সুভাষ বোস বাঙালি হয়েছেন ১৭ বছর বয়সে। নেতাজী হয়েছেন তারও অনেক পরে। সাধারণ জনমানসে, সুভাষের সঙ্গে ওড়িশার, বিশেষ করে ওড়িশার কটক শহরের সম্পর্ক, শুধুই সুভাষের জন্মস্থান হিসেবে। এ কথা ঠিক ১৮৯৭ সালের ২৩ শে জানুয়ারি, কটকের ওড়িয়া বাজার অঞ্চলে যে পেল্লাই দো-তলা বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন সুভাষের বাবা জানকীনাথ বোস, সেই বাড়িতেই মা প্রভাবতী দেবীর কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন ভারতের এই বীর, মহান সন্তান। কিন্তু প্রায়শই আমরা ভুলে যাই জন্মের পরে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে সুভাষকে একটু একটু করে নেতাজী করে গড়ে তোলার পেছনে কটকের জলহাওয়ার অবদান কতটা!
সুভাষ তাঁর আত্মজীবনী, ‘An Indian Pilgrim’ এ কটক সম্বন্ধে যা লিখেছেন তাতে বোঝা যায়, সুভাষ কতটা উচ্চ ধারনা পোষণ করতেন তাঁর এই জন্মস্থান তথা তাঁর কৈশোর এবং যৌবনের সোনালী দিনগুলি যেখানে কেটেছে সেই ‘City of Silver’, কটক শহর সম্পর্কে।
১৯৩৭ এর
শেষের দিকে, ইউরোপ সফর কালে সুভাষ লিখেছিলেন তাঁর এই আত্মজীবনী। আত্মজীবনীতে, সুভাষ তাঁর দীর্ঘ কটক যাপনের কথা যার মধ্যে তাঁর শৈশব
এবং স্কুলজীবন রয়েছে, তুলে ধরেছেন বেশ অকপট এবং গৌরবময় অনুভূতির রঙে।
সুভাষের কটক সম্বন্ধীয় ধারনার আঁচ পেতে আত্মজীবনীর বিশেষ এই অংশটি এখানে তুলে
দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রথমে ইংরেজি, পরে বঙ্গানুবাদে।
“Though at that time a
comparatively small town with a population of 20,000, Cuttack had an importance
of its own owing to a variety of factors. It had an unbroken tradition since
the days of the early Hindu kings of Kalinga. It was de facto capital of Orissa
which could boast of such a famous place of pilgrimage as Puri and glorious art
relics as those of Konarka, Bhubaneswar and Khandagiri-Udayagiri. It was the
headquarters not only for the British administration in Orissa, but also for
the numerous ruling chiefs in that province. Although Cuttack afforded a
healthy environment for the growing child, it had some of the virtues of both
city and country life.”
“এ কথা ঠিক, মাত্র ২০,০০০ লোক সংখ্যা বিশিষ্ট কটক শহর, আয়তনের বিচারে তেমন বড় কিছু
নয়। কিন্তু, গুরুত্বের দিক দিয়ে কোনোভাবেই একে খাটো করে দেখানো সম্ভব নয়।সেই কলিঙ্গ
রাজাদের আমল থেকেই এই শহরের ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাস সর্বজনবিদিত। শুরুর থেকেই ওড়িশা
রাজ্যের রাজধানী হওয়ার গৌরবে গৌরবান্বিত এই শহর, যার অনতিদূরে রয়েছে পুরী ধামের মত
জগতবন্দিত তীর্থ স্থান। এছাড়াও কোনারক, ভুবনেশ্বর কিংবা খণ্ডগিরি বা উদয়গিরির
স্থাপত্যকলা সমৃদ্ধ নিদর্শন গুলিও আদিকাল থেকে গড়ে উঠেছে এই শহরকে কেন্দ্র করেই। ব্রিটিশ
শাসনের আগেও দেশীয় নৃপতিরা কটক থেকেই তাদের রাজ্য পরিচালনা করেছেন। এই শহরের জীবন
চর্যায় গ্রাম এবং শহর দুই ধারারই জীবন ধারার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায়, খুব সহজে।
সর্বোপরি, এই শহরের স্নিদ্ধ আবহাওয়া, শিশুদের জন্যে খুবই স্বাস্থ্যকর এবং তাদের বেড়ে ওঠার পক্ষে আদর্শের।"
সুভাষের যখন পাঁচ বছর বয়স, অর্থাৎ সাল ১৯০২ য়ে ছোট্ট সুভাষ ভর্তি হন Protestant ইউরোপিয়ান স্কুলে। স্কুলটি ছিল কটকে, সুভাষের বাড়ির কাছেই। ছোট্ট সুভাষ দাদাদের হাত ধরে, হেঁটে হেঁটে পৌঁছতেন স্কুলে। এর পরে, ১৯০৯ সালে সুভাষ তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে, ভর্তি হন ঐতিহ্যময় রেভেনশা কলেজিয়েট স্কুলে। এবং সেখান থেকেই তিনি তাঁর মেট্রিকুলেশন কমপ্লিট করেন ১৯১২ সালে। নিঃসন্দেহে সুভাষের এই দীর্ঘ স্কুল জীবন, পরবর্তী কালে তাঁকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রধান শত্রু হিসেবে পরিণত করার পেছনে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। সুভাষ তাঁর আত্মজীবনীতে, কলেজিয়েট স্কুলের কথা উল্লেখও করেছেন সবিশেষে। সর্বোপরি কলেজিয়েট স্কুলের তখনকার হেড মাষ্টার বেনীমাধব দাসের কথা, সুভাষ তাঁর আত্মজীবনীতে স্মরণ করেছেন বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে। বেনীমাধব দাস যেমন সুভাষের মেধায় ছিলেন মুগ্ধ, সুভাষও তাঁর জীবনের আদর্শ এই হেড মাষ্টার মশাইয়ের প্রভাব স্বীকার করেছেন অক্লেশে।
"I secretly said to myself that if I wanted an ideal for my life it should be to emulate him’ সুভাষ লিখেছেন ‘An Indian Pilgrim’ এ।
সুভাষের বাবা, মা সহ পুরো পরিবার, তখনো কটকেই। তাই ওড়িয়া সুভাষের, বিভিন্ন ছুটির অবসরে কোলকাতার প্রবাস ছেড়ে বাড়ি ফেরা চলতো অবিরাম।
সুভাষ নিজেও বোধহয় তাঁর ওড়িয়া আইডেন্টিটিকে নিয়ে বেশ সপ্রতিভই ছিলেন। সবথেকে বড় কথা, সুভাষ নিজেকে কখনো বঙ্গ সন্তান বলে পরিচয় দেননি। সে যতই বাঙালীরা সুভাষকে বাংলার সন্তান বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুক না কেন, সুভাষ কিন্তু উৎকল সন্তান বলেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন সবসময়। “Being a son of Utkal, my heart is always there...”
এ কথা তো সত্যি, জীবনের সেরা সময়টা তিনি ওড়িশাতেই কাটিয়েছেন; সুভাষ সে কথা স্বীকারও করেছেন অকপটে। The best part of my life was spent in Odisha...”,
ওড়িয়া সুভাষ কি ওড়িয়া জানতেন? বলতে পারতেন ওড়িয়া? কারণ, তাঁর স্কুল জীবন কটকে কাটলেও, তিনি কিন্তু কোনো ওড়িয়া মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেননি। প্রথম থেকেই পড়েছেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। আর স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরলে, বাড়ির লোকেদের সঙ্গে যাবতীয় কথোপকথন চলতো বাংলাতেই।
তাই প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এই প্রশ্নের নিরসন করতে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা খুব দরকার এখানে। ১৯২০ তে সুভাষ, উৎকল বন্ধু পণ্ডিত গোপবন্ধু দাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওড়িয়া শ্রমিক-মজদুরদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষে এবং বিশেষ করে তাদের একত্রিত করার উদ্দেশ্যে একটা সভা ডাকেন কোলকাতা শহরে। সেখানে সুভাষ বক্তব্য রাখেন শুদ্ধ ওড়িয়ায়। সভাস্থল ফেটে পড়ে হাততালিতে এবং উপস্থিত শ্রমিকদের তুমুল হর্ষ ধ্বনিতে।
সুভাষ শেষ বারের মত কটকে এসেছিলেন ১৯৩৯ সালের ৫ই আগস্ট। রেভেনশা কলেজের সভায় বক্তব্যও রেখেছিলেন সেদিন।
তারপরে আর সুভাষের ‘ঘরে ফেরা’ হয়নি ঠিকই, কিন্তু কটক শহর, শহরে অবস্থিত হাই কোর্ট, হাই কোর্ট সংলগ্ন সেই ‘জানকিভবন’ যা এখন ওড়িশা সরকারের কল্যানে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে, রেভেনশা কলেজিয়েট স্কুল, মহানদী, মহানদীর পাড় এখনও যে সেই ওড়িয়া যুবক সুভাষের অপেক্ষায় প্রহর গোনে।
Netaji Subhas had an
undying love for Odisha, The Pioneer
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন