ঘাটশিলা এবং বিভূতিভূষণের মধ্যে সম্পর্ক ছিল আত্মার সঙ্গে শরীরের। একান্ত নিবিড় এবং পরম আত্মীয়তার।
'চাঁদের পাহাড়' এর লেখককে তাঁর ঘাটশিলা যাপনের কথা বাদ দিয়ে বিচার করার ভাবনা, সূর্যকে বাদ দিয়ে সৌরজগতের বর্ণনা করার মত অর্থহীন। কারণ, বিভূতিভূষণের শুধু সেরা সৃষ্টি গুলির পটভূমিই ছিল না ঘাটশিলা, বাংলা সাহিত্যের প্রথম আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'পথের পাঁচালী' র সৃজণভূমিও ছিল বন্য নান্দনিকতায় ভরা এই নাতি উচ্চ পাহাড়ী জনপদটি। অন্তত, 'পথের পাচালী' র সূচনা পর্ব গুলি বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন এখানে বসে। ঘাটশিলায়, বিভূতিভূষণ প্রথম এসেছিলেন কাজের সূত্রে। খেলাত ঘোষ এস্টেটের সহকারী ফরেস্ট ম্যানেজার হিসেবে। প্রকৃত পক্ষে ঘাটশিলা ছিল বিভূতিভূষণের Love at first sight। আমৃত্যু সেই প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটেনি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটাও নিয়েছিলেন এই ঘাটশিলাতেই। ১৯৫০ সালের ১লা নভেম্বর, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বিভূতিভূষণের। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে। বাংলা সাহিত্যের এই মহান লেখকের মৃত্যু দিনের, রোমহর্ষক ঘটনার কথা অনেকেরই অজানা। কিন্তু সেই দিনকার ঘটনা পরম্পরার উপর আলোকপাত করার আগে একটু প্রেক্ষাপটটা বুঝে নেওয়া দরকার। ১৯১৮'য়, বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায়, সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যু হয় বিভূতিভূষণের প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবীর। একা হয়ে যান বিভূতিভূষণ। স্ত্রী বিহীন ছন্নছাড়া বিভূতিভূষণের জীবনে, গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত নেমে আসে আরো এক বিপর্যয়। একমাত্র সম্বল, স্কুল শিক্ষকতার চাকরি টুকু চলে যায় তাঁর। সেই সময় প্রায় নিরুপায় হয়েই ঘাটশিলায় এসেছিলেন বন দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে। নিয়তি তাড়িত বিভূতিভূষণ, ঘাটশিলায় পৌঁছে যেন তাঁর সাধনপীঠে এসে পৌঁছলেন। এখানকার সুবর্ণরেখা নদী, তার চর, পঞ্চপান্ডবের টিলা, ফুল ডুঙরীর জঙ্গল সব যেন কত যুগ ধরে অপেক্ষা করছিল 'আরন্যক' এর স্রষ্টার সামনে তাদের অমিত সৌন্দর্য রাশি মেলে ধরার জন্যে। বন্ধু মন্মথ ঘোষের বাড়িতে প্রথমে, ভাড়ায় থাকতেন। পরে কিনেছিলেন, বাড়ি। জনৈক অশোক বোস, বিভূতিভূষণের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন। অনেক দিন কেটে যায়। ধার শোধ দিতে না পেরে, অশোক বোস বিভূতিভূষণকে তাঁর ঘাটশিলার বাড়িটিকে সেই ঋণের অর্থ বাবদ দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলে বিভূতিভূষণ তাতে রাজি হয়ে যান। সেটা ছিল ১৯৩৮ সাল। দুবছর পর অর্থাৎ ১৯৪০ এ, ৪৬ বছর বয়সে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন বিভূতিভূষণ। পাত্রী, তাঁর বয়সের অর্ধেকেরও কম, রমা চট্টোপাধ্যায়। বিয়ে করে রমা দেবীকে নিয়ে ঘাটশিলার নতুন বাড়িতে বিভূতিভূষণ থাকা শুরু করেন। কিন্ত বাড়ির নামকরণ করতে গিয়ে তখনও প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবীর স্মৃতিতে কাতর বিভূতিভূষণ, বাড়ির নাম রাখেন গৌরী কুঞ্জ। সাত বছর পর, বিভূতিভূষণ ও রমা দেবীর পুত্র সন্তান তারাদাসের জন্ম হয়। কিন্তু পুত্র সুখ বেশি দিন ছিল না, বিভূতিভূষণের কপালে। মাত্র তিন বছরের মাথায় তাঁকে চলে যেতে হয় সব কিছু ছেড়ে। চির নিদ্রার দেশে। মৃত্যুর কারণ, করোনারি হার্ট অ্যটাক। মৃত্যুর দিন, ঘাটশিলা রাজবাড়িতে ছিল সাহিত্য বাসরের আয়োজন। সেখানে অন্যান্য বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমন্ত্রিত ছিলেন বিভূতিভূষণও। সাহিত্য সভা শেষ হলে খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে বাড়ি ফেরার পথে অসুস্থতা অনুভব করতে শুরু করেন, তিনি। রাস্তায় অনেকবার বমিও করেন। কোনোরকম বাড়িতে পৌঁছলে, ছোট ভাই নটুবিহারী যিনি তাঁর স্ত্রী কে নিয়ে গৌরী কুঞ্জেই থাকতেন সেই সময়, পেশায় একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে প্রায় জান লড়িয়ে দেন বাংলা সাহিত্যের এই মহিরুহকে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু ব্যর্থ হন। রাত ৮ টা ১৫ মিনিটে চির বিদায় নেন বিভূতিভূষণ। লেখকের বড় প্রিয় সে সুবর্ণরেখার বালুচরেই দাহ করা হয় তাঁকে। কিন্তু তারপরে যা ঘটলো, তা আরো মারাত্মক। দাদার মৃত্যুর আট দিনের দিন অর্থাৎ ৯ ই নভেম্বর নটুবিহারী আত্মহত্যা করে শেষ করে ফেলেন, নিজের জীবনকে। তাঁর আত্মহত্যার কারণ যদিও জানা যায়নি। এরপরে, আর ঘাটশিলায় থাকেননি রমা দেবী। তিন বছরের পুত্র সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন বনগাঁয় নিজের গ্রামে, গোপাল নগরে। মর্মন্তুদ এই কাহিনী, কাহিনীকার বিভূতিভূষণের মর্মস্পর্শী ভাষায় না জানি কোন অমর রচনার জন্ম দিত।
'পথের পাঁচালী' র স্রষ্টা বিভূতিভূষণ সম্পর্কে আরো দুটি লেখা পড়তে দেখুন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন