কাজুবাদাম খেতে যতটা ভালো মূল্যটাও কিন্তু মন্দ কিছু নয়। তবে কিনা কাজুবাদাম বলে কথা। ছোটবেলায়, ভুগোল বইয়ের পাতায় যখন পড়লাম সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল হিসেবে কাঁথির (পূর্ব মেদিনীপুর,
পশ্চিমবঙ্গ)
ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য গুলোর কথা - যার মধ্যে সমুদ্র, ঝাউবন, সামুদ্রিক মাছ, বালিয়াড়ি ছাড়াও সেই সর্বজনবিদিত সুদীর্ঘ ও সুস্বাদু কাজুবাদাম ও তার সুরম্য জঙ্গলে ঘেরা ভূপ্রকৃতির বিশেষ সুনন্দিত বর্ণনাকথা - তখন যাকে বলে গর্বে একেবারে ষাঁড়াষাড়ির জোয়ার বয়ে যেতো বুকের মধ্যে।
কারণ আমার বাড়ির (কাঁথি শহর থেকে ৩
কিমি পূর্বে অবস্থিত বালিয়াড়ি ঘেরা জনপদ, দারুয়া) কাছেই যে কত অযত্নে বেড়ে ওঠা কাজুবাদামের জঙ্গল ছিল, একেবারেই প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা, কে কবে সে গাছ লাগিয়েছিল কেউ বলতে পারে না। উঁচু উঁচু বালিয়াড়ি - একেবারে পাহাড়ের মতোই তার সুউচ্চ চূড়া, আর তার কোলে পিঠে গজিয়ে যাওয়া কাজুর নাতিদীর্ঘ গাছ ও তার চতুর্দিকে বিস্তৃত ডালায় পালার ঘনিয়ে আসা ছায়া আঁধারি ঝোপ।
কেউ কখনো বেড়া দেওয়ার কথা ভাবতোই না।
গ্রীষ্ম কাল এলেই, প্রচন্ড রোদে যখন বালি উত্তপ্ত হয়ে উঠতো, বড়দের দেখেছি মট মট করে বাদাম পাতা গুলো ছিঁড়ে বালির ওপরে ফেলতো আর তার উপরে পা রেখে রেখে - হেঁটে এগিয়ে যেতো সামনের দিকে। আর এই গরম কালেই ধরে বাদাম। লাল, কমলা, হলুদ রঙের বাদাম ফলগুলো বরের টোপরের মতো দেখতে, অকথ্য ভাবে ঝুলে থাকতো গাছের শাখা প্রশাখাতে। যেহেতু কাজুবাদাম একটি ব্যক্তবীজী ফল, বীজ গুলো থাকে বাইরে, ফলের ঠিক নীচে। সেই কিডনি বা বৃক্কের মতো দেখতে বীজের মধ্যে থাকা শাঁসই আমরা কাজুবাদাম হিসেবে খাই।
আমার বাড়ির অনতিদূরেই ছিল কাজুবাদামের একটা ঘন জঙ্গল, জনৈক দেবেন মাইতি ছিলেন তার মালিক। সকলে আমরা বলতাম দেবেন মাইতির জঙ্গল। তাতে কাজু ছাড়াও শ্যাওড়া, বকুল, শিরীষ সহ নানা কিসিমের গাছ ও ছোট ছোট ঝাটু কুলের ঝোপ ঝাড় থাকতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেমন গা ছমছমে ভাব। লুকোচুরি খেলায় কেউ কেউ ওখানে গিয়ে লুকোলে আর তাকে খুঁজে পাওয়ার জো ছিল না। জঙ্গলটির মাঝখানে একটা অগভীর পুকুর ছিল। গরমের সময় দু এক আঁজলা ঝরা জলই কেবল পড়ে থাকতো তলায় । আমরা খুব ভোরে উঠে দল বেঁধে সেই জঙ্গলে যেতাম কাজু কুড়োতে। রাতে বাদুড় খেয়ে ফেলে দিয়ে যেতো, সেইগুলোই তুলে নিয়ে আসতাম আমরা। পাকা কাজুর রং হয় কালচে বাদামী। কিন্তু কাঁচা অবস্থায় একেবারে ডিপ সবুজ। মাঝে মাঝে, দু একটা কাঁচা বাদাম ছিঁড়ে নেইনি সে কথা বলবো না।
কাঁচা বাদাম খাওয়ার পদ্ধতি কিন্তু বেশ জমকালো। একটা ইঁটের ওপর কাঁচা কাজুটিকে রেখে আর একটি আধলা ইঁট দিয়ে থেঁতো করলে কষাটে দুধ-সাদা শাঁস ছিটকে বেরুতো, ছোটবেলায় তাই ছিল অমৃত।
আস্তে আস্তে বালিয়াড়ি কেটে পরিষ্কার হয়েছে, লোকসংখ্যা বেড়েছে তাই জঙ্গল কেটে ঘরবসতি গড়ে উঠেছে সেই জায়গায়। এখন কাজুর গাছকে তাই বেড়া দিয়ে সর্বক্ষণ নজরে নজরে রাখার বন্দোবস্ত করে গাছমালিকেরা।
গোয়ায় পর্যটকদের কাছে কাজুবাদাম থেকে তৈরি পানীয় ফেনি খুবই জনপ্রিয়।
কাঁথি, কাজুবাদামের জন্য বিখ্যাত হলেও এ নিয়ে কোনো কথা শোনা যায় না।
লোকে বলে, কাঁথি নাকি তিনটে 'ব' এর জন্য বিখ্যাত। বালি, বালিকা আর বাদাম। কিন্তু কাঁথির নিজস্ব কাজু গাছের আজ বড়ই আকাল। সেই তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ আবার কখনোও কখনোও বিদেশ থেকে আমদানি করে আনা হয় কাজু, কাজু প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে অনেক মানুষের রুটি রুজি নির্ভর করে কাঁথি তে। তবু কাজু আজ সুন্দরবনের মধুর মতোই কাঁথির মানুষের কাছে অধরা, সহজলভ্য তো নয় মোটেই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন