সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ওই যে অমলতাস এবং ভাবনার মুক্তহাঁস!

অনেকদিন হাত খুলে লেখা হয় না। খালি চিন্তার দাসত্ব। চেতনার গোলামী করা। মাত্রা বৃত্ত ছন্দের সীমায় যেন আটকে যায় বল্গা হারা সেরোটোনিন নিঃসরণ। নীতিকথার উপসংহার টানতে কত খিদমত যে খাটতে হয় সারাদিন। রুচিশীলতার ঢেঁকুর তুলতে কত যে খাদ্যাখাদ্যের বিচার বসাতে হয় কলম-তলার খাপ পঞ্চায়েতে তার ইয়াত্তা নেই। জলঙ্গীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে কতদিন মনে হয়েছে ভিড়ে যাই মাচানে বসা গোঁসাইদের দলে, ডাক যে আসেনি এমন নয়, জয়গুরু বলে কল্কে তে টান দিতে দিতে সেই অলীক সুখের সাগর প্রায় কালাপানির মতো আমাকে তার নিষিদ্ধ অবগাহনে আপ্যায়িত করেছে; যাকে পার হওয়ার দুঃসাহস জোটাতে হন্যে হয়ে ঘুরেছি; কিন্তু ওই এক বস্তা পচা দায় আমাকে পাগল হতে দেয়নি।

পলাশীর আম বাগানে এক বুড়ো কাঠঠোকরাকে দেখেছিলাম, জীবন বাঁচাতে সে ওই কালচে পড়া গাছের গুঁড়ির ওপর ক্রমাগত তার ঘষে যাওয়া - দীর্ঘ ব্যবহারে দীর্ণ চঞ্চু দিয়ে ঠুকরে যাচ্ছে। আসলে, কলম যে কখন শ্রমিকের ছেনি হাতুড়ির মতো রোজানা অর্জনের অভীপ্সায় নিজের সর্বস্ব পণ করেছে, বুঝতে পারি নি।
ওই তো অমলতাস ঝুলে আছে, কবরী বন্ধনে প্রলম্বিত গজরা যেন! কল্পনা তো শ্লীল অশ্লীলতার দায় মানে না। কবিতা লিখবো? মুক্ত বৃত্ত ছন্দে! বড্ড স্ববিরোধী। কবিতা মুজরা হতে চায়, পারে না। মহা উদযাপনের বাহাদুর ইচ্ছেগুলো মনের আকাশে গর্জায় গোঙানির মতো করে, শিৎকারে - সমস্ত সম্ভোগ সুখ লুটে নিতে চায় নিষ্ঠুর বর্গীদের মতো, কিন্তু কলমের মুখে ছাই দিয়ে শুধুই তা সৌন্দর্যের কীর্তন হয়ে যায়। লালিত্যে সুমধুর, ব্যঞ্জনায় সুচতুর, ছন্দে যেন পোষ মানানো কবুতর। প্রাচীন সেই অজন্তা ইলোরার যুগে, অরণ্যের নিভৃতি যেখানে স্বাভাবিক, গুহার গায়ে লেগে থাকা অন্ধকার যখন জৈবিক তাড়নায় সজীব হয়ে উঠতো, ওপিয়ামের নেশায় দিঘল চোখে জেগে থাকতো বাসনার চন্ড আকাঙ্খা, সভ্যতার নামে কলম যেন অজৈবিক হয়ে পড়ছে ক্রমশ। জৈবনিক বৈচিত্র্য, নিরুদ্দিষ্ট আইটেম। ঔচিত্য অনৌচিত্যের মাঝে গতিহারা; মজে যাওয়া নদীর মতো, বুকে বালির চর জেগে উঠেছে কলমের স্রোতে। আমি তো, এক বুক জ্যোৎস্না ধারায় ডুবে যেতে যেতে জোনাকির সাথে কানামাছি খেলার সুখ খুঁজতে চাই, বাঁশ বনে রোদের জাফরি দিয়ে আমি সাজাতে চাই আমার লেখার ঘর।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় মাঝে মধ্যে হাওয়া হয়ে যেতেন, কাউকে বলে না কয়ে। আবার কিছু দিন পরে একাই ফিরে আসতেন। নিজের কাছ থেকে হয়তো পালাতে চাইতেন এইভাবে। সেগুন মঞ্জরীর অবিন্যস্ততায় কিংবা মহুয়া ফুলের মাতাল করা গন্ধে হয়তো নিজের আমিকে খুঁজে পেতেন তিনি।
ওই যে অমলতাস, ঝিল পাড়ের গাছে দুলছিল আদুরে আহ্লাদী যেন, হঠাৎই চোখে পড়লো আমার, তার হলুদ রঙে লেগে থাকা গোপন ঈশারা আমাকে বললো এবার অন্তত আমাকে নিয়ে তুমি হাত খুলে লেখো। মন খুলে আমার পাঁপড়ির সম্মোহন স্বীকার করো, এড়িয়ে যেও না; অবচেতনের নিষিদ্ধ ফুলশয্যায় অন্তত পরিত্যক্ত ফেলে যেও না আমাকে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...