সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মদের আসরে শীর্ষেন্দু? শক্তি-সুনীলের 'গান্ধীগিরি'!

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নিজেকে 'সংসারে থাকা সন্ন্যাসী' ভাবতে ভালোবাসেন। ১৯৬৫ সালে যখন শীর্ষেন্দু মাত্র ৩০ বছর বয়সের তরতাজা যুবক তখনই  দীক্ষা নিয়েছেন অনুকূল ঠাকুরের কাছে।  আদ্যোপান্ত আধ্যাত্মিক শীর্ষেন্দু বিশ্বাস করেন পরজন্মে; যিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সুরে বলেন, “মৃত্যুর পরে সব শেষ হয়ে যায় না। আত্মার সঙ্গে থেকে যায় স্মৃতিও।” 


যিনি তাঁর ভূতে বিশ্বাস থাকার কথা বলেন প্রকাশ্যে, কোনো সংকোচ ছাড়াই। এমনকি আনন্দবাজার অনলাইনে স্রবস্তি বন্দ্যোপাধ্যায় কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জোরের সঙ্গে বলেন তাঁর “ভূতের সঙ্গে বেশ কয়েকবার" দেখা হওয়ার কথা। নিশ্চিত ভাবে ঠাকুরের দীক্ষিত হওয়ার কারণে তিনি একজন নির্ভেজাল নিরামিষাহারী। বলা যায়, খান পানে তাঁর নিষ্ঠা প্রায় বাঙালী ঘরের বিধবা পিসি মাসীদের মতনই।  এ হেন শীর্ষেন্দু ভাবতেই পারেন না মদ্যপান করার কথা। কিন্তু তাই বলে তাঁর প্রবল মদ্যাসক্ত বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনো চিড় কিন্তু কোনোদিন দেখা যায় নি।  আজকের নিবন্ধে আমরা খোঁজার চেষ্টা করবো ব্যবহারিক জীবনে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা শীর্ষেন্দুর সঙ্গে শক্তি-সুনীলের যে নিবিড় সম্পর্ক তার নেপথ্যে থাকা আসল রহস্যকে।  শীর্ষেন্দু ব্যাতিত বাকি দুজনেই বর্তমানে প্রয়াত।  কিন্তু জীবিত অবস্থায় তাঁরা কখনোই একই পেশায় থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে ঈর্ষার ছোঁয়াচ লাগতে দেন নি।  ঈর্ষা নয় বরং গুনগ্রাহী ছিলেন একে অপরের।  স্রবস্তির সঙ্গে ইন্টার্ভিউ তে শীর্ষেন্দু বলছেন, “সুনীল আমার ভালো লেখা পড়ে ভালো বলার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। আমিও তাই।"  “শ্যামল বা বরেনের কোনো গল্প পড়ে চমকে উঠলে মনে হত এখনি ওদের কথাটা জানাই।" বৈরিতা ছিল না, ছিল পারস্পরিক মুগ্ধতার মিথস্ক্রিয়া।   কিন্তু তাই বলে কি সমালোচনার কোনো জায়গা ছিল না? ছিল।  কিন্তু গঠনমূলক। শীর্ষেন্দু অকপটে সে কথা বলেছেন, “সমালোচনা করতে চাইলেও করতাম খোলা মনে।" কিন্তু ওই একটা বিষয় যা শীর্ষেন্দু সবিনয়ে এড়িয়ে চলতেন তা হোল লেখক বন্ধুদের কাছ থেকে আসা নাছোড় মদ্যপানের আর্জি। শুধু প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত থাকেন নি, কখনো কখনো কষে ধমকও দিয়েছেন তাঁদের। বিরত থাকতে বলেছেন মদ্যপান থেকে। ৭৫ তম জন্মদিনে খানিক বেশী খেয়ে ফেলেছিলেন বার্থডে বয় সুনীল। অসংলগ্ন সুনীলের পা টলতে দেখে শীর্ষেন্দু তাঁকে শাসনের সুরে বলেছিলেন, “সুনীল আপনাকে বাংলা সাহিত্যের জন্য অনেকদিন বাঁচতে হবে। তার জন্য যা নিয়ম মানার আপনি সেটা করুন।" এখানেই একটা টুইস্ট আছে।  এবং এই টুইস্টই এই নিবন্ধের আসল আকর্ষণ।   কারণ শীর্ষেন্দু নিজে মদ খেতেন না বলে ওদের সঙ্গী হন নি এমনটি কিন্তু নয়। NDTV বাংলায় বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে শীর্ষেন্দু এই ব্যাপারে থাকা যাবতীয় ধোঁয়াশা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এ কথা ঠিক তিনি শক্তি সুনীলের মতো কোনোদিন মধ্যরাতের কোলকাতা দাপিয়ে বেড়ান নি, কিন্তু শক্তি সুনীলের মদের আসরে উপস্থিত থেকেছেন বহাল তবিয়তে। শক্তি সুনীলরাও কোনোদিন শীর্ষেন্দু কে ‘আউটসাইডার’ ভাবেননি।  “আমি মদ খেতাম না ঠিক, কিন্তু আমি ওদের বহু আড্ডার শরিক ছিলাম।"  বোধিসত্ত্ব কে শীর্ষেন্দু অকপটে জানিয়েছেন সে কথা। তবে আনন্দের পাশাপাশি কখনো কখনো যে এই সব আসরে তাঁকে প্রবল অস্বস্তির মধ্যেও পড়তে হয়েছে তা তিনি অবলীলায় স্বীকার করে নিয়েছেন।  যেমন একবার শিলং এ গিয়ে মদের নেশায় কি যে হোল, শক্তি- সুনীল দুজনেই তাঁকে উদ্দেশ্য করে প্রায় কীর্তনের দোহার দেওয়ার মতন করে একই কথা বারবার বলতে শুরু করে দিলেন। প্রবল অস্বস্তিতে পড়ে গেছিলেন শীর্ষেন্দু সেবার।  একটাই কথা  “আপনার মতো ভালো লেখক কেউ নেই।" এই আপাত প্রশংসা সূচক কথাটি যে তাঁকে ভীষণ লজ্জার মধ্যে ফেলে দিচ্ছিল সেদিন সে কথা বলে বোঝাতে পারেন নি তাঁদের কে। নেশায় চূড় শক্তি ও সুনীলের সেদিনকার সেই 'গান্ধীগিরি' যে শীর্ষেন্দু কে একেবারে ধরাশায়ী করে ছেড়েছিল সে কথা বলাই বাহুল্য। মুক্তি পেয়েছিলেন শক্তি ও সুনীল ঘুমিয়ে পড়ার পরই।  


সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর সম্পর্কে আরও লেখাঃ -

কুভেম্পু পুরষ্কার ঃ শীর্ষেন্দুর মুকুটে নতুন পালক!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

'জল পড়ে, পাতা নড়ে' ঃ রবীন্দ্রনাথ না বিদ্যাসাগরের লেখা?

জল পড়ে, পাতা নড়ে - সহজ অথচ অমোঘ এমন দুটি লাইন মনে হয় কোনো উপনিষদীয় ঋষির স্বর্গীয় কাব্য সিদ্ধির অনুপম ফসল ছাড়া কিছু হতে পারে না।  বৃষ্টিপাতের সঙ্গে অনিবার্য ভাবে উচ্চারিত হওয়া এই শ্লোক কেবল সৃষ্টির আপন খেয়ালেই রচিত হতে পারে। সেই কবে থেকে এর অনন্য স্বাদ মস্তিস্কের কোষে কোষে এক অদ্ভুত ভালোলাগার মোহ তৈরি করা শুরু করেছিল তা আজও অটুট এবং সমানভাবে সক্রিয় , মোহ ভঙ্গের নামই নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এর জাদুময় মোহপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। যদিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই দুটি লাইন লেখেন ‘জীবন স্মৃতি’ র পাতায়। মনে হয় স্রষ্টা যেন নিজেই তাঁর সৃষ্টির মহিমায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ এই দুটি লাইন লিখলেও লেখার শ্রেয় কিন্তু তিনি দিয়েছেন বিদ্যাসাগরকে। এখন প্রশ্ন, কেন! উত্তর - ভ্রান্তি সুখে। কিন্তু সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। ‘জীবন স্মৃতি’ তে তাই দেখা গেল যতবার তিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখেছেন ততবারই তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রেখেছেন। অন্য কারোর লেখা লিখলে তাকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখাই দস্তুর। কিন্তু তাতে কি! শিশুবেলার মুগ্ধতা যেন কিছুতেই প্রশমিত হতে পারে...

১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট, কোথায় ছিলেন গান্ধীজী?

১৫০/বি বেলেঘাটা মেন রোড। শিয়ালদহ স্টেশন ও ই-এম বাইপাস এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন কারী মূল রাস্তা - বেলেঘাটা মেন রোড তথা সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রোডের ওপর পড়া এই বিশেষ ঠিকানা টি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে । বিশেষ করে, প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সময় আসন্ন হলে, এই ঠিকানার কথা স্মরণ না করে থাকা যা য় না। কারণ ১৯৪৭ এ গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত, বিশেষ করে রাজধানী দিল্লিতে স্বাধীনতা লাভের (১৫ ই আগস্ট) দিনটিকে স্মরনীয় করে রাখতে আয়োজিত হয়েছে অভূতপূর্ব রাজকীয় সমারোহের - যার শুভ সূচনা হয়েছে, ১৪ ই আগস্টের মধ্যরাতে; ১৫ তারিখ পদার্পণ করতেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে শুভারম্ভ হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পালনের মহা নির্ঘণ্ট। এই উচ্ছ্বাস যদিও কাঙ্ক্ষিতই ছিল। কারণ দীর্ঘ ২০০ বছরের পরাধীনতার কৃষ্ণ কাল অতিক্রম করার পরেই দেশবাসীর কাছে এসে পৌঁছেছিল সে বিরল মাহেন্দ্রক্ষণ। সমাগত হয়েছিল সেই মহা মুহূর্ত যখন প্রায় শত বর্ষ ধরে চলা স্বাধীনতাকামী মহাযজ্ঞে মুক্তিলাভের সিদ্ধি স্পর্শ করছিল তার চূড়ান্ত শিখর দেশ। কিন্তু এই যজ...

রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর এবং দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ!

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাকে আদিকবির আখ্যায় ভূষিত করেছেন, যার লেখা বইয়ের (বর্ণ পরিচয়) হাত ধরে তাঁর প্রথম পরিচয় বাংলা বর্ণ যোজনার সঙ্গে, মাত্র চার বছর বয়সে পড়া যার লেখার প্রভাব থেকে কোনোদিন পারেননি মুক্ত হতে, ৫১ বছর (১৯১২) বয়সে লেখা 'জীবন স্মৃতি' তে তাই যার লেখার কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র মত বাংলা কাব্যের ইতিহাসে চির কালজয়ী দুটি লাইন সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মেট্রোপলিটন স্কুলে।   ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের সভাপতি আর সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃত ভাষার গৃহ শিক্ষক। রামসর্বস্ব পণ্ডিত ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ কে ‘ম্যাকবেথে’র বাংলা অনুবাদ  করে শোনাতেন, আর তা শুনে বাংলায় লিখিত তর্জমা করতে হত রবীন্দ্রনাথকে। তর্জমা সম্পূর্ণ হলে তার গুনমান বিচার করতে রামসর্বস্ব ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসাগরের কাছে। কেমন ছিল সেই প্রথম সাক্ষাৎ পর্ব! রবীন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’ তে সে কথা লিখেছেন বিস্তারিত। ‘জীবন স্মৃতি’র ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে লেখা সে কাহ...