সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ফিরিঙ্গী কালী ও অ্যান্টনি সাহেবের কথা!

এখনকার ঠিকানা - ২৪৪ নং বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট, বউবাজার, কোলকাতা। কিন্তু আজ থেকে ৫০০ বছর আগে, এই ঠিকানার কোনো তাৎপর্য ছিল না। কারণ কোলকাতা শহরেরই গোড়াপত্তন হয় ১৬৯০ সালে। তারও ২০০ বছর আগে কেমন ছিল এই স্থান, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়াটা এই নিবন্ধের পক্ষে খুব জরুরী। প্রকৃত পক্ষে, ভাগীরথী নদীর বিভিন্ন খাঁড়ি নদীতে বিভক্ত, জলা জঙ্গলে ভর্তি ছিল তখনকার এই কোলকাতা শহরের ভিত্তিভূমি। সেই সময় জনৈক ডোম, যিনি শ্রীমন্ত ডোম নামে তৎকালীন সময়ে পরিচিত ছিলেন স্থানীয় এলাকায়, পাতায় ছাওয়া এক কুটিরের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেন শিব ও শীতলার মূর্তি। নিচু জাতীর বলে, শ্রীমন্ত নিজেই ছিলেন তাঁর মন্দিরের পূজক। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে সেই পর্ণ মন্দিরই আজকের বিখ্যাত, ফিরিঙ্গী কালীর মন্দির। মধ্য কোলকাতার বউবাজার এলাকায় অবস্থিত এই মন্দিরের প্রধান মূর্তি এখন আর শিব বা শীতলার নয়, শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মাতা ঠাকুরানীর।


মন্দিরেরর পুরোহিতও এখন আর সেই ডোম পরিবারের কেউ নন। এখন মায়ের প্রধান সেবাইত, পোলবার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা যে প্রতিষ্ঠা সালের উল্লেখ রয়েছে সেই অনুযায়ী ৯০৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ইংরেজি ১৪৯৮ সালে এই মন্দিরের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। যদিও প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমন্ত ডোমের কোনো  উল্লেখ এখানে পাওয়া যায় না, তবে  Sir Harry Evan Cotton এর লেখা ‘Calcutta Old and New’  বইয়ে শ্রীমন্ত ডোমকেই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবী করা হয়েছে। 
প্রকৃত পক্ষে, ফিরিঙ্গী কালী মন্দিরের বর্তমান রূপান্তর এবং সেই রূপান্তরের যাত্রাপথ কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর। এর সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে এক পর্তুগীজ সাহেবের নাম। সাহেব, ফরাসডাঙ্গার (বর্তমানে চন্দননগর) বাসিন্দা হেন্সম্যান অ্যান্টনি।  মাত্র ৫০ বছরের তাঁর জীবৎকালে (১৭৮৬ -১৮৩৬) , এই অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী, সে সময়ে ইউরোপীয়দের ফিরিঙ্গী বলার চল সর্বজনবিদিত, তাঁর সমসাময়িক কালের যবন হরিদাসের মতই প্রমান করে ছেড়েছিলেন যে বিধর্মী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর হিন্দু ধর্মের প্রতি ভালোবাসা কতটা নিখাদ এবং আন্তরিক ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই ফিরিঙ্গী তখন বয়সে খুবই তরুন।  প্রায়ই আসতেন কোলকাতার বউবাজার এলাকায়, মামার বাড়িতে। বেড়াতে যেতেন মন্দিরেও। মন্দিরের তখন দাসী ছিলেন অল্প বয়সী বিধবা সৌদামিনী দেবী। সুন্দরী, প্রিয়দর্শিনী এই সৌদামিনীর প্রেমে না পড়ে থাকতে পারেননি, অ্যান্টনি। অনেকে আবার এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁদের মতে খ্রিষ্টান হওয়া সত্ত্বেও অ্যান্টনির মনে যে নিখাদ ভক্তির উদয় হয়েছিল মাটির তৈরি এই মাতৃ মূর্তির প্রতি তাকে কোনো ভাবে ছোট করা উচিৎ হবে না। অ্যান্টনি  ফিরিঙ্গী যদিও সৌদামিনীকে পরে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রথম প্রেম, মায়ের ওই দুই রাঙ্গা চরনের জন্যই নিবেদিত ছিল। ফিরিঙ্গী সাহেবের এই ভালোবাসা যে কতটা গভীর ছিল, যার জন্যে তিনি শুধু বাংলা ভাষাটাই শিখলেন না, রচনা করলেন অনেক কালোত্তীর্ণ শ্যামা সঙ্গীতও। রপ্ত করলেন বাংলার লোক- সংস্কৃতির অনন্য ধারা কবিগানকেও। সেই সময়ের বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রার কাছে নিলেন কবিগানের পাঠ। অনেকে অনেক কথা বললেও এই ফিরিঙ্গী সাহেব কিন্ত কবিয়াল হিসেবে চিরকালের জন্যে বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে রেখে গেছেন তাঁর অনপনেয় ছাপ। যার জন্যে বাংলায় দুটি সুপারহিট ছবির নির্মান হয়েছে এই ফিরিঙ্গীর জীবন কথা নিয়ে। ১৯৬৭ তে 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী' ও ২০১৪ তে 'জাতীস্মর'। ফিরিঙ্গীর চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে দুই যুগের দুই মহানায়ক, উত্তম কুমার ও প্রসেনজিৎ কে। 
যদিও মতভেদ আছে, অ্যান্টনিই প্রথম মা সিদ্ধেশ্বরীর মাটির তৈরি মূর্তি এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কি না। তবে ১৯৪৬ এর দাঙ্গায় মায়ের মূর্তি সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট হয়ে গেলে, পাথরের তৈরি মায়ের মূর্তি প্রতিস্থাপিত হয় মন্দিরের বেদীমূলে। যদিও মা সিদ্ধেশ্বরী ঠাকুরানীর মূর্তির পাশে, যিনি শায়িত শিব মূর্তির উপরে অধিষ্ঠিতা থাকেন এখানে, রয়েছে একটি করে শীতলা, মনসা ও অষ্ট ধাতুর তৈরি দুর্গা মূর্তি। 
আজও মায়ের মন্দিরে প্রতিদিন নানা ধর্ম, নানা জাতের অগণিত মানুষ আসেন তাদের ভক্তি অর্ঘের ডালি সাজিয়ে মনের বেদনা ঘোচাতে। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...

জনগণমনঃ জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু প্রশ্নের উত্তর!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ব্রহ্ম সঙ্গীত ‘ জনগণমন অধিনায়ক’ কে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সর্ব সম্মীলিত সিদ্ধান্ত হয় ১৯৫০ সালের ২৪ শে জানুয়ারি । কিন্তু কেন এত দেরী? দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কেন তিন বছর সময় লেগেছিল জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করতে? ‘ভারত বিধাতা’ শিরোনামে লেখা, স্বদেশ পর্যায় ভুক্ত (গীতবিতান অনুসারে) এই রবীন্দ্রগীতিটি কিভাবে -  দেশের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে গেল! ‘জনগনমন’র জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীই আজ আমরা ফিরে দেখবো এই প্রবন্ধে।  ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট - দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরে অবশেষে দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে এসে উপস্থিত হোল বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি। উদিত হোল স্বাধীনতার নতুন সূর্যের।   স্বাধীন হোল দেশ। কিন্তু সদ্য ব্রিটিশ অধীনতা মুক্ত দুটি দেশ ভারত এবং পাকিস্থান তখনও পায় নি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা। ১৯৪৭ এর ১৮ই জুলাই তারিখে লাগু হওয়া ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুসারে নিজ নিজ সংবিধান প্রণয়নের আগে পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্থান এই দুটি ভূখণ্ড কমনওয়েলথ দেশের অধীনস্থ দুটি অধিরাজ্য হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারা...