সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কাঁথি এবং কাঁথির কাজু কথকতা!

কাজুবাদাম খেতে যতটা ভালো মূল্যটাও কিন্তু মন্দ কিছু নয় তবে কিনা কাজুবাদাম বলে কথা ছোটবেলায়, ভুগোল বইয়ের পাতায় যখন পড়লাম সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল হিসেবে কাঁথির (পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ) ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য গুলোর কথা - যার মধ্যে সমুদ্র, ঝাউবন, সামুদ্রিক মাছ, বালিয়াড়ি ছাড়াও সেই সর্বজনবিদিত সুদীর্ঘ সুস্বাদু কাজুবাদাম তার সুরম্য জঙ্গলে ঘেরা ভূপ্রকৃতির বিশেষ সুনন্দিত বর্ণনাকথা - তখন যাকে বলে গর্বে একেবারে ষাঁড়াষাড়ির জোয়ার বয়ে যেতো বুকের মধ্যে
কারণ আমার বাড়ির (কাঁথি শহর থেকে ৩ কিমি পূর্বে অবস্থিত বালিয়াড়ি ঘেরা জনপদ, দারুয়া) কাছেই যে কত অযত্নে বেড়ে ওঠা কাজুবাদামের জঙ্গল ছিল, একেবারেই প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা, কে কবে সে গাছ লাগিয়েছিল কেউ বলতে পারে না উঁচু উঁচু বালিয়াড়ি - একেবারে পাহাড়ের মতোই তার সুউচ্চ চূড়া, আর তার কোলে পিঠে গজিয়ে যাওয়া কাজুর নাতিদীর্ঘ গাছ তার চতুর্দিকে বিস্তৃত ডালায় পালার ঘনিয়ে আসা ছায়া আঁধারি ঝোপ
কেউ কখনো বেড়া দেওয়ার কথা ভাবতোই না

কাঁচা কাজুবাদাম ঝুলে আছে গাছে! 
আমি আমার একটি গল্পে এইরকম বালিয়াড়ি আর কাজুবাদামের জঙ্গলের কথা লিখেছিলাম। গল্পটির সকল কুশীলবই, উপরিল্লিখিত পরিবেশের মধ্যে থেকে সমস্ত ঘটনার বিন্যাস ঘটানোর কাজ করে। ছোটবেলায় দেখা আমার জন্মস্থানের সেই ছবিই যে গল্পের পটভূমি হয়ে ফুটে উঠেছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। গল্পটির নাম ছিল 'খেলা'। প্রসঙ্গত, ছোটবেলায়, এই বালির পাহাড় গুলোই ছিল আমাদের প্রিয় ক্রিড়া ক্ষেত্র
গ্রীষ্ম কাল এলেই, প্রচন্ড রোদে যখন বালি উত্তপ্ত হয়ে উঠতো, বড়দের দেখেছি মট মট করে বাদাম পাতা গুলো ছিঁড়ে বালির ওপরে ফেলতো আর তার উপরে পা রেখে রেখে - হেঁটে এগিয়ে যেতো সামনের দিকে আর এই গরম কালেই ধরে বাদাম লাল, কমলা, হলুদ রঙের বাদাম ফলগুলো বরের টোপরের মতো দেখতে, অকথ্য ভাবে ঝুলে থাকতো গাছের শাখা প্রশাখাতে যেহেতু কাজুবাদাম একটি ব্যক্তবীজী ফল, বীজ গুলো থাকে বাইরে, ফলের ঠিক নীচে সেই কিডনি বা বৃক্কের মতো দেখতে বীজের মধ্যে থাকা শাঁসই আমরা কাজুবাদাম হিসেবে খাই
আমার বাড়ির অনতিদূরেই ছিল কাজুবাদামের একটা ঘন জঙ্গল, জনৈক দেবেন মাইতি ছিলেন তার মালিক সকলে আমরা বলতাম দেবেন মাইতির জঙ্গল তাতে কাজু ছাড়াও শ্যাওড়া, বকুল, শিরীষ সহ নানা কিসিমের গাছ ছোট ছোট ঝাটু কুলের ঝোপ ঝাড় থাকতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কেমন গা ছমছমে ভাব লুকোচুরি খেলায় কেউ কেউ ওখানে গিয়ে লুকোলে আর তাকে খুঁজে পাওয়ার জো ছিল না জঙ্গলটির মাঝখানে একটা অগভীর পুকুর ছিল গরমের সময় দু এক আঁজলা ঝরা জলই কেবল পড়ে থাকতো তলায় আমরা খুব ভোরে উঠে দল বেঁধে সেই জঙ্গলে যেতাম কাজু কুড়োতে রাতে বাদুড় খেয়ে ফেলে দিয়ে যেতো, সেইগুলোই তুলে নিয়ে আসতাম আমরা পাকা কাজুর রং হয় কালচে বাদামী কিন্তু কাঁচা অবস্থায় একেবারে ডিপ সবুজ মাঝে মাঝে, দু একটা কাঁচা বাদাম ছিঁড়ে নেইনি সে কথা বলবো না
কাঁচা বাদাম খাওয়ার পদ্ধতি কিন্তু বেশ জমকালো একটা ইঁটের ওপর কাঁচা কাজুটিকে রেখে আর একটি আধলা ইঁট দিয়ে থেঁতো করলে কষাটে দুধ-সাদা শাঁস ছিটকে বেরুতো, ছোটবেলায় তাই ছিল অমৃত
আস্তে আস্তে বালিয়াড়ি কেটে পরিষ্কার হয়েছে, লোকসংখ্যা বেড়েছে তাই জঙ্গল কেটে ঘরবসতি গড়ে উঠেছে সেই জায়গায় এখন কাজুর গাছকে তাই বেড়া দিয়ে সর্বক্ষণ নজরে নজরে রাখার বন্দোবস্ত করে গাছমালিকেরা
গোয়ায় পর্যটকদের কাছে কাজুবাদাম থেকে তৈরি পানীয় ফেনি খুবই জনপ্রিয়
কাঁথি, কাজুবাদামের জন্য বিখ্যাত হলেও নিয়ে কোনো কথা শোনা যায় না
লোকে বলে, কাঁথি নাকি তিনটে '' এর জন্য বিখ্যাত বালি, বালিকা আর বাদাম কিন্তু কাঁথির নিজস্ব কাজু গাছের আজ বড়ই আকাল সেই তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ আবার কখনোও কখনোও বিদেশ থেকে আমদানি করে আনা হয় কাজু, কাজু প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে অনেক মানুষের রুটি রুজি নির্ভর করে কাঁথি তে তবু কাজু আজ সুন্দরবনের মধুর মতোই কাঁথির মানুষের কাছে অধরা, সহজলভ্য তো নয় মোটেই

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...