সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দূরের পথিক কিশোর কুমার


 "সে যে পথিক, হৃদয়পথের পথিক"। ১৯২৯ এর ৪ ঠা আগস্ট মধ্যপ্রদেশের খানডোয়ায় শুরু হয়েছিলো সে পথিকের পথ চলা, ৫৮ বছর পরে ১৯৮৭ এর ১৩ ই অক্টোবর মুম্বাই এর গৌরী কুঞ্জে খানিকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই ছেদ পড়ে সে যাত্রাপথে। ৫৮ বছরের এই জীবন এবং তার যাত্রাপথ ছুঁয়ে গেছে বহু পথ, বহু পথকে দিয়েছে নতুন দিকচিহ্ন, বহু পথ পেয়েছে নতুন দিশা, বহু পথের ফলকে লেখা হয়েছে নতুন নাম কিশোর কুমার। হ্যাঁ, কিশোর কুমার আসলে ছিলেন বহু পথের পথিক।  দূরের পথিক কিশোর কুমার।  
কিশোর কুমার যে আসলে কি ছিলেন, তা এক কথায় বলে বোঝানো মুশকিল।  সঙ্গীত শিল্পী কিশোর কুমার, রুপোলী পর্দার  হিরো কিশোর কুমার, সুরকার কিশোর কুমার, গীতিকার কিশোর কুমার, চিত্র পরিচালক, চিত্র প্রযোজক কিশোর কুমার! প্রত্যেকটি সত্তাই তাদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে রেখে গেছে  অনপনেয় ছাপ; নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বকীয়তায় স্বমহিম উজ্জ্বলতা। কিন্তু দিনের শেষে এরা সবাই যে পথে  এসে মিলিত হয় সে পথ মানুষের স্মৃতির স্মরণিকায় চির অমর এক সরণি;  যুগের পর যুগ ধরে অক্ষয় এবং অমোঘ তার অস্তিত্ব, তিনি কিশোর কুমার।  
পথিকের যেমন পথ চলাতেই আনন্দ। কিশোর কুমা্রও ভালোবাসতেন পথ চলতে।  যে পথের কোন অন্ত নেই। 
 ১৯৭১ এ কিশোর কুমারের পরিচালনায় একটি ছবি মুক্তি পায়। ছবির নাম "দূর কা রাহি"। দূরের পথিক। ছবিতে প্রশান্ত নামের এক সমাজ কর্মীই সেই "দূর কা রাহি"। মানুষের কল্যানে যার অন্তহীন পথ চলা ঘিরে ছবির কাহিনী আবর্তিত হয়। প্রশান্তের চরিত্রে কিশোর কুমার আসলে তার নিজের জীবন দর্শনের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরেন। এই ছবিতে আফজল ইরশাদের লেখা একটি গান "পন্থি হু ম্যায় উস পথ কা, অন্ত নেহি হ্যায় জিস কা", যেটির অসাধারন একটি সুর করেন স্বয়ং কিশোর কুমার , গানটি এখনো মানুষের মনের ভিতরে ঘুপটি মেরে বসে থাকা পথিক সত্তাকে বের করে নিয়ে আসে সেই চির অন্তহীন পথের অক্লান্ত পথিক করে।    
ছবিতে এই গানটি শুরু হওয়ার পূর্বে কিশোর কুমার (প্রশান্ত) এবং অশোক কুমারের (জোসেফ সাহাব) মধ্যে যে সংলাপ শোনা যায়, তাই আসলে কিশোর কুমারের জীবনদর্শনের মূল কথা- লাইফলাইন, আবার ছবিটির থিমলাইনও বটে। যেখানে কিশোর কুমার বলছেন জীবন একটি সফর ছাড়া কিছু নয়। যে সফরে রাস্তাই এক এবং একমাত্র মাধ্যম এবং অবলম্বন। আর সেই রাস্তা কখনো শেষ হয় না। একটা পুরনো রাস্তা নতুন রাস্তার জন্ম দেয়।  গন্তব্য থেকে গন্তব্যে পৌছনো আসলে এই অনন্ত পথ চলার এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। তাই গন্তব্য পরিক্রমা চলতেই থাকে।  কেবল পথ-চলা পথিকের বদল হয়। 
আপাত-চপল বহিরঙ্গে কিশোর কুমারের ভিতর ঘরে বাস করতো এক ভাবুক উদাস পথিক। বহু দূরের পথিক। 
পথ আর পথের রোমান্টিকতায় কিশোর কুমার বরাবরই বিবশ। ১৯৫৫ এ প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় "পথের পাঁচালী"  নির্মাণ কালে যে আর্থিক অসুবিধায় পড়েন, তখন এই কিশোর কুমারই সত্যজিৎ কে পাঁচ হাজার টাকার আর্থিক সাহায্য করে "পথের পাঁচালী" র মুক্তির পথ সুগম করেন। 
এখানেই কিশোর কুমার থেমে থাকেননি।  "পথের পাঁচালী" র দ্বারা তিনি এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে, আস্ত একটা ছবিই তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন হিন্দিতে। যার নাম ছিল "দূর গগন কি ছাও মে". ১৯৬৪ তে মুক্তি পাওয়া এই ছবি করার আগে কিশোর কুমার "পথের পাঁচালী" ১৩ বার দেখেছিলেন। যদিও এই ছবির কাহিনীতে ১৯৫৮ সালে Michael Curtiz পরিচালিত  আমেরিকান ছবি "The Proud Rebel" এর ছায়া কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...