সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুনীলের নাক বোঁচা হওয়ার নেপথ্য কাহিনী।

বনলতা সেন কে বাদ দিয়ে জীবনানন্দকে ভাবা যায় না। আবার নীরা কে বাদ দিয়ে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। শুভ্র কেশ যুক্ত লম্বা দাঁড়ি বাদ দিলে যেমন রবীন্দ্রনাথের পরিচিত লুক, একেবারেই ঢিলে পড়ে যায়। তেমনি উদ্দেশ্যহীন ভাবনায় নিমগ্ন দুটি চোখকে বাদ দিলে, জীবনানন্দকে ফুটিয়ে তোলা, অন্তত ছবিতে তো প্রায় অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে। নজরুলের কথা উঠলেই, চোখে ভেসে ওঠে কান ঝাপা কোঁকড়ানো চুলের তরতাজা এক সুদর্শন মুখের। তেমনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখ মনে করতে বসলে, সুনীলের  মঙ্গোলিয়ান শৈলীর মুখাবয়বের সেরা বৈশিষ্ট্য ওই বোঁচা নাকেটাকেই আগে মনে পড়ে।

এবারে আসা যাক আসল কথায়। কুলীন ব্রাহ্মণ বাড়ির সন্তান হয়েও, সুনীলের নাক টিকালো হওয়ার পরিবর্তে বোঁচা হল কি করে সে কাহিনী বেশ রসাত্মক এবং রহস্যময়।
সুনীল নিজেই বলেছেন তাঁর বংশের কৌলীন্য নিয়ে কোনোরকম প্রশ্নের সম্ভাবনা ছিল না। সুনীলের বাবা কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায়, কোনো অসবর্ণের মেয়েকে বিয়ে করেননি। কারণ, তখন বিয়ের ব্যাপারে জাত পাত ছিল প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের কাছে। সুনীল তাঁর আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ এ লিখছেন – “বংশে একটি বিয়েও ঠিক ঠিক স্ব – বর্ণে না হলে বংশ পতিত হয়ে যেত।“ “বিশেষ করে উপাধ্যায় যুক্ত পদবীধারী রাড়ি ব্রাহ্মণরা যারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতো, তাঁদের ক্ষেত্রে তো অসবর্ণে বিয়ে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল।“ বলাই বাহুল্যা সুনীলের পদবী উপাধ্যায় যুক্ত। এবং তাঁর কথা মত তাঁর জন্ম হয়ে ছিল এক রাড়ি ব্রাহ্মণ বংশেই। এমনকি একটা জায়গায় তিনি বলছেন, বংশ কৌলীন্য ছাড়া তাঁর বাবার আর কোনো গৌরবই ছিল না। তাহলে সুনীলের বোঁচা নাক রহস্য তো সেই অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে।
যদিও সুনীল তাঁর বাবার চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন,’ বেঁটেখাটো, ভালোমানুষের মতন গোল মুখ এবং অল্প বয়স থেকেই টাঁক পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে’ বলে। এককথায় সুপুরুষ বলা যাবে না। তবে তাঁর গায়ের রঙ ফরসা ছিল বলে সুনীল উল্লেখ করেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। কিন্তু সুনীল কোথাও তাঁর বাবার বোঁচা নাক থাকার কথা উল্লেখ করেননি।  
এবারে তাঁর মা মীরা দেবীর চেহারা কেমন ছিল, দেখা যাক। যদি কিছু সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সুনীল বলছেন, তাঁর মা’র ছিল সুন্দর চেহারা। একটা জায়গায়, তিনি অকপটে স্বীকারও করে নিয়েছেন, যে তাঁর মা মীরা দেবী যদি মামাবাড়িতে থেকে বড় না হতেন তাহলে হয়তো তাঁর বাবার মত সাধারন শিক্ষক কে তাঁকে বিয়ে করতে হত না।  “মামাবাড়ির আশ্রিতা না হলে মীরা তাঁর রূপ ও গুনের জন্যে যোগ্যতর পাত্র পেতে পারত।“ এমন কি সুনীল তাঁর মায়ের সুন্দর টিকালো নাকের কথা উল্লেখও  করেছেন খুব গর্বের সাথে।
তাহলে, বোঁচা নাকের রহস্য তো রহস্যই থেকে যাচ্ছে।
‘অর্ধেক জীবন’ এ সুনীল নিজেই সে রহস্যের জট ছাড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন। তবে রহস্য উন্মোচিত হওয়ার আগে একটু প্রেক্ষাপটটা বুঝে নেওয়া দরকার।
সুনীলের পৈত্রিক ভিটে ফরিদপুরে হলেও, তাঁর জন্ম স্থল কিন্তু বরিশালের আমগ্রামে। আমগ্রামে সুনীলের মামার বাড়ি। তখনকার গাঁ-ঘরের প্রথা মত, চ্যাঁচড়ার বেড়া দিয়ে তৈরি অস্থায়ী আঁতুড় ঘরেই জন্ম হয় বাংলা সাহিত্যের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ রত্নের। নবজাতক শিশুকে দেখভাল করতে একমাত্র সম্বল বলতে ওই ধাত্রি বা দাই। বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ওরা কাজ চালাত; স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কোনো জ্ঞানের বালাই ছিল না তাঁদের।
কালীপদ ও মীরার প্রথম সন্তান, সুনীলের দাই ছিলেন এমন একজন যাকে সবাই ডাকতো বোঁচার মা বলে। কারণ তাঁর ছেলের নাম, বোঁচা। সুনীল লিখছেন, “বোঁচার মা ছিলেন বেশ হাট্টাগোট্টা, পুরুষালি চেহারার। মামার বাড়ির পাশের একটা মস্ত জলাশয়ের ওপারে থাকতেন, আসতেন একটি নৌকা চালিয়ে।“   
তারপরে উনি বলছেন, “ উনার ছেলের নাম বোঁচা, তাঁর নিজের নাকটিও ছিল খুব বোঁচা।" “চক্ষু উন্মীলনের পর সেই রমনীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার নাকটিও বোঁচা হয়ে যায়।"
জানি না সুনীল যখন তাঁর বোঁচা নাকের নেপথ্য কাহিনী এই ভাবে ফাঁস করছেন, তাঁর ঠোঁটের কোনায় কোনো নির্মল হাসির ঝিলিক দেখা দিয়েছিল কিনা। তবে পরক্ষণেই তাঁর কলমে ঝরে পড়েছিল খেদ, “মায়ের অমন সুন্দর টিকালো নাক, কে বলবে আমি তাঁর সন্তান।“    
যদিও, সুনীল নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে এই উপসংহারে এসে পৌঁছেছিলেন যে, মনুষ্য জন্ম আসলে এক আকস্মিকতার ফসল মাত্র। “পৃথিবীতে আসাটাই আকস্মিক। তবু সারাজীবন আমরা নানারকম যুক্তি দিয়ে এই জীবনটাকে সাজাবার চেষ্টা করি।"

সুনীলের ডুপ্লিকেট কপির গল্প পড়তে অবশ্যই দেখুনঃ 

পথে, হঠাৎ দেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে!

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...