এই বাড়ি থেকেই শুরু হয় দুর্গা পূজার প্রচলন। এই বাড়িরই দুর্গা মণ্ডপে সর্বপ্রথম শুরু হয় জগদ্ধাত্রী দেবীর আরাধনা। অষ্টাদশ শতাব্দীর দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে এখানকার ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজসভাতেই কবি রায় গুনাকর ভারতচন্দ্র (১৭১২-১৭৬০) অলংকৃত করে ছিলেন রাজ কবির পদ। উল্লেখযোগ্য ভাবে এই রাজসভায় রাজ কবি থাকা কালীনই ভারতচন্দ্র রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অন্নদামঙ্গল’। আর যার কথা না বললে বাংলা কৌতুক সাহিত্য প্রায় অনাথ হয়ে পড়ার উপক্রম হয় সেই গোপাল ভাঁড়েরও প্রাণ ফাটা হাস্য রসলীলা নির্মাণের সুউর্বর ক্ষেত্র ছিল এই রাজবাড়িরই রাজদরবার। যদিও গোপাল ভাঁড়ের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে দ্বিমত আছে কিন্তু সে কথায় পরে আসছি।
গোপাল ভাঁড়ের নাম উঠতেই পাঠকের মনের পর্দায় নিশ্চিত ভাবে যে ছবিটি সর্বপ্রথম ভেসে ওঠে সেটি আর কারুর নয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এবং সেই আমোদ প্রিয় এবং সংস্কৃতিতে রুচি রাখা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্য পরিচালনার ভরকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সেই বিখ্যাত রাজসভার। সৌজন্যে অবশ্যই গোপাল ভাঁড়ের কৌতুক রসের হাজারো কাহিনী সম্বলিত ছোট ছোট চটি বই যার অমোঘ টান সম্ভবত উপেক্ষা করতে পারেনা আপামর কোনো বাঙালীই। তবে গোপাল ভাঁড় বা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের যে ছবি বাঙালী মানসে দীর্ঘ দিন ধরে আঁকা হয়েছিল শুধুমাত্র ছাপা অক্ষরের দৌলতে অধুনা দূরদর্শনের পর্দায় তাঁদের কার্টুন অবয়বের কল্যানে তা আর কষ্টকল্পিত নয় মোটেই। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো গোপাল ভাঁড়ের অস্তিত্ব কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত নয়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় গোপাল ভাঁড় নামের কোনো ব্যক্তি আদৌ ছিলেন কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট মতভেদ আছে। যদিও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ঘূর্ণিতে গোপাল ভাঁড়ের জন্ম হয়েছিল বলে কথিত আছে। কিন্তু আদতে সেরকম কোনো বাড়ির হদিস কিন্তু পাওয়া যায় না, মাটির পুতুল তৈরির জন্য জগত বিখ্যাত স্থান এই ঘূর্ণিতে।
তবে ঘূর্ণি বাসস্টপে একটা গোপাল ভাঁড়ের আবক্ষ মূর্তি ও তার তলায় একটি ভগ্ন প্রস্তর ফলক দেখতে পাওয়া যায় বটে যাতে ঘূর্ণিকেই বাংলা কৌতুক রসের কিংবদন্তী স্রষ্টা গোপাল ভাঁড়ের জন্মস্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি ঘূর্ণি তে গিয়ে গোপাল ভাঁড়ের বাড়ি খুঁজতে গিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরেছি এদিক ওদিক। শেষে প্রখ্যাত মৃৎ শিল্পী সুবীর পালের স্টুডিওতে পৌঁছে রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হই। সুবীর পালের মতে গোপাল ভাঁড় আসলে একটি কাল্পনিক চরিত্র। প্রসঙ্গত সুবীর বাবু ঘূর্ণিরই বাসিন্দা এবং তার স্টুডিওটিও ঘূর্ণি তেই অবস্থিত। সুবীর বাবু তাঁর যুক্তির স্বপক্ষে যে কথা বললেন তার নির্যাস কিন্তু গোপাল ভাঁড় কে যারা সত্যি সত্যিই একদা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার বিদূষক ছিলেন বলে ভাবতে ভালবাসেন তাদের খুব একটা ভালো লাগবে না। তার কারণ সুবীর বাবুর মতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মধ্যেই গোপালের থাকার কোনো প্রমান বা চিহ্ন পাওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে আচার্য সুকুমার সেনের মন্তব্যও একই। সুকুমার সেনের মতে, গোপাল ভাঁড়ের কোনো বাস্তবিক অস্তিত্ব ছিল না। “গোপাল ভাঁড় একটি কাল্পনিক চরিত্র।"
বর্তমান যে রাজবাড়ি আমরা দেখি কৃষ্ণনগরে তার পত্তন হয়েছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের
আমলেই। ১৭১০ সালে জন্ম হওয়া কৃষ্ণচন্দ্রের
রাজ্যাভিষেক হয় ১৭২৮ সালে। বাবা রঘুরাম রায়ের অকাল মৃত্যুতে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই
রাজা হন কৃষ্ণচন্দ্র। আমৃত্যু, ১৭৮৩ সাল অবধি তিনিই ছিলেন নদীয়া- নবদ্বীপ অঞ্চলের মহারাজা। পরে
রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনপদের নাম অবশ্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামেই রাখা হয়
কৃষ্ণনগর।
কৃষ্ণচন্দ্রের সুদীর্ঘ পাঁচ দশক ব্যাপী রাজত্বকালের মধ্যে বাংলা তথা ভারতবর্ষের
ইতিহাসে ঘটে যায় অনেক ঐতিহাসিক দিকচিহ্ন রচনাকারী ঘটনা। যে জলঙ্গি নদীর তীরে
বর্তমানের কৃষ্ণনগর শহরটি অবস্থিত, সেই জলঙ্গি দিয়ে বয়ে যায় অনেক জল। কারণ ১৭৫৭ র
২৩ শে জুন পলাশীর প্রান্তরে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় সে সময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার
সিংহাসনেই আসীন ছিলেন স্বমর্যাদায়। ওই যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজৌদ্দলার পরাজয় বরন করার মাধ্যমে ভারতের
স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার কথা ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত। পলাশীর যুদ্ধে কিন্তু
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, নবাবের পক্ষ নেন নি। লর্ড
ক্লাইভের বিশেষ স্নেহধন্য হিসেবে পরিচিত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেই যুদ্ধে ছিলেন নবাবের
সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা নবাবেরই প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের সঙ্গে। বিনিময়ে ইংরেজদের কাছ থেকে, কৃষ্ণচন্দ্র পান মহারাজা
উপাধি।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে নবাবের বিরোধ এবং কৃষ্ণচন্দ্রের তথাকথিত হিন্দু আইকন হয়ে ওঠা নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ পড়ুন পরের পর্বে।
নবাব - কৃষ্ণচন্দ্র বিরোধ ও কৃষ্ণচন্দ্রের হিন্দু পোস্টার বয় হয়ে ওঠা নিয়ে বিতর্ক!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন