শিশির ছড়ানো পথ বড় কোমল এক রূপোলী চিত্রপট, অপাপবিদ্ধ তৃণ দল পরম যতনে ধরে রাখে সে রূপোর উষ্ণীষ। রাতের অন্ধকারে শ্বাপদ জন্তু দের থেকে বাঁচিয়ে রাখে তাদের অক্ষত কৌমার্য। কেউ আসবে ভোররাতে, বড় আকাঙ্খিত। তখনো অপাদবিদ্ধ শিশির ভেজা সেই পথে রেখে যাবে তার প্রথম পায়ের চিহ্ন।
হৃদয়ের হাওয়ায় ছড়িয়ে থাকা আর্দ্রতা শীতের রাতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হতে চায় সম্পৃক্ত। সে সম্পৃক্ততা এক সময় সকল সহন সীমা ছাড়িয়ে স্খলনের অভিলাষে হয়ে পড়ে উন্মুখ। এবং অবশেষে সে নিদারুন পতন ঘটে ঘনীভূত আবেগের; ভোররাতের পথে, পথে পাতানো তৃণ শয্যায় ছড়িয়ে পড়ে রজত শুভ্র শিশিরের কণা।
ভোররাতের শিশির ধোয়া পথ রাতের ক্লেদ মুক্ত ঝরঝরে, নবারুনের নরম আলোয় শুচিশুদ্ধ। পথের পাশে শিউলি গাছ সে পথে অবলীলায় ঝরিয়ে দেয় কমলা বৃন্তের সাদা ফুল। এমন সিক্ত পথের বুকে মধুর পেলবতা মাড়িয়ে যেতে যে বড় বাধে।
অনেক কাল আগে, মুনিঋষিরা আদুল পায়ে ভোররাতের শিশির ঝরা পথে হেঁটে যেতেন নদীর ঘাটের দিকে। দূর্বা ঘাসের শিশির শুদ্ধ গালিচায় সেই সকল পরম পুরুষদের দৃপ্ত পদচারনা আজ রূপকথা।
বর্তমান যারা এ পথের পথিক, তারা কেউ কাকভোরে পাইকারী বাজারে যাওয়া পাড়ার মাছ, সব্জী বা ফলের হকার, বা কোন দূরপাল্লার বাস- ট্রেন ধরার যাত্রী বা সন্তপর্ণে চুরির মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া কোন গেঁয়ো চোর। হতে পারে কোন চাষি হয়তো ভোররাতে নিজের জমির দিকে যাচ্ছে কোদাল কাঁধে, বা সকালের নিত্যকর্ম সারতে বা হয়তো কোন ভক্ত গৃহস্থ ফুলের সাজি নিয়ে বেরিয়েছে ফুল সংগ্রহে। এ ছাড়া গ্রাম শহর নির্বিশেষে অগণিত মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে পড়া স্বাস্থ্য-সচেতন নারী পুরুষ, যারা প্রতিদিন দাপিয়ে বেড়ায় ভোরবেলার শিশির ভেজা পথ-প্রান্তর।
ছোটবেলায় পৌষ সংক্রান্তির দিন আমরা খুব ভোরে দাদুর হাত ধরে জুনপুটের সমুদ্র সৈকতে বসা পৌষ মেলার উদ্দেশ্যে রওনা দিতাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাথার উপর বড় বড় গাছ গুলোর পাতায় শিশির পড়ার টুপ টাপ আর সেই কৃষ্ণ ভোরের ঝিম ধরা নৈশব্দ -এত বছর পরেও পৌষের পার্বণী টিউন হয়ে আমার কানে বাজে।
মেলায় পৌঁছানোর অনেক আগেই সকালের রোদ এসে পথের দু পাশে, বিস্তীর্ণ শিশির সিক্ত খেসারী ক্ষেতে পরম যত্নে পরিয়ে দিত ঝলমলে "হিরের নাকছাবি"। সে দুর্লভ নৈসর্গিক দৃশ্য আজও ভোলার নয়।
সরস্বতী পূজার দিন ভোররাতে- সারারাত পূজার প্যান্ডেল করা সেরে, প্যান্ডেল বলতে মা- কাখিমার কাছ থেকে চেয়ে পাওয়া তাদের ধোয়া কাপড় চার দিকের চারটি বাঁশের খুঁটিতে টাঙ্গিয়ে একটা কাঠামোর আদল দেওয়া আর কি। তো আমরা অন্ধকার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়তাম সৌরভ মাষ্টারের বাড়ির বাগান থেকে শিশিরে ভেজা ডবকা ডবকা হলুদ গাঁধা ফুল চুরি করতে। আমাদের কৈশোরের সেই রোমাঞ্চকর অভিযানের সাক্ষী শুধু সেই ভোররাতের শিশির ভেজা পথ। একবার আমাদেরই পাড়ার শিউলী দি আর আমার মামার ছেলে ভোলা দা কে আবিষ্কার করেছিলাম খোলা আকাশের নীচে শিশিরসিক্ত পথে দাঁড়িয়ে একে অপরকে প্রেম নিবেদন করতে। তখন বুঝিনি যে দূর্বা ঘাসের উপর শিশির পড়ে পথ কতটা রোমান্টিকতায় পিচ্ছিল হতে পারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন