সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভোররাতে শিশির ভেজা পথে!

 শিশির ছড়ানো পথ বড় কোমল এক রূপোলী চিত্রপট, অপাপবিদ্ধ তৃণ দল পরম যতনে ধরে রাখে সে রূপোর উষ্ণীষ। রাতের অন্ধকারে শ্বাপদ জন্তু দের থেকে বাঁচিয়ে রাখে তাদের অক্ষত কৌমার্য। কেউ আসবে ভোররাতে, বড় আকাঙ্খিত। তখনো অপাদবিদ্ধ শিশির ভেজা সেই পথে রেখে যাবে তার প্রথম পায়ের চিহ্ন।   


হৃদয়ের হাওয়ায় ছড়িয়ে থাকা আর্দ্রতা শীতের রাতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হতে চায় সম্পৃক্ত। সে সম্পৃক্ততা এক সময় সকল সহন সীমা ছাড়িয়ে স্খলনের অভিলাষে হয়ে পড়ে উন্মুখ। এবং অবশেষে সে  নিদারুন পতন ঘটে ঘনীভূত আবেগের; ভোররাতের পথে, পথে পাতানো তৃণ শয্যায় ছড়িয়ে পড়ে রজত শুভ্র শিশিরের কণা।  
 ভোররাতের শিশির ধোয়া পথ রাতের ক্লেদ মুক্ত ঝরঝরে, নবারুনের নরম আলোয় শুচিশুদ্ধ। পথের পাশে শিউলি গাছ সে পথে অবলীলায় ঝরিয়ে দেয় কমলা বৃন্তের সাদা ফুল। এমন সিক্ত পথের বুকে মধুর পেলবতা মাড়িয়ে যেতে যে বড় বাধে। 
অনেক কাল আগে, মুনিঋষিরা আদুল পায়ে ভোররাতের শিশির ঝরা পথে  হেঁটে যেতেন নদীর ঘাটের দিকে। দূর্বা ঘাসের শিশির শুদ্ধ গালিচায় সেই সকল পরম পুরুষদের দৃপ্ত পদচারনা আজ রূপকথা।
 বর্তমান যারা এ পথের পথিক, তারা কেউ কাকভোরে পাইকারী বাজারে যাওয়া পাড়ার মাছ, সব্জী বা ফলের হকার, বা কোন দূরপাল্লার বাস- ট্রেন ধরার যাত্রী বা সন্তপর্ণে চুরির মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া কোন গেঁয়ো চোর। হতে পারে কোন চাষি হয়তো ভোররাতে নিজের জমির দিকে যাচ্ছে কোদাল কাঁধে, বা সকালের নিত্যকর্ম সারতে বা হয়তো কোন ভক্ত গৃহস্থ ফুলের সাজি নিয়ে বেরিয়েছে ফুল সংগ্রহে। এ ছাড়া গ্রাম শহর নির্বিশেষে অগণিত মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে পড়া স্বাস্থ্য-সচেতন নারী পুরুষ, যারা প্রতিদিন দাপিয়ে বেড়ায় ভোরবেলার শিশির ভেজা পথ-প্রান্তর।  
 ছোটবেলায় পৌষ সংক্রান্তির দিন আমরা খুব ভোরে দাদুর হাত ধরে জুনপুটের সমুদ্র সৈকতে বসা পৌষ মেলার উদ্দেশ্যে রওনা দিতাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাথার উপর বড় বড় গাছ গুলোর পাতায় শিশির পড়ার টুপ টাপ আর সেই কৃষ্ণ ভোরের ঝিম ধরা নৈশব্দ -এত বছর পরেও পৌষের পার্বণী টিউন হয়ে আমার কানে বাজে। 
মেলায় পৌঁছানোর অনেক আগেই সকালের রোদ এসে পথের দু পাশে, বিস্তীর্ণ শিশির সিক্ত খেসারী ক্ষেতে পরম যত্নে পরিয়ে দিত ঝলমলে "হিরের নাকছাবি"। সে দুর্লভ নৈসর্গিক দৃশ্য আজও ভোলার নয়।
সরস্বতী পূজার দিন ভোররাতে- সারারাত পূজার প্যান্ডেল করা সেরে, প্যান্ডেল বলতে মা- কাখিমার কাছ থেকে চেয়ে পাওয়া তাদের ধোয়া কাপড় চার দিকের চারটি বাঁশের খুঁটিতে টাঙ্গিয়ে একটা কাঠামোর আদল দেওয়া আর কি। তো আমরা অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়তাম সৌরভ মাষ্টারের বাড়ির বাগান থেকে শিশিরে ভেজা ডবকা ডবকা হলুদ গাঁধা ফুল চুরি করতে।  আমাদের কৈশোরের সেই রোমাঞ্চকর অভিযানের সাক্ষী শুধু সেই ভোররাতের শিশির ভেজা পথ। একবার আমাদেরই পাড়ার শিউলী দি আর আমার মামার ছেলে ভোলা দা কে আবিষ্কার করেছিলাম খোলা আকাশের নীচে শিশিরসিক্ত পথে দাঁড়িয়ে একে অপরকে প্রেম নিবেদন করতে। তখন বুঝিনি যে দূর্বা ঘাসের উপর শিশির পড়ে পথ কতটা রোমান্টিকতায় পিচ্ছিল হতে পারে।    
 
     
 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...