তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা উপন্যাস, ছোট গল্প সবেতেই ভীষণ ভাবে ছড়িয়ে থাকে রাঢ় বাংলার প্রান্তিক ও অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মানুষের কথা। দুলে, বাগদী, সাঁওতাল, কাহার, বাউরি, বোষ্টম প্রভৃতি পিছিয়ে পড়া মানুষের সুখ দুঃখ, প্রেম, লড়াই, আপোষ, অভিমান, ক্ষোভ, আবেগ ইত্যাদি কিভাবে বদলে ফেলে সমাজ জীবনের প্রবহমান সুরকে তারই দরদী ও সংবেদনশীল অনুসন্ধান কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে দেখা যায় তারাশঙ্করের অধিকাংশ কালজয়ী কাহিনীর ঘটনাপ্রবাহ কে। যার উজ্জ্বল নজির ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’, ‘কালিন্দী’, ‘মন্বন্তর’ ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’, ‘গনদেবতা’ বা ‘রাধা’ র মতো অমর উপন্যাস।
রাঢ় বাংলার প্রান্তিক জনপদ - বীরভুমের লাভপুর। যেখানে তারাশঙ্করের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। লাভপুরের জল হাওয়ায় সম্পৃক্ত তারাশঙ্করের উপন্যাসে তাই পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবন যাত্রার ছবি কখনোই কষ্ট কল্পিত বা আমদানি কৃত মনে হয় না। উপন্যাসের চরিত্রদের মুখের ভাষা খোয়াইয়ের লাল মাটির মতোই অকৃত্রিম এবং সহজাত লাগে। তারাশঙ্করের রচনার বৈভবও সম্ভবত এই প্রান্তিক মানুষদের জটিলতা হীন জীবন যাপনের সহজিয়া ভাবের মধ্যেই নিহিত থাকে। তাদের মুখের ভাষার মধ্যেই অন্তর্নিহিত থাকে তারাশঙ্করের লেখার আসল ঐশ্বর্য। সমসাময়িক কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকেরা যখন জটিল শহর জীবনের ছবি আঁকতে ব্যস্ত, তারাশঙ্কর তখন কোলকাতা নিবাসী হয়েও শহর জীবনের পরিবর্তে তাঁর আত্মার খুব কাছের সেই গ্রাম-জীবনের অপার বৈচিত্র্যের মধ্যেই খুঁজে নেন তাঁর লেখার রসদ। কারণ তারাশঙ্কর ভালো করেই জানতেন তাঁর লেখনী শক্তির আসল প্রাণ স্পন্দন লুকিয়ে ছিল রাঢ় বাংলার আঞ্চলিক সমাজ এবং তাঁর মৌখিক ভাষার মধ্যেই। কিন্তু তারাশঙ্করের তথাকথিত এই শক্তিই কি তাঁকে পিছিয়ে দিয়েছিলো নোবেল পুরস্কার জয়ের দৌড়ে?
এই প্রশ্ন উঠেছে সম্প্রতি সুইডেনের নোবেল কমিটির দ্বারা একটি তালিকা প্রকাশ্যে আসার পর । সুইডিশ নোবেল কমিটি তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (www.nobelprize.org) সম্প্রতি ১৯৭১ সালের নোবেল পুরস্কার নমিনিদের নাম প্রকাশ করেছে। নোবেল কমিটির সংবিধান অনুসারে পঞ্চাশ বছরের আগে কোনো নমিনির নাম প্রকাশ্যে আনা যায় না। সম্প্রতি সেই নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ১৯৭১ এর নোবেল পুরস্কার নমিনিদের যে তালিকা বের করেছে নোবেল কমিটি তাতে দেখা যাচ্ছে সাহিত্য বিভাগে অন্যতম নমিনি হিসেবে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়য়ের নাম। যা জানার পরে ভারতবর্ষ তথা বাংলার সাহিত্য সমাজে ছড়িয়েছে চরম চাঞ্চল্য। চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে তারাশঙ্করের নোবেল না পাওয়ার মুখ্য কারণ নিয়ে। তবে মুখ্য কারণ নিয়ে কথা বলার আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন সেই ব্যক্তির নাম যিনি তারাশঙ্করের নাম নোবেল কমিটির কাছে মনোনীত করে পাঠিয়েছিলেন। সুইডিশ নোবেল কমিটির সংবিধান অনুসারে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পাঠাতে পারেন মুলত সুইডিশ কমিটির কোনো সম্মানীয় সদস্য বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগের অধ্যাপক বা পূর্বের কোনো নোবেলে প্রাপকও পাঠাতে পারেন সুপারিশ। এদের ছাড়া কোনো দেশের লেখক সংগঠন যারা সংশ্লিষ্ট দেশের সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য এরকম সংগঠনের প্রধানও পারেন নমিনেশন পাঠাতে। ১৯৭১ এ তারাশাঙ্করের নাম মনোনীত করেছিলেন তখনকার সাহিত্য একাডেমীর মহাসচিব, বিশিষ্ট লেখক কৃষ্ণ কৃপালিনী। কৃষ্ণ কৃপালিনী সম্ববত নমিনেশন দিতে পারেন এমন চারটে শ্রেণীর মধ্যে চতুর্থ তথা শেষ শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলেন। যেমন ১৯১৩ তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম নোবেল কমিটির কাছে সুপারিশ করেছিলেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ কবি এবং লেখক টমাস মুরে। সুইডিশ একাডেমী প্রকাশিত তালিকা অনুসারে সেবারে সাহিত্য বিভাগে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সহ আরও ৯১ জন মনোনীতের নাম পৌঁছেছিল নোবেল কমিটির কাছে। তাদের মধ্যে জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসের নাম করতে হয়, সর্বাগ্রে। কারণ গুন্টার গ্রাসের কোলকাতা সংযোগের কথা বাঙালীর কাছে একটা অন্যরকম ভাবাবেগ নিয়ে আসে। গুন্টার গ্রাস ছাড়াও অন্য মনোনীত লেখকদের মধ্য্যে গ্রাহাম গ্রিন, আরথার মিলার, ভ্লাদিমির নবোকভ এবং এজরা পাউণ্ড উল্লেখযোগ্য। যদিও সেবার নোবেল পুরস্কারের শিরোপা জুটেছিল চিলি লেখক তথা বামপন্থী রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদার ভাগ্যে।
এবারে দেখা যাক তারাশঙ্করের সেবার নোবেল পুরষ্কার না পাওয়ার নেপথ্যে ঠিক কি কারণ ছিল। যে অবিসংবাদিত কৃতি ঔপন্যাসিকের ঝুলিতে রয়েছে একাধিক রাষ্ট্রীয় সম্মানের ভূষণ, তাঁর নোবেল অপ্রাপ্তির পেছনে ঠিক কোন কারনকে দায়ী করা হয়। তারাশঙ্করের পাওয়া পুরস্কারের ভাণ্ডারের দিকে এক ঝলক তাকালে দেখা যাবে সেখানে বিবিধ মণি মাণিক্যের ছড়াছড়ি। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তারাশঙ্কর পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার তাঁর ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের জন্য । পরের বছর, ১৯৫৬ তে একই উপন্যাসের জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরষ্কার পেয়েছেন।। ১৯৬৬ তে ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের জন্যে পেয়েছেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। প্রসঙ্গত বাঙালী হিসেবে তিনিই ছিলেন প্রথম জ্ঞানপীঠ প্রাপক।। এছাড়াও সাহিত্যে তাঁর অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬২ তে পদ্মশ্রী এবং ১৯৬৮ তে পেয়েছেন পদ্মবিভূষণ। শুধু নোবেল পাওয়ার ক্ষেত্রেই নৌকা তীরে ভেড়ে নি। বিশেষজ্ঞদের মতে তারাশঙ্করের উপন্যাসে ব্যবহৃত রাঢ় বাংলার আঞ্চলিক ভাষাই এ ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। কারণ সেই ভাষার ভাবার্থ অনুবাদ করা যদিও বা সম্ভব হয় অনুবাদকৃত ভার্সনে মূল ভাষ্যের আঘ্রান খুঁজে পাওয়া যায় না। যে সুবাসের কারণে মূল উপন্যাস হয়ে উঠেছিল অনন্য, সেটাই অনুবাদের পরে মামুলী হয়ে পড়ে। যে কারণে বিশিষ্ট সাহিত্য গবেষক সুরেশ্চন্দ্র মৈত্র তারাশঙ্করকে ‘রাঢ়ের অকৃত্রিম একনিষ্ঠ শিল্পী’ বলেছেন; বলেছেন, ‘রাঢ়ই তাঁর পৃথিবী, বসুন্ধরা’, সেখানে সেই রাঢ়ের কথ্যভাষার মূল সুবাস যা অনুবাদ করে কখনো অবিকৃত রাখা সম্ভব নয়, তার প্রাণ প্রতিমাই বা প্রতিষ্ঠা হবে কি করে। বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই এই ব্যাপারে একমত। ইঙ্গ-ইউরোপীয় নোবেল কমিটির কাছে তারাশঙ্করের সাহিত্যের যে মূল ফ্লেভার তা কোনো মতে তুলে ধরা সম্ভব হয় নি।একটা উদাহরণ দেওয়া যায় বিখ্যাত উপন্যাস ‘কবি’ থেকে। তারাশঙ্কর সেখানে লিখছেন– ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ ক্যানে!’ এই সহজ এবং মরমী রাঢ় বাংলার শব্দ গুচ্ছই ছিল তারাশঙ্করের আসল শক্তির জায়গা। আবার সেটাই তাঁর নোবেল পাওয়ার ক্ষেত্রে হয়ে যায় প্রধানতম দুর্বলতার হেতু।যে বছরের শুরুর দিকে তাঁর নাম পৌঁছেছিলো নোবেল কমিটির কাছে, সে বছরই অর্থাৎ ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে তারাশঙ্কর চিরতরে বিদায় নেন পৃথিবী থেকে। তাই তারাশঙ্করের নোবেল প্রাপ্তির আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কারণ মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেওয়ার এখনও পর্যন্ত কোনো নিয়ম নেই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন