সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তালবাগান ও তালবাগানের পথ এবং আমি!


তালবাগানের যে কুহকী ছবি তার টুকরো টুকরো অস্তিত্ব নিয়ে কোন এক দুরূহ কারণে পুনরায় মনের বায়স্কোপে ফুটে উঠতে চায় তা বেশ রোমাঞ্চের। তালবাগানের সেই মন কেমন করা ক্যানভাসে তাল পাতার খড় খড়,  ভাদ্র মাসে পাকা তালের  ভূপতিত হওয়ার ঢপ্পা-নিনাদ - নির্মাণ করে অদ্ভুত এক স্মৃতি মথলে উঠে আসা পরমান্নের মত আবহ প্রেক্ষিত, যেন মায়াবী ঝাঁপতালে সন্তুর-ফনকারী।     
যেখানে, প্রকাণ্ড এক দীঘির পাড়ে গুটিকয় ঢ্যাঙা তালগাছ, প্রখর ভাবে ঋজুরেখ হয়েও ঢলে ঢলে পড়ে কারনে-অকারনে, শুকনো তালপাতার হাওয়ায় শালিখেরা খানিক আমোদ-উড়ানে গা ভাসায়, আর গাছগুলির গোড়ায় দড়ির মত কালো কালো শক্ত শেকড় বেয়ে ওঠা রাবণ লতার ঝোপ আর তাদের মাঝে মুথা ঘাসের মখমলি জমি যেন এক একটি সবুজ উপত্যকা সঙ্গে ইতি উতি ফুটে থাকা উড়ে এসে জুড়ে বসা হলুদাভ বেগুনি ফুল, সেখানে ব্যস্ত মন কোন বাদ-বিচার ছাড়াই এক পলকের জন্য হলেও বিফল অতীতে হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি উদাসীনতায় হয়ে যায় বিকল-বিবশ, তাই সে তালবাগান এবং তালবাগানের পথ বড়ই জাদুময়। 
                                                   
 তালবাগানেই সেই ছেলেবেলায় পড়া "উল্টানো কুঁজো" গুলো কে ঝুলে থাকতে দেখা যায় তালগাছের মাথায়। খড় কুটো দিয়ে বাবুইয়ের বিনি-বিনি বুননে বানানো সে বিখ্যাত বাসা, আজকাল প্রায় জাদুঘরের সম্পদ হয়ে গেছে, দেখাই যায় না। বাবুই পাখি কি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে,না কি হারিয়ে যাচ্ছে তার বিরল শিল্পী সত্তা না কি পুরনো বাসা ছেড়ে তারা উঠে গেছে নতুন কোন ডিজিটাল বাসায়। জানা নেই। কবির ভাষায় প্রায় "বিপন্ন বিস্ময়ে" পরিনত হয়েছে পৃথিবীর এই অষ্টম আশ্চর্য।  
বেলতলার মত তালতলায় ও কি ন্যাড়ারা একবার গিয়ে দ্বিতীয় বার যাওয়ার সাহস দেখায় না।  আমার বাড়ির সামনে একটা বড় পুকুর আছে, নাম 'বাতসা' পুকুর, বাতাসার মত গোল বলে তার এই নাম।  তার উত্তর পাড়ের এক কোনে সবে ধন নীলমণি একটা বুড়ো লম্বা তাল গাছ ছিল। গাছের নীচটায় ভেটকানি, ঝাটুর মত ঝুপড়ী গাছ  আর বুনো লতা পাতায় একেবারে জঙ্গল হয়ে থাকতো সারা বছর। কাঁচা অবস্থায় তালশাঁস খেতে পাড়ার কেউই ওই ঝোপঝাড় সরিয়ে তালগাছে ওঠার সাহস দেখাত না। অগত্যা সেই তাল কালের নিয়মে পাকত আর সেই গাছ পাকা তাল নিউটনের অভিকর্ষ থিয়োরি মেনে সরাসরি পুকুরের জলে পড়তো ঝপ করে। সময়ের কোন ঠিক নেই। দাদু বলতো সময় হলে ঠিক পড়ে যাবে। আপাত সাধারন এই কথায় যে গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে ছিল তা তখন না ধরতে পারলেও এখন বুঝতে পারি। 
এই প্রসঙ্গে, আমার পিসির বাড়ির কাছে জোড়া তালগাছের গল্প না বলে কিছুতেই এই লেখা শেষ করা যায় না। পৌষ মাসে পাকা ধান কেটে চাষিরা মাঠ একেবারে ফাঁকা করে দেয়। ওই রকম সময়ে আমরা বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ করে  পিসির বাড়ি বেড়াতে যেতাম। ধান কুড়িয়ে কুঁচো ভরতাম আর দুনিয়ার খোশগল্প চলতো পিসতুতো ভাই বোনেদের মধ্যে। মাঠের মধ্যে ছোট একটা ডোবা ছিল এবং তার পাড়ে একটা শিশু বট ছায়া দিত তার মত করে। ওই বট গাছের নীচ দিয়ে একটা সরু পায়ে হাঁটা মেঠো পথ চলে গেছে ওই তালগাছ দুটির দিকে। পৌষ মাসের ওইরকম  ধু ধু করা মাঠে এক জোড়া তালগাছ প্রায় স্বামী স্ত্রীর মত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতো গায়ে গা লাগিয়ে। সহসা আমরা ছোটরা কেউই ওই গাছ গুলির কাছে যেতাম না। কারন গাছ দুটির নীচে একটু উঁচু ঢিপির মত জায়গা ছিল যেখানে মৃত বাড়ির হাঁড়ি কলসী ফেলে আসা হত। বড়রা বলতো ভর দুপুরে ওই তালতলায় যেতে না, কারন কেউ নাকি কাঁদে। ভোররাতে অনেকসময় একটা বুড়িকে দেখা গেছে পাকা তাল কুড়োতে। 
স্বপ্নে একবার তালবাগান দেখেছিলাম যার অনতিদূরে এক পোড়ো শিব মন্দির, পাশেই একটা বড় তালপুকুর এবং তার পাশ দিয়ে তালবাগানে আসার ঘেসো পথ -  মানে তালবাগানের পথ। স্বপ্নটি এই কারণে স্মরনীয় যে ওই তালবাগানের পথে এক গেরুয়া বেশী সাধু কে দেখেছিলাম যাকে পরিষ্কার বলতে শুনেছিলাম - এই পৃথিবীতে সবকিছুই চলে ঈশর নির্দিষ্ট সুর-তাল-লয়ে। এই পৃথিবী আসলে আস্ত একটা তালবাগান এবং আমরা এই মানুষেরা তালবাগানের পথের পথিক বৈ কিছু নয়। স্বপ্নের তাল কেটে যায় হঠাৎ পুকুর পাড়ের গাছ থেকে ঝুপ করে তাল পড়ার শব্দে। ঘোর কেটে দেখি পূবের জানালা বয়ে রোদ এসেছে ভোরের বার্তা দিতে। অগত্যা...।।!
                                                       



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...