কাঁঠালের আমসত্ত্ব পুরনো আইটেম। যদিও বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে সোনার পাথর বাটি বানানোর কারিগরেরা কিন্তু তাদের উৎপাদন যথারীতি বজায় রেখেছেন। এবং তা চালিয়ে যাচ্ছেন বেশ বহাল তবিয়তেই।
কিরকম? বলছি। এমনিতে আম ভীষণ গনতান্ত্রিক ফল। ফলের রাজা বলে কিছু মানুষ, আমকে রাজতন্ত্রের মহিমা প্রদান করতে চায় বটে, তবে আম আর উর্দু আওয়াম, সাধারণ উচ্চারণে যা আম এর মতোই শোনায়, দুটি শব্দের মধ্যে অর্থগত তারতম্য থাকলেও আমের উপভোক্তা হিসেবে আম জনতার মধ্যে কিন্তু কোনো প্রভেদ নেই। সেখানে রাজা, প্রজা সকলেই আম ভক্ত আওয়াম। সে পেট্রোল পাম্পের সাধারণ কর্মচারী, নান্টু মন্ডল হোক কি বহুজাতিক কোম্পানির বড় আধিকারিক- আম কেনার ক্ষেত্রে সকলেই এক।
গ্রীষ্মের দিনে বাজার জুড়ে যত্র তত্র দেখা যায় আমের পসরা সাজানো ঠেলা বা পাতাই ইত্যাদি। দোকানে - চার পাঁচ রকমের আম ডাই করে সাজানো থাকে পাশাপাশি। কোনোটা হয়তো হিমসাগর, কোনোটা বা বেগুনফুলি বা ল্যাংড়া আবার কোনোটা হয়তো গোলাপি আভায় উদ্ভাসিত গোলাপখাস। দেশী মল্লিকা, চৌসা, আম্রপালী এসবও থাকে পাশাপাশি। কিন্তু মাদ্রাজী মুম্বাই আম, দোকানদারের মুখে নামটা শুনতেই ভালো করে নেড়ে চেড়ে দেখার ইচ্ছে হোল। টুবো টুবো হলদেটে আমগুলো, জাপানি কুস্তিগীরদের মতন দেখতে, যেমন কুঁদোনো দেহ সৌষ্ঠব তেমন পেলব গদ্গদ ভাব। গাদাগাদি করে সাজানো আছে একটার পর একটা। দোকানিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমটার নাম। আরে বাবা, শুনতে পেলেন না! এটা হোল মাদ্রাজী মুম্বাই আম। আসলে ধন্দটা বাধলো অন্যত্র, কিছুতেই স্থির করতে পারছিলাম না আমটা আসলে মুম্বাইয়ের মাদ্রাজী আম না মাদ্রাজের মুম্বাই আম। সাধারণত বিশেষ্য পদের পূর্বে একাধিক বিশেষণ পদ থাকলে দুরতম পদটিকেই বিশেষণ বলে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে আমটির নাম মুম্বাই আম কিন্তু জন্ম এবং বড় হওয়া মাদ্রাজে। হয় না, ভারতীয় বংশোদ্ভুত কিন্তু নাগরিক অমেরিকার। তেমনি। সোনারপুরের বারুইপুরি পেয়ারার মতন কিংবা পটাসপুরের পাঁশকুরার চপের মতন। মালদার ফজলী কিন্তু মুর্শিদাবাদের গাছে জন্ম, বড় হওয়া এবং সবশেষে পেকে বাজারজাত হওয়া শিয়ালদহ স্টেশনে। এখন আউটসোরসিং এর যুগ। বাটার জুতো শুধু বাটানগরের কারখানা থেকেই বেরোবে এমন কথা নেই। না হলে, রানাঘাটের মিষ্টি দোকানে শক্তিগড়ের ল্যাংচা পাওয়া যাবে কি করে। কিংবা সোনারপুরের হালুইকর রানাঘাটের গজা কিংবা বর্ধমানের সীতাভোগ বানাবেন কোন সাহসে। ছোটবেলায় আমাদের ঘরের পেছনে একটা পেল্লাই সপেদা গাছ ছিল, ইয়া বড় বড়, নলেন গুড়ের রাজভোগের মত দেখতে সপেদা হত তাতে। দাদুর মুখ থেকে শুনেছিলাম এটি নাকি মুম্বাই সপেদা। বারুইপুরে মুজফফরপুরী লিচু হওয়ার মতো, মুম্বাই থেকে দু হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের কাঁথিতে হত মুম্বাই সপেদা। যেমন পানামা হ্যাট, যে টুপি প্রয়াত সি পি এম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর মাথায় - শোভা পেতে দেখেছি আমরা, শুনলে অবাক হবেন এটি আসলে ইকুয়েডরীয় পানামা হ্যাট। জন্ম দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরে, জিপিজাপা পাম গাছের পাতা থেকে তৈরি; কিন্তু উত্তর আমেরিকার পানামায় খাল খননের সময় এই জিপিজাপা টুপি পরার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। সেই থেকে টুপিটি পানামা হ্যাট নামে খ্যাতি পায়। তাহলে কি মাদ্রাজী মুম্বাই আম আসলে মাদ্রাজী কন্য যার শ্বশুর বাড়ি মুম্বাইয়ে? স্ববিরধীতার রহস্য জিইয়ে থাকুক, ওতে আওয়াম জনতার আম ভোজন খানিক বিশেষত্ব পাবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন