সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কোঝিকোড়কে, ইউনেস্কো দিল সাহিত্য শহরের স্বীকৃতি!

সে আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো ডা গামার বাণিজ্য তরী, তার দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার শেষে ১৪৯৮ সালের এক শীতের সকালে এসে পৌঁছল, কেরালার মালাবার উপকূলে। চুম্বকে, সেই স্থানটির নাম ছিল কালিকট। জাহাজ থেকে অবতরণের পর ভাস্কো ডা গামা, কালিকটের সোনালী সৈকতেই প্রথম তাঁর পা রেখেছিলেন। প্রকৃত পক্ষে ভাস্কো ডা গামার এই মহা পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে, ইউরোপীয় দেশ গুলির সামনে উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল ভারত নামক এক নতুন সম্ভাবনার দরজা। আবিষ্কৃত হয়েছিল ভারত ভূখন্ডের মধ্যে প্রবেশ করার প্রথম গেটওয়ে, কালিকট। যা বর্তমানে কোঝিকোড় নামে পরিচিত।

অতীতে, মশলার শহর হিসেবে কোঝিকোড়ের খ্যাতি ছিল বিশ্ব জোড়া। ২০২৩ এ এসে কোঝিকোড়ের মুকুটে জুড়ল আর এক মর্যাদার পালক। কারণ, ইউনেস্কো City of Spices কে দিল City of Literature এর সম্মান। ইউনেস্কো কৃত সৃজনশীল শহরের তালিকায় (UCCN - UNESCO's Creative Cities Network) এবছর ঢুকে পড়ল কেরালার এই উপকূলবর্তী শহরের নাম। ৩১ শে অক্টোবর, বিশ্ব নগর দিবসের সন্ধ্যায় ইউনেস্কো মহাসচিব, Audrey Azoulay তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বিবৃতি দিয়ে জানালেন কোঝিকোড়কে এই স্বীকৃতি দেওয়ার কথা। কোঝিকোড়, ভারতের প্রথম শহর যার কপালে জুটল এই সাহিত্য শহরের শিরোপা। প্রসঙ্গত ইউনেস্কোর বিচারে এবারে সঙ্গীতের শহরের মর্যাদা পেয়েছে ভারতবর্ষের অন্য একটি ঐতিহ্যবাহী শহর, মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র। যে কারণে ভারতের ইতিহাসে ২০২৩ সাল বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এদিকে ইউনেস্কোর এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরে পরেই টুইট করে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী জি রেডডী। এখন প্রশ্ন উঠছে, দেশের তথাকথিত সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিগণিত কোলকাতা কি এ ক্ষেত্রে বিফল হোল ইউনেস্কোর কাছে তার সাহিত্যের ঐতিহ্যের কথা সঠিক ভাবে তুলে ধরতে?
সংবাদে প্রকাশ, 
কোঝিকোড়ের National Institute of Technology (NIT) এর স্থাপত্য ও পরিকল্পনা বিভাগের ছাত্ররা এ ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য পেশ করতে যে ভাবে ২০২২ এর জুলাই মাস থেকে টানা ২০২৩ এর জানুয়ারি পর্যন্ত দিনরাত এক করে পরিশ্রম করেছে, এবং চলতি বছর জুন মাসে ইউনেস্কোর সামনে পুরো রিপোর্ট জমা দিয়েছে, সেটাই এই সম্মান প্রাপ্তির পেছনে মূল কারণ বলে মনে করছে সবাই। ইউনেস্কোর কাছে পেশ করা তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, কোঝিকোড় শহরের ৫০০ র বেশি গ্রন্থাগার, প্রায় ৭০ টির মত প্রকাশনা সংস্থা ও ১০০টি বই বিপণী থাকার কথা। স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে এই শহরের বিখ্যাত লেখক এস কে পতেকাট, মহম্মদ বাসির, বাসুদেবন নায়ার প্রমূখের, সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য অবদানের কথা। প্রসঙ্গত এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই কোলকাতা শহর, কয়েকশ কদম এগিয়ে কোঝিকোড়ের থেকে। পিছিয়ে শুধু সৎ উদ্যোগ নেওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যমের ক্ষেত্রে। সাফল্য পাওয়ার জন্য যে নিষ্ঠা এবং শ্রমের প্রয়োজন, বিশেষ করে কোনো কিছুকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার ব্যাপারে যে একনিষ্ঠতার প্রয়োজন সে ক্ষেত্রে কোলকাতার অনাগ্রহ সুপরিচিত। কোঝিকোড়ের এই স্বীকৃতির পেছনে রয়েছে আরো একটি বড় কারণ, তা হল সাহিত্য প্রেমী এই শহরেই প্রতি বছর আয়োজিত হয় রাজ্যের মুখ্য সাহিত্য মেলা, কেরালা সাহিত্য উৎসব। 
২০০৪ সাল থেকে শুরু হওয়া ইউনেস্কো দ্বারা এই সৃজনশীল শহরের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া এবার ১৯ বছরে পড়ল। সংস্কৃতি বিষয়ক সাতটি বিভিন্ন বিভাগ যেমন শিল্প, কলা-কৃতি, লোক সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও সঙ্গীতে ইউনেস্কো প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন শহরকে বেছে নেয় সৃজনশীল
শহরের
তালিকায়। এবছর যোগ হয়েছে নতুন ৫৫ টি শহর। এই নিয়ে ইউনেস্কোর তালিকায় এ পর্যন্ত বিশ্বের ১০০ টি দেশের প্রায় ৩৫০ টি শহরের নাম এই তালিকা ভুক্ত হয়েছে। আগামী বছর, ২০২৪ এর জুলাই মাসে পর্তুগালে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইউনেস্কো দ্বারা নির্বাচিত সৃজনশীল শহর গুলির বার্ষিক সম্মেলন। সেখানে উপস্থিত থাকবে নতুন সংযুক্ত হওয়া 
কোঝিকোড় ও গোয়ালিয়র এর প্রতিনিধিরাও।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...