সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কোলকাতা বই মেলা হারিয়ে দিল লন্ডন বই মেলাকে!

কোলকাতা বই মেলা বিশ্ব সেরা কি না, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা কিংবা তথ্য-রেকর্ড ঘেঁটে আসল সত্যটাকে বার করার মত ধৈর্য বা সময় কোনোটাই গড়পড়তা বাঙালীর নেই। আত্মপ্রসাদে ভোগা বাঙালী সর্বদাই অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে, এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। তা সে স্বঘোষিত আস্ফালন, যতই অসার হোক কিংবা যুক্তি-তর্কে না টিকুক। মিথ্যে স্বপ্ন নিয়ে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দেওয়ার অভ্যাস বাঙালীর বহু পুরনো।

কিন্তু সত্যিকারের তথ্য কি অন্য কথা বলছে? তথ্যের কথা উঠলেই প্রথমে যার কথা মনে পড়ে সেই সব জান্তা গামছাওয়ালা উইকিপিডিয়ার কাছে শরনাপন্ন হতেই হয়। উইকিপিডিয়া অনুসারে, ৪৭ বছরে পড়া কোলকাতা আন্তর্জাতিক বই মেলা কিন্তু সত্যিই বিশ্ব সেরা। সে তার বহরের দিক থেকে হোক কিংবা মেলায়া আসা লোক সংখ্যার বিচারে। একটা তথ্য এই প্রসঙ্গে দিয়ে রাখা ভালো, প্রতি বছর কোলকাতা বই মেলায় নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে আসেন প্রচুর সংখ্যক মানুষ যার হিসেবটা প্রায় ২৫ লক্ষের মত। তা সত্ত্বেও কিন্তু একটা কাঁটা আছে, কাঁটাটা বই মেলায় হওয়া বইয়ের বাণিজ্যকে ঘিরে। কারণ বাণিজ্যের প্রশ্নে কোলকাতা বই মেলা কিন্তু তার বিশ্ব সেরা তকমা ধরে রাখতে পারছে না। বরাবরের লক্ষ্মীছাড়া বাঙালী কবেই বা বাণিজ্যে তার পসার জমাতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় কি করে। তাই পিছিয়ে যেতে হয়েছে তিন নম্বর স্থানে। প্রথমে জার্মানের ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলা এবং তার পরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে লন্ডন বই মেলা। বোঝাই যাচ্ছে, কোলকাতার আগে যে দুটি বই মেলা রয়েছে তারা প্রত্যেকেই ইউরোপীয় দেশের।  তাই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মহাদেশ এশিয়া মহাদেশের মধ্যে কোলকাতার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার মত আর কেউ যে নেই, সে কথা বলাই বাহুল্য।
তবে এবারের বই মেলায়, (৪৭ তম, ১৮ই জানুয়ারি থেকে ৩১ শে জানুয়ারি) যে ঘোষণাটি স্বয়ং ব্রিটিশ হাই কমিশনার অ্যালেক্স এলিস রেখেছেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সন্ধ্যাতে, তাতে কিন্তু কোলকাতা আন্তর্জাতিক বই মেলার আয়োজক সংস্থা (কোলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলারস Guild)  থেকে শুরু করে এর পৃষ্ঠপোষক, শুভান্যুধ্যায়ী, অনুরাগী তথা লক্ষ কোটি বই মেলা দেখতে আসা ধুলো মাখা পাবলিক যারপরনাই খুশি হবেন; এর পরেও যদি নিতান্তই কেউ গুরুত্ব নাও দিতে চায়, নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়ে নিতে কোনো অসুবিধা থাকবে না।  প্রসঙ্গত এবারের বই মেলার থিম দেশ হিসেবে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্স এলিস বই মেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন বিশেষ সম্মানীয় অতিথি হিসেবে। সেখানেই তিনি নিজের দেশের পিছিয়ে পড়ার খবর ঘোষণা করে কোলকাতা বই মেলাকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বই মেলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নিঃসন্দেহে এই ঘোষণার পর, উইকিপিডিয়ার তথ্য রিভিউ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সেই ১৯৭৬, অর্থাৎ আমার জন্মের ঠিক দুই বছরের মাথায় কোলকাতা বই মেলার শুভারম্ভ হয়। তখন শুধুই কোলকাতা বই মেলা। আন্তর্জাতিক তকমা জোটে অনেক পরে, ১৯৮৩ তে। ৮৩ তে জেনেভায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক প্রকাশক সমূহ (IPA) কোলকাতা বই মেলাকে আন্তর্জাতিক বই মেলার মর্যাদা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। ১৯৭৬ থেকে ২০২৪, ৪৮ বছরের ইতিহাসে কোলকাতা বই মেলা পেরিয়েছে অনেক চড়াই উৎরাই। তার প্রতিটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বলতে গেলে লাগবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বৃহত্তর নিবন্ধের পরিসর।


তবে এ ক্ষেত্রে যেটুকু না বললেই নয়, সেটা হোল বইমেলার বারবার স্থান পরিবর্তনের কথা। প্রথমে শুরু হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের বিপরীতে, ফাঁকা জায়গায়। এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য আপনারা যেটা শুনে খুব আনন্দিত হবেন সেটা হোল, কোলকাতা বইমেলা শুরু হয়েছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারির দিন অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইন ডে’র দিন। প্রথম স্থান পরিবর্তন হয় ১৯৮৮ তে; সেই বছর বই মেলা বসে ময়দানে। ২০০৭ পর্যন্ত বই প্রেমীদের গন্তব্য ছিল ময়দানই। ২০০৮ এ বই মেলা উঠে যায় সল্টলেক স্টেডিয়ামে। কিন্তু তার আয়োজন করে ভিন্ন একটি সংস্থা। ২০০৯ এ ৩৩ তম বইমেলা আয়োজিত হয় পুরনো আয়োজক সংস্থা Guild এর দ্বারাই, তবে বইমেলা পায় নতুন গন্তব্য -  সাইন্স সিটির বিপরীতে থাকা মিলন মেলা ময়দানে হয় সেবারের মেলা। সেখানেই চলতে থাকে বইমেলা, ২০১৮ পর্যন্ত। ২০১৯ এ এসে বইমেলার আবার স্থান বদলে যায়। এবারে বইমেলা চলে আসে সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে। তারপর থেকে এখানেই। এবছরও সেন্ট্রাল পার্কেই আয়োজিত হয়েছে বইমেলা।
ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন ছাড়াও বই মেলার ইতিহাসে রয়েছে ১৯৯৭য়ে ঘটা ভয়াবহ অগ্নি কাণ্ডের মত ঘটনা। ভয়ংকর আগুনে সেবার ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছিল ১০ হাজারেরও বেশী বই। প্রাননাশ হয়েছিল একজন মানুষের। পরের বছর আবার শহর ভাসানো বৃষ্টির প্রকোপে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্রচুর বই। কিন্তু কয়েনের উলটো পিঠটাও কিন্তু বেশ চিত্তাকর্ষক। কারণ ১৯৯৭ সালেই শুরু হয় বইমেলার থিম হিসেবে রাজ্যের বদলে, দেশকে বেছে নেওয়ার প্রচলন। প্রথম থিম দেশ ছিল ফ্রান্স।
এইবছরের থিম দেশ ইংল্যান্ড এই নিয়ে চতুর্থ বার কোলকাতা বইমেলার থিম দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করলো। কোলকাতা বইমেলায় তাই এবছর নির্মিত হয়েছে বিশেষ ইউ কে প্যাভিলিয়নের। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে ব্রিটিশ শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিশেষ অবদানের কথা।
কিন্তু আমাদের এই নিবন্ধের ফোকাস যে বিষয়টার উপর মূলত দাঁড়িয়ে ছিল সেটা হোল ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত 
অ্যালেক্স এলিসের একটি বিশেষ ঘোষণা, যার উপরে ভিত্তি করে আমরা বলতেই পারি  বিশ্ব সেরা হওয়ার দৌড়ে কোলকাতা বইমেলার সামনে এখন শুধু ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলাই রইল দাঁড়িয়ে। 
প্রসঙ্গত অ্যালেক্স এলিস বই মেলার উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে এসে বই মেলার উদ্বোধক তথা পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কবিতাও পড়ে শুনিয়েছেন। 



তথ্য সুত্রঃ   Kolkata Book Fair: A look at over 4-decade history of Boi Mela, The Statesman   

  ছবিগুলি সবকটিই প্রিয় সম্পাদক-গল্পকার সুদর্শন খাটুয়া সম্পাদিত 'দীঘল পত্র' পত্রিকা এবং প্রকাশনের পক্ষ থেকে দেওয়া এবারের কোলকাতা আন্তর্জাতিক বই মেলার ১৮ নং স্টলে তোলা বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন সাহিত্য গুনীজনের।  (ছবিগুলির জন্য সমস্ত কৃতিত্ব শ্রদ্ধেয় সুদর্শন দার) 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...