তালবাগানের যে কুহকী ছবি তার টুকরো টুকরো অস্তিত্ব নিয়ে কোন এক দুরূহ কারণে পুনরায় মনের বায়স্কোপে ফুটে উঠতে চায় তা বেশ রোমাঞ্চের। তালবাগানের সেই মন কেমন করা ক্যানভাসে তাল পাতার খড় খড়, ভাদ্র মাসে পাকা তালের ভূপতিত হওয়ার ঢপ্পা-নিনাদ - নির্মাণ করে অদ্ভুত এক স্মৃতি মথলে উঠে আসা পরমান্নের মত আবহ প্রেক্ষিত, যেন মায়াবী ঝাঁপতালে সন্তুর-ফনকারী।
যেখানে, প্রকাণ্ড এক দীঘির পাড়ে গুটিকয় ঢ্যাঙা তালগাছ, প্রখর ভাবে ঋজুরেখ হয়েও ঢলে ঢলে পড়ে কারনে-অকারনে, শুকনো তালপাতার হাওয়ায় শালিখেরা খানিক আমোদ-উড়ানে গা ভাসায়, আর গাছগুলির গোড়ায় দড়ির মত কালো কালো শক্ত শেকড় বেয়ে ওঠা রাবণ লতার ঝোপ আর তাদের মাঝে মুথা ঘাসের মখমলি জমি যেন এক একটি সবুজ উপত্যকা সঙ্গে ইতি উতি ফুটে থাকা উড়ে এসে জুড়ে বসা হলুদাভ বেগুনি ফুল, সেখানে ব্যস্ত মন কোন বাদ-বিচার ছাড়াই এক পলকের জন্য হলেও বিফল অতীতে হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি উদাসীনতায় হয়ে যায় বিকল-বিবশ, তাই সে তালবাগান এবং তালবাগানের পথ বড়ই জাদুময়।

তালবাগানেই সেই ছেলেবেলায় পড়া "উল্টানো কুঁজো" গুলো কে ঝুলে থাকতে দেখা যায় তালগাছের মাথায়। খড় কুটো দিয়ে বাবুইয়ের বিনি-বিনি বুননে বানানো সে বিখ্যাত বাসা, আজকাল প্রায় জাদুঘরের সম্পদ হয়ে গেছে, দেখাই যায় না। বাবুই পাখি কি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে,না কি হারিয়ে যাচ্ছে তার বিরল শিল্পী সত্তা না কি পুরনো বাসা ছেড়ে তারা উঠে গেছে নতুন কোন ডিজিটাল বাসায়। জানা নেই। কবির ভাষায় প্রায় "বিপন্ন বিস্ময়ে" পরিনত হয়েছে পৃথিবীর এই অষ্টম আশ্চর্য।
বেলতলার মত তালতলায় ও কি ন্যাড়ারা একবার গিয়ে দ্বিতীয় বার যাওয়ার সাহস দেখায় না। আমার বাড়ির সামনে একটা বড় পুকুর আছে, নাম 'বাতসা' পুকুর, বাতাসার মত গোল বলে তার এই নাম। তার উত্তর পাড়ের এক কোনে সবে ধন নীলমণি একটা বুড়ো লম্বা তাল গাছ ছিল। গাছের নীচটায় ভেটকানি, ঝাটুর মত ঝুপড়ী গাছ আর বুনো লতা পাতায় একেবারে জঙ্গল হয়ে থাকতো সারা বছর। কাঁচা অবস্থায় তালশাঁস খেতে পাড়ার কেউই ওই ঝোপঝাড় সরিয়ে তালগাছে ওঠার সাহস দেখাত না। অগত্যা সেই তাল কালের নিয়মে পাকত আর সেই গাছ পাকা তাল নিউটনের অভিকর্ষ থিয়োরি মেনে সরাসরি পুকুরের জলে পড়তো ঝপ করে। সময়ের কোন ঠিক নেই। দাদু বলতো সময় হলে ঠিক পড়ে যাবে। আপাত সাধারন এই কথায় যে গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে ছিল তা তখন না ধরতে পারলেও এখন বুঝতে পারি।
এই প্রসঙ্গে, আমার পিসির বাড়ির কাছে জোড়া তালগাছের গল্প না বলে কিছুতেই এই লেখা শেষ করা যায় না। পৌষ মাসে পাকা ধান কেটে চাষিরা মাঠ একেবারে ফাঁকা করে দেয়। ওই রকম সময়ে আমরা বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ করে পিসির বাড়ি বেড়াতে যেতাম। ধান কুড়িয়ে কুঁচো ভরতাম আর দুনিয়ার খোশগল্প চলতো পিসতুতো ভাই বোনেদের মধ্যে। মাঠের মধ্যে ছোট একটা ডোবা ছিল এবং তার পাড়ে একটা শিশু বট ছায়া দিত তার মত করে। ওই বট গাছের নীচ দিয়ে একটা সরু পায়ে হাঁটা মেঠো পথ চলে গেছে ওই তালগাছ দুটির দিকে। পৌষ মাসের ওইরকম ধু ধু করা মাঠে এক জোড়া তালগাছ প্রায় স্বামী স্ত্রীর মত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতো গায়ে গা লাগিয়ে। সহসা আমরা ছোটরা কেউই ওই গাছ গুলির কাছে যেতাম না। কারন গাছ দুটির নীচে একটু উঁচু ঢিপির মত জায়গা ছিল যেখানে মৃত বাড়ির হাঁড়ি কলসী ফেলে আসা হত। বড়রা বলতো ভর দুপুরে ওই তালতলায় যেতে না, কারন কেউ নাকি কাঁদে। ভোররাতে অনেকসময় একটা বুড়িকে দেখা গেছে পাকা তাল কুড়োতে।
স্বপ্নে একবার তালবাগান দেখেছিলাম যার অনতিদূরে এক পোড়ো শিব মন্দির, পাশেই একটা বড় তালপুকুর এবং তার পাশ দিয়ে তালবাগানে আসার ঘেসো পথ - মানে তালবাগানের পথ। স্বপ্নটি এই কারণে স্মরনীয় যে ওই তালবাগানের পথে এক গেরুয়া বেশী সাধু কে দেখেছিলাম যাকে পরিষ্কার বলতে শুনেছিলাম - এই পৃথিবীতে সবকিছুই চলে ঈশর নির্দিষ্ট সুর-তাল-লয়ে। এই পৃথিবী আসলে আস্ত একটা তালবাগান এবং আমরা এই মানুষেরা তালবাগানের পথের পথিক বৈ কিছু নয়। স্বপ্নের তাল কেটে যায় হঠাৎ পুকুর পাড়ের গাছ থেকে ঝুপ করে তাল পড়ার শব্দে। ঘোর কেটে দেখি পূবের জানালা বয়ে রোদ এসেছে ভোরের বার্তা দিতে। অগত্যা...।।!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন