মেঘলা দিনে, বাড়ির সামনে এত গাছ গাছালী - শাখা প্রশাখা মেলা বড় নিম, বুড়ো গোলাজ ফুলের ডালা পালা তো - বাড়ির দেওয়ালে গা লাগিয়ে উঠে গেছে একেবারে চিলে কোঠা ছাড়িয়ে, তার সঙ্গে গেটের কাছে বিশাল একটা কদম গাছ, যার ঘন পাতার ছাউনিতে দিনের আলো থমকে দাঁড়ায়, নীচে আসতে পারে না। বাড়ির সামনেই কমন পাঁচিল দক্ষিণ কোলকাতা গার্লস কলেজের। বিশাল বড় দেবদারু গাছ সারা বছর ঝেঁপে থাকে বাড়ির উঠোনের উপরে। ভালো করে না দেখলে বোঝা যাবে না ওটা কলেজের গাছ। বৃষ্টির দিনে ছায়া আর পাতা গলে পড়া বৃষ্টি ফোঁটায় উঠোনের মাটি কেমন স্যাঁতস্যাঁতে, শ্যাওলা সবুজ হয়ে থাকে। ফাঁক ফোঁকর গলে যতটুকু আলো পড়ে তাও ঠিকঠাক প্রতিফলিত হতে পারে না। সত্যজিৎ রায় যদি এখানে কোনো ছবির শুটিং করতেন নির্ঘাত চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রের কথাই তাঁর মনে পড়তো, সর্বপ্রথম। 'অপরাজিত' এর সেটে যেভাবে সাদা কাপড়ের ফ্রেমে স্টুডিওর কৃত্রিম আলো ফেলে দিনের পর্যাপ্ত আলোর অনুভব এনেছিলেন এখানেও নিশ্চিত একইভাবে আলোর বন্যা বইয়ে দিতেন। প্রসঙ্গত বাইরের আলোকে এইরকম উছলে ভেতরে আনানোর প্রক্রিয়াকে বলা হয় বাউন্সড লাইট প্রক্রিয়া। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে সুব্রত মিত্রই ছিলেন এই প্রক্রিয়ার প্রথম উদ্ভাবক। সুব্রত মিত্র প্রয়াত হয়েছেন অনেকদিন। কিন্তু বাউন্সড লাইট প্রক্রিয়ার সার্থক প্রয়োগশালা করে রেখে গেছেন নিজেরই বসত বাটীর সামনের উঠোনটাকে।
৭০, শরৎ বোস রোডের পেল্লাই দোতলা বাড়িটিকে বর্তমানে একটি ভুতুড়ে বাড়ির মতই দেখতে লাগে বাইরে থেকে। দরজা জানালা বন্ধ কতকাল কেউ জানে না। কারণ উত্তরসূরি হীন সুব্রত মিত্রের মৃত্যুর পরে এই বাড়ি একান্ত ভাবেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে সেই ২০০১ সাল থেকে। কেউ থাকেন না। ভাঙা চোরা দেওয়ালের যত্র তত্র বট, অশ্বত্থের শেকড় এবং তার ডালা পালার দৃষ্টিকটু বিস্তার। বাড়ির উত্তর দিকের বারান্দা বেলতলা মোটর ভেইকলসের দিকে মুখ করা। মোটর ভেইকলসের অফিস পেরিয়ে একটু এগোলেই বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল, এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন সুব্রত মিত্র। প্রসঙ্গত সত্যজিৎ রায়, যিনি সুব্রত মিত্রের চোখ দিয়ে তাঁর বিশ্ব নন্দিত চলচ্চিত্র গুলির দৃশ্য রুপায়নের কথা ভাবতেন (সিনেমাটিক আই) তিনিও এই স্কুলেই পড়েছেন।
বাড়ির কথাতেই আবার ফিরে আসি।
দীর্ঘদিন বারান্দার আরসায় শ্যাওলা পড়ে পড়ে কালো হয়ে গেছে, তাতে আবার যেখানে সেখানে ফার্ন জাতীয় গাছের বিশ্রী জমায়েত। তার মধ্যে অযত্নে ফুটে থাকা গুটিকয় বেগুনী রঙের নয়নতারা ফুলই খালি মন ভালো করে দেয়। এছাড়া গোটা বাড়িটাই পলেস্তরা হীন, দেওয়াল গুলো নোনা ধরা, বিশ্রী ভাবে লাল লাল ইটের দাঁত বার করা। রাস্তার দিকে মুখ করা সামনের দেওয়ালে একটি নেভি ব্লু রঙের ছোট্ট টিনের বোর্ড সাঁটা রয়েছে - যা এত বড় বাড়ির তুলনায় এতই নগন্য যে তা হাতির বিশাল শরীরের নিরিখে তার চোখের
ক্ষুদ্রতার সঙ্গেই কেবল তুলনীয়। বোর্ড টি পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের পক্ষ থেকে লাগানো হয়েছে ২০২১ সালে। সম্প্রতি এই বোর্ড টি দেখেই আমি বাড়িটির সম্পর্কে আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ি। কারণ অত ক্ষুদ্র পরিসরের ওই বোর্ডটি তে যা লেখা রয়েছে তা দেখে যুগপৎ গর্ব এবং ক্ষোভ দুই-য়ের চোরা স্রোত বয়ে গিয়েছিল আমার মধ্যে। গর্ব হয়েছিল জেনে যে এই বাড়িতে একদা বসবাস করতেন এমন একজন মানুষ যিনি সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালী' র সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন। কোনোদিন সিনেমাটোগ্রাফি না করেও 'পথের পাঁচালী' তে কাজ শুরু করেছিলেন চিত্রগ্রাহক হিসেবে। বলাই বাহুল্য প্রথম কাজেই ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন। তারপরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে 'পথের পাঁচালী', 'অপরাজিত', 'অপুর সংসার' (অপু ট্রিলজি) 'দেবী', 'জলসাঘর' 'চারুলতা' থেকে উত্তম কুমার অভিনীত 'নায়ক' পর্যন্ত। সত্যজিৎ ও সুব্রত জুটি প্রায় তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো গোটা বিশ্ব কে। ক্যামেরার পেছনে সুব্রত মিত্র থাকলে সত্যজিৎ রায় একপ্রকার নিশ্চিন্তই থাকতেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এর কেমিস্ট্রি যেমন জগত বন্দিত ছিল সত্যজিৎ এর সঙ্গে ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্রের জুটি ও তেমনি তৈরি করে গেছে - অনেক গৌরবময় ইতিহাস। প্রসঙ্গত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম রঙিন ছবি 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' তেও সুব্রত মিত্রের কাজ ছিল উচ্চ প্রশংসিত বিশেষ করে সূর্যোদয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা'র ভিউ কে প্রায় স্বপ্ন সম্ভব করে তোলার পেছনে সুব্রত মিত্রের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য যা তাঁকে একজন আইকনিক চিত্রগ্রাহকের মর্যাদা এনে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আমেরিকান পরিচালক জেমস আইভরি পর্যন্ত তাঁর বিভিন্ন ছবি যেমন 'দি হাউস হোল্ডার', 'শেক্সপিয়ার ওয়ালা' থেকে 'গুরু' ও 'বম্বে টকি' তে সুব্রত মিত্রকেই দিয়েছিলেন ক্যামেরা পরিচালনার গুরু দায়িত্ব। এছাড়াও ইসমাইল মার্চেন্ট পরিচালিত ছবি 'মহাত্মা অ্যান্ড দি ম্যাড বয়' এ তাঁর কাজ পেয়েছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ১৯৮৫ তে রমেশ শর্মার ছবি 'নিউ দিল্লি টাইমস' এর জন্য তিনি পান সেরা সিনেমাটোগ্রাফারের জাতীয় পুরস্কার। ১৯৮৬ তে পান পদ্মশ্রী পুরষ্কার। বিন্দুতে এ সবই লেখা ছিল নেভি ব্লু রঙের ছোট্ট সেই টিনের বোর্ড টিতে। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের মত আমি যারপরনাই অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম বোর্ড টির সামনে আর দারুন গর্বের অনুভূতিতে চারিদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম - রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ি গুলোকেও ভীষণ অন্যরকম লাগতে শুরু করেছিল তখন। ভাবা যায় এই বাড়ির বাসিন্দাই ১৯৯৭ থেকে আমৃত্যু (২০০১, ৭ই ডিসেম্বর) সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট এর সিনেমাটোগ্রাফি বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক এর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। যার সম্পর্কে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় বলেছেন বাউন্সড লাইট প্রক্রিয়ার উদ্ভাবনে সারা বিশ্বে সুব্রত মিত্রই ছিলেন পথিকৃৎ। কারণ দাবী করা হয় বারগম্যান পরিচালিত সুইডিশ ভাষায় তৈরি 'থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি' ছবিতেই সর্বপ্রথম বাউন্সড লাইটের প্রয়োগ হয় বলে, যদিও ১৯৬১ তে হওয়া এই ছবির অন্তত চার পাঁচ বছর আগে 'অপারাজিত'(১৯৫৬) তেই বাউন্সড লাইটের সফল প্রয়োগ করে ফেলেন ভারতীয় সিনেমাটোগ্রাফির 'গডফাদার’ সুব্রত মিত্র।
এত কিছু গর্বের স্মৃতি যে
ব্যক্তিকে ঘিরে, সেই ব্যক্তিরই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তাঁর আপন বসত স্থল কে হেরিটেজ বিল্ডিং এর মর্যাদা দিতে, রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের লেগে গেল দীর্ঘ ২০ বছর। টাইমস অফ ইণ্ডিয়া'র ২০২১ সালের মার্চ মাসের রিপোর্ট অনুসারে, প্রয়াত সুব্রত মিত্রের
পারিবারিক বন্ধু সুনন্দা বসু পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের কাছে এই মর্মে একটি ই-মেল
পাঠান যে বাড়িটি প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়েছে এবং এর এখনই সংরক্ষণের
প্রয়োজন আছে বলে জোরদার সওয়াল করেন তাঁর চিঠিতে। যার ফলশ্রুতিতে কমিশন শেষ
পর্যন্ত বাড়িটিকে হেরিটেজ বিল্ডিং এর স্বীকৃতি দিলেও তিন বছর অভিক্রান্ত হয়ে গেছে
এখনও বাড়িটিকে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ কিন্তু চোখে পড়ছে না। দুঃখ হছিল, ক্ষোভ ও
হচ্ছিল ভীষণ, এই বাড়িরই বাসিন্দা যিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে জগৎ বিখ্যাত ফরাসী পরিচালক জ্যা রনোয়ার বহু চর্চিত ছবি ‘দি রিভার’ এর সেটে
পর্যবেক্ষক হয়ে ক্যামেরার অবস্থান, ক্যামেরার দৃষ্টিকোণ এবং তার নিরিখে অভিনেতাদের অবস্থান ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোট নিতেন ছবি এঁকে একে। প্রসঙ্গত, কোলকাতায় এই ছবির শুটিং চলাকালীন, ছবির সেটেই সুব্রত মিত্রের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় সত্যজিৎ রায়ের। পরিচালক
রনোয়া পর্যন্ত তাঁর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শুধু তাই নয় তাঁর নেওয়া নোট থেকে ছবির
পরবর্তী শটের পরিকল্পনা পর্যন্ত করেছেন। ইস্টম্যান কোডাক লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার বিজেতা মানুষটির স্মৃতি
রক্ষায়, টাইমস অফ ইণ্ডিয়া'র খবর অনুযায়ী, কিংবদন্তী চিত্রগ্রাহকের এই বাসস্থান
টিতে একটি জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বর্তমানে বাড়িটিতে প্রবেশের মুখে কালো রঙের দুটি লোহার পাল্লা ২৪ ঘণ্টা তালা বন্ধ অবস্থায় থাকে। পাল্লায় জনৈক
সুবিমল চক্রবর্তীর নাম এবং ফোন নং লেখা।
বোর্ড দেখার পর, পাল্লার ফাঁক দিয়ে উকি দিতে ভেতর একজন
সিকিউরিটির ভদ্রলোক কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁকে কাছে আসার অনুরোধ করি। সবিনয়ে কয়েকটি ছবি তোলার আর্জি জানালে তিনি আমার
আবদার সরাসরি খারিজ করে দেন বাবুর নিষেধ আছে বলে। বাবু - কে? জিজ্ঞেস করতে তিনি
পাল্লার সামনে লেখা নামটি দেখতে বলেন।
দেখলাম ইংরেজিতে বড় বড় করে লেখা আছে
This property belongs to Subimal Chakraborty. তার মানে এই সম্পত্তি এখন সুবিমল
চক্রবর্তীর। কিন্তু হেরিটেজ সম্পত্তি কি
করে কোনো ব্যক্তির মালিকানাধীন হতে
পারে, বুঝে উঠতে পারি না। যদিও টাইমস অফ ইণ্ডিয়া'র খবরে সুবিমল চক্রবর্তী কে সুব্রত মিত্র আর্কাইভস নামক ট্রাস্টের সেক্রেটারি বলে বলা হয়েছে। পাল্লায়
যদিও সেরকম কিছু লেখা নেই। যাই হোক, সমস্ত বিতর্ক সরিয়ে যত তাড়াতাড়ি এই হেরিটেজ বিল্ডিং এর সংস্কার এবং প্রয়াত চিত্রগ্রাহকের
স্মৃতি রক্ষার্থে একটি বিশ্ব মানের জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ শুরু করা হয় তত
মঙ্গল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন