সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নররেন্দ্রনাথের সন্ন্যাস নেওয়ার গল্প!

 ১৮৬৩ সালের  ১২ জানুয়ারিতে (মকর সংক্রান্তির পুন্য তিথি) জন্ম নেওয়া নরেন্দ্রনাথ দত্ত তখন ২৪ বছরের তরতাজা যুবক।   কিন্তু তখনই তাঁর পরনে উঠেছে সন্ন্যাসীর গেরুয়া ধুতি ও ফতুয়া। এই গেরুয়া পোশাক স্বয়ং রামকৃষ্ণের মন্ত্রপূত।  সে এক গল্প।


নরেন্দ্রনাথেরই গুরু ভাই গোপাল ঘোষ, যিনি বয়সে নরেন্দ্রনাথের থেকে অনেক বড়, রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসেছিলেন তাঁর হঠাৎ স্ত্রী বিয়োগের পরে। সেই গোপাল ঘোষ সেবার মকর সংক্রান্তির কয়েকদিন আগে বাজার থেকে বারো খানা ধুতি কিনে এনেছিলেন এবং সেগুলিকে গেরু মাটি দিয়ে গেরুয়া রং করে গুছিয়ে রেখেছিলেন গঙ্গা সাগরে আসা সাধুদের দেবেন বলে। কিন্তু সাধু খুজতে গঙ্গা সাগরে কেন, যখন চোখের সামনেই এত গুলো ‘ত্যাগী সাধু’ ঘুরে বেড়াচ্ছে।  গুরু রামকৃষ্ণ যেন গোপালের জ্ঞান চক্ষু খুলে দিলেন।  আমার এই ছেলেদের মতো ত্যাগী সাধু আর কোথায় পাবি? এদের এক-এক জন হাজার সাধুর সমান
যেমন বলা তেমন কাজ। গোপাল ঘোষের গুছিয়ে রাখা বারো খানা গেরুয়া বস্ত্রকে মন্ত্রপূত করে দিলেন ঠাকুর। সঙ্গে গলায় ধারন করা রুদ্রাক্ষকেও করে দিলেন মন্ত্র শুদ্ধ। সেই যে গেরুয়া বস্ত্র পেলেন নরেন্দ্রনাথ, আমৃত্যু সেই গেরুয়া বস্ত্র থাকলো তাঁর সঙ্গে। তবে নরেন্দ্রনাথ ও তাঁর বাকি এগারো জন সতীর্থ  যাদের মধ্যে আঁটপুরের বাবুরাম ঘোষ থেকে শুরু করে নাট্যকার গিরীশ চন্দ্র ঘোষ পর্যন্ত কেউই তখন কাশীপুরের বাগানে ধ্যান জপ করার সময়টুকু ছাড়া অন্য সময় গেরুয়া পরতেন না। গিরীশ ঘোষ তো তাঁর গেরুয়া বস্ত্রটিকে, আলমারিতে তুলে রেখেছিলেন সযত্নে।
সর্বক্ষণের জন্যে গেরুয়া বস্ত্র পরে থাকতে হলে যে বিরজা হোমের মাধ্যমে নিজের পূর্বাশ্রমকে বিদায় জানাতে হবে চিরকালের জন্যে। তখনো যে সেই পর্ব আসেনি পার্ট টাইম সাধু নরেন্দ্রনাথের জীবনে।
 
ইতিমধ্যে ১৮৮৬ র ১৬ই আগস্ট তারিখে দেহ রেখেছেন ঠাকুর। ঠাকুরের মৃত্যুর পর, কাশীপুরের বাগান বাড়ি ছেড়ে নরেন্দ্রনাথ সহ তাঁর বাকি গুরুভাইরা তখন থাকছেন বরাহনগরের ভাড়া বাড়িতে। দশ টাকা ভাড়ায়। মাধুকরি করে কোনোরকমে উদরপূর্তি আর বাকি সময় জুড়ে চলে মগ্ন জপ, তপ আর গভীর শাস্ত্রচর্চা। কিন্তু বিধাতা নির্দিষ্ট সেই সময় যে এবার সমাগত প্রায়। তাই তো রামকৃষ্ণের তিরোধানের কয়েক মাসের মধ্যেই নরেনের মনের আকাশে উঁকি দিল সেই আকুতি, “এবার শাস্ত্র মতে সন্ন্যাস নিলে কেমন হয়?” গুরুভাইরাও যেন প্রস্তুতই ছিলেন মনে মনে। স্থির হল আনুষ্ঠানিক ভাবে সন্ন্যাস নেওয়ার দিন ক্ষণ। ডিসেম্বর মাসের ২৪ তারিখ, অর্থাৎ বড় দিনের আগের দিন। হুগলীর আঁটপুরে, সতীর্থ বাবুরাম ঘোষের বাড়িতে এই উদ্দেশ্যে জড় হলেন নরেন সহ বাকিরা। হোমের জন্য জোগাড় করে আনা হয়েছিল বারো খানা বেল গাছের ডালা। গাওয়া ঘি। সামনে রাখা হয়েছিল গুরু রামকৃষ্ণের পাদুকা জোড়া। কিন্তু মন্ত্র? বিরজা হোমের মন্ত্র, শেষ পর্যন্ত তারও ব্যবস্থা হল।  গুরুভাই কালীপ্রসাদ, কয়েকদিনের জন্যে গিয়েছিলেন গয়ায়। তখন ঠাকুর বেঁচে ছিলেন। গয়ার এক দশনামী সন্ন্যাসীর কাছ থেকে শোনা বিশেষ এই হোমের মন্ত্র, কালীপ্রসাদ টুকে নিয়েছিলেন তাঁর খাতায়। সেটাই এবার কাজে এল। কালীপ্রসাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো বিরজা হোমের পবিত্র মন্ত্র। বাকি সকলে সেই মন্ত্র পুনঃচ্চারিত করে লাভ করলেন নতুন জীবন, নতুন চলার পথ; পেলেন নতুন পরিচয়। কালীপ্রসাদ হলেন, স্বামী অভেদানন্দ।  বাবুরাম ঘোষ হলেন, স্বামী প্রেমানন্দ আর সিমুলিয়ার নরেন্দ্রনাথ দত্ত হলেন, স্বামী বিবিদিষানন্দ। স্বামী বিবিদিষানন্দ, সন্ন্যাস গ্রহনের পরে প্রথমবার ভারত পরিক্রমার সময় কখনো কখনো তাঁর নিজের পরিচয় দিয়েছেন স্বামী সচ্চিদানন্দ হিসেবে। কিন্তু ১৮৯৩ য়ে শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম মহা সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে পাকাপাকি ভাবে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন স্বামী বিবেকানন্দ নামে, যে নামে তিনি আগামী দিনে সমাদৃত হবেন সারা বিশ্ব জুড়ে। 

তথ্য সুত্রঃ গৌতম চক্রবর্তীর লেখা 'পরিব্রাজক', আনন্দবাজার পত্রিকা   

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...