এই কবি কথাটা কিন্তু বেশ গোলমেলে। অনেকটা গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লের মতো। প্রকৃত কবির অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। সে আপনি তাকে কবি বলে মানুন আর নাই মানুন।
এই প্রসঙ্গে বলি কবির থেকেও বড় গোলমেলে কবির কবি কবি ভাব। তবে প্রকৃত কবির কাছে সে ভাব তার একান্তই স্বভাবগত, কষ্ট করে বয়ে বেড়াবার বিষয় নয়। বাকিদেরকে তা ই আবার হায়ার করতে হয়। মুখোশের মতন। একজনের কাছে কবি হওয়া আর একজনের কাছে কবি সাজা।
কিন্তু কাকে বলবো প্রকৃত কবি?
ছোটবেলায় আমি এক বুড়ো রিক্সাওয়ালা কে দেখেছি যিনি কথায় কথায় ছড়া বানিয়ে ফেলতে পারতেন। একবার আমরা দুই ভাই এবং আমার এক পিসি তিনজনে যাচ্ছিলাম সার্কাস দেখতে। ওই দাদুর রিক্সায় চেপে। যথারীতি রাস্তায় রিক্সার প্যাডেলে চাপ দিতে দিতেই আপনমনে তিনি ছড়া কেটে উঠলেন - আমার গাড়ি এক্সপ্রেস/ দেখতে যাবে সার্কেস। সেই রিক্সা চালক - মোশলেম আলি ছিলেন আমার দেখা প্রথম কবি। রবীন্দ্রনাথের মতন পাকা চুল আর ঝোলা দাঁড়িতে সেই রিক্সা চালক কারো কাছে ছিলেন কবি দাদা, কারো কাছে কবি কাকা আবার আমাদের মতন ছোটোদের কাছে তিনি ছিলেন কবি দাদু।
সাধারণ ব্যাখ্যায় যিনি কবিতা লেখেন তিনিই কবি। সে অর্থে সকল মৌলিক কবিতারই তো একজন করে লেখক থাকেন। কিন্তু তাই বলে কি সব লেখককে কবি বলা যাবে?
এই পরিপ্রেক্ষিতে ছোটবেলায় পড়া ভৌত রসায়নের একটা অনুসিদ্ধান্তের কথা ভীষণ মনে পড়ছে আমার। সেটা হলো - সব ক্ষারক ক্ষার হলেও সব ক্ষার কিন্তু ক্ষারক হয় না। একই ভাবে সকল কবিতা লেখকই যে কবি হয়ে যান না সেটা বোঝাতে কবি ও কবিতা লেখককে যথাক্রমে ক্ষার ও ক্ষারকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অর্থাৎ সব কবি লেখক হলেও সব কবিতা লেখক কবি হন না। কিন্তু কেন?
কবিতা লিখলেই যে তিনি কবি হয়ে যাবেন এমনটা মানতে চাননি কবি জীবনানন্দ দাশও। জীবনানন্দ তাঁর প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত প্রবন্ধ - কবিতার কথা' য় তার এমন ভাবার কারণ সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রবন্ধটিতে জীবনানন্দের করা সেই মহাকাব্যিক উক্তি - সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি, বোধহয় প্রকৃত কবির সংজ্ঞা নিরূপণে একটি অবশ্য উল্লেখ্য উদ্ধৃতি হয়ে আছে।
কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকার ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখী সংখ্যায় প্রকাশিত ওই প্রবন্ধের শুরুতেই জীবনানন্দ বলেছেন সে কথা।
"সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি ; কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য বিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না ; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয় ; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।"
জীবনানন্দের এই লেখায় যে বিশেষ লাইনটিকে ঘুরে ফিরে বারবার উল্লেখিত হতে দেখা যাচ্ছে সেটা হলো 'যাদের হৃদয়ে কল্পনার ও কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে' - কবি জীবনানন্দের মতে তাদেরকেই কবি বলা যেতে পারে। কিন্ত এখানেই শেষ নয়। এর পরেও তাঁর কিছু শর্ত এবং প্রতি শর্ত আছে। জীবনানন্দের মতে সত্যি কারের কবি হয়ে ওঠার জন্য শুধু হৃদয়ে কল্পনা থাকাটাই যথেষ্ট নয়। থাকতে হবে 'বিগত শতাব্দীর সম্যক কাব্য জ্ঞান এবং তৎসহ আধুনিক জগতের নব নব কাব্য বিকিরণের' হিরন্ময় স্পর্শ। যার সাহায্যে একজন লেখক প্রকৃত অর্থে একজন কবি হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু শর্ত এখানেও। অতীত ও বর্তমানের কাব্য ধারনা তখনই সাহায্য করবে যখন সে লেখকের হৃদয়ে কল্পনা থাকবে।
কবি জয় গোস্বামী তাঁর একটা লেখায় লিখেছিলেন, কবির কল্পনার আকাশে কবিতার উদয় বিদ্যুতের ঝলকের মতো আচম্বিতে হয়। তার অর্থ জীবনানন্দ যে দুটি আবশ্যকিতার কথা বলেছিলেন, কবি জয় গোস্বামী তার সঙ্গে আরও একটি আবশ্যকিতার কথা যোগ করে দিলেন। যেটার পূরণে কবিকে একান্ত ভাবেই ঐশ্বরিক কৃপার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। ঈশ্বর ও হয়তো কবির অপেক্ষাতেই থাকেন তার অনুপম রচনার ভার কবির কল্পনার কাঁধে সঁপে দেওয়ার জন্য। সেই কারণেই বুঝি কবিকে ঈশ্বরের দূত বলা হয়!
সবশেষে তাই বলাই যায় কবির কল্পনার দীগন্তে যে আশ্চর্য ফ্লাশ কবিকে বাধ্য করায় কবি হয়ে উঠতে তা আসলে তার চেতন- অবচেতনের মায়ায় বেড়ে ওঠা সর্বশক্তিমান অনুভূতি। অনুভূতিই আসল কবি। আসলে তা নিরাকার, নির্গুণ এবং বিমূর্ত।
প্রচ্ছদে লেখা চারটে লাইন সেই কথাই বলে।
চার লাইনের এই ছত্র টি আমার অনেক আগের লেখা একটি কবিতা থেকে নেওয়া।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন