সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মাদ্রাজী মুম্বাই আমঃ স্ববিরোধীতার নয়া উপমা!

কাঁঠালের আমসত্ত্ব পুরনো আইটেম যদিও বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই তবে সোনার পাথর বাটি বানানোর কারিগরেরা কিন্তু তাদের উৎপাদন যথারীতি বজায় রেখেছেন এবং তা চালিয়ে যাচ্ছেন বেশ বহাল তবিয়তেই। 
কিরকম? বলছি। এমনিতে আম ভীষণ গনতান্ত্রিক ফল। ফলের রাজা বলে কিছু মানুষ, আমকে রাজতন্ত্রের মহিমা প্রদান করতে চায় বটে, তবে আম আর উর্দু আওয়াম, সাধারণ উচ্চারণে যা আম এর মতোই শোনায়, দুটি শব্দের মধ্যে অর্থগত তারতম্য থাকলেও আমের উপভোক্তা হিসেবে আম জনতার মধ্যে কিন্তু কোনো প্রভেদ নেই। সেখানে রাজা, প্রজা সকলেই আম ভক্ত আওয়াম। সে পেট্রোল পাম্পের সাধারণ কর্মচারী, নান্টু মন্ডল হোক কি বহুজাতিক কোম্পানির বড় আধিকারিক- আম কেনার ক্ষেত্রে সকলেই এক। 

যে কথা প্রথমেই বলছিলাম, সেটা হলো তেঁতুলের আম আচার বা জাতীয় স্ববিরোধী জিনিস যারা বানান তারা কিন্তু এই বাজারেও বেশ আছেন, এবং বলা যায় স্বমহিমায় আছেন। সে দুধের দইবড়া হোক কি আমের টমেটো চাটনি, তাদের স্ববিরোধী সৃজনে কিন্তু কোনোরকম বিরাম নেই। আসলে স্ববিরোধী ভাবনায় বেশ একটা ইন্টেলেকচুয়াল বেপরোয়াপনা রয়েছে। রসবোধ এবং দুষ্টুমির সুষম মিশেলে গড়ে ওঠা এই স্ববিরোধী তকমা গুলো সাধারণত কাউকে উপহাসের পাত্র করে পেশ করার ক্ষেত্রে একেবারে মোক্ষম অস্ত্র। আমাদের গ্রামের এক মাস্টারমশাই ছিলেন, তাঁর পড়ানোর পারদর্শিতা মোটেই প্রশ্নাতীত ছিল না। কিন্তু তাতে কি! সহজেই তিনি সকলের কাছে পন্ডিত স্যার হিসেবে নিজের একটা হাস্যকর ব্র্যান্ড ইমেজ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন দেওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে তার বাবা মায়ের, অন্তত নিজের ছেলের অন্ধত্ব নিয়ে কোনোরকম রসিকতা করার অভিপ্রায় থাকে বলে মনে হয় না। 

আমরা সকলেই জানি, ভগবান কৃষ্ণকে কেন কালাচাঁদ বলা হয় আর চৈতন্যদেবকে কেন গোরাচাঁদ। কিন্তু পরিহাস প্রিয় মানুষ, তারা এমনকি ঠাকুর দেবতার নাম নিয়েও খিল্লি করতে পিছপা হয় না। স্ববিরোধীতার রসে চুবিয়ে, তাকে এমনভাবে পেশ করে যে নামের মহিমা উল্টে বিড়ম্বনার কারণ হয়ে ওঠে।।  যেমন রংপুরের কৃষ্ণ বাবু, কুচবর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কেলো নামে পরিচিত হন সর্বত্র; অমন গোরা সাহেবদের মত গায়ের রঙ, কিন্তু তার বাবা নিশিকান্ত মশাই তাঁর পাঁচ ছেলের - সকলের নামের শেষে কান্ত জোড়ার গেরোয় তৃতীয় পুত্রের ভালো নাম স্থির করেন কৃষ্ণকান্ত, ব্যাস একেবারে লপ্পা ক্যাচ। সকলেই বলে, কি কেলো রে বাবা, এত ফর্সা হওয়া সত্তেও কি না কৃষ্ণকান্ত।  সেই থেকে বন্ধু বান্ধব পাড়ার সকলের কাছে তিনি কেলো নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বোবার তর্কালঙ্কার উপাধি পাওয়ার মতন। যেমন ধরুন নাকছাবি, তা সোনার কিংবা হীরেরও হতে পারে কিন্তু কানের নাকছাবি এক অলীক সম্ভাবনা।  হাতের পাদানি যেমন হয় না, তেমনি রাজপুরের জয়পুরী মার্বেল হওয়াও ঘোর স্ববিরোধী। কিন্তু হয়। কেমন বলছি। 

গ্রীষ্মের দিনে বাজার জুড়ে যত্র তত্র দেখা যায় আমের পসরা সাজানো ঠেলা বা পাতাই ইত্যাদি। দোকানে - চার পাঁচ রকমের আম ডাই করে সাজানো থাকে পাশাপাশি। কোনোটা হয়তো হিমসাগর, কোনোটা বা বেগুনফুলি বা ল্যাংড়া  আবার কোনোটা হয়তো গোলাপি আভায় উদ্ভাসিত গোলাপখাস। দেশী মল্লিকা, চৌসা, আম্রপালী এসবও থাকে পাশাপাশি। কিন্তু মাদ্রাজী মুম্বাই আম, দোকানদারের মুখে নামটা শুনতেই ভালো করে নেড়ে চেড়ে দেখার ইচ্ছে হোল। টুবো টুবো হলদেটে আমগুলো,  জাপানি কুস্তিগীরদের মতন দেখতে, যেমন কুঁদোনো দেহ সৌষ্ঠব তেমন পেলব গদ্গদ ভাব। গাদাগাদি করে সাজানো আছে একটার পর একটা। দোকানিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমটার নাম। আরে বাবা, শুনতে পেলেন না! এটা হোল মাদ্রাজী মুম্বাই আম। আসলে ধন্দটা বাধলো অন্যত্র, কিছুতেই স্থির করতে পারছিলাম না  আমটা আসলে মুম্বাইয়ের মাদ্রাজী আম না মাদ্রাজের মুম্বাই আম। সাধারণত বিশেষ্য পদের পূর্বে একাধিক বিশেষণ পদ থাকলে দুরতম পদটিকেই বিশেষণ বলে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে আমটির নাম মুম্বাই আম কিন্তু জন্ম এবং বড় হওয়া মাদ্রাজে। হয় না, ভারতীয় বংশোদ্ভুত কিন্তু নাগরিক অমেরিকার। তেমনি। সোনারপুরের বারুইপুরি পেয়ারার মতন কিংবা পটাসপুরের পাঁশকুরার চপের মতন। মালদার ফজলী কিন্তু মুর্শিদাবাদের গাছে জন্ম, বড় হওয়া এবং সবশেষে পেকে বাজারজাত হওয়া শিয়ালদহ স্টেশনে। এখন আউটসোরসিং এর যুগ। বাটার জুতো শুধু বাটানগরের কারখানা থেকেই বেরোবে এমন কথা নেই। না হলে,  রানাঘাটের মিষ্টি দোকানে শক্তিগড়ের ল্যাংচা পাওয়া যাবে কি করে। কিংবা সোনারপুরের হালুইকর রানাঘাটের গজা কিংবা বর্ধমানের সীতাভোগ বানাবেন কোন সাহসে।  ছোটবেলায় আমাদের ঘরের পেছনে একটা পেল্লাই সপেদা গাছ ছিল, ইয়া বড় বড়, নলেন গুড়ের রাজভোগের মত দেখতে সপেদা হত তাতে।  দাদুর মুখ থেকে শুনেছিলাম এটি নাকি মুম্বাই সপেদা। বারুইপুরে মুজফফরপুরী লিচু হওয়ার মতো, মুম্বাই থেকে দু হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের কাঁথিতে হত মুম্বাই সপেদা। যেমন পানামা হ্যাট, যে টুপি প্রয়াত সি পি এম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর মাথায় - শোভা পেতে দেখেছি আমরা, শুনলে অবাক হবেন এটি আসলে ইকুয়েডরীয় পানামা হ্যাট। জন্ম দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরে, জিপিজাপা পাম গাছের পাতা থেকে তৈরি; কিন্তু উত্তর আমেরিকার পানামায় খাল খননের সময় এই জিপিজাপা টুপি পরার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। সেই থেকে টুপিটি পানামা হ্যাট নামে খ্যাতি পায়। তাহলে কি মাদ্রাজী মুম্বাই আম আসলে মাদ্রাজী কন্য যার শ্বশুর বাড়ি মুম্বাইয়ে? স্ববিরধীতার রহস্য জিইয়ে থাকুক, ওতে আওয়াম জনতার আম ভোজন খানিক বিশেষত্ব পাবে।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...