সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জীবনানন্দ কি সিনেমার গান লিখতে চেয়েছিলেন?

জীবনানন্দ দাশের কবিতা কি গীতিধর্মী? প্রকৃতির গোপন নিঃসঙ্গতার সৌন্দর্য যার কবিতায় মূল সম্পদ, তাঁর কবিতার সুর এমনিতেই স্বতঃ উৎসারিত; কান পাতলেই শোনা যায় সে অন্তসলীলা ফল্গু স্রোতের বুঁদ করে দেওয়া সুরধ্বনি।
তাই শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের কণ্ঠে জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে, ধান সিঁড়িটির তীরে ...।' স্বাভাবিক ভাবে হয়ে ওঠে একটি অন্যতম জনপ্রিয় গান।



জীবনানন্দ হয়তো, তাঁর কবিতার গীতিময়তার কথা অনুভবও করতেন অন্তরের সলাজ নিভৃতে। কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও জীবনানন্দের বাক্সবন্দী থাকা প্রচুর অপ্রকাশিত লেখার মধ্যে কোথাও কোনো গানের দেখা পাওয়া যায় না। সেখানে পাওয়া যায় অসংখ্য কবিতা, ছোট গল্প, প্রবন্ধ এমনকি দু দুটো বড় উপন্যাস – ‘মাল্যবান’ ও ‘সুতীর্থ’। বাংলায় রবীন্দ্রনাথ থেকে কবি নজরুল অনেকেই কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন অজস্র গান। কিন্তু জীবনানন্দ সেভাবে কোনো গান লিখে যান নি।

কিন্তু সময়ের এক বাধ্যবাধকতার সামনে দাঁড়িয়ে লিখতে চেয়েছিলেন সিনেমার গান। জীবনানন্দ সিনেমার জন্য গান লিখতে চেয়ে বন্ধু অরিন্দম গুহের কাছে নিজের মনের ইচ্ছা ব্যক্তও করেছিলেন।  তবে ‘ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ নয়, দুটো পয়সার জন্যে। শখে নয়, বরং চরম আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যের শক পেয়ে, বাধ্য হয়ে। গীতিকারের ভাবে নয়, একান্তই অভাবে পড়ে।
কিন্তু জীবনানন্দের সে ইচ্ছে ভাগ্যের নিদারুন পরিহাস হয়েই থেকে গেছে, বাস্তবের মুখ কোনোদিন দেখে নি।
তার কারণ অবশ্য তিনি নিজে। তাঁর নিজের উন্নাসিকতা। আর সেই 'সব খোয়াবো তবু জাত খোয়াবো না’র মত নাছোড় মনোভাবের। 
একদিন রাসবিহারী অ্যাভিনিউর আড্ডায়, বন্ধু অরিন্দম গুহকে জীবনানন্দ বলেছিলেন, “সিনেমার গান লিখলে নাকি অনেক পয়সা পাওয়া যায়?”

অরিন্দম গুহ, জীবনানন্দের এ হেন ইচ্ছের কথা শুনে তাঁকে কবি তথা চিত্র পরিচালক প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে জীবনানন্দের ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিন্তু বলবো, বলবো করে জীবনানন্দ কখনো সে কথা প্রেমেন্দ্র মিত্রকে বলেননি।
পরে অরিন্দম গুহ, জীবনানন্দকে চিত্র পরিচালক শৈলজানন্দ মুখপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে বললে জীবনানন্দ প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলেন।  কারণ শৈলজানন্দের সঙ্গে জীবনানন্দের সখ্যতা বহু পুরনো।
 এছাড়াও, অরিন্দম গুহ যে দুটি গূঢ় তত্ত্বের কথা জীবনানন্দকে শুনিয়েছিলেন তাতে স্বভাব লাজুক কবিও খানিক বুকে বল পেয়েছিলেন তার মনের কথা 
অকপটে বলে ফেলার জন্য। “সিনেমার ডিরেক্টর হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের চেয়ে শৈলজানন্দের দাপট অনেক বেশি। তা ছাড়াও একটা কথা আছে প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজেই সিনেমার গান লেখেন, কিন্তু শৈলজানন্দ নিজে সিনেমার গান লেখেন না।"

যদিও, শেষ পর্যন্ত লাভ কিছু হয় নি। মামলা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যায়। নিয়তিতাড়িত জীবনানন্দ কোনোদিনই বলতে পারেন না শৈলজানন্দকে তার গোপন ইচ্ছার কথা

কেন বলেন নি সে কথা অবশ্য বন্ধু অরিন্দম গুহকে বলেছিলেন, তবে সংগোপনে। ফুটপাতের এক পাশে, এক কোনায় অরিন্দম গুহকে ডেকে চুপি চুপি বলেছিলেন, “শৈলজার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলিনি কেন জানো, যদি কথার কথা ধরে নাও শৈলজা আমার জন্য কোথাও কিছু ব্যবস্থা করেও দেয়, আমি কি করে লিখবো, ‘রাধে...এ...এ...এ ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়!" 

কোথাও, উপরের বক্তব্যের মধ্যে জীবনানন্দের আপাত বিষণ্ণ জীবনেও সরসতায় ভরা মরুদ্যান, আবিষ্কৃত হতে দেখা যায়। যদিও সে অন্য গল্প। 

 তথ্য সুত্রঃ 'উজ্জ্বল উদ্ধার', শঙ্করলাল ভট্টাচার্য।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন; যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে; মাত্র চার বছর বয়সে পড়া - যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি তিনি মুক্ত হতে; ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইনের কথা - সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...