সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পথে নয় বেপথেই ঝরে চাঁদ থেকে মধু!

    জলঙ্গির নিস্তরঙ্গ জলে - সবে অম্বর রাজ্যের চন্দ্র বণিক ভাসিয়েছে তার রজতপঙ্খি নাও। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, গুম মেরে থাকা সন্ধ্যার অন্ধকারটাকে, ধীরে ধীরে চাঁদের আলোয় দ্রবীভূত হয়ে যেতে। নদীর বুক, পাড়, বালির চর, কাশবন যেন রূপোলী রশ্মির ঝরনা তলায় শুয়ে থাকা সাপের খোলসের মত জেগে উঠছিল লুপ্ত আয়নায় হারানো স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস হয়ে।
নদীর পশ্চিম পাড়ের কংক্রিটের বেঞ্চ গুলিতে তখন বেশ কয়েকজন যুবক যুবতী চুটিয়ে প্রেম করাতে ব্যস্ত। চাঁদের আলোয়, আদরের আড়াল খুলে পড়লেও, উন্মাদনায় কিছু মাত্র ভাটা পড়েছিল বলে মনে হয় না।
জলঙ্গির জলে, সেই সময় নাইতে নামা পূর্ণিমার চাঁদ যেন টলটলে পদ্ম পাতা - স্থির, নিষ্কম্প। অবচেতনের লজ্জায় সেদিনকার সেই চাঁদের অবগাহন ছিল অভিসারিণীর মত। গোপন মধুযাপনের স্বপ্নে বিভোর। সেতুর উপর, আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এক তরুন, একা। বিক্ষিপ্ত খেয়ালে সে বারবার নদীর জলে ইট ফেলে বিস্রস্ত করে দিচ্ছিল স্বপ্নের ঘোর। অহেতুক ঢেউয়ের দোলায় ভেঙ্গে যাচ্ছিল জলে ভেজা চাঁদের শরীর। পাগল করা জ্যোৎস্না ধারায় যদিও তা কোনো দাগ কাটতে পারছিল না।
আসলে কিছু মানুষ, ওই ছেলেটির মত একা সেতুর উপর দাঁড়িয়ে বাধ্য হয় 'ঠিক' পথে চলতে। আর পাড়ে বসা যুবক যুবতীরা 'বেপথু' হয় নিজেদের খুশিতে। যেখানে চাঁদ সত্যি সত্যিই মধু ঝরায়। আর তথাকথিত 'পথে' থাকা ওই তরুনের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ, অন্ন শূন্য থালার মত মূল্যহীন হয়ে জলঙ্গির জলে ভেসে থাকে। পথ আর বেপথের তত্ত্ব তাই আপেক্ষিক। দেব আর অসুরের মত পথ এবং বেপথের মধ্যেকার বিবাদেরও তাই কোনো অন্ত নেই।
পথিক যখন মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়ায়, তার মনের দড়ি ধরে রীতিমত টানা টানি শুরু করে দেয় এই দুই জন, প্রায় ভক্তদের নিয়ে পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা যেমন করে। পথ চলা যদি পথিকের কাছে দায় রক্ষার ব্যাপার হয়, বিপথগামী হলে আবার মেলে নষ্ট হওয়ার রোমাঞ্চ। ঠিক যেরকম শীতের সকালে গেঁজে যাওয়া খেজুরের রস। পথে, থাকে না কোনো মায়া। দিনের শেষে নিছক 
কায়া আর ছায়ার মরণপণ লড়াইয়ের পটভূমি হয়েই থেকে যায়। আর বেপথে থাকে অপার মুগ্ধতার মায়াজাল। তাকে ছেঁড়ার সাধ্য যেমন কারোর নেই, ছিঁড়ে ফেলার সাধও জাগে না কারোর মনে। কারণ স্খলিত কামনা মিটেও মেটে না। আর এখানেই শুরু হয় লড়াই, পথের সঙ্গে বেপথের। মনের মধ্যে ভিড় করে আসে হাজারো অবাধ্য প্রশ্ন। প্রলোভনের মুখে, 
সোজা পথে হাঁটা পথিক কি পারবে বেপথের সব সোনার হরিণগুলির আড়ালে থাকা মারীচ রাক্ষসদের চিনে নিতে?
এইরকমেরই এক অচিন জিজ্ঞাসাকে পুঁজি করে একদিন সন্ধ্যায়, আমার পূর্ব চাকরী স্থল নদীয়ার পলাশীপাড়ায়, সেখানকার ব্লক হাসপাতালের ছোট্ট কোয়ার্টারে বসে লিখে ফেলেছিলাম নীচের এই কবিতাটি। তাড়া ছিল, কারণ ‘সমন্বয়’ পত্রিকায় সেবার পূজা সংখ্যায় লেখা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রন এসেছিল সংশ্লিষ্ট মহল থেকে আর হাতে বেশী সময় ছিল না।

কবিতাটিতে অদ্ভুত ভাবে এসেছিল মধুক্ষরা চাঁদের কথা। এসেছিল সেই চাঁদের মধু চুষে খাওয়ার অনুষঙ্গও। ওপরের লেখা থেকে মনে হতে পারে, ঠিক পথে চলা মানুষজনের বুঝি বেপথু হওয়ার ক্ষমতা নেই তাই বাধ্য হয়ে হাঁটে সোজা পথে। কিন্তু কবিতাটি বলে অন্য কথা। যেখানে অবশ্যম্ভাবী ভাবে থাকে বেপথের মায়াবী হাতছানিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা। আমার নিশ্চল বিশ্বাস, কবিতাটির সম্পূর্ণ পাঠ, পাঠকের মনে জাগিয়ে তুলতে পারবে 'বেপথে' ঝরা মধু-আস্বাদনের আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারার অন্য আকর্ষণ। তাই কবিতাটি পড়ার আর্জি জানিয়ে একটাই কথা বলবো, যদি লেখকের বুকের আগুনে কখনো জ্বালানোর দরকার পড়ে অন্ধকার পথে দিশা দেখানো কোনো দুর্জয় আলোকবর্তিকাকে, তাহলে স্বাগত। কারণ কবিতার এই আলো, আসলে লেখকের মনের আলো, যা কখনো বাঁকা পথে চলে না। অন্ধকারের প্রাচীর ভেদ করেও, সোজা পৌঁছে যায়  - হতাশ মানুষের চোখে, সুড়ঙ্গ শেষের রুপোলী রেখা হয়ে।

পথ-বেপথ   
দেবাশিস জানা  

পথেই আছি! এক্কেবারে সোজা।/ আঁধার চিরে আলোর রেখার মতো।/ রাস্তায় সরাইখানার উদম খাটিয়াগুলো/ চিত হয়ে শুয়ে, বলেছিল – এসো, একসাথে/ চাঁদের মধু চুষে খাই।/ আমার মুখে আগুনের স্বাদ/ হোমকুণ্ডের খিদে।

ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিগুলো আবার জেগে/  ওঠার আগে যেন নিভে না যায়।/ দুর্মুখগুলোর লালার স্রোত/ ঘর পোড়া গরুর মত ছুটে আসে/ দমকলের মলম ছেটাতে।/ এ জন্মে দেখো আমার প্রাণ বায়ু ফুঁকেও/ জ্বালিয়ে রাখবো যত রাবণের চিতে। 



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...