত্থ আর মনসার এমন অতিজাগতিক মিলন যে সম্ভব হল এখানে, তা বোঝা - এককথায় শিবেরও অসাধ্য।
কারণ বেশির ভাগ সময়, অশ্বত্থকে দেখা গেছে বট বৃক্ষের সঙ্গেই দাম্পত্যের বন্ধনে আবদ্ধ হতে। দীর্ঘদিনের সঙ্গী বটকে ছেড়ে, অশ্বত্থের তাই মনসাকে নতুন সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেওয়ার পেছনে সম্পর্কের একঘেয়েমী কাটানোর গল্প আছে কিনা কে বলতে পারে! এমনকি বট এবং অশ্বত্থের বিয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় রামায়ণেও। বাংলায়, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জের শিবনিবাস মন্দির প্রাঙ্গনে বট এবং অশ্বত্থের বিয়ের ইতিহাস রয়েছে। বহু বছর পরে- সম্প্রতি সেই ইতিহাসের আবার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা গেছে, শিবনিবাস গ্রামে। খবরে প্রকাশ, নতুন করে আবার বট এবং অশ্বত্থের বিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই গ্রামে। গ্রামবাসীরা রীতিমত ঘটা করে আয়োজন করেছিলেন এই দুই বৃক্ষের শুভ পরিণয়ের। সম্পূর্ণ ভাবে শাস্ত্র মেনে, পুরোহিত ডেকে এবং বৈদিক মন্ত্র উচ্চারন করে সম্পন্ন হয় বিয়ের অনুষ্ঠান। পাশাপাশি তিনটি গ্রামের কয়েক হাজার লোক অংশগ্রহণ করেছিলেন এই বিয়েতে। ব্যবস্থা ছিল কব্জি ডুবিয়ে ভুরিভোজের। শোভাযাত্রা করে, ব্যান্ড পার্টি- তাসার তালে নাচতে নাচতে তিন গ্রাম ঘুরে বিয়ের জল সাজতে যাওয়ার খবরে রীতিমত সাড়া পড়ে গেছিল চারিদিকে। বিয়েতে বট বৃক্ষ, যিনি দেবী লক্ষ্মীর প্রতিভূ, পতি রূপে বরণ করে নেন নারায়ণ রূপী অশ্বত্থকে। বাঁধা হয় ছাদনাতলা। গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে, উলুধ্বনি, মালাবদল, সিঁদুর দান, বাদ যায়নি কিছুই। একই ছবি - যেখানে যেখানে বট এবং অশ্বত্থের বিয়ে হয়েছে, সব জায়গাতেই।
নদীয়ারই মাজদিয়া, পলাশীপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে আবার ষষ্টি পূজার পূর্বে বট ও অশ্বত্থের মধ্যে বিয়ে দেওয়ার চল আছে। ওড়িশার কেন্দ্রাপাড়ার জমাধার গ্রামে যে বট আর অশ্বত্থের বিয়ে হয়, সেখানে আবার উলটো পুরান। কারণ বট এখানে পাত্রের ভূমিকায়, আর অশ্বত্থ পাত্রী। এই বিয়েতে বটকে নারায়নের এবং অশ্বত্থকে লক্ষ্মীর রূপ ধরা হয়। অশ্বত্থকে লক্ষ্মী হিসেবে ধরা কিন্তু একান্তই লৌকিক ভাবনা। শাস্ত্রের কোথাও কিন্তু এর সমর্থন নেই। স্কন্দ এবং পদ্ম পুরান অনুসারে অশ্বত্থ বৃক্ষে যে তিন পরমেশ্বর অবস্থান করেন, তারা সবাই পুরুষ। মূলে ব্রহ্মদেব, কাণ্ডে বিষ্ণু এবং পাতায় ভগবান শিব। তাও অশ্বত্থের এই লিঙ্গ পরিবর্তনের কারণ সম্ভবত লুকিয়ে আছে প্রচলিত লোকগাথায়, যেখানে অশ্বত্থকে তুষ্ট করলে লক্ষ্মীর কৃপা পাওয়া যায় বলে কথিত আছে। প্রচলিত ধারনায়, সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী নাকি প্রতি শনিবার বিরাজিতা থাকেন এই অশ্বত্থের কোলে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন