জীবনানন্দ দাশের কবিতা কি গীতিধর্মী? প্রকৃতির গোপন
নিঃসঙ্গতার সৌন্দর্য যার কবিতায় মূল সম্পদ, তাঁর কবিতার সুর এমনিতেই স্বতঃ উৎসারিত; কান
পাতলেই শোনা যায় সে অন্তসলীলা ফল্গু স্রোতের বুঁদ করে দেওয়া সুরধ্বনি।
তাই শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের কণ্ঠে জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে,
ধান সিঁড়িটির তীরে ...।' স্বাভাবিক ভাবে হয়ে ওঠে একটি অন্যতম জনপ্রিয় গান।
কিন্তু সময়ের এক বাধ্যবাধকতার সামনে দাঁড়িয়ে
লিখতে চেয়েছিলেন সিনেমার গান। জীবনানন্দ সিনেমার জন্য গান লিখতে চেয়ে বন্ধু
অরিন্দম গুহের কাছে নিজের মনের ইচ্ছা ব্যক্তও করেছিলেন। তবে ‘ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ নয়, দুটো পয়সার
জন্যে। শখে নয়, বরং চরম আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যের শক পেয়ে, বাধ্য হয়ে। গীতিকারের
ভাবে নয়, একান্তই অভাবে পড়ে।
কিন্তু জীবনানন্দের সে ইচ্ছে ভাগ্যের নিদারুন পরিহাস হয়েই থেকে গেছে, বাস্তবের মুখ
কোনোদিন দেখে নি।
তার কারণ অবশ্য তিনি নিজে। তাঁর নিজের উন্নাসিকতা। আর সেই 'সব খোয়াবো তবু জাত
খোয়াবো না’র মত নাছোড় মনোভাবের।
একদিন রাসবিহারী অ্যাভিনিউর আড্ডায়, বন্ধু অরিন্দম গুহকে জীবনানন্দ বলেছিলেন, “সিনেমার
গান লিখলে নাকি অনেক পয়সা পাওয়া যায়?”
অরিন্দম গুহ, জীবনানন্দের এ হেন ইচ্ছের কথা
শুনে তাঁকে কবি তথা চিত্র পরিচালক প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র
মিত্রের সঙ্গে জীবনানন্দের ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিন্তু বলবো, বলবো করে জীবনানন্দ
কখনো সে কথা প্রেমেন্দ্র মিত্রকে বলেননি।
পরে অরিন্দম গুহ, জীবনানন্দকে চিত্র পরিচালক শৈলজানন্দ মুখপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা
বলতে বললে জীবনানন্দ প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলেন।
কারণ শৈলজানন্দের সঙ্গে জীবনানন্দের সখ্যতা বহু পুরনো। এছাড়াও, অরিন্দম গুহ যে দুটি গূঢ় তত্ত্বের কথা জীবনানন্দকে শুনিয়েছিলেন তাতে স্বভাব লাজুক কবিও খানিক বুকে বল পেয়েছিলেন তার মনের কথা অকপটে বলে ফেলার জন্য। “সিনেমার ডিরেক্টর হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের চেয়ে শৈলজানন্দের দাপট অনেক বেশি। তা ছাড়াও একটা কথা আছে প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজেই সিনেমার গান লেখেন, কিন্তু শৈলজানন্দ নিজে সিনেমার গান লেখেন না।"
যদিও, শেষ পর্যন্ত লাভ কিছু হয় নি। মামলা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যায়। নিয়তিতাড়িত জীবনানন্দ কোনোদিনই বলতে পারেন না শৈলজানন্দকে তার গোপন ইচ্ছার কথা।
কেন বলেন নি সে কথা অবশ্য বন্ধু অরিন্দম গুহকে বলেছিলেন, তবে সংগোপনে। ফুটপাতের
এক পাশে, এক কোনায় অরিন্দম গুহকে ডেকে চুপি চুপি বলেছিলেন, “শৈলজার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলিনি কেন জানো, যদি কথার কথা ধরে
নাও শৈলজা আমার জন্য কোথাও কিছু ব্যবস্থা করেও দেয়, আমি কি করে লিখবো, ‘রাধে...এ...এ...এ
ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়!"
কোথাও, উপরের বক্তব্যের মধ্যে জীবনানন্দের আপাত বিষণ্ণ জীবনেও সরসতায় ভরা মরুদ্যান, আবিষ্কৃত হতে দেখা যায়। যদিও সে অন্য গল্প।
তথ্য সুত্রঃ 'উজ্জ্বল উদ্ধার', শঙ্করলাল ভট্টাচার্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন