ছোটোবেলা থেকে এই ফুলটিকে ভেটকানি ফুল বলে জানি। পরে জেনেছি কবি জীবনানন্দের ঘেঁটু ফুল আর 'আরন্যক' বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাট ফুল আসলে আমার জানা ভেটকানিরই ভিন্ন দুটি নাম। কয়েকমাস আগে এই সময়ের এক অন্যতম কৃতি সাহিত্যিক মনিশঙ্কর মণির একটি মন্তব্যের সৌজন্যে ফুলটির ফোটার সময় নিয়েও আর কোনো অস্পষ্টতা থাকে না আমার মনের মধ্যে।
গত ২৯ শে অক্টোবর, ২০২৩ এ আমারই এক ফেসবুক পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য জানাতে গিয়ে মনিশঙ্কর বাবু বলেছিলেন - ঘেঁটু ফুল বসন্তের শুরুতে ফোটে, এবং গুচ্ছে ফোটে। তিনি ঘেঁটু ফুলের একটি ছবিও পোস্ট করেছিলেন।
প্রসঙ্গত বলি, আমি আমার সেদিনকার পোস্টে - যার শিরোনাম ছিল 'সকালে বিকেলের ফুল' একটি নাম না জানা ফুলের ছবি পোস্ট করেছিলাম।
ফুলটি গোটা শীতকাল জুড়েই রাস্তার ধারে অথবা খোলা মাঠে এমনিই অযত্নে ফুটে থাকে এদিক ওদিক। ফুলটির রং হলুদ, সোনার মতো, যেন সোনালী মালাই খাঁচি- ঝুপো গুল্মজাতীয় গাছের ডগায় ডগায় আকাশের পানে উল্লম্ব ভাবে উত্থিত অবস্থায় ফুটে থাকে পাহাড়ী পাইন গাছের মতো। অনেক ভেবে আমি এই নাম না জানা ফুলটির নামকরণ করেছিলাম - কনকাঞ্চন।
শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক গৌতম দাস অবশ্য ফুলটির একটি নাম বলেছিলেন। সম্ভবত - দার্দমর্দন
কিন্তু গোল বাঁধে বিশিষ্ট কবি প্রলয় বসুর উক্ত ফুলটিকে ঘেঁটু ফুল বলে মন্তব্য করার পরে। কবির ভুল ভাঙাতে মনিশঙ্কর বাবুকে সেদিন পুনরায় নামতে হয় আসরে। এবং প্রলয় বাবুকে আশ্বস্ত করতে জোরের সঙ্গে বলতে হয়- ঘেঁটু ফুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সেই ছেলেবেলা থেকে।
ঘেঁটু শব্দটা কানে আসলে ঘেঁটু ফুল ছাড়াও আরো কতকগুলি শব্দ-বন্ধ উঁকি মারে মনের পর্দায়। যেমন - ঘেঁটু পূজা, ঘেঁটু গান ইত্যাদি। গ্রাম বাংলায় চৈত্র সংক্রান্তির দিন ভোরে এই ঘেঁটু পূজার আয়োজন হয়। কুলোয় রাখা ঘেঁটু মঞ্জরী নিয়ে নদী বা পুকুর ঘাটে দলে দলে ভিড় জমান বাড়ির বয়স্ক মহিলারা। তাদের পিছে পিছে ঘেঁটু গান গাইতে গাইতে পৌছোয় বাড়ির বাচ্চারা।
লোক-সংস্কৃতিতে যে কোনো পূজার পেছনেই থাকে অবশ্যম্ভাবী ভাবে কোনো দেবতার হাত। ঘেঁটু পূজার পেছনেও রয়েছে সেরকম একজন দেবতা। যার নাম ঘেঁটু। আসল নাম অবশ্য ঘন্টকর্ণ। গ্রাম্য, দেহাতি মানুষের উচ্চারণে ঘন্টকর্ণ ক্রমে ক্রমে ঘেঁটু তে রূপান্তরিত হয়েছে।
দেব দেবতার কথা যখন উঠলো তখন একটু পুরান না ঘাঁটলে আবার আলোচনা পূর্ণাঙ্গ হয় না।
পুরানে দেখা যাচ্ছে, শ্রীমান ঘন্টকর্ণ আসলে দেবাদিদেব মহাদেবের অন্যতম একজন অনুচর।
তিনি আবার বসন্ত, হাম ইত্যাদি রোগের দেবী, শীতলার পতিদেবও বটে। স্বভাবতই শীতলা দেবীকে শান্ত রাখতেই এই ঘেঁটু পুজার আয়োজন করা হয়।
সিক্ত ঘেঁটু মঞ্জরী নাড়িয়ে ভক্তের মাথায় জল ছড়িয়ে দেওয়ার রীতি, ঘেঁটু পূজার একটি অন্যতম উপাচার।
বৈজ্ঞানিক ভাবেও এই ঘেঁটু ফুল ও পাতার মধ্যে নানা উপকারী ভেষজ উপাদান বিশেষ করে বিভিন্ন চর্ম রোগ উপশমকারী উপাদান থাকার কথা সংশয়াতীত ভাবে প্রমানিত।
তাহলে ব্যাপারটা দাড়ালো এইরকম ঘেঁটু গাছের উপকারীতা রয়েছে, সে তার দৈবিক সত্তা থাকুক বা না থাকুক।
আর সৌন্দর্য নিয়ে বলতে বসলে এর রূপের মুগ্ধতা জাস্ট সীমাহীন, অসীম। আমার কাছে তো মনে হয় ফুলে ভরা কোনো সুন্দরী রমণীর খোঁপা।
কি অপূর্ব ফুলের সজ্জা, তার উপরে সাদা, দীর্ঘসূত্রী কেশর গুলো যেন বাতাসের দোলায় এলো চুলের মতোই প্রেমিকের মনের সৈকতে আবেগের জোয়ার বয়ে আনে।
পরিশেষে বলবো, বসন্তের সকল মুখরতাই কেন্দ্রীভূত থাকে কেবল পলাশ আর শিমূল কে ঘিরে। সুন্দরী ঘেঁটু সেই বাসন্তী সমাদরে যেন ব্রাত্য হয়ে পড়ে থাকে অবহেলায়, পথে ঘাটে কিংবা নদীর পাড়ে। ।
ঘেঁটু ফুলকে কিন্তু ইংরেজরাও এতো ব্রাত্য করে রাখেনি। ইংরেজি তে তাই একে গ্লোরী ফ্লাওয়ার বলা হয়েছে। সত্যিই এর গ্লোরী শুধু এর অপরূপ রূপে নয়, এর সুবাসেও কম গ্লোরী নেই কিন্তু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন