মাতৃভাষার অধিকার, মানুষ মাত্রেরই তার জন্মগত অধিকার। যে ভাষায় সে প্রথম কথা বলা শেখে, সেই ভাষাতেই তাকে দিতে হবে লেখা পড়া করার অধিকার, সেই ভাষাতেই দিতে হবে তাকে সাহিত্য করা, গান গাওয়া, নাটকের সংলাপ বলার অধিকার; তার আপন সংস্কৃতিকে উদযাপন করার সমস্তরকম নৈতিক ও আইনি অধিকার তাকে দিতে হবে তার মাতৃভাষাতেই। সর্বোপরি, সেই ভাষাই হবে তার একমাত্র কাজের ভাষা, সে অফিস, বাজার, কোর্ট – কাছারি, থেকে শুরু করে সর্বত্র।
এই লক্ষেই, ইউনেস্কো - ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর, প্যারিসে অনুষ্ঠিত ৩০ তম বার্ষিক অধিবেশনের
সভায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস পালনের কথা। প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দেয়
বাংলাদেশ সহ ২৮ টি দেশ। সর্ব সম্মত ভাবে বেছে
নেওয়া হয় ২১ শে ফেব্রুয়ারীর দিনটিকেই। কিন্তু কেন
এই দিনটি, এর প্রেক্ষিতটাও একটু বুঝে নেওয়া দরকার।
১৯৪৭ এ দেশ ভাগের পরে, নবগঠিত দেশ পাকিস্থানের অফিসিয়াল ভাষা কি হবে এই প্রশ্নে পরিষ্কার
মতানৈক্য দেখা যায় সে দেশের নীতি নির্ধারক ও দেশের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দেশের পূর্ব ভাগ – পূর্ব পাকিস্থানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের
মধ্যে।। তার কারণ, তখনকার পাকিস্থানের প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা
বাংলা হওয়া সত্ত্বেও, বাংলা ভাষাকে ক্রমশ গুরুত্ব হীন করে দেওয়ার যে হীন প্রচেষ্টা
সেদিনকার পাকিস্থান প্রশাসন নিয়েছিল, যার ফল আর শুধু মাত্র মতদ্বৈধতায় সীমাবদ্ধ থাকে নি।
বাংলা ভাষার আত্মমর্যাদায় প্রথম আঘাতটি আসে, দেশভাগের মাত্র কয়েক মাসের
মধ্যে। ১৯৪৭ এরই নভেম্বর মাসে,
পাকিস্থানের সমস্ত সরকারী কাগজ - ডাক টিকিট, মানি অর্ডার, রেল টিকিট ইত্যাদি ছাপা শুরু হয় উর্দু আর ইংরেজি ভাষায়। বলাই বাহুল্য, বাংলাকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব কে সরকারী ভাবে বিপন্ন করে তোলার এই প্রচেষ্টা পূর্ব পাকিস্থানের প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সেদিন ভালো ভাবে নেয় নি। এরপরে গোদের ওপরে বিষ ফোঁড়ার মত, ওই নভেম্বর মাসেরই ১৫ তারিখে পাকিস্থান পাবলিক
সার্ভিস কমিশনের তদানীন্তন সচিব একটা 'কালা' সার্কুলার পাঠান দেশের বিশ্ববিদ্যালয়
গুলিতে, যাতে বিতর্ক ক্রমশ বিক্ষোভে পরিনত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। সার্কুলারটিতে, যে নয়টি ভাষার উপর পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশিকা জারি করা হয় তাতে থাকে জার্মান,
ফরাসী থেকে শুরু করে এমনকি ল্যাটিন এবং সংস্কৃত পর্যন্ত। কিন্তু স্থান পায় না
বাংলা। স্বাভাবিক ভাবেই, এতে ক্ষোভ আরও বাড়ে। এবং যার ফল স্বরূপ, ওই বছর ডিসেম্বরের ৬ তারিখে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় এবং বাংলাকে উর্দুর পরে সে দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ঘোষনার দাবীকে সামনে রেখে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ছাত্র সভার। সেই সভার সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তমদ্দুন মজলিশের।
সেই শুরু। বলাই বাহুল্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসই
ছিল ভবিষ্যৎ ভাষা আন্দোলনের আঁতুড় ঘর। কারণ ওই সভার কয়েকদিন পরেই গঠিত হয় রাষ্ট্র
ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। পরবর্তী কালে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা
নাজিমুদ্দিনের এক বিতর্কিত বক্তব্য সামনে চলে এলে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্থানের অধিকাংশ অধিবাসী উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মেনে
নিতে প্রস্তুত, যার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্থান বন্ধের ডাক দিয়েছিল ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ, সর্বতোভাবে সেই বন্ধ পালিত হয় পূর্ব পাকিস্থানে। বন্ধের দিনে গ্রপ্তার করা হয় শেখ
মুজিবুর ছাড়াও শামসুল হক সহ ৬৯ জনকে। তার প্রতিবাদে পুনরায় ১৩ থেকে ১৫ই মার্চ, ঢাকা
বন্ধের ডাক দেয় সংগ্রাম পরিষদ। চাপের সামনে নতি স্বীকার করে, মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ১৫ই মার্চ
সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৮ দফা সমঝোতা পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। মুক্তি দেওয়া হয় সংগ্রাম পরিষদের
গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্র কর্মীদেরও।
ইতিমধ্যে ১৯ মার্চ কায়েদে
আজম, মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার কথা ঘোষিত হলে পূর্ব পাকিস্থান জুড়ে চর্চা শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু, ২১ শে মার্চ ঢাকার রেস
কোর্স ময়দানের এক বিশাল সমাবেশে জিন্নাহ ঘোষণা করেন, “Urdu and Urdu alone shall be the state
language of Pakistan।" “উর্দুই
পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে। অন্য কোনো ভাষা নয়।“ আরও এক ধাপ এগিয়ে
দুদিন পরে ২৩ শে মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সভায় জিন্নাহ বলেন,
“যারা যারা উর্দুর বিরুদ্ধে যাবে তারা পাকিস্থানের শত্রু বলেই বিবেচিত হবে।" সমাবর্তনের
সভা স্থলেই, জিন্নাহ তখন বক্তৃতা দিচ্ছেন তার মধ্যেই বক্তব্যের বিরুদ্ধে উঠে আওয়াজ।
কিন্তু জিন্নাহ তাঁর সিদ্ধান্তকে কোনরকম নরম করতে চান নি। উল্টে ২৮ শে
মার্চ ঢাকা ছাড়ার আগে তিনি আরও কঠোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে যান, "যে কোন অসাংবিধানিক আন্দোলন কঠোর হস্তে দাবিয়ে রাখা হবে।"
এবারে যেন, আগুনে ঘি পড়ে। যার দুঃখজনক পরিনতি দেখা যায় ১৯৫২
সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে ঘটা মর্মান্তিক হত্যা লীলার মধ্য দিয়ে।
২১ শে ফেব্রুয়ারী ঘটার আগে, ষড়যন্ত্র হয়েছিল বাংলাকে আরবী হরফে লেখার, পরে উর্দু হরফে লেখারও চেষ্টা করা
হয়েছিল।
শেষমেশ কোনো কিছুই যখন ফলপ্রসূ হোল না, ১৯৫২ সালের ২৭ শে জানুয়ারী তারিখে ঢাকার পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু’ এবং ‘উর্দু হরফে বাংলা লিখনের প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হচ্ছে’ বলে উক্তি করে জল মাপার চেষ্টা করেন। তাতেই শুরু হয় পূর্ব পাকিস্থান ব্যাপি ক্ষোভ বিক্ষোভ। ২৯ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতীকী
ধর্মঘট পালন করা হয়। ৩১ তারিখে নাজিমুদ্দিনের ভাষা সম্পর্কিত ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগের উদ্যোগে বার লাইব্রেরী হলে এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভা থেকেই ঘোষণা করা হয় ২১ শে ফেব্রুয়ারীর দিন পূর্ব পাকিস্থান বন্ধের কথা। হরতালের দিনে ঢাকা শহরে জারি হয় ১৪৪ ধারা। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গেই বেরোয় ছাত্রদের মিছিল। দমন পীড়নের
নীতি অবলম্বন করে পাকিস্থান প্রশাসন সেই মিছিলের উপরে প্রথমে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ
করে, তারপরে লাঠি চার্জ করে এবং সব শেষে শুরু হয় নির্বিচারে
গুলি। যার ফলে ঘটনাস্থলেই আবদুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন আহমদ শহীদ হন।আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে
শহিদ হন আবুল বরকত। বিক্ষোভের আগুন দাবানলে পরিনত হয়, এর পরে। অফিস আদালতের কর্মী থেকে সাধারন মানুষেরাও ভয় ভেঙ্গে
বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়, দেখাতে থাকেন বিক্ষোভ। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে আবার লাঠি চার্জ
করে এবং তাতে আহত হয়ে পরে শহিদের মৃত্যু বরণ করেন, হাইকোর্টের কেরানী শফিউর রহমান।
সারা বিশ্বের কাছে চির স্মরনীয় হয়ে থাকে ২১ শের এই
রক্ত রঞ্জিত মহান আন্দোলনের কথা। তাই ইউনেস্কোর কাছে মহান ২১ শে ফেফ্রুয়ারীর দিনটিকে
মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের আবেদন আসলে, ইউনেস্কো তাতে সম্মতি দিতে দেরী করে না।
নির্দেশিকা সনদে লেখা হয়, "21st February be proclaimed International Mother Language Day
throughout the world to commemorate the martyrs who sacrificed their lives on
this very day in 1952."
সিদ্ধান্ত গ্রহনের পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে
১৮৮ টি দেশে শুরু হয়ে যায় ২১ শে ফেব্রুয়ারী পালনের ব্রত।
দিনটি বাংলা ভাষা ভাষী হিসেবে আমাদের কাছে খুবই গর্বের। সারা বিশ্বের কাছেই বাংলা ভাষার
প্রতি একরকমের স্বীকৃতির মর্যাদা পায় এই দিনটিতে। স্বীকৃতি পায় প্রান্তিক থেকে প্রান্তিক তম মানুষের মাতৃভাষারাও।
কিন্তু পাকিস্থানেও কি পালিত হয় অমর ২১ শে।
হ্যাঁ, পালিত হয়। কিন্তু সরকারী ভাবে
নয়। এখনো পাকিস্থানের অধিকাংশ মানুষ পাঞ্জাবী
(৩৮.৭৮%, ২০১৭ সেন্সাস অনুসারে) ভাষায় কথা বলেন, কিন্তু তা একান্তই কথ্য ভাষা। যদি কেউ তার মুখের
ভাষাকে লিখতে চায় তবে তাকে লিখতে হবে উর্দু হরফে।
কারণ উর্দুই পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় তথা অফিসিয়াল ভাষা। যদিও প্রবল আন্দোলনের সামনে মাথা নামিয়ে ১৯৫৬ সালের
৭ ই মে পাকিস্থান সরকার, সংবিধানের (২১৪/ ১) ধারা অনুসারে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষার সম্মান দেয়; কিন্তু ১৯৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পরে, তার আর কোনো মূল্য থাকে না।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, পাকিস্থানে এখনো
ভাষা- মা কে নিধনের প্রক্রিয়া জারী রয়েছে একই ভাবে। উর্দু ভাষী মানুষের (৬-৭%) সংখ্যা সিমীত হওয়া সত্ত্বেও, উর্দুকেই সেখানে বাকি সিংহভাগ মানুষকে (যার মধ্যে রয়েছে পাঞ্জাবী, সিন্ধি,পাস্থ, বালুচি ভাষাভাষী মানুষ)
মেনে নিতে হয়েছে একমাত্র রাষ্ট্রীয় তথা অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে। তাদের ভাষা-মা'র চেহারা যে লুক্কায়িত থাকে উর্দু হরফের আড়ালে।
উইকিপিডিয়া, সর্বশেষ পাকিস্থানের ভাষা সেন্সাসের রিপোর্ট।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন