সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বৃষ্টিবালার তেরো স্বর!

বৃষ্টি ভীষণ মেয়েলি, নামেই রয়েছে কেমন ফেমিনিস্ট গন্ধ। সন্ধ্যায় তাই যখন বৃষ্টি আসে - ফিসফিস করে, কথা বলে; যেন কত গোপনীয়তা কন্ঠস্বরে। জানালা খুলে দিলে, মিষ্টি করে ছুঁয়ে দিয়ে যায় আদর ক’রে। খোলা ছাদে, একা আসতে বলে। হাওয়ায় বৃষ্টির আঁচল, সর্বদাই ভেজা থাকে; তাই দিয়ে রোদে পোড়া মুখে, চোখে কত না আহ্লাদ তার!
যখন মন - নুপুরের তিন তাল শুনতে চায়, তখন বৃষ্টি নর্তকীর মতো টাপুর টুপুর ধ্বনি তুলে নেচে দেয় শাল বৃক্ষের দীর্ঘ পত্রফলক পরে।

কিশোরবেলায় যখন একান্তই স্কুলে যেতে মন সায় দেয় না, তখন বৃষ্টি ঝমঝম করে ঝরে পড়ে রাগী দিদিমনিদের মতন। বাড়ির বাইরে, রঙ্গন গাছটির মাথায় ফুটে থাকা লাল, থোকা থোকা ফুল গুলো তখন ভীষণ নাজেহাল, বৃষ্টির কড়া শাসনে; কেঁদে কেঁদে খালি মাথা দুলিয়ে যায় - ওপরে নীচে। আবার ভূতের গল্প শুরু হলে কিন্তু, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ে; ভয় পেয়ে যাওয়া কোনো কিশোরীর বুকের মতন, টিপ টিপ করা সেই স্বর। রহস্যের রাত্রে বৃষ্টি পড়ে নিঃশব্দে যেন অচিনপুরে বন্দী থাকা কোনো রাজকন্যা; মুক্তির অপেক্ষায় যে নিতান্তই অসহায়, মূক-কন্যা সেজে ঝরে যায় অবিরাম!
বিকেলে তেলেভাজা খেতে খেতে, বৃষ্টি পড়ে ঝিমঝিম করে; যেন নেশায় জড়িয়ে আসা যুবতীর চোখের পাতা। 
ফোনে কখনো কখনো মিথ্যা বলতে গিয়ে আমাদের এখানে গপগপে বৃষ্টি হচ্ছে বলে বৃষ্টিকে দস্যু রানী সাজাতে হয়। বেরোলেই খুন হয়ে যেতে হবে, তাই যাওয়া যাবে না।

কখনো হাওয়ায় বৃষ্টি ওড়ে, পাকা শিরিষ পাতার মতন; গায়ে লাগে না। শুধু ভেসে বেড়ায় চপলা তরুনীর মতন। যখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি কারুর দিকে, তখন বৃষ্টি হঠাৎ রিমঝিম স্বরে ঝরতে শুরু করে।
আষাঢ়ে গল্প বলায় খুব দড় ছিলেন আমাদের পাড়াতুতো এক দাদু, তিনি বৃষ্টি ঝরাতেন ঝুপ ঝুপ করে। তারপরেই তাঁর গল্পের নিশি পোকা হঠাৎ চুপ মেরে যেতো, আর তখনই ঘটতো যত অঘটন। হয় বিড়াল বাঘ হয়ে যেতো নয় ইঁদুর হয়ে যেতো হাতি।
সেই দাদুর চোখে বৃষ্টি ছিল কোনো জাদু কন্যার মতো; যাবতীয় বিরল কাহিনী শোনানোর নেপথ্যে থাকা রহস্যময়ী নারী।
গোলাম আলীর গজল শুনতে শুনতে যদি বৃষ্টি নামে তবে তা ঝিরঝির করে ঝরে; যেন কোনো সুন্দরী রমণী, তানপুরায় সঙ্গত করে চলেছেন মুগ্ধ- মিহি সুরে ।
কবিতা পাঠের আসরে আবার বৃষ্টি নামে, গলগল করে; অনর্গল! যেন কোনো প্রগলভ রূপবতী তার উচ্চারিত শব্দ রসে বন্দী করে ফেলতে চান শ্রোতাদের। জানালার শার্সি বেয়ে বয়ে যাওয়া বৃষ্টি ধারার মতন ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে, চুম্বন করে যায় - অনবরত।
যখন কান্না পায়, একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখার ইচ্ছে হয় বৃষ্টিকে - তখন বৃষ্টি ঝরে ঝরঝর করে।
যখন রঙীন পানীয় ভরা পেয়ালায়, একান্তই বরফের কুচি হাত গলে পড়ে, ডুব দেয় অতল স্পর্শের গরিমায় - তখন বৃষ্টি ঝরে ঝিপ ঝিপ করে ।
আর বৃষ্টি যখন কবিতা হয়, তখন শুধুই সে শব্দস্পর্শ - শিহরণ তোলে; যে পরশ, কোনো লাবণ্যময়ীর পেলব স্পর্শসুখের চেয়ে কম তৃপ্তিদায়ক নয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...